কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ পর্ব-১৯

0
189

কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ১৯
_______________
দীর্ঘদিন ধরে নিজের সাইকেল না চালানোর ফলে সেটি ক্ষয় হয়ে গেছে। সহজে গড়ল না। বাধ্য হয়ে রিম্পির সাইকেল নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে গেল। চরম উত্তেজনায় শরীর বারবার ঝিমঝিম করে উঠছে। দুটো বছর পর ভালোবাসার মানুষটির মুখোমুখি হবে। মুখোমুখি বসে গল্প করবে। মখমলে চোখে একে অপরকে দেখবে। কয়েকটি লাল-নীল মুহূর্তের সৃষ্টি হবে। আনন্দে ছটফট করছে সে। চোখেমুখে ফুরফুরে মেজাজ ফুটে উঠেছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেল সে, তাদের শেষ দেখা যেখানে হয়েছিল। পুরনো রেললাইনের রাস্তায়। একদিন প্রাইভেট থেকে ফেরার সময় সড়কের উপর দিয়ে চলে যাওয়া রেল লাইন ছিল শেষ গন্তব্য।ট্রেন চলে আসায় বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে গল্প করেছিল। কাছে পৌঁছতে দেখল স্নেহা বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পৌঁছনোর অনেক আগে পৌঁছে গেছে। অনেক বকা খেতে হবে। স্নেহার বকুনিও তার ভালো লাগে। তার বকাতে অদ্ভুত এক মিষ্টি রয়েছে। তাকে দেখে আকাশে উড়তে ইচ্ছে করলো। আকাশে উড়ে মেঘেদের সঙ্গে খেলা করতে ইচ্ছে করছে। তার কাছে পৌঁছে সাইকেলের বেল বাজালো। স্নেহা নিজের গোল মুখখানা ঘুরিয়ে আর্যকে দেখল। তাড়াতাড়ি রাগান্বিত স্বরে বলল,”হনুমান, তোর সব জায়গায় দেরি না করলে হয় না বল? স্কুল,কলেজ, প্রাইভেট, কারোর সঙ্গে দেখা করা। সব জায়গায় দেরি।” স্নেহার একটা কথাও শুনলো না আর্য। নিস্পলক চোখে স্নেহার দিকে তাকিয়ে রইল। স্নেহা গজ কাপড় দিয়ে তৈরি গোল জামা পরে আছে। তার ওপর জ্যাকেট পরেছে। মাথায় উলের টুপি। শীতের পোশাক পরে থাকায় তার শীর্ণ শরীর মোটা দেখাচ্ছে। মুখ ভালো মত করে দেখা যাচ্ছে না। বর্তমানের স্নেহা সেই পুরনো স্নেহাই থেকে গেছে। একটু অগোছালো, অন্যান্য মেয়েদের মত তেমন সাজুগুজু পছন্দ নয়। ঠোঁটে সামান্য লিপস্টিক খুঁজে পেল না। খুঁজে পেল না চোখের কাজল, কানের দুল কিংবা পায়ের পায়েল। অতি সাধারণ সে। আরও কিছু কথা বলেছে স্নেহা কিন্তু একটাও শোনেনি আর্য। স্নেহা এবার আর্যকে নাড়িয়ে বলল,”শরীর খারাপ?” আর্য কম্পিত হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,”না তো। আমি ঠিক আছি।”
“তাহলে জড় বস্তুর মতো স্থির হয়ে আছিস কেন? কিছু বলছিস না যে।”
“এমনি। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। এবার যাওয়া যাক।”
স্নেহা নিজের সাইকেলের প্যাডেল ঘোরালো,সঙ্গে আর্যও। পাশাপাশি রয়ে সাইকেলের প্যাডেল ঘুরে এগোলো। স্নেহা খেয়াল করলো আর্য আগের মত দ্রুত সাইকেল চালাতে পারছে না। কারণ, সে বাদামী রঙের শাল পরেছে। দ্রুত সাইকেল চালাতে গেলে তা পড়ে যাচ্ছে। শাল ঠিক করতে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। স্নেহা একটু বিমুখ হয়ে নিজেও আস্তে সাইকেল চালালো। বলল,”জ্যাকেট পরলে কি অসুবিধা হয়? মেয়েদের মত গায়ে শাল দিয়েছিস কেন?” আর্য বাম হাতে নিজের শাল সামান্য তুলে দেখালো, ভিতরে জ্যাকেটও আছে। স্নেহা মাথা নাড়ালো।
