কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ পর্ব-১৫

0
365

কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ১৫
____________________
একটি ফুটবল মাঠ রয়েছে। মাঠে দুটি বিপরীত দল এবং রেফারি রয়েছে। দর্শকের সংখ্যা নিতান্ত অল্প নয়। কিন্তু মাঠে কোনো গোল পোস্ট নেই। ওই মাঠে কি একটাও গোল হওয়া সম্ভব? বিশ্বে যত বড় খেলোয়াড় আসুক না কেন সে কখনো গোল দিতে সক্ষম হবে না। ক্রিকেট মাঠ আছে কিন্তু পিচ নেই। বিশ্বের যত বড় বোলার আসুক না কেন, সে কখনো উইকেট নিতে পারবে না। সে যত বড় ব্যাটসম্যান হোক না কেন, কখনো রান করতে পারবে না। প্রত্যেকটি খেলায় একটি নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। খেলার যদি নিয়ম মেনে চলেন তাহলে খেলা সুন্দর। কিন্তু নির্দিষ্ট খেলার নির্দিষ্ট নিয়ম না মানলে ওই খেলার কোনো মূল্য নেই। এই পৃথিবীতে প্রত্যেকটি জিনিসের একটি নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। জীবনেরও একটা নিয়ম রয়েছে।একটা উদ্দেশ্য রয়েছে। জীবনের নিয়মগুলো না মানলে, জীবনও ছন্নছাড়া হয়ে উঠবে। কখনো নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হবে না। নিজের জীবনের জন্য অন্য কেউ আইন তৈরি করে দেবে না। নিজের জীবনের আইন নিজেকে তৈরি করতে হবে।প্রথম থেকেই আর্য নিজের জীবনের জন্য আইন তৈরি করে রেখেছিল। সবকিছু ধীরেসুস্থে বোঝার চেষ্টা করে এসেছে। নিজের বিবেক বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে এগিয়ে গেছে। আজ আর পেরে উঠছে না। ভেঙ্গে পড়েছে। অদৃশ্য কোনো এক আত্মা বলে দিচ্ছে তার জীবনের নিয়ম গুলো ভুল। সমাজের প্রভাবশালী মানুষগুলো যে নিয়ম বানিয়েছে ওই গুলো মেনে নাও। তাদের তৈরি নিয়ম গুলো কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
নিজের উৎকণ্ঠা কাটিয়ে ওঠার আগে আবার একটা উৎকণ্ঠার মধ্যে পড়তে হলো আর্যকে। পরীক্ষার হতাশা কাটিয়ে তুলতে পারেনি। নিজেকে কেমন একটা খারাপ লাগে। শৃংখলাবদ্ধ জীবনযাপন হারিয়ে ফেলেছে। জীবনের নিয়মের মধ্যে নিজেকে ফেলতে পারছে না। ক্রমশ একঘেঁয়ে হয়ে যাচ্ছে। খিটখিটে হয়ে উঠেছে। থিওরি পরীক্ষা সম্পন্ন হলেও প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা তখনো সম্পন্ন হয়নি। প্র্যাকটিক্যাল খাতাগুলো স্টাফ রুমে জমা পড়ে রয়েছে। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার দুদিন আগে কলেজ থেকে নোটিশ জারি করা হলো,পরীক্ষার উত্তরপত্র বলে দেওয়ার জন্য প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে পাঁচ হাজার টাকা করে দিতে হবে। টাকা জমা না দিলে প্র্যাকটিক্যাল খাতায় কোনো শিক্ষিকা স্বাক্ষর করবেন না। নোটিশ পাওয়া মাত্র কোনো রকম একটা ড্রেস পরে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিল আর্য। বেশিরভাগ ছাত্র ছাত্রী টাকা দিতে আগ্রহী । তবে বেশ কয়েকজন ছাত্র ছাত্রী রয়েছে যারা টাকা দিতে আগ্রহী নয়। প্রিন্সিপাল ম্যাম উপস্থিতি নেই।