কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ পর্ব-৬

0
356

কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ৬
_________________
ফাল্গুন মানে আমের মুকুল, ফুরফুরে মৃদু বাতাস, হলতে বসন্ত, দ্বিগুণ জমে গান আড্ডায় বন্ধুত্ব। পূর্ণিমার রাত, আকাশে বড় চাঁদ উঠেছে। চারিদিকে ঝলমলে পরিবেশ। অহনা নদীর ব্রিজের উপর দিয়ে সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে এগিয়ে আসছে স্নেহা আর আর্য। দুজনের মন এই বসন্তেও ভারাক্রান্ত। সামনে উচ্চমাধ্যমিক, শারীরিক মানসিক দু-দিক দিয়ে বিপর্যস্ত। তারা পুরনো পরিচিত শহরের গণ্ডি পেরিয়ে গ্রামের সবুজ মাখা রাস্তায় এসে পড়ল। প্রতিদিনের মত আজও সবকিছু পুরনো, শুধু মাত্র বিচ্ছেদটাই নতুন। তারা একটা বিষয় নিয়ে খুব সহজভাবে আলোচনা করছে। প্রত্যেকদিন শহরে আসা যাওয়া করার সময়,তারা একটা নতুন বাড়ি নির্মাণ হতে দেখেছিল। বর্তমানে সেই বাড়ি সম্পূর্ণতা পেয়েছে। ওই বাড়ির সৌন্দর্য দেখার মত। স্নেহার দাবি, এই সৌন্দর্য মানুষের সৃষ্টি করা। মানুষ চাইলে কত কিছুই না পারে! কিন্তু আর্য তা মনে করে না। মানুষ কখনো অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে না। অপরূপ সৌন্দর্য কেবল প্রকৃতি সৃষ্টি করতে পারে। ওই বাড়ির সামনে অসংখ্য গাছ রয়েছে, মনোহর সবুজ বাগান রয়েছে, তাই বাড়িটি সুন্দর। যদি সবুজ গুলো নষ্ট করে দেওয়া যায়,তাহলে অতটা সুন্দর মনে হবে না। একটি বাড়ি ততটা দৃষ্টিনন্দন লাগে, যতটা পরিমাণ ওই বাড়ি সবুজে ঘেরা থাকে। স্নেহা আবার দাবি করে, তাজমহল কিন্তু মানুষের তৈরি, তার সৌন্দর্যের কাছে সমস্ত কিছু হার মানে। আর্য উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। তাজমহল নিশ্চিন্তে একটা অপরূপ সৌন্দর্য। মানুষের প্রচন্ড রকমের শখ এবং শৌখিনতার পরিচয় দেয়, কিন্তু তা প্রকৃতির মতো অতটা সুন্দর নয়। কাশ্মীরের ভৌগলিক সৌন্দর্যর মতো পৃথিবীতে আর কোন দ্বিতীয় সৌন্দর্য আছে কি? কাশ্মীরের ভৌগলিক সৌন্দর্য কোনো মানুষের তৈরি হয়, প্রকৃতির তৈরি। স্নেহা চুপ করে যায়। কোনো যুক্তি খুঁজে পায় না। বেশ অনেকক্ষণ চুপচাপ। ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। স্নেহার মুখ থেকে অনেক কথা শুনতে ইচ্ছে করছে আর্যর। অনেক কিছু জানতে হবে। অনেক প্রশ্ন আছে। প্রথম থেকে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর জানবে বলে স্থির করেছিল। কখন সময় বয়ে গেল বুঝতে পারিনি। আজ বিদায় বেলা। অজস্র প্রশ্ন করা সম্ভব নয়। তবুও মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখা এতদিনের প্রশ্ন আর লুকিয়ে রাখতে পারল না। সে জানতে চাইল, স্নেহার কোন মনের মানুষ আছে কি না! হালকা হেসে উঠে সে। কথা এড়িয়ে গেল না। অকপটে স্বীকার করল, তার জীবনে তেমন কোনো মানুষ নেই। এমন কথা শুনেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে পারল না আর্য। সে নিজের চোখে দেখেছে, স্নেহাকে অন্য কারোর সঙ্গে ঘুরতে। একবার নয় বহুবার। এগুলো কি সব মিথ্যে? হ্যাঁ মিথ্যে। স্নেহা