“তোর একা শীত করছে? আমার করছে না বল?” আর্য কোনো জবাব দিল না। তার জবাব না পেয়ে বলল,”কিরে চুপ হয়ে গেলি কেন? বুড়োর মত জ্ঞান দে।”
“তুই যতই জ্যাকেট কিংবা সোয়েটার পরিস না কেন, শালের মত কোনো জিনিসে আরামদায়ক হবে না। শীতের সবচেয়ে বেস্ট পোশাক শাল।” হাসতে লাগলো স্নেহা। হাসতে হাসতে বলল,”এই তো আসল আর্য। আমি তো এই আর্যকে খুঁজছিলাম। ভাবছিলাম, শহরে গিয়ে, হয়তো, এই বুড়োটা ইয়াং হয়ে গেছে। কিন্তু না, সে পুরনোই থেকে গেছে।”
“আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছিস?” স্নেহা একটু ঘাবড়ে গেল। সে তো শুধুমাত্র মজা করছিল। কিন্তু আর্য কথাগুলো সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছে। ছেলেটা একটু উল্টাসিধা। মজার জিনিস সিরিয়াস আর সিরিয়াস জিনিস মজা হিসাবে নেয়।
“বিরক্ত হচ্ছিলাম বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলাম। তোর সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম। একটু গল্প করবো। আমি তোকে চিনি না? বল? আমি জানি, তুই সবার সঙ্গে ভালো ভাবে মিশতে পারিস না। কিন্তু যার সঙ্গে অকপট হও,তাকে সম্পূর্ণ আপন ভেবেনিস। বকবক করতে থাকিস। তোর বকবকানিতে আমি কখনো বিরক্ত হই না।” আর্য ফিক করে হেসে ফেললো। তার ঠোঁটের হাসি ভালো করে লক্ষ করল স্নেহা। এতক্ষণে আর্যকে ভালো করে দেখলো। মাথায় একগাদা চুল রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে কাটেনি। কোনো রকম ভাবে দু-এক বার চিরুনি বোলিয়েছে। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। পুরনো সবকিছুই অপরিবর্তিত রয়েছে। শুধু দাড়ি গোঁফ বেরিয়েছি। একটু হেসে বলল,”ও মা, তোর তো দাঁড়ি গোফ বেরিয়ে গেছে। বড় হয়ে গেছিস!” স্নেহার কথায় লজ্জা পেল আর্য। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। তার দিকে তাকাতে একটু ভয় করছে। অবচেতন মনে স্নিগ্ধতায় ভরে উঠেছে। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল,”সব সময় ছোট থাকবো না কি!”
“ছোট থাকতে বলছি না। কিন্তু বড় হলে অনেক দায়িত্ব বাড়ে। দায়িত্ব নিতে পারবি তো?”
“অবশ্যই পারবো। দায়িত্ব নেওয়ার অভ্যাস আমার রয়েছে।”
“এত জোর দিয়ে কি করে বলছিস?”
“নিজের প্রতি বিশ্বাস থেকে। নিজেকে অনেক বিশ্বাস করি, তাই।”
গল্প করতে করতে তারা একসময় শহরে পৌঁছলো। শহরে প্রবেশের মুখে কিছুটা দূরে স্নেহার বাবার দোকান রয়েছে। উভয় সেখানে গিয়ে নিজেদের সাইকেল রেখে দিল। স্নেহার বাবাকে দেখে একটু ভয় পেল আর্য। কোনো কথা না বলে মুখ নিচু করে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। এরপর স্নেহার কথা মত সামান্য হেঁটে চলল। তারপর রয়েছে অহনা নদীর তীরে কফি হাউস। সেখানে বসে দুজন গল্প করবে। তার কথামতো পাশাপাশি দুজন হাঁটতে শুরু করল। আর্য বলল,”তোর বাবা কিছু বলবে না? তুই যে আমার সঙ্গে ঘুরছিস।”
“কি বলবে?”
“এই যে তুই একটা ছেলের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিস।”
“তাহলে, তুইও ছেলে-মেয়ের মধ্যে পার্থক্য খুঁজিস?”