একজন সিনিয়র শিক্ষিকা সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করছেন। কলেজে পৌঁছে আরিফুল আর ইয়াসমিনকে দেখে মন পুলকিত হয়ে উঠলো । তারা টাকা দিতে রাজি নয়,আবার এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেও রাজি নয়। এত ঝুট ঝামেলার মধ্যে পড়তে চায় না তারা। কয়েক বছর এই দেশে এসেছে। কোর্স কমপ্লিট করে নিজের দেশে ফিরে যাবে। এটুকু হলেই হলো। কিন্তু আর্যর বিদ্রোহী মন সবকিছু সহ্য করলো না। শান্তশিষ্ট সহজ সরল হলেও ছোটবেলা থেকে তার মনের গভীরে এক বিদ্রোহী বীজ বুনে দিয়েছেন অশোকবাবু। সে কিছুতেই অন্যায় মেনে নিতে পারছে না। এই অন্যায় মেনে নেওয়া মানে প্রত্যক্ষ ভাবে নিজের শিক্ষাগুরুকে অপমান করা। নিজের বাবাকে কিছুতেই অপমান হতে দেবে না। বাবার জন্য সবকিছু করতে পারে। অন্তত একবার বলে দেখবে। তবে মনের মধ্যে জোর পেল না। শরীরের কোষগুলো এত মানুষের ভিড়ে শিক্ষিকার সঙ্গে কথা বলতে সাহস জোগাতে পারলো না। বাইরে বসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড় কমে যাওয়ার পর সে স্টাফ রুমের মধ্যে প্রবেশ করল। গা ঝিমঝিম করছে। জীভ অসাড় হয়ে এসেছে। গলা শুকিয়ে গেছে। মনের কোণে ভয়ের বাসা বেঁধেছে। লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। তবুও এগিয়ে গেল। ম্যাডামের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তিনি চোখ তুলে আর্যকে দেখলেন। কিছু বলার আগে আর্য গড় গড় করে বলে গেল, আমরা তো সারা বছর ধরে পড়াশোনা করেছি। খুঁটিনাটি সব কিছু করেছি। তাহলে উত্তর গুলো বলে দেওয়া হলো কেন? উত্তর বলেছেন আপনাদের ব্যাপার। কিন্তু তারপর টাকা চাইছেন কেন? যদি এমনটা হওয়ার কথা ছিল তাহলে পরীক্ষা নেওয়ার উদ্দেশ্য কি? পরীক্ষা না হলেও চলতো। সবাইকে পাস করে দিলেই হতো। কথা বলতে গিয়ে আর্য লক্ষ্য করল তার শরীর থেকে ঘাম ঝরে পড়ছে। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। জীবনে প্রথম কোনো গুরুজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করল। মাথা উঁচু করার সাহস পেল না। স্থির চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। আর্যর কথায় একটু অবাক হলেন ম্যাডাম। কোনো ছাত্র এসে তাঁর কাছ থেকে জবাবদিহি চাইতে পারে -তা ভাবেননি। করুন স্বরে বললেন,”তোমাদের পক্ষে ওই ডিফিকাল্ট কোশ্চেন সমাধান করা সম্ভব হতো না। সবাই ফেল করতো। দ্বিতীয় বর্ষে চাপ বেড়ে যেত। তাছাড়া ফেল করলে বাড়িতে কী জবাব দিতে?কলেজের ম্যাডামরা পড়ায়নি। তখন সমস্ত দোষ আমাদের ঘাড়ে চেপে বসতো। সারা বছর তো একবারও বই খুলে দেখোনি। পাশ কী করে করতে শুনি?”