তাকে কখনো মিথ্যা কথা বলেনি, আজও বলবে না। তারা সব কথা একে অপরকে বলে, কোনো কিছু গোপন থাকে না। সে আর স্নেহা যেমন একে অপরের ভালো বন্ধু, সব সময় পাশে থাকে, ঘোরাঘুরি করে, একজন অপরজনকে না হলে চলে না। হয়তো, স্নেহার ভালো আরও এমন একটা বন্ধু আছে, তার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে, ক্লোজ ভাবে মিশে। এতে সন্দেহ করার কি আছে? স্নেহার কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করল। আরো অনেক কথা বলা বাকি ছিল, তা হলো না। কোথা থেকে আদ্বিতিয়া চলে আসলো তাদের মাঝখানে। আর্য জানে, আদ্বিতিয়া আর স্নেহা খুব ভালো বন্ধু। তারা খোশগল্পে মেতে ওঠে। আর্য পিছনে চলে আসে। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। আদ্বিতিয়া উপর রাগ হয়। স্নেহা আর্যকে তাদের সাথে কথা বলতে বলে। আর্য কোনো কথা খুঁজে পায় না। নিজের পরিবার আর খুব পরিচিত ছাড়া তেমন কারোর সাথে কথা বলতে ভালোবাসে না। একটু উদাসীন আর ভাবুক টাইপের ছেলে। সব সময় কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে থাকে। হালকা কথোপকথনে তারা একসময় বাড়ির কাছাকাছি চলে আসলো। প্রথমে আদ্বিতিয়ার বাড়ি, সে দুজনকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল। আর খুব সামান্য পথ বাকি, তারপর স্নেহা বিদায় নেবে। তারপর একা দীর্ঘ পথ চলতে হবে আর্যকে।
“তুই সবার সঙ্গে ভালোভাবে মিস, দেখবি ভালো লাগবে। আদ্বিতিয়া অন্য কেউ নয়, আমার মতো তোরও ক্লাসমেট। অমিশুক টাইপের ছেলেদের বেশিরভাগ মানুষ কিন্তু এভোয়েড করে। কেমন একটা খাপছাড়া লাগে।” গলায় বেশ জোর দিয়ে বলল স্নেহা। পাশাপাশি দুজন সাইকেল চালাচ্ছে। মৃদু হাসল আর্য।
“আমার কিন্তু তা মনে হয় না। পরিচিত আর বন্ধুত্ব দুটোর মধ্যে পার্থক্য অনেক। পরিচিতি অনেকের সাথে হওয়া যায় কিন্তু বন্ধুত্ব খুব অল্প মানুষের সঙ্গে হয়। একটা বড় বন্ধু সার্কেল বানিয়ে নিলাম, সবাইকে সময় দেওয়ার মত সময় থাকলো না। একে অপরের মধ্যে রাগ অভিমান বাড়তে থাকলো। আবার, সবাইকে সময় দিতে গিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের থেকে দূরত্ব বাড়তে থাকে। তার চাইতে ভালো কম বন্ধু রাখা, যে কজন আছে তাদের সঙ্গে সারা জীবন বন্ধুত্ব অটুক রাখা শ্রেয়। জীবনে কত বন্ধুত্ব পেয়েছি তা কিন্তু ইম্পর্টেন্ট নয়, কতগুলো বন্ধু সারা জীবন একসাথে পাশে থেকেছি তা ইম্পর্টেন্ট।
“তোর সাথে আমি কখনো পেয়েছিলাম না আজ পারবো!বাড়ি চলে এসেছি। এবার আমায় যেতে হবে।”
মিনিট পাঁচেকের পর স্নেহা তার বাড়ির গলির মধ্যে প্রবেশ করবে, তারপর সামান্য রাস্তা বাড়ি পৌঁছতে। আর্য বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। একটা বিচ্ছেদের স্পষ্ট গন্ধ পাচ্ছে। বিধতা সহায়ক হলেন। ভাগ্যের পরিহাসে সময়টা দ্বিগুণ হয়ে গেল। ট্রেন আসার সময় হয়েছে। রেড সিগন্যাল। তাদের সামনে আপনি আপনি আস্ত বড় একটা লোহার রড নেমে পড়ল। এখন অপেক্ষা করতে হবে। ট্রেন যাওয়ার পর তারা যাবে।খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর প্রচন্ড গতিতে ছুটে আসলো ট্রেন, সাঁই সাঁই করে বেরিয়ে গেল। যখন ট্রেনটি ব্রিজের উপর উঠল সেখান থেকে ধারালো একটা আওয়াজ কানে বাজতে শুরু করল। দূরপাল্লার ট্রেন মুগ্ধ করেছে স্নেহাকে। আপন-মনে ট্রেনটির দিকে তাকিয়ে আছে। যেন কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে,আর প্রেমিকা বাড়ি উঠোনে বসে প্রেমিকের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে আছে। ট্রেনের প্রতি এমন প্রেম আর্যর জীবনে প্রথম দেখা। চোখের সামনে আপনা আপনি সেই মোটা লোহার রড কখন অদৃশ্য হয়ে গেল বুঝতে পারলো না। বোঝার পর আবার সাইকেল চালাতে শুরু করল। বিদায়ের আগে স্নেহা বলল,”ভালো করে পরীক্ষা দিবি। পরীক্ষায় অন্তত দেরি করে আসবি না। সব জায়গায় তোর দেরি হয়।”হেসে ওঠে স্নেহা। আর্য প্রতুত্তর করে বলল,”তুইও ভালো করে পরীক্ষা দিস আর ভালো থাকিস। হয়তো আমাদের আর কখনো দেখা হবে না। এবার আমাদের গন্তব্য সম্পূর্ণ আলাদা।” এতক্ষণে স্নেহা তার বাড়ির গলির রাস্তা প্রবেশ করে গেছে, তবুও আর্যর কথা পুরোপুরি কানে বেজে উঠল। একটু জোর গলায় বলল,”আরে ভাই, চিন্তা করিস না। ঠিক দেখা হবে। পৃথিবীটা কিন্তু গোল, যেখানেই যাই না কেন ঘুরে ফিরে আসতে হবে।”
আবার এক বিচ্ছেদের সাক্ষী থাকলো, প্রেমের উর্বর ভূমি বসন্ত। পৃথিবীর গোল হলেও, গোলের পরিধি বিশাল। শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, শুণ্যতাই জানো শুধু? কিন্তু শূন্যের মধ্যে কত ঢেউ আছে তা কি জানো? সেই ঢেউ এর মধ্যে স্নেহাকে খোঁজা কতটা সম্ভব তা জানা নেই। লাস্ট প্রাইভেট ছিল। সামনে পরীক্ষা তাই সবকিছু বন্ধ। স্নেহার সঙ্গে আর দেখা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। স্নেহার ছোট বেলা থেকে শখ, সে ‘ল’ নিয়ে পড়াশোনা করবে। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ হলে, নিশ্চয়ই বাইরে কোথাও চলে যাবে।আর্যর নিজের ভাগ্যে কি আছে,জানে না। সেও এমনভাবে কোথাও হারিয়ে যাবে। আর কি ফিরে পাবে এমন সোনালী মুহূর্ত? কতগুলো বছর তারা একসাথে কাটিয়েছে। নদীর পাশ দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সাইকেল চালিয়েছে, স্কুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে গল্প করেছে, একসাথে স্কুলে যাওয়া আসা করেছে। কান ধরে দাঁড়িয়েছে, পড়া না করে মার খাওয়া মুহূর্তগুলো ফ্যাকাসে হয়ে উঠছে। অন্তর বারবার কেঁপে উঠছে। মন কান্না করছে। তাকে সারা জীবন কাছে পেতে চাইছিল। কিন্তু অল্প দিনে বিচ্ছেদ হলো। আমরা যাকে সব সময় কাছে পেতে চাই, ঈশ্বর তাকে খুব দ্রুত আমাদের জীবন থেকে সরিয়ে দেয়। হারিয়ে দেয় শূন্যের মধ্যে ঢেউগুলোতে।