“না, কিন্তু তিনি তো গ্রামের মানুষ। তাই বললাম। রাগ করিস না।”
“গ্রামের মানুষ হলেও বাবা এমনটা নয়। তাছাড়া, আমি মিথ্যা কথা বলে চলে আসলাম। কোনো কারণে বাবা সবকিছু জানতে পেরে গেল। তখন আমায় অনেক খারাপ ভাববে। অনেক সন্দেহ করবে।” নিজের কথা শুনে নিজেই আঁতকে উঠল। এগুলো কি স্নেহার কথা? না অন্য কেউ শিখিয়েছিল? তার কথাগুলো আজ বলছে। সত্যিই কি বাবা-মার কাছ থেকে কোনোকিছুই লুকায়নি? কথাগুলো যদি প্রথম থেকে বুঝতো তাহলে আজ বাবা-মাকে এত কষ্ট পেতে হতো না। বিক্রম প্রেমিক ছিল তাই হয়তো বলতে পারেনি। আজ বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। তাই সহজে সব কিছু বলতে পেরেছে। তাছাড়া তাদের বাড়িতে সবাই আর্যকে চেনে। স্কুলে পড়াকালীন পরিচয় হয়েছে। আর্যর সঙ্গে তার মা কথাও বলেছে। কিছুটা পথ হেঁটে গেল। হাঁটতে হাঁটতে আর্য এক সময় তৃপ্ততা ভরা স্নেহার চোখের দিকে তাকিয়ে লাজুক মুখে বলল,”তোর হাতটা একটু ধরি?” স্নেহার বুক মুহূর্তের মধ্যে দুমড়ে-মুচড়ে গেল। তা আর্যর কাছে কিছুতে প্রকাশ করল না। বরং খিলখিল করে হেসে উঠলো। আর্যর চোখের দিকে তাকালো। তার চোখ এক বিশেষ কারণে তৃপ্ততায় পরিপূর্ণ হয়েছে। চোখ মুখ লজ্জায় লাল হয়ে আছে। তার মুখশ্রী থেকে মুগ্ধতা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে স্নেহা বলল,”আচ্ছা ধর।” আর্য নরম হাত স্নেহার নরম হাতে স্পর্শ করল। বেশ জোরে পাঁচ আংগুলের মধ্যে আঙ্গুল ভরে জাপ্টে ধরল। মুহূর্তের মধ্যে সারা শরীরে বিদ্যুৎ ঝলকানি দিয়ে উঠলো। বুক কেমন একটা হচ্ছে। দুরু দুরু বুক কেঁপে উঠছে। ভালোলাগার ফুল বুকের মধ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে। প্রাণবন্ত ভালোবাসা আর স্নিগ্ধতা একে অপরকে স্পর্শ করে মুগ্ধতায় ছেয়ে গেলো। আর্য আনন্দে চোখের কোণে জলের রেখা টপটপ করে উঠলো। স্নেহার বড্ড ভালো লাগলো। শুধুমাত্র তার নরম হাতের স্পর্শ পেয়ে একটা ছেলে কতটা খুশি হয়েছে। একটা মুহূর্ত থাকতে পেরে নিজেকে কতটা সুখী মনে করছে। স্নেহার ভাবতে কেমন কষ্ট লাগলো। খুব কম মানুষ পারে এমন ভালবাসতে। এমন অল্পতে খুশি হতে। স্নেহাও ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে বলল,”তুই বড্ড বোকা।”
“চালাকি করে ভালোবাসা কিংবা কিছু জয় করা তো যায় না।”
“তাহলে তুই একটু বেহায়া?”
“যদি বেহায়া না হলাম তাহলে কেমন ভালোবাসলাম?”
“ধুর! তোর সঙ্গে কোনোদিন আমি কথায় পেরে উঠব না। সব সময় হারাতে হয়। নিজে থেকে তো একবার হারতে পারিস।” দুজনে খিলখিল করে হেসে উঠলো। আরও কিছুটা হাঁটার পর স্নেহা লক্ষ করল, আর্য এখনো তার হাত ছাড়েনি। খুব সুন্দর ভাবে আলতো করে নিজের হাতে বন্দি করে রেখেছে। সহজে মুক্ত করবে না।

কফি হাউসে একটা টেবিলের মুখোমুখি বসে রয়েছে দুজন। স্নেহার কফির প্রতি বড্ড ইন্টারেস্ট রইলেও আর্যর একদমই নেই। স্নেহা বার দু-একবার চুমুক দিলেও আর্য একবারও দেয়নি। পাশে নদী থাকায় শীত একটু বেশি অনুভব হচ্ছে। শীতল হাওয়া শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে। এতক্ষণে আকাশে এক ফালি চাঁদ উঠেছে। চাঁদের চারিদিকে অসংখ্য তারা মিটমিট করছে। জোৎস্নার আলো নদীর জলে পড়েছে। নদীর এপার-ওপারে টিপটিপ করে অসংখ্য আলো চলেছে। নদীর জলের দিকে তাকাতেই এপার-ওপার দুই দিকের আলো কাটা কাটা ভাবে ভেসে উঠলো। নদীর জলে আলো আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।একটি দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য। আর্য অনেকক্ষণ নদীর দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষন পর চোখ ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দেখল। জায়গাটা বড্ড সুন্দর। চতুর্দিকে নমনীয়তায় পরিপূর্ণ।
“কফিটা তো ঠান্ডা হলো। আগে কাপে চুমুক দে তারপর এদিক-ওদিক দেখবি।” স্নেহার দিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে হাসলো। কাপে চুমুক দিয়ে বলল,”জায়গাটা বড্ড সুন্দর তাই না রে!”
