কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ৭
_________________
অহনা নদীর ব্রিজের উপর ট্রেন উঠতেই একটা জোরালো আওয়াজ শুরু হলো। মন আরও ক্লান্ত এবং বিষন্নতায় ভরে উঠল। ছোটবেলা থেকে দ্রুতগামী ট্রেনের চলা দেখে এসেছে, আজ ট্রেনের মধ্যে থেকে এক অচেনা শহরে উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে আর্য। ট্রেন ব্রিজের উপর উঠতেই আর্য জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করল। ঘুটঘুটে অন্ধকার, আবার কোথাও কোথাও ছোটখাটো আলো মিটমিট করছে। এখানেই তো স্নেহার বাড়ি। গত কয়েক মাস আগে বাড়ি ফেরার সময় ট্রেন চলে আসায় দাঁড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। একসাথে দাঁড়িয়ে ট্রেন দেখেছিল। দিনগুলো অনেক মজার ছিল। তারপর থেকে আর দেখা হয়নি। পরীক্ষার দিন গুলো মোটামুটি ভাবে দেখা হয়েছিল তবে ঠিক মত কথা হয়নি। তারপর রেজাল্টের অপেক্ষায় ঘরে বন্দি থেকেছে। বাবাকে মিথ্যা কথা আবার কখনো মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে শহরে এসেছে যদি একবার স্নেহার দেখা পায়। ঋষি যে স্কুলে পড়াশোনা করতো, ওই স্কুলেও অনেক বার গেছে। সে জানতো স্নেহা তার ভাইকে স্কুলে ছাড়তে যায়। হতাশ হয়েছে। কোথাও তাকে খুঁজে পায়নি। সে কোথায় আছে,কি করছে,জানা নেই। ভালোবাসার জন্য মন আকুল হয়ে উঠছে। বুক হাহাকার করে উঠেছিল,একবার তো দেখতে চাইছিল, দেখার তৃষ্ণা পূর্ণ হলো না। ভালোবাসা মানুষের তৃষ্ণা বাড়িয়ে দেয়, চেনা গণ্ডি পেরিয়ে মুক্ত স্বাধীনতা অনুভব করায়। সে সারাজীবন বাবার কথা শুনে এসেছে, কখনও অমান্য হয়নি। কিন্তু ভালোবাসার কাছে হার মেনেছে, কারোর বাধা তাকে থামাতে পারেনি। শেষ অপেক্ষা ছিল, অন্তত রেজাল্ট আনতে স্কুলে যাবে স্নেহা। তাও যায়নি। আর্য সাহস পায়নি, স্নেহার বাড়ি গিয়ে দেখা করার। নিরবে সবকিছু মেনে নিয়ে কর্ণাটকের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে। শেষ মুহূর্তে যদি একবার দেখা হতো তাহলে অন্তত খুশি হতো,-কবে আবার এই গ্রামে ফিরবে সে জানে না। আজ ভালোবাসা ভুলে বন্ধুত্বের কথা মনে ভাসছে। তারা খুব ভালো বন্ধু। সেই অনুযায়ী স্নেহার বাড়িতে গিয়ে দেখা করে আসতো। সে ভীন রাজ্যের পড়াশোনা করতে চলে যাচ্ছে। তার আগে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করা অন্যায় নয়। বরং স্নেহা আরও খুশি হতো। তাকে কিছু কথা বলতো। হয়তো, যোগাযোগটাও নিয়মিত থাকতো।
আর্য কেবিনের মধ্যে জ্বলতে থাকা আলো নিভিয়ে দিলো। লক্ষ করল বাবা ঘুমিয়ে পড়েছেন। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। অশোক বাবু,যিনি তিন ঘন্টা বাসে ভ্রমণ করলে বমি করে ফেলতেন। মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়ে যেত। গায়ে জ্বর চলে আসতো। তাইতো তিনি বহু দূরে যেতে পছন্দ করতেন না। কখনও যান নি ও। কিন্তু আজ ছেলের জন্য তিন দিন ধরে ট্রেন জার্নি করবেন। বিষয়টি এখন উনার কাছে স্বাভাবিক। একমাত্র বাবাই পারে, এমন দুঃসাহস কাজ করতে। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, তাঁর ছেলে অনেক বড় হবে। বড় একজন আদর্শ ডাক্তার হবে। এর জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে রাজি আছেন। আর্য স্থির চোখে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ঘুমন্ত অবস্থায় খুব অসহায় লাগছে। নিশ্চুপ ভাবে ঘুমিয়ে আছেন। যে মানুষটিকে এক মুহূর্ত না হলে চলতো না,পরশু থেকে সেই মানুষটিকে ছেড়ে দিনের পর দিন কাটাতে হবে। তা কী করে সম্ভব? জীবনে কোন জটিল ধাঁধাঁ জড়িয়ে পড়লো সে? দুটো চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। বাড়ির কথা মনে পড়তেই বুক ফাঁকা ফাঁকা লাগলো। আজকে সকালে তাদের বাড়িতে চন্ডী পূজা শেষ হয়েছে। বাড়ি ভর্তি মানুষ রয়েছে। পিসি, মাসি, দিদি সবাই আছেন। তাদেরকে ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু কিছু করার ছিল না। জীবনে বড় হতে হলে অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হয়। আর্য বাবার মুখ থেকে চোখ ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকালো। চেনা গণ্ডি পেরিয়ে এসেছে। এখন যা কিছু চোখের সামনে ভাসছে সবই অচেনা। আরও কিছুটা যাওয়ার পর ঘুটঘুটে অন্ধকার কেটে আলোর সন্ধান পেল। আষাঢ় মাস, তবুও মাটিতে ফাটল রয়েছে। এখনো বর্ষা নামে নি। পশ্চিমবাংলায় মূলত আষাঢ়,শ্রাবণ,ভাদ্র এই তিন মাস বর্ষাকাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ সময় শ্রাবণ মাসে বর্ষা নামে। আবার কখনো জ্যৈষ্ঠ মাসেও জল নেমে আসে। বৃষ্টির অনিশ্চিয়তা সব সময় রয়েছে। চাষিরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সবুজ প্রেমিক আর্যর মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। যদি জল নেমে আসতো তাহলে মাঠের পর মাঠ সবুজে ভর্তি থাকতো। সবুজ দেখতে তার ভালো লাগে। অনেকটা সময় কেটে গেল। গভীর রাত। অচেনা জায়গায় ট্রেনের নিজস্ব শব্দ, চোখে ঘুম কিছুতেই আসছে না। ব্যাগ থেকে একটা মোড়া কাগজ বার করল। চোখের সামনে কাগজটি মেলে ধরতে চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়লো। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, জিভ অসাড় হয়ে আছে। মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার আগে, পুরো শরীর চেকআপ করতে হয়েছে। আর সেখানে ধরা পড়েছে আর্য থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার। মানতে পারছে না সে। না এগুলো ভুল। তার সাথে এমনটা কেন হলো? সে অনেক স্বপ্ন দেখেছিল স্নেহাকে নিয়ে। সব স্বপ্ন কি শেষ হয়ে যাবে? বিধাতা এত নিষ্ঠুর কেন? স্নেহার অনিশ্চয়তা কোনোদিন নিশ্চয়তা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তাদের রোগ! এই নিশ্চয়তাকে অনিশ্চিয়তা করতে কতক্ষণ?