বৈশাখ মাস, চারিদিকে সুনসান পরিবেশ। ফেরিওয়ালা আর পথিকরা আশ্রয় নিয়েছেন গাছের তলায়। মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছে গ্রাম বাংলার চলমান জীবন। তীব্র গরম হাঁপিয়ে তুলেছে। এই গরম যেন বিকেলে প্রচন্ড ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে। বিলের মধ্যে চরতে থাকা বেশ কয়েকটা গরু লোকালয়ের দিকে তাকিয়ে আছে, বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় আছে তারা। কাঠফাটা রোদ আর গরম সহ্য করতে পারছে না। তাদের মালিক সম্ভবত কোনো কাজে ব্যস্ত, তাদের কথা ক্ষণিকের জন্য ভুলে গেছে। গ্রামবাংলায় বিদ্যুতের অনিশ্চয়তা নতুনত্ব নয়। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর স্নেহা নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় মাদুর পাতিয়ে ক্ষণিকের জন্য ঘুমিয়ে পড়ে। বাইরে হালকা বাতাস হচ্ছে। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল ঠিক জানে না। হঠাৎ নাকে সুড়সুড়ি পাওয়ায় ঘুমটা এলোমেলো হয়ে যায়। বিরক্ত হয়ে পাশ ঘুরে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ঋষি ছাড়ার পাত্র নয়। দিদিকে বিরক্ত করা তার কাজ। সে আবার দিদির কানের মধ্যে হাত ভরে সুরসুরি দিতে থাকে। তাতেও কাজ হলো না। এবার সে দিদির পায়ের কাছে চলে আসলো। পায়ের পাতায় খুব আলতো করে হাত বোলাতে লাগলো। আর সহ্য করতে পারলো না। ঘুম ভেঙে গেল। ঋষি খিলখিল করে হাসছে। ঘুম জড়ানো চোখে স্নেহা বলল,”তুই কি রে? শান্তিতে একটু ঘুমাতে দিবি না! মায়ের কাছে ঘুমিয়ে ছিলিস তো, মা কই?”
“মাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি।”এক বিজয়ী যোদ্ধার মত হাসতে লাগল। যেন কোনো মহান কাজ করে এসেছে। মা তাকে ঘুম পাড়াতে নিয়ে গেছিল, উল্টে সে মাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। এর চাইতে মহৎ কাজ কি হতে পারে? স্নেহা হাসবে না কান্না করবে বুঝতে পারছে না। ভাই এর এই পাগলামো গুলো বেশ ভালই লাগছে। ঋষি আবার হেসে উঠলো। তার দ্বিতীয় হাসির হেতু বুঝলো না স্নেহা। কারণ জানতে চাইলো। উত্তরে ঋষি বলল,”আয়নায় গিয়ে নিজের মুখ দেখ, বুঝতে পারবি?”
ভাই কি বোঝাতে চাইছে বুঝতে বাকি থাকলো না। সে ঘুমিয়ে পড়েছিল চোখ মুখ মায়া ভর্তি আর চুলগুলো এলোমেলো,পাগলীর মতো দেখাচ্ছে। একটু বিরক্ত হয়। আবার ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়। সেই সময় ঋষি তার হাতে পঞ্জিকা তুলে দিয়ে বলে,”একটা ভালো তারিখ দেখ তো? আমার ছোট পুতুলটার বিয়ে দেব।” আশ্চর্য করার মতো কোনো ঘটনা নয়। সে সব সময় এমন করে। নতুন পুতুল কিনার কিছুদিনের পর তার বিয়ে দেয়। বিয়ের লগ্ন না থাকলেও তাকে বলতে হবে। না হলে সারাদিন সারারাত মুখটা বাংলার নয়ের মতো করে বসে থাকবে। স্নেহা মিছামিছি চার-পাঁচবার পঞ্জিকা উল্টে বলল,”আজকে বিকালে একটা ভালো লগ্ন আছে।” ঋষির মন খুশিতে ভরে ওঠে। দিদির পাসে চুপটি করে শুয়ে পড়ে। তার আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারে স্নেহা।
“এই দিদি,শোন না…।”
“বল।”
“দশ টাকা দিবি?বুঝতে তো পারছিস বিয়েতে খরচ অনেক।”
“আচ্ছা, তারপর।”
ঋষি দিদির আরও কাছে যায়। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। গালে চুমু খায়। মুখের কাছে মুখ নিয়ে যায়।
“আমার সোনা দিদি টা। কত ভালো।”
“অনেক হয়েছে, আর আদর করতে হবে না। টাকা আর মার কাছে মার খাওয়ার সময় হলে দিদি, আর অন্য সময় অন্য কেউ। তাইতো!”