“হুম, তুই এর আগে এখানে আসিস নি?”
“না, এটাই প্রথম।”
“আরও অনেক সুন্দর জায়গা আছে। সব কিছু ঘুরে দেখাবো। তুই তো প্রতি দিন পড়তে আসতিস। নিজে থেকে ঘুরে দেখিসনি কেন? নিজের শহর নিজেই ভালো করে ঘুরে দেখিসনি! বোকা একটা।” আর্য নিরুত্তর। চুরি করে বারবার স্নেহাকে দেখলো। স্নেহার মাথায় টুপি থাকায় ভালো মত দেখতে পারছে না। কিছুক্ষণ মৌন থেকে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে আর্য বলল,”মাথার টুপিটা খোল না রে। কতদিন দেখিনি তোকে। একটু ভালো করে দেখি।” স্নেহা একটা জোরে ধাক্কা খেলো। তারপর খুব হাসলো। মুখের মধ্যে মুগ্ধতা মেখে অনেকক্ষণ ধরে হাসতে রইল। বসন্তের ফুল বাগানের চেয়েও সুন্দর তার হাসি। মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল আর্য। শীতের মধ্যেও তার চুলে মৃদু বসন্তের বাতাস বইছে। তার শরীর পুরো রোমাঞ্চিত হয়ে কাঁপতে শুরু করল।স্নেহা আস্তে আস্তে নিজের মাথা থেকে টুপি সরিয়ে ফেললো। এবার স্পষ্ট ভাবে তার নরম মুখশ্রী উন্মোচিত হলো আর্যর সামনে। জ্যোৎস্না এবং কৃত্রিম আলো স্নেহার মুখের উপর পড়ে চকচক করে উঠলো। ভোরে তোলা স্নিগ্ধ উজ্জ্বল অসংখ্য রংবেরংগের ফুলের মত সুন্দর মুখশ্রী। এখনো হাসি থামাতে পারেনি। চাপা আনন্দের হাসি হাসতে রইল। স্নেহা কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। তার জিভ কথা বলার সাহস জোগাতে পারছে না। হঠাৎ করে এমন হচ্ছে কেন বুঝতে পারল না।ছোটবেলা থেকে এই পুরুষ মানুষটির দিকে তাকাতে কোনো সংকোচন হয়নি। আজও হলো না। স্থির চোখে আর্যর চোখের দিকে তাকালো। আর্যর চোখ বড্ড বেহায়া ভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওর চোখ যেন কিছু বলতে চাইছে। অনেক কিছু লুকিয়ে রয়েছে ওর মধ্যে।
“কি রে? এতক্ষণ ধরে কি দেখছিস?” স্নেহার কণ্ঠস্বর ভরাট।
“তোকে। তোর হাস্য উজ্জ্বল দয়ামাখা মুখটি দেখতে ভালো লাগছে।”
“আমায় কোনোদিন দেখিসনি? আর কতক্ষন এভাবে তাকিয়ে থাকবি‌। এবার তো চোখ নামা।” আর্য কুন্ঠা বোধ করলো। নিমিষে চোখ নামিয়ে নিল। ঘাড় নাড়ালো। আবার খিলখিল করে হাসতে শুরু করলো। স্নেহার চোখে মুখে এমন হাসি আগে কখনো দেখেনি আর্য। স্নেহাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে বড্ড উদ্দীপনায় রয়েছে। অদ্ভুত রহস্যময় খুশিতে খুশি সে। স্নেহাও নিজেই নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করল। তার মনে নেই, কবে ঠিক এতটা খুশি হয়েছিল? এত হেসেছিল? তার দিকে কেউ কখনো দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকেনি। মিষ্টি কন্ঠে কেউ বলেনি তাকে দেখবে বলে। এতকিছুর মধ্যেও লজ্জা পেল না। খুব কাছের মানুষের কাছে লজ্জা বলে কিছু থাকে না। বেশ অনেকক্ষণ পর হাসি থামালো। তবে চোখ-মুখ থেকে হাসি সম্পূর্ণ সরাতে পারল না। আর্যর দিকে তাকাতেই চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠছে। একা একা চোখ লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। ঠোঁট ফুটে আপনা আপনি হাসি বেরিয়ে আসছে। এই হাসির মধ্যে কোনোরূপ তাচ্ছিল্য নেই। মুগ্ধতা আর তৃপ্ততা রয়েছে। হৃদয়ের বহুদিনের হাহাকার আজ পরিপূর্ণতা পেয়েছে। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে মিষ্টি কণ্ঠস্বরে স্নেহা বলল,”চল না আর একটু হাঁটি।” স্নেহার চোখের দিকে তাকালো আর্য। ঠোঁট টিপে হাসলো। বলল, “না।”
“কেন?”