প্রত্যেক দিনের মতো আজও স্নেহা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ট্রেনের চলে যাওয়া দেখল। তারপর অনেকক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করল। অন্ধকার আর্ণবের দিকে তাকিয়ে অনুভব করল আমোদ। মন আপনা আপনি ভালো হলো। তারপর বিছানায় ফিরে আসলো। বিক্রমের সাথে মধুর সাক্ষাতে তলিয়ে গেল। স্নেহা বরাবরই ভালো স্টুডেন্ট। সব সময় ক্লাসে প্রথম হয়েছে। কিন্তু এখন কোথায়? সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে সে। উচ্চ মাধ্যমিকে কোনোরকম নাম্বার পিয়ে পাস করেছে। কলেজে ভর্তি হতে সমস্যা হচ্ছে। এমনটা হলো কেন? তার কারণ খুঁজতে গিয়ে স্নেহা আবিষ্কার করে বিক্রমকে। প্রেম-ভালোবাসা ইতিবাচক বিষয় গুলোকে বেশি প্রশ্রয় দিতে গিয়ে কখন নিজের ক্যারিয়ারকে শেষ করে ফেলছে বুঝতে পারছে না।তাহলে কি প্রেম করা উচিত নয়? প্রত্যেক কাজের একটা নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। সেই নির্দিষ্ট সময়কে চিহ্নিত করা উচিত। ছোটবেলা থেকে বাবা মা আমাদের একটা জিনিস শিখিয়ে আসেন, পড়ার সময় পড়া খেলাধুলোর সময় খেলা। জীবনে এই জিনিসটাকে মেনটেন করা খুবই প্রয়োজন। বয়ঃসন্ধিকালে প্রচুর পরিমাণে আবেগ থাকে। এই বয়সে বেশির ভাগ ছেলে মেয়ে গুরুত্বহীন কথাবার্তা এবং গুরুত্বহীন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকে। জীবনে বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পায়। নিজেরাও জানে, তারা নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে, অশ্লীল কথাবার্তা, অশ্লীল নেশায় মেতে উঠেছে, দায়িত্ব নিতে পারছে না। রাতে ঘুমানোর সময় মাথায় চিন্তা চলে আসে,এইভাবে যদি জীবন চলতে থাকে তাহলে ভবিষ্যতে একটা কঠিন অধ্যায়ের অপেক্ষায় থাকবে। সেই অধ্যায় সহজ করতে হলে এখন থেকে পরিশ্রম করতে হবে। ঘুমানোর আগে তারা প্রতিজ্ঞা করে সবকিছু ছেড়ে দেবে, নতুন একটি সকাল শুরু করবে।কিন্তু, সকালবেলায় রাতের যুক্তিকে কোনো অযুক্তিকে যুক্তি বানিয়ে হারিয়ে দেয়। আবার একইভাবে দিন শুরু করে। সকালে নতুন যুক্তি বানানোর একটা কমন পয়েন্ট থাকে -তাদের বয়স অল্প!কিন্তু আঠারো বছর বয়সকে অল্প ভাবাটাও অনর্থ। এই বয়সে কেউ এক সময় সিংহাসনে বসে ছিলেন আবার কেউ বিদেশের মাটিতে গিয়ে সেঞ্চুরি করেছেন। ম্যাচুরিটি কখনো বয়সের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে নিজের অভিজ্ঞতা আর বুদ্ধির উপর। বেশিরভাগ সময় জীবনের কালো অধ্যায়গুলো নিজেরা তৈরি করি, অন্য কেউ নয়। দোষী সে নয় যে তোমায় ধোঁকা দিয়েছে, দোষী তুমি। কারণ, তুমি তাকে সুযোগ দিয়েছো।
রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠছে। স্নেহা বিক্রম আরও বেশি মধুর গল্পে মেতে উঠেছে। একে অপরকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তারা কখনো ছেড়ে যাবে না। বিয়ে করবে সংসার করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। একটা সময় স্নেহা বিক্রমকে চোখ বন্ধ করে তার একটা কুৎসিত রূপের কথা স্মরণ করতে বলে। বিক্রম হঠাৎ করে রেগে যায়। সে কুৎসিত হতে যাবে কেন? সে ভালো। তার প্রেমিকা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী। বিক্রমের উত্তর স্নেহার ভালো লাগলো না। এই যে বিক্রম কথায় কথায় রেগে যায়,ফোন ধরতে দেরি করলে অভিমান করে, এক মুহুর্ত দেখা না হলে মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়, সবসময় খেয়াল রাখে -জল, ওষুধ, খাবার খেয়েছে কি না সব সময় জিজ্ঞেস করে। এ ও এক ধরনের ভালবাসা। পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষই চায়, তার এমন একজন মানুষ থাকুক যে সবসময় তার খেয়াল রাখবে। খারাপ কাজে বাধা দেবে ভালো কাজের প্রশংসা করবে। তাকে সব সময় আগলে রাখবে, যত্ন করবে, ভালোবাসবে। বিক্রম তেমন একটা মানুষ। কিন্তু তার মধ্যে তো সবকিছু ভালো নেই। কিছু জিনিস স্নেহাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। কৃতজ্ঞতা খাতিরে কিংবা ভালোবাসা খাতিরে সেগুলো মুখ ফুটে বলতে পারে না।কিন্তু মনের আনাচে কানাচে সেই খারাপ লাগাটা দীর্ঘদিন ধরে থেকে যায়। এমনটা যদি নিজের হয় তাহলে বিক্রমের ও হওয়া উচিত। কোনো মানুষ পারফেক্ট নয়। খারাপ লাগা থেকে অস্বস্তির সৃষ্টি হয়। অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেতে মানুষ কিন্তু অনেক কঠিন কঠিন সিদ্ধান্ত খুব সহজে নিয়ে নেয়।
আধো আধো ঘুমে রাত কাটল।গতকাল রাত্রে বিক্রমের মুখে অপ্রত্যাশিত উত্তর শোনার পর থেকে মনটা খারাপ হয়ে আছে। সকালে আবার কথা হয়, কিন্তু মনের মধ্যে একটা খুঁত থেকে গেছে। খুব সহজে এড়িয়ে যেতে পারছে না। স্নেহা খুব সহজেই শাড়ি পড়তে পারে। ইলেভেন-টুয়েলভ দু’বছর ধরে স্কুলে শাড়ি পড়ে গেছে। অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। শাড়ি পরে সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে গেছে। তবুও বারবার নিজেকে দেখতে ভালো লাগছে। বড্ড মিষ্টি সে। আজ টিকলির বিয়ে,না না বিয়ে বলা ভুল, সঠিক হলো বাল্যবিবাহ। ছোটবেলার বন্ধু। টিকলি তার চাইতে প্রায় দু বছরের ছোট। অগোছালো রুমকে গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এমন সময় আকাশ আর নিলেশ দুমদাম শব্দ করে সিঁড়ি বেয়ে তার রুমে চলে আসলো। এর মধ্যে নিলেশ দুম করে সিঁড়িতে পড়ে যায়। আকাশ আবার তাকে তুলে নিয়ে আসে। স্নেহা মাথায় হাত চাপড়ায়।