“আমরা ফেল করলে বাড়িতে কি বলতাম জানি না। কিন্তু এখন বাড়িতে কোন অজুহাত দেখিয়ে টাকা চাইবো বলুন তো! ম্যাম, আপনারা মাস ফুরিয়ে গেলে একটা মোটা অংকের টাকা পেয়ে যান। কিন্তু আমাদের পরিবারে এমনটা হয় না। রোদে পুড়ে কাজ করে সামান্য টাকা রোজগার হয়। অনেক স্বপ্ন নিয়ে আমাদের বাবা-মা নামিদামি কলেজে ভর্তি করায়। আর আপনারা শুধুমাত্র নিজেদের সামান্য স্বার্থের জন্য আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলা করছেন। আজ শুধুমাত্র আমার মত কয়েকজন ছাত্র ছাত্রীদের নয়, আপনারা দরিদ্র কৃষকদেরও ঠকাচ্ছেন। ওঁরা সবকিছু জানার পর চোখের জল ফেলবে। তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে। তারা কখনো আপনাদের অভিশাপ দেবে না। কিন্তু প্রকৃতি! তাদের কাছে আপনারা ছাড় পাবেন তো! প্রকৃতি কিন্তু কোনোদিন কাউকে ছাড় দেয় না, সবকিছু কড়ায়-গণ্ডায় মিটিয়ে নেয়। আজ ওদের চোখের জল, হয়তো আপনাদের একদিন চোখের রক্ত হিসেবে বের হবে।” কথাগুলো বলেই আর্য আশ্চর্য হয়ে গেল। সে যেন নিজের মধ্যে নেই। কেউ একজন ভেতর থেকে তাকে একটা শক্তি যোগাচ্ছে। আর সেই অলৌকিক শক্তি থেকে বলে যাচ্ছে। খুব দ্রুত বারবার নিঃশ্বাস ত্যাগ করছে। চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠলো। তবুও ম্যাডামের মন গলাতে পারল না। বরং তিনি প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বললেন,”ইয়োর বিহেভিয়ার ইজ ভেরি ব্যাড। গুরুজনদের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় তা জানো না।” আর্য কোনো উত্তর করলো না। মুখ নিচু করে রাখল। একজন শিক্ষিকা হয়ে যে ছাত্রের ইমোশনাল কথাগুলো বুঝতে পারে না। তাদের দারিদ্রতার কথা মাথায় ঢুকলো না, উল্টো তার আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তাঁকে বুঝিয়ে লাভ নেই। ভারাক্রান্ত মনে স্টাফ রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। হাঁটার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছে। পায়ের নিচে যেন শিকড় গজিয়েছে। খুব ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে সোজা কলেজের গার্ডেনে চলে আসলো। সুন্দর করে সাজানো কাঠের বেঞ্চের উপর চুপিসাড়ে বসে পড়ল। মৃদু শীতল হাওয়া গায়ে লাগছে। শীতল হাওয়ায় শরীর থরথর করে কেঁপে উঠলো। শরীর ঝাঁকুনি দিল। ম্যাডামের বলা শেষ কথা তাকে ভীষণ ব্যথিত করে তুলেছে। সত্যিই কি তার আচরণ খুব খারাপ? ম্যাডামকে এইভাবে বলা কি উচিত হয়নি? আবার ভাবে, সে তো তেমন কিছু বলেনি। যুক্তি দিয়ে নিজের সামান্য মনোভাব প্রকাশ করেছে। এতে বিপরীত মানুষটি যদি আঘাত পেয়ে থাকেন তাহলে তার কিছু করার নেই। সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যদি খারাপ হতে হয়, তাতে অসুবিধা নেই। তবে এই পান্ডববর্জিত এলাকায় তার কথাগুলো কতটা গ্রহণযোগ্য? মানুষগুলো টাকা ছাড়া কিছু জানে না। তবে তাদের মনের মধ্যে যে একটা ভয় রয়েছে -বেশ ভালো করে বুঝলো আর্য। ওই ম্যাডাম কখনো বুঝতে পারেনি,এই বিষয়ে কোনো ছাত্রের মুখোমুখি হবে তিনি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে।ম্যাডামটি প্রথমের দিকে যেভাবে তারস্বরে কথাবার্তা বলেছিলেন পরের দিকে আর্যর কথা শোনে অনেক নমনীয় হয়েছেন। উচ্চস্বরে আর কথা বলতে দেখা যায়নি। আরও একটি অবাক করা বিষয় হলো, এক্সট্রা টাকা নেওয়ার জন্য কলেজের নোটিশ বোর্ডে কোথাও নোটিশ দেওয়া হয়নি। আসলে,নিজেদের মধ্যেও একটা ভয় রয়েছে। এই কাজ তারা বেআইনিভাবে করছেন। উক্ত প্রমাণ দিয়ে যদি বোর্ডের কাছে সমস্ত কিছু ফয়সালা করা যায়, তাহলে সম্পূর্ণ নিশ্চিত কলেজের লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হবে। তাই তারা সম্পূর্ণ সচেতন। তাঁদের উর্বর মস্তিষ্ক খুব ধীরে সুস্থে কাজে লাগিয়েছেন। অনেকক্ষণ এক জায়গায় বসে রইল। কলেজে দু-চার জন ছাত্র-ছাত্রী রাস্তা দিয়ে বারবার যাচ্ছে আবার আসছে। কেউ আবার বাগানে এসে বসে অপেক্ষা করছে, কিছুক্ষণ পর ফিরে যাচ্ছে। শুধুমাত্র সে অনেকক্ষণ নির্দিষ্ট জায়গায় স্থির রইল। আরও কিছুটা সময় পর লক্ষ্য করল লক্সমিকে। সে তার কাছে আসছে সম্পূর্ণ নিশ্চিত। হতাশ হতে হলো না। কাছে এসে পাশে বসল। তাকে ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। কোনো এক ব্যাপারে আঘাত পেয়েছে। তার কাঁধে হাত রেখে বলল,”টাকা জমা দিয়ে দিয়েছো।”আর্য মুখ ফিরে লক্সমির চোখের দিকে তাকালো। চোখে চোখ পড়তেই লক্সমি চোখ নামিয়ে নিল।
“উত্তর দাও!”