“আমরা যখন হাঁটবো, তখন ঘন কালো মেঘ উঠবে কিন্তু বৃষ্টি হবে না।
আমরা যখন হাঁটবো, তখন পাখিরা বাসায় ফিরবে।
আমরা যখন হাঁটবো, তখন প্রতি ঘরে ঘরে শঙ্খধ্বনি বাজবে।
আমরা যখন হাঁটবো, তখন শিশুরা মায়ের কোলে বসে দুধ পান করবে।
আমরা যখন হাঁটবো, তখন আকাশে মাত্র একটা তারা দেখা যাবে।”
নিরুত্তর রইল স্নেহা। এতদিন ধরে মনে হয়েছে আর্য একটি আনরোমান্টিক ছেলে।মেধাবী হিসেবে পারফেক্ট কিন্তু কোনো প্রেমিক হিসেবে নয়। আর্য দায়িত্ব নিতে পারে। ভালোবাসতে পারে। স্নেহ, ভালোবাসা, আদর, যত্ন সবকিছু করতে পারে।তবে ভালোবাসার ধরনগুলো একগুঁয়ে। কিন্তু আজ অন্য কিছু মনে হচ্ছে। আর্য ভয়ঙ্কর প্রেমিক।তলোয়ার চেয়েও ধারালো তার দৃষ্টি। ওই দৃষ্টি খুঁজে বেড়াচ্ছে শুধু একটি নারীকে। চোখেমুখে কোনো রকম লালসা নেই। সৃষ্টির নতুন সৌন্দর্যের ভালোবাসা রয়েছে। অকৃত্রিম ভালোবাসা। তার চোখ বড্ড পবিত্র। সহজে লোভনীয় জিনিসের প্রতি প্রবৃত্ত হয় না। কিছুক্ষণের মৌনতা কাটিয়ে বলল,”তুই কখনো পালিয়ে যাবি না তো?”
“পালাবো কেন? পালালেও তোর বাড়ি থেকে আমার বাড়ি বেশি দূর নয়। এসে নিয়ে যাবি। তুই বাইরে যাওয়ার পর আমি কিন্তু আর পড়াশোনা করিনি। সবকিছু তো জানিস। আমায় কিন্তু সারা জীবন খাওয়াতে হবে তোকে।” কথা বলে ফিক করে হেসে ফেললো স্নেহা। আর্য কোনো উত্তর দিল না। একটু পর বলল,”যদি আমি তোর থেকে পালিয়ে যাই! তখন কি হবে?”
“তাহলে,তোর মাথায় একটাও চুল থাকবে না। সব ছিঁড়ে ফেলবো।” আর্য হেসে উঠলো।
“হাসবি না একদম। সত্যি সত্যি সব চুল ছিঁড়ে ফেলবো।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। এবার বাড়ি চল। রাত বাড়ছে।”
দুজন উঠে আবার হাঁটতে শুরু করল। কিছুটা হাঁটার পর স্নেহা বলল,”কাল আবার আসবি? অনেকদিন ধরে একা ঘরে বন্দি থেকেছি। আর থাকতে ভালো লাগে না। সারাদিন ছটফট করতে থাকা পাখিটাকে যদি ঘরে বন্দি করে দেওয়া হয়, তাহলে সে কি ভালো থাকবে? বল?”