“তোরা না, সত্যি! ধীরে সুস্থে আসতে পারিস না!” দুজন ফিক করে হেসে ওঠে। তারাও সম্পুর্ণ সাজানো গোছানো এবং পরিপাটি। বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। ছোটবেলার বন্ধুর বিয়ে বলে কথা। সবার বাড়ি এক গ্রামে, কিন্তু বয়সের পার্থক্য অনেক। আকাশ আর নিলেশ সমবয়সী, আর স্নেহা তাদের চাইতে চার বছরের বড়। বন্ধুত্ব কখনো বয়স মানে না। ছোটবেলায় তারা কাদামাখা মাঠে ঘুরে বেড়িয়েছে, ঘুড়ি উড়িয়েছে, শাপলা ফুল তুলেছে, দিঘির জলে সাঁতার কেটেছে একসঙ্গে। এখন যে তাদের বন্ধুত্ব সম্পূর্ণ ফিকে হয়ে গেছে তা নয়। এখনো বন্ধু অটুক আছে। স্নেহা বড় হওয়ার সত্তেও নিলেশ আর আকাশের সঙ্গে বিকেল বেলায় সাইকেল নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরতে চলে যায়। প্রত্যেক শনিবার ও রবিবার দিঘির জলে সাঁতার কাটে। আম গাছে উঠে আম পাড়ে। সীতারাম, গোলসীতা, টিয়া পাখি ঠোঁটটি লাল, ফল ফুল, হাট্টিমাটিম, লুকোচুরি বিকেল হলে এইসব খেলার আড্ডা বসে গ্রাম বাংলায়। স্নেহা যথেষ্ট বড় হওয়ার সত্বেও খেলতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। বাইরে যেতে পারে না। নিলেশ, আকাশ আর টিকলি তার বাড়িতে চলে আসে, ঋষি আর স্নেহাকে সঙ্গে নিয়ে তারা খেলা করে। নিলেশ আকাশ আর টিকলি তিনজন চাইলে কিন্তু বাইরে গিয়ে অনেকের সঙ্গে খেলা করতে পারত। কিন্তু তারা কখনো যায় না। কারণ, সেখানে স্নেহা যাবে না। স্নেহা ছাড়া তাদের কোনো কিছু করতেই ভালো লাগে না। এ তো এক বন্ধুর প্রতি অন্য এক বন্ধুর অপরূপ ভালোবাসা প্রকাশ। ভালো সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ পালিয়ে না গিয়ে কাছে থেকে যায়, জানবে সে জীবনে সর্ব শ্রেষ্ঠ বন্ধু। তাকে হারাতে দেওয়া উচিত নয়। ভগবানের দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। তাদের ব্যবহার মুগ্ধ করে স্নেহাকে। আপনি আপনি তাদের প্রতি অগাধ ভালোবাসা চলে আসে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক বন্ধুত্ব।
“তোর থেকে তো চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। এত সুন্দর হলি কি করে?” নিলেশের বাক্য ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে আকাশ হেসে ওঠে।
“টিকলির বিয়ে! না তোর বিয়ে! টিকলি তো এত সাজুগুজু করে নি।”
“সামান্য সাজুগুজু করেছি, আর তাতেই তোদের…”
“এটা সামান্য!”
“তা নয় তো কী? তোদের কাছে সবকিছু বেশি বেশি লাগে।”
“এই চল তো। বেশি কথা বলিস না। কন্যার একমাত্র বন্ধু আমরা, রাত্রি হয়ে গেল এখন পর্যন্ত যায়নি। টিকলি কি ভাববে বলতো?” আকাশের কথায় সবার হুশ ফিরল।