“টাকা দেবো না। কিসের জন্য দেবো বলো? আমি তো কোনো চাকরি করি না। টাকা বাবার কাছে চাইতে হবে। কি বলে টাকা চাইবো? বলবো, এখানে পরীক্ষায় উত্তর বলে দিয়েছে ওই জন্য পাঁচ হাজার টাকা নেবে। আমাকে এখানে পাঠিয়ে ছিল কঠিন পরিশ্রম করে একটি সাজানো গোছানো মার্কশিট আর সঠিক শিক্ষা অর্জন করার জন্য।”
“আমি সবকিছু বুঝতে পারছি। কিন্তু কি করবে বলো? তুমি একা ওদের সঙ্গে ঝামেলা করবে? কেউ কিন্তু পাশে থাকবে না। শেষমেষ তোমাকে সবকিছু মেনে নিতে হবে। অযথা ঝামেলা করে লাভ নেই। চারটা তো বছর! টাকা বেশি নিচ্ছে আর কিছুটা প্রতারণার শিকার হচ্ছো। কিন্তু তুমি পরিশ্রম করলে সঠিক শিক্ষা অর্জন করতে পারবে। তারপর এখান থেকে চলে যাবে নিজের বাড়িতে। এখানে কেউ মনে রাখবে না তোমায়।” লক্সমি থামলো। আর্যর চোখের দিকে তাকালো। মিটমিট করে দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। কতটা হতাশ হলে মানুষ এমন ভাবে তাকিয়ে থাকে, তা জানে না সে। প্রত্যেক মানুষের কষ্ট গুলো আলাদা। কেউ কাঁদে ভালোবাসার জন্য। কেউ কাঁদে একটু ভালো থাকার জন্য। কেউ কাদের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পর। আবার কেউ কাঁদে স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার জন্য। আর্যর কষ্ট বোঝার মতো সক্ষমতা হয়তো কেউ অর্জন করতে পারেনি এখনো। কোন পরিস্থিতির মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছে কেউ জানে না। কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এমন বিষয়গুলো গৌণ। এগুলো নিয়ে মাথা ব্যথা করে না। কিন্তু গ্রামে কোনো এক পল্লী থেকে বড় হওয়া ছেলেমেয়েদের কাছে এই গৌণ বিষয় গুলো অনেক মুখ্য বিষয়। তারা অসৎ পথে কোনো কিছু অর্জন করতে চায় না। তারা লড়াই চায়। সবকিছু পরিশ্রম করে অর্জন করতে চায়। পরিশ্রম করার পর তাদের ছোট ছোট স্বপ্ন গুলো যখন ভেঙে যায়, জীবনে এগিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন হয়ে ওঠে। জীবনে সব কিছুতে অস্বস্তি চলে আসে। লক্সমি আবার বলল,”আমি ছোটবেলা থেকে শোনে এসেছি মানুষের অভাবের কথা। কিন্তু এই জিনিসটির সম্মুখীন কখনো হতে পারিনি। জানো তো, লড়াই রাজার সঙ্গে রাজার হয়। মেডিকেলের জিনিসপত্রগুলো ইঞ্জিনিয়ারে ব্যবহার করা যায় না। আবার ইঞ্জিনিয়ারের জিনিসগুলো মেডিকেলে ব্যবহার করা যায় না। তেমনি তোমার চিন্তা ভাবনা গুলো এই পান্ডববর্জিত এলাকায় প্রয়োগ করে কিছু হবে না। এরা কখনো বুঝবে না। তোমার কথা শুনবে না। উল্টে তোমার দোষ খুঁজে বার করবে। প্র্যাকটিক্যালে তোমার নাম্বার কমিয়ে দেবে। প্রাইভেট কলেজ তোমায় বের করে দিতে বেশি সময় নেবে না। তখন কী করবে তুমি? ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে? বাবার সামনে দাঁড়াতে পারবে তো? তোমাকে আমি জোর করছি না। একটু ভেবে দেখো।”