“মোটেও না। আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি।”
“আচ্ছা,আমার স্কুল ব্যাগে টাকা আছে নিয়ে নিবি যা।” আর কে শোনে কার কথা ! এক ছুটে দিদির রুমে চলে আসে। স্নেহার অস্বস্তিটা ভালোলাগায় পরিনত হয়। মনটা আহ্লাদে ভরে ওঠে। ভাইয়ের এই খুশি তাকে তৃপ্ত করেছে। ব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে ঋষি আবার দিদির কাছে আসলো। সে বাগান থেকে কিছু ফুল নেবে, মালা গাঁথার জন্য। স্নেহা ফুল ভীষণ ভালোবাসে। বাড়িতে অনেক ফুলের গাছ লাগিয়ে রেখেছে। পুজো ছাড়া তেমন ব্যবহার করতে দেয় না। ঋষি খুব তাড়াতাড়ি তারও পার্মিশন পেয়ে যায়। ঋষির ব্যবহার বারবার মুগ্ধ করে স্নেহাকে। সে জানে দিদির টাকা কোথায় থাকে। চাইলে লুকিয়ে নিয়ে নিতে পারতো,এবং ফুল তুলে আনতো, কিন্তু সে অনুমতি ব্যতীত কোনো কাজ করে না। স্নেহা আবার ঘুমানোর চেষ্টা করল‌। পারলো না। একবার কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেলে সেই ঘুম খুব সহজে ফিরে আসে না। ভাইকে সাহায্য করল, সুচ সুতো নিয়ে মালা গাঁথতে শুরু করে। বয়সে বড় হলেও তার মন এখনো সেই বাচ্চা শিশু।

আকাশে আচমকা কাঁপছে মেঘ থরথর করে। বৈশাখ মাসে বিকাল বেলায় হঠাৎ আকাশ কালো আভায় ডেকে যাওয়া কোনো অস্বাভাবিক নয়। একটা প্রচণ্ড গুমোট ভাব রয়েছে। সূর্য দেবতা মুহূর্তের মধ্যে উবে গেছেন। কালবৈশাখীর ঝড় আবির্ভাবে,যেমন বহু মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, তেমনই বহু মানুষ‌ অস্বস্তিও হয়ে উঠে। প্রত্যেক জিনিসের ভালো খারাপ উভয় দিক রয়েছে, বিষয়টি ঠিক তেমন। কালবৈশাখীর ঝড় কৃষকদের কাছে কখনো স্বস্তিকর নয়। তাদের সাজানো সবজি বাগান মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যায়। কঠোর পরিশ্রম পরিশ্রম থেকে যায়, ফসল বাড়িতে আনতে পারে না। এই যে কিছুক্ষণ আগে কাঠফাটা রোদ ছিল,তখন কিন্তু আচার্য পরিবারের কেউই বাড়িতে বসে বিশ্রাম করতে পারেনি। তীব্র রোদেও তাদের বিলের মধ্যে থাকতে হয়েছে। তাদের বাড়িতে আলু চাষ হয়েছে, এখন মাটি খুঁড়ে সেগুলো তুলতে হবে। অল্প বৃষ্টি হলে সমস্ত আলু পচে যাবে। পরিশ্রম আর অর্থ উভয়ই জলে চলে যাবে। তাই তারা এত চড়া রোদকে পরোয়া করেনি। চারজন সদস্য মাঠের মধ্যে উপস্থিত রয়েছেন। বেশ ভালো ফলন ধরেছে, মন ভীষণ হাসি খুশি। অল্পক্ষণের পর ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করে। ফসল তছনছ করতে শুরু করে। বেশ কয়েকটা বস্তাভর্তি আলু ইতিমধ্যে তোলা হয়ে গেছে। সেগুলো বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য উদ্যত হয় অশোকবাবু। রোগা শীর্ণ শরীর বিশিষ্ট বাবাকে বড় বড় আলু বস্তা মাথায় করে বাড়িতে আনতে কেমন একটা দৃষ্টিকটু লাগলো আর্যর। সে বাবাকে