“হ্যাঁ চল, কিন্তু সেখানে গিয়ে দুজন একদম বদমাশ করবি না। অনেক মানুষজন আছে।” আকাশ আর নিলেশ মাথা নাড়ায়। তাদেরই মাথা নাড়া কতটা যুক্তিসঙ্গত তা জানে না। তারা কতটা শান্তশিষ্ট আর নম্র সেটা সবারই জানা। নিলেশ স্নেহার পারফিউম দেখতে পেয়ে যায়, ছুটে গিয়ে ফস ফস করে জামায় স্প্রে করতে থাকে। তার দেখাদেখি আকাশও ছুটে যায়। নিলেশ আবার স্নেহার শাড়িতেও স্প্রে করতে করতে বলে,”একটু বেশি করে স্প্রে কর। না হলে সবাই ভাববে আমরা একদম গাঁইয়া। এত আনন্দের মুহূর্তে স্নেহার হঠাৎ করে আর্যর কথা মনে পড়ে। সেও তার খুব ভালো বন্ধু। ছোটবেলা থেকে পরিচিত না হলেও খুব আপন হয়ে উঠেছিল। সে এখন কোথায় জানে না, তবুও একসাথে থাকলে ভালো হতো। এই যে তার সামনে দুটো নাছোড়বান্দা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের এত ভালো লাগে কেন? এত হাস্য উজ্জ্বল সে আগে কখনো কাউকে দেখেনি। দুজনের জীবনে যেন কোনো দুঃখ কষ্ট কিছুই নেই। সবসময় হাসিখুশিতে থাকে। তাদের এই চারজনের বন্ধুত্বের চাইতে আকাশ ও নিলেশের বন্ধুত্বটা আরও গভীর। একজন স্কুল না গেলে আর একজন যায় না। রাস্তায় কখনো একজনকে দেখা যায় না। সব সময় যুগলবন্দি থাকে। সে মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে, তাদের বন্ধুত্ব যেন কোনদিন না হারিয়ে যায়। সারা জীবন অটুট থাকুক।
তারা তিনজন মিলে একসঙ্গে গ্লাসের সেট কিনেছে, যা টিকলিকে বিয়ের গিফট দেবে। রাস্তায় যেতে যেতে তা নিয়ে গণ্ডগোল লাগিয়ে দিল। স্নেহা সামান্য রাগ করায় সেই গন্ডগোল আবার মিটেও গেল। নির্দিষ্ট সময়ে তারা পৌঁছে যায় টিকলি রুমে। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকে টিকলকে বেশি সুন্দর লাগছে।
ফুলে ভর্তি ঘরের মধ্যে বসে থাকা মেয়েটিকে আজ ফুলপরীর মতো দেখাচ্ছে। তাকে আজ বাচ্চা মনে হচ্ছে না। মুহূর্তে মধ্যে যেন সে অনেক বড় হয়ে গেছে। বেশি কথা বলছে না। সারা ঘর জুড়ে ফুলের মোহ বইছে। তবে তাদের উপস্থিত টিকলির মনকে ফুরফুরে করে তুলল। পৃথিবীর তিনজন মানুষই রয়েছে, যাদের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো অনেক দামী। আকাশ নিলেশ নিজেদের কথা রাখলো। বদমাশ করছে না চুপচাপ টিকলির পাশে বসে আছে। টিকলির মা এসে তাদেরকে শরবত দিয়ে গেলেন। কত আদর যত্ন করলেন। আশ্চর্য হয় নিলেশ আর আকাশ, কদিন আগে তাদের বাড়িতে আসলেই তিনি বকাবকি করতেন। টিকলিকে তাদের সঙ্গে যেতে বারণ করতেন। কিন্তু আজ সম্পূর্ণ আলাদা। তারা দুজন উপস্থিত হওয়া ভীষণ খুশি তিনি। তারাও আজ নতুন অতিথি। বড্ড নাটকীয় এই জীবন। খুব পরিচিত মানুষও একদিন আত্মীয় হয়ে ওঠে,তার সঙ্গেও আত্মীয় সুলভ মনোভাব প্রকাশ করতে হয়। তাদের চঞ্চল মনটাকে বেশিক্ষণ স্থির রাখতে পারল না। রুম থেকে লোকজন কমতেই,উভয় উঠে গিয়ে টিকলির জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে শুরু করে। নিলেশ প্রশ্ন করে,”টিকলি, তোর অনেক গিফট হয়েছে না রে! এত গিফট কি করবি?” মৃদু হেসে টিকলি কিছু উত্তর দিতে চাইছিল, তার আগেই স্নেহা বলে উঠল,” এখনো টিকলি, তুই কি টিকলির বড় দাদা! তার বরকেও নাম ধরে ডাকবি বুঝি?”
“অবশ্যই, তোর বরের নাম তো জানা হয়নি। বরের নাম কি রে?”