“আসতে অসুবিধা নেই। কিন্তু বাবা!” আর্যর মনের সংকোচন বুঝতে পারল স্নেহা। বলল,”আমি কাকুকে ফোন করে বলবো। আমি বললে কাকু কখনো না বলবে না।” আর্য মাথা নেড়ে হেসে উঠলো। তার দেখাদেখি স্নেহাও হাসলো।

অনেকগুলো রাতের পর আজকের রাতে বেশ খোশ মেজাজে রয়েছে স্নেহা। সুন্দর একটা সন্ধ্যা কাটিয়েছে। কয়েক ঘন্টার আগের মুহূর্ত মনে করে যেমন বুক তৃপ্ততায় ভরে উঠছে। তেমনি অনেক আগেকার কথা মনে পড়তেই বুক শূন্য হয়ে উঠছে। হাহাকার বুকে মৃদু শীতল বায়ু আঘাত হানছে। ব্যথা করছে। ঘরের মধ্যে বারবার পায়চারি করতে লাগলো। দূরের ট্রেন ছুটে গেলেও হুশ ফিরল না। বারবার আর্যর বলা কথাগুলো স্মরণ করলো। তার প্রতিটি বাক্য স্মৃতিতে মুদ্রিত হয়ে গেছে। তার যুক্তি গুলো একের পর এক সাজিয়ে দেখল। আর্য সঠিক মানুষ। সঠিক প্রেমিক। তার ভালোবাসার মধ্যে শুদ্ধতা প্রচুর। তার ভালোবাসার দিকে কেউ আঙ্গুল তুলতে পারবে না। মুহূর্তগুলো যখন বন্দি করছিল তখন আর্যর মধ্যে ফিলিংস সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। চরম উত্তেজনা এবং আবেগ ভরপুর ছিল।সেই মুহূর্তে স্নেহাকে বন্ধু হিসেবে দেখেনি দেখেছে প্রেমিকা হিসেবে। কিন্তু স্নেহা পারেনি তাকে প্রেমিক হিসেবে দেখতে। তার প্রতি কোনো ফিলিংস আসেনি। বিক্রমের প্রতি যে ফিলিংস, আগ্রহ, কৌতুহল ছিল। এগুলোর একটাও আর্যর উপর অর্পিত হয়নি। তাই তো আর্যর সমস্ত কথায় রাজি হয়েছে। কিন্তু নিজে থেকে কিছু চায়নি। কোনো কিছুতে অধিকার ফলায়নি। বিক্রমের চোখের দিকে তাকাতে লজ্জা বোধ করতো কিন্তু আর্যর চোখের দিকে তাকাতে লজ্জা বোধ করেনি। তার সঙ্গে কথা বলতো ভেবেচিন্তে কিন্তু আর্যর সঙ্গে কথা বলতে ভাবতে হয় না। নির্বিধায় সবকিছু বলা যায়। মনের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। মন থেকে কখনো বিক্রমকে ভোলা সম্ভব নয় তাও বুঝতে পারে। সমুদ্রে তো অনেকগুলো সুন্দর পাথর রয়েছে। শুধুমাত্র একটা পাথরের জন্য নিজের জীবনকে এলোমেলো করার কোনো প্রয়োজন নেই। যখন আর্য তার হাত ধরল কিংবা তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো তখন দেখেছে আর্যর চোখের মুখের উজ্জ্বলতা। কতটা ললিত ভাবে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। একটা মুহূর্ত তাকে পেয়ে কতটা আনন্দিত হয়েছিল। কেউ তাকে পেয়ে সুখী হয়েছে। তার জীবন স্নিগ্ধতায় ভরে গেছে। তাহলে,সে নিজেই নিজেকে পেয়ে কেন সুখী হবে না? নিজে চাইলেও পৃথিবীতে সকলকে ভালোবাসা যায় না। শুধু বাম হাত দিয়ে চোখের জল মুছে ডান হাতটি অন্য কোনো এক মানুষের নরম কিংবা বলিষ্ঠ হাত ধরে এগিয়ে যেতে হয়। জীবন মানে শুধুমাত্র ঘন কালো মেঘের মত অন্ধকার নয়। আবার জীবন মানে শুধু মাত্র ঝলমলে রোদের মত উজ্জ্বল নয়। জীবন মানে ‘কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ।’

পর্ব ২০ আসছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here