বাধা দিল। নিজে নিয়ে যেতে চাইলো। তার শরীর যে এত মেদবহুল পুষ্টিকর তা কিন্তু নয়। সেও বাবার মতো রুগ্ন। তবুও বাবাকে পরিশ্রম করতে দেখে কষ্ট হয়। তিনি ছোটবেলা থেকে কাজ করে আসছেন, এখন বিশ্রামের প্রয়োজন। ছেলে বড় হয়েছে, একটু একটু করে যদি দায়িত্ব নিতে শিখে তাহলে খুব ভালো হয়। আর্য তাই করল। মাথায় ভারী বস্তা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে চলল। হালকা বাতাস মনের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে। একটু শীতল অনুভব করছে। বাড়ির কাছে এসে আগড় খুলল, বাড়ির মধ্যে সুন্দর করে বস্তা রেখে আবার আগড় লাগিয়ে চলে গেল। বেশ কয়েকবার এমনটাই করল। ঝড়ো হাওয়া যেমন কয়েকটা বাগান তছনছ করে দিয়ে গেল, তেমনই কালো মেঘকেও সঙ্গে করে নিয়ে গেল। আকাশ এখন পরিষ্কার। সম্ভবত বৃষ্টি হবে না। হালকা শীতল ভাব রয়েছে সঙ্গে বাতাস। হঠাৎ আর্যর কানে ভেসে আসলো ট্রেনের ঝাঁজালো শব্দ। প্রচন্ড গতিতে ট্রেন ছুটে আসছে। আর্য দাঁড়িয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে নিজের বোনও। ছুটে চলা ট্রেনকে লক্ষ করল। কোনো বাধা, পিছুটান কিছুই অপেক্ষা করল না। আশেপাশে কোনো স্টেশন নেই। থাকলেও শুধুমাত্র লোকাল ট্রেন গুলো দাঁড়ায়। এখানকার মানুষকে ট্রেন ধরতে হলে তিন ঘন্টায় বাসে চেপে হাওড়ায় যেতে হয়। আবার ট্রেন ধরে এই পথ দিয়ে ঘুরতে হয়, বড্ড অদ্ভুত জায়গা। ভালো লাগার জায়গা। মাঠের মধ্যে থাকতে আর ভালো লাগছে না আর্যর। সকাল থেকে মাঠে আছে , দুপুরে স্নান করে খাবার খেয়ে আবার মাঠে এসেছে। ঘামে ভিজে যাওয়া শরীর এখন ঘাম শুকিয়ে গিয়ে চটচট করছে। তার বয়স বা আর কত? বাবার কাছে অনুমতি নিয়ে বাড়ি চলে আসে। আবার একবার স্নান করার জন্য পুকুর ঘাটে যায়। এইসময় রিম্পিকে দেখে তার চোখ রীতিমতো কপালে উঠে যায়। কাকিমা ধান সেদ্ধ করছিলেন, কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় তিনি রিম্পিকে উনুনের পাশে বসিয়ে দিয়ে গেছেন। রিম্পি উনুনে আগুন-জ্বালা সরঞ্জাম জুগিয়ে দিচ্ছে।হাওয়া ছাইগুলো উপরে উড়ে যাচ্ছে, আবার সেগুলোর ফিরে এসে তার মাথায় পড়ছে। সেদিকে খেয়াল নেই। তার মুখ ভীষণ ক্লান্ত আর বিবর্ণ। ঘেমে একাকার হয়ে আছে ।এমন কাজ একদমই পছন্দ নয়। পরিস্থিতি শিকার হয়ে করছে। এত সুন্দর সাজানো-গোছানো মেয়েকে এমন কাজ করতে দেখে খারাপ লাগল আর্যর। এমনিতে তীব্র গরম রয়েছে তার ওপর উনুনের গরম, সহ্য করার ক্ষমতা সহজ নয়। সে রিম্পির কাছে আসলো। তাকে চলে যেতে বলল। তার এখন খেলাধুলার বয়স। এই বয়সে পরিশ্রম করা উচিত নয়। রিম্পি মহা খুশি। দাদার গালে একটা চুমু দিয়ে পালিয়ে যায়। রিম্পির কাজ আর্য শুরু করল। কাকিমা বলে রিম্পিকে এই অল্প বয়সে কাজ করতে দিয়েছেন। আর্যর