“আবার! বরের বাড়ির লোকজন শুনলে কি ভাববে? বউ এর বন্ধু গুলো একদম শিষ্টাচার জানে না।” লজ্জায় মুখ রাঙ্গা করে ফেলল টিকলি।মাথা নত করে চুপিচুপি হাসছে সে। একটা হাসির শোরগোল পড়ে গেল। টিকলিকে নিয়ে সামান্য ঠাট্টা হলো।
“তুই এবার আমাকে পুরো পারমিশন দিয়ে যা, তোদের বাগানে সমস্ত ফুল প্রত্যেকদিন আমি তুলবো!” আকাশের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিলেশ বলে উঠল,” না না, তা হবে না। আমি কি টকের আলু। টিকলি তুই বলে দে, ফুল শুধু সে নয় আমিও নেবো।” আকাশ আর নিলেশ দুজন তর্ক শুরু করে দেয়। স্নেহা মাথায় হাত চাপড়ায়। এরা বিয়ে বাড়ি এসেছে না তর্ক করতে এসেছে বোঝা মুশকিল। তাদের এই ছেলেমানুষি দেখতে ভালো লাগছে টিকলির। মনে স্নিগ্ধতার জাগরণ হচ্ছে। হঠাৎ করে চোখের কোনে জল জমা হয়ে যায়। কাল থেকে এদের ছাড়া কি করে থাকবে সে? বড্ড মিস করবে। এদেরকে দেখলে বুকটা কেমন হয়ে ওঠে। টিকলির চোখের জল সকলেই আন্দাজ করতে পারল। তারা দুজন তর্ক থামিয়ে দেয়। কাছে এসে বসে। হঠাৎ করে মৌনতা ভালো লাগলো না টিকলির। হাসার চেষ্টা করল, পারলো না। কথা বলতে গিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠলো। তবুও কান্না ভেজা গলায় বলল,”তুই একদিন আর আকাশ একদিন করে ফুল তুলে নিস। দিলে আর কোনো ঝামেলা হবে না। দুজন সমান পাবি।” টিকলির ভেজা কণ্ঠস্বর তাদেরকে নিরুত্তর করে দিল। এমন দিনে চুপচাপ থাকতে কার ভালো লাগে! প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়। মন খারাপ হয়ে যায়। কাল থেকে টিকলির বাড়িতে ফুল তুললে হয়তো কেউ বাধা দেবে না,কিন্তু তারা ফুলের চাইতেও আর এক দামি ফুল হারিয়ে ফেলবে।নিলেশ আর আকাশ ঘর থেকে বেরিয়ে একটু বাইরে যেতে উদ্যত হয়। ধীরগতিতে বেরিয়ে যাচ্ছিল এমন সময় স্নেহা তাদেরকে ডেকে বলল,”তোরা কিন্তু খাবার খেয়ে নিবি না। খবার খাওয়ার আগে আমায় ডাকবি। একসঙ্গে তিনজন মিলে খাব। বুঝলি!”
“তিনজন মানে কি? আমায় পর করে দিচ্ছিস? আমিও তোদের সঙ্গে বসে খাবো। আগে যেমন কারোর বাড়িতে নিমন্ত্রণ থাকলে চারজন একসঙ্গে যেতাম, আজও তেমনটা করব।” টিকলির মুখে এমন কথা শুনে আকাশ আর নিলেশ না হেসে পারল না। হা হা করে হেসে উঠলো। স্নেহা চুপচাপ বসে টিকলিকে লক্ষ করল। তাদের হাসির কারণ এখনো বুঝতে পারেনি টিকলি।
“পাগলের মতো হাসছিস কেন?”