বেশিরভাগ ছাত্র ছাত্রী স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না ভবিষ্যতে নিজেকে কোথায় দেখতে চায়।কলেজ জীবন সম্পর্কে তাদের তেমন কোনো ধারণা থাকে না। সিনিয়ররা যেমন বুঝিয়ে দেয় তারা ঠিক তেমন বুঝে নেয়। আর সমস্যা এখানেই তৈরি হয়। আর জীবনটা হয়ে ওঠে শুকনো পাতার মতো। বাতাস যেদিকে হয় পাতা সেদিকে উড়তে থাকে। তিতা হলেও সত্য, বর্তমানে দেশে প্রায় সত্তর শতাংশ প্রাইভেট কলেজের আসল উদ্দেশ্য ব্যবসা-বাণিজ্য। শিক্ষাকে লঘু করে ব্যবসা-বাণিজ্যকে মুখ্য করে তোলে। ঝাঁ-চকচকে তকতকে ক্লাসরুম। উন্নত মানের চেয়ার টেবিল। প্রত্যেকটি রুমের মধ্যে এসি রয়েছে। আধুনিক ল্যাবও আছে। শুধুমাত্র শিক্ষাটাই টলমলে। আর এই ঝা-চকচকের জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন। টাকাগুলো কোনো না কোনোভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে উসুল করা হয়। তাদের পরিবার পরিস্থিতির কথা বোঝে না কেউই। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অনেকটা নিচে নেমে যায়। আর্য বিদ্রোহী মনোভাব নিজের মনের মধ্যে বেশিক্ষণ স্থায়ী করে রাখতে পারল না। আস্তে আস্তে করে মিলিয়ে গেল। সেও মাথা নিচু করে মেনে নিল। লক্সমির বলা কথাগুলো ভালো করে বিবেচনা করে দেখলো। কথাগুলো যেমন গ্রহণ করার মতো নয় তেমনি ফেলে দেওয়ার মতোও নয়। মাঝখানে পড়ে গেছে।
পরেরদিন দুপুরে টাকা জমা দেওয়ার পর নিজের রুমে ফিরে আসলো। মিনাজ কলেজে গেছে। রুমের মধ্যে একা আছে। জানালা খুলে বাইরে আকাশের দিকে তাকালো। সূর্যের বাঁকা রশ্মি অগোছালো রুমের মধ্যে এসে পড়েছে। বাইরের পরিবেশ মনোমুগ্ধকর । লালমাটির শহরে যেখানে সেখানে ছোট ছোট টিলা রয়েছে।দোতলা থেকে জানালায় চোখ রাখলে কিছু কিছু টিলা চোখে ভেসে ওঠে। সামনে হাই রোডের উপর গাড়ি সাঁই সাঁই করে বেরিয়ে যাচ্ছে। ব্যস্ত বহুল মানুষের ভিড়ে আজ নিজেকে একা মনে হচ্ছে। এত আনন্দ এত উচ্ছাসের মধ্যেও অন্তরে শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। এত হাস্য উজ্জ্বল শহরের মধ্যে কত নোংরামি হচ্ছে তা কেউই দেখতে পাচ্ছে না। যার সঙ্গে এমন নোংরামি হচ্ছে শুধুমাত্র সেই মানুষটি মনে রাখছে। চোখ থেকে জল গড়িয়ে আসলো। বাবাকে একের পর এক মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছে। এ জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।অশোক বাবু আর্যকে ছেড়ে যাওয়ার সময় বলে গেছিলেন, জীবনে আর যাই হয়ে যাক নিজের পরিবার আর সৃষ্টিকর্তা থেকে কখনো দূরে যাবে না। বাবা-মার কাছে কোনো কিছু লুকোবে না। আজ বাবার একটা কথাও রাখতে পারিনি। হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী হয়ে উঠছে সে। উত্তরপত্র বলে দেওয়ার জন্য টাকা চাওয়ার কথা বাবাকে বলতে পারেনি। সে অসুস্থ, ওই জন্য কিছু টাকা দরকার। বাবা সঙ্গে সঙ্গে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি ভীষণ চিন্তিত। ছেলে অসুস্থ কি করে ভালো থাকবেন তিনি। অস্থির