বাবা হলে কখনো এমনটা করতে দিতেন না। তার নিজের বোনের বয়স খুব অল্প, একটা কাজও করতে দেন না। যা করে নিজের ইচ্ছায়। আর্য আবার ভাবে, রিম্পিকে এখান থেকে তুলে দেওয়া কি উচিত হলো? সে নিজে তো সামান্য বিশ্রাম করার জন্য মাঠ থেকে বাড়ি চলে এসেছিল। এসে কি হলো? আবার কাজ করতেই হলো। নিজের বোন কাজ করবে আর সে বসে বসে দেখবে, তা তো অন্যায়। স্বার্থপরতা! রিম্পির কাজ নিজের হাতে তুলে না নিলে,সে যেমন স্বার্থপর হতো,তার কাজ করেও স্বার্থপর হলো। সে তো নিজের জন্য কিছু করলো না। নিজেকে নিয়ে ভাবলো না। নিজের ভালো-মন্দ বুঝলো না। নিজেকে অবজ্ঞা করা, দূরে ঠেলে দেওয়া অন্যায় নয়? এটাও নিজের আত্মার প্রতি স্বার্থপরতা।

সারা বিকাল জুড়ে বৃষ্টি না হলেও, সন্ধ্যের দিকে হালকা বৃষ্টি হলো। কথায় আছে, ভারী মেঘে বৃষ্টি হয় না, বৃষ্টি হয় হালকা মেঘে। গুমোট ভাবটা কেটে গেছে। হালকা শীত অনুভব হচ্ছে। চোখ মিটমিট করছে আর শরীরকে বিছানা ডাকছে। এমন পরিবেশে ঘুম ভালো হয়। আর্য বিছানায় গা এলিয়ে দেবে বলে ভেবেছিল, তার আগে কানে একটা ভালো সংবাদ ভেসে আসে। মা বোনকে টাকা দিয়েছেন, এখনই দোকান থেকে বিস্কুট কিনে আনার জন্য। বোন সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেছে। আর্য আর ঘুমোতে গেল না। দোলনায় দুলতে লাগল। বিস্কুট খাবে তারপর বিছানায় যাবে। এই অপেক্ষা মনের তৃপ্ত পূরণ করল। আবার আলাদা একটা ভালো লাগা শুরু হলো। তার এই ভালোলাগা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। তারা বিস্কুট আনলো কিন্তু নিজেরা খেয়ে নিল। একটি বারের জন্যও আর্যকে ডাকলো না। আর্য চোখ থেকে নিবিড়ভাবে জল গড়িয়ে আসলো। চুপচাপ গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। চোখের জল ঝরে পড়ে বিছানায়। এমনটা কেন হলো? একটুকরো বিস্কুট দিলে কি হয়ে যেত? সে নিজের মাকে দোষারোপ করতে থাকে। কিন্তু দোষ কি শুধুমাত্র নিজের মায়ের? না নিজেরও? তারা হয়তো কোনো ভাবে আর্যর উপস্থিতি টের করতে পারেননি। ভুলবশত এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু আর্য! সে অপেক্ষা করেছিল। নিজে থেকে এগিয়ে বিস্কুট নিয়ে দিতে পারতো। তারা কেউ পর নয়, তার নিজের মা এবং বোন। তাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। সেখানে লজ্জা কিসের? এটা কি লজ্জা না অন্য কিছু? পরিবার থেকে একটা মানুষ কিন্তু হঠাৎ করে দূর হয়ে যায় না। একজন মানুষ একটু একটু করে পরিবার থেকে আলাদা হতে থাকে, এবং তার জীবনে একাকীত্ব চলে আসে।যে ছোট ছোট বিষয় যেগুলোকে আমরা গুরুত্ব দেই না, সেগুলো থেকেই কিন্তু দূরত্ব শুরু হয়। আর পরে পরিস্থিতির ওপর দায় চাপিয়ে দিই।

পর্ব ৭ আসছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here