“জানিস না, বিয়ের দিন বউকে খেতে নেই, উপোস থাকতে হয়। তাছাড়া এখন তোকে কেউ আমাদের সঙ্গে বসে খেতে দেবে না।”
“এই নিলেশ চল চল….। মাইক বন্ধ করে রেখেছে, আমরা গিয়ে একটু সানাই বাজাতে বলি।” তারা দুজন আনন্দের সহিত দ্রুত বেগে বেরিয়ে গেল।টিকলি মনের মধ্যে আবার একটা খারাপ লাগা শুরু হয়ে গেছে। নিলেশের বলা শেষ কথা কানে বারবার বাজছে। কথাগুলো তেতো হলেও চরম সত্য। এই বিয়ে এক নারীর জীবন সম্পূর্ণ বদলে দেয়। কতটা কঠিন হয়ে ওঠে। চাইলেও চেনা মানুষ গুলোর সাথে দাঁড়িয়ে দু’দন্ড কথা বলা যায় না, বললেও আগের মতো নয়। চেনা বন্ধু গুলো পর হয়ে যায়। শুধুই কি বন্ধু, পরিবারের সাথেও অনেকটা দূরত্ব তৈরি হয়। স্নেহা তার পাশে বসে রয়েছে।
“কি রে? আমার কথা বিশ্বাস হলো, এখনো তোর শিশু স্বভাব যায়নি। আর তুই বিয়ে করে নিচ্ছিস। এখনো সময় আছে একটু ভাব।”
টিকলি মৃদু হাসলো। তার বিয়ে সবার পছন্দ হলেও স্নেহার পছন্দ নয়। সে প্রথম থেকেই বারণ করেছিল, অল্প বয়সে বিয়ে করতে। স্নেহা সামান্য মেয়ে, তার কথা কে শুনবে? এতদিন ধরে টিকলিকে অনেক বুঝিয়েছে, অনেক উদাহরণ দিয়েছে, কিন্তু সে বুঝলো না। সে বিয়েতে রাজি। স্নেহার এখানে কিছু করার নেই।আইনের দ্বারস্থ হলে অবশ্যই এই বিয়ে বরখাস্ত করা যাবে, কিন্তু এমন দুঃসাহস স্নেহার মধ্যে নেই। যেখানে মেয়ে নিজে রাজি সেখানে লড়াই করা বৃথা। স্নেহা হালকা কণ্ঠস্বরে বলল,”তোর এই বিয়েটা আমি কিছুতেই মানতে পারছি না রে। এখন আমার কথাগুলো হয়তো কাঁটার মতো বিঁধছে, কিন্তু পরে এই কথাগুলোর মূল্য বুঝবি। বিয়ে এত সহজ বিষয় নয়। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্ব বিয়ে, আর সেই পর্ব খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে তুই।”
“বাবা বলেছে ছেলে খুব ভালো, অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। মেনে নিলাম অসুবিধা হচ্ছে, আবার এখানে ফিরে আসবো। এখানে থাকবো।”
স্নেহার হাসতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু টিকলির চোখের দিকে তাকিয়ে পারছে না। সে এখনো বোকা বোকা কথা বলায় অভ্যস্ত, আবার তার নাকি আজ বিয়ে। কাল থেকে একটা পরিবারের দায়িত্ব মাথায় তুলে নেবে।
“এই যে বলছিস, ভালো না লাগলে এখানে চলে আসবি।বিয়ের আগে এমন কথা বলতে পারছিস কিন্তু বিয়ের পর এমন কথা মুখে আসবে তো? একবার কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে সে সম্পর্ক থেকে খুব সহজে বেরিয়ে আসা যায় না। হ্যাঁ, শারীরিক কিংবা লিখিতভাবে বেরিয়ে আসা যায় কিন্তু মানসিকভাবে নয়। এটা কিন্তু শহর নয়,গ্রাম। এখানে বিয়ের পর, বাপের বাড়িতে থাকলে অনেক কথা সহ্য করতে হবে, তুই সহ্য করতে পারবি তো? অল্পতে রেগে যাস, খুব মুখ করিসও।” বেশ অনেকক্ষণ নীরবতা। কেউ কোনো কথা বলছে না। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর স্নেহা আবার বলল,”যাই হোক, বিয়ে যখন হচ্ছে তখন কিছু কথা বলে রাখি। শশুর বাড়ির সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবি। বেশি মুখ করবি না, সবাইকে ভালবাসবি। কিন্তু সবকিছু মেনে নিবি না। যখন মনে হবে এটা ভুল তখনই প্রতিবাদ করে উঠবি। তুই যত মেনে নিবি তারা কিন্তু তত চাপিয়ে দেবে।”
পর্ব ৮ আসছে