হয়ে উঠছেন। কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না। অথচ একটু আড়াল থেকে দেখলে দেখা যাবে, ছেলে দিব্যি রয়েছে। তার শরীর কোনোভাবে অসুস্থ নয়। এই মিথ্যা অজুহাত আর্যর ভালো লাগছে না। বাবাকে কখনো কষ্ট দেবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল। আর এখন বাবাকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছে। সে নিরুপায়। আজ বুঝতে পারছে, স্কুলের ভালো স্টুডেন্ট কলেজে ওঠার কিছুদিন পর তারা কেন নেশায় বুঁদ হয়ে ওঠে?কেন তারা অসৎ পথ বেছে নেয়? সবসময় তাদের দোষ থাকে না। কিছু কিছু সময় পরিস্থিতি বাধ্য করে তোলে।

সন্ধ্যায় হালকা বৃষ্টিতে ভিজে গেছে মেধাহালি শহর। কর্নাটকের মানুষেরা বরাবরই রুচিশীল আর শৌখিন। সামান্য বৃষ্টি ভেজা শহর দেখতে লক্সমি চুলের বেনিতে রজনীগন্ধা ফুলের মালা বেঁধেছে, কোমরে কোমর বন্ধনী বেঁধেছে। আর্যর নরম হাত নিজের নরম হাতে বন্দী করে হেঁটে চলেছে। লক্সমি আর্যর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কর্ণাটকা ভাষায় ফিসফিস করে বলল,”মানুষের চোখে কখনো তৃষ্ণা দেখেছো, তুমি?”
“হ্যাঁ।”
“কার!”
“বাবা’র! আমি আমার বাবার চোখের তৃষ্ণা দেখেছি। জানেন, আমার বাবা এক রাজ্যের রাজা।রাজার সাম্রাজ্য আছে, ধন সম্পদ আছে, সিংহাসন আছে, প্রজারাও আছে,শুধু মুকুট নেই। রাতদিন এক করে জমিতে ফসল ফলায়। কিন্তু প্রত্যেক বছর সেই ফসল আমাদের বাড়িতে আসে না। বন্যার কারণে ডুবে যায়। জল নেমে যাওয়ার পর বাবা চাষের জমিতে ফিরে গিয়ে করুণ চোখে নষ্ট হয়ে যাওয়া ফসল গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন আমি বাবার চোখে তৃষ্ণা দেখতে পাই। বাড়ির সকল সদস্য ভেঙে পড়লেও বাবা ভেঙ্গে পড়ে না। মুখে প্রসন্ন হাসি বজায় রাখে। একজন রাজা যুদ্ধে হেরে গেলেও মাথা নিচু করে না। যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ মুখ উঁচু করে যুদ্ধ করে যায়। আমার বাবাও ঠিক তেমন। শহরের বেশিরভাগ মানুষরা ভাবে বন্যার কারণে চাষিরা একবার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে আবার সরকারের থেকে অনেক অনুদান থাকে। খুব শীঘ্রই তারা ক্ষতিপূরণ পেয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তব কতটা কঠিন জানেন, একবার সমুদ্রের নোনা জল জমিতে প্রবেশ করলে ওই জমিতে কমপক্ষে দুই বছর ধরে একটা লঙ্কা পর্যন্ত হয় না। ভাবুন তো, যাদের দুবেলা ভাতের জন্য সম্পূর্ণভাবে চাষের উপর নির্ভরশীল হতে হয়, তাদের জমিতে দু-বছর ধরে ফসল না ফললে কেমন অবস্থা হয়? আমি আমার বাবাকে কখনো কাঁদতে দেখিনি কিন্তু ঘামতে দেখেছি। আমরা ভাতের সাথে আলু সেদ্ধ পেঁপে সেদ্ধ বছরের-পর-বছর খেয়ে বড় হয়েছি।একদিন আমি অনেক বড়ো হবো,বাবার অপ্রকাশিত কান্নাগুলো সফলতার রুমালে মুছে দেওয়ার জন্য।”
আর্যর দীর্ঘ বক্তব্যে চোখ ভিজে গেছে লক্সমির। তার ব্যথায় ব্যথিত সে। কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু পারল না। মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। ব্যাকুল কণ্ঠস্বর প্রকাশ করতে চাইল না। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থেকে হাঁটতে লাগল। ইতিমধ্যে লালমাটির শহরে দমকা হাওয়া ছাড়াই আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টি দেখার জন্য তারা শহরে বেরিয়েছিল। এক ছাতার তলায় দুজন কুঁকড়ে রয়েছে। হালকা শীত অনুভব হচ্ছে। সামনের দিকে আর এগুলো না। বৃষ্টির বেগ ক্রমশ বাড়তে পারে। নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। চারিদিকে বৃষ্টির ঝুম ঝুম শব্দ এবং লালমাটি আর বৃষ্টির অচেনা এক গন্ধ খুব মধুময় লাগছে। অচেনা মানুষ গুলো দৌড় দিচ্ছে নিরাপদ স্থানে। মাথার উপর তারাগুলো মিটমিট করছে। মেঘের বুক চিরে হালকা চাঁদের আলো তাদের ছাতার উপর পড়েছে। খুব সন্তর্পণে হেঁটে চলল। মুহূর্তগুলোকে বন্দী করল স্মৃতিতে। এমন সময় আর্যর ফোন বেজে ওঠল। ফোনের স্ক্রিন দেখে ভীষণ আশ্চর্য হলো। সে ফোন ধরল না কাটলও না। পকেট থেকে যেমন ভাবে বার করেছিল তেমনভাবে রেখে দিল। আবার একবার বাজলো কিন্তু তুললো না। ফোন কে করেছে তা নিয়ে মাথা ঘামালো না লক্সমি। তবে ফোনের রিংটোন শোনে অবাক হয়। কোনো এক গ্রাম্য নারী গানটি গাইছে। আর সেটা আর্য রেকর্ডিং করে রিংটোন সেট করে রেখেছে। খুব ভালো লাগলো লক্সমির।
বলল,”মেয়েটা কে? স্নেহা!”
“কোন মেয়ের কথা বলছো?”
“রিংটনে যে মেয়েটি গান গাইছে।”
“হ্যাঁ, স্নেহা। খুব সুন্দর গান গাইতে পারে।” মুখের মধ্যে একটা নির্মল হাসি ফুটে উঠল।
“তোমার এমন বোকামি যদি বর্তমানে কোনো ছেলে-মেয়ে জানতে পারে, তাহলে তারা কিভাবে নেবে জানো?”
“জানি, কেউ ভাববে অতিরিক্ত ঢং আবার কেউ ভাববে ন্যাকামি। কিন্তু আমার ভালো লাগে। ওর সব কিছুই আমার ভালো লাগে। গানটি অনেক পুরনো। কবে গেয়েছিল ঠিক মনে নেই। স্নেহা হয়তো এই গানের কথা ভুলে গেছে। কিন্তু আমার কাছে ঠিক থেকে গেছে।”
“তুমি না বললে সেদিন -তোমার সাথে স্নেহার প্রায় এক বছর হলো কোনো কথা হয়নি। কোনো যোগাযোগ নেই।”
“ঠিকই বলেছি। প্রয়োজন ছাড়া আমি মিথ্যা বলি না।আসলে, আমি তাকে ভুলতেই ভুলে গেছি।”
খানিকক্ষণ নিস্তব্ধতা। বৃষ্টির প্রভাব ক্রমশ বাড়তে শুরু করলো। একটা ছাতার তলায় দুজন বেশিক্ষণ থাকতে পারলো না। বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিজে গেল।বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে মন চাইল না। বৃষ্টিভেজা শহরে দ্রুত পা মাড়িয়ে মাড়িয়ে চলতে রইল নিজেদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

পর্ব ১৬ আসছে
যারা নিয়মিত এই উপন্যাসটি পড়ে আসছেন, কিন্তু কখনো কোনো মন্তব্য করেননি। তাদের কাছে একটা অনুরোধ রইল আজকে অন্তত সবাই গল্প সম্বন্ধে কিছু মন্তব্য এবং রিয়্যাক্ট করে যান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here