বেখেয়ালি মনে পর্ব-৫

0
1079

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-০৫
.
.

ত্রয়ী শুয়ে আছে তার দাদীমার পাশে। কতশত গল্প জুড়ে দিয়েছে তার দাদীমা তাকে কাছে পেয়ে। তাদের দু’জনের সাথে অবশ্য হিমা, ঝুমাও আছে। ত্রয়ীর দাদীমা আনোয়ার বেগম বললেন,
-তগোর তিনডার লাইগা তিনডা রাজপুত্তুর আইবো দেহিস বইনেরা।

আনোয়ারার কথা শুনে হিমা বলল,
– উফ! দাদীমা এসব কী ভাষায় কথা বলছো তুমি? আমি একটুও বুঝতে পারছিনা।

হিমার কথা শুনে আনোয়ারা আর ত্রয়ী মুখ টিপে হাসছে। হিমা, ঝুমার জন্মই হয়েছে লন্ডনে, তাই তারা গ্রামীণ ভাষার সাথে পরিচিত নয়। হিমার কথার পিঠে ঝুমা ও বলল,
– হ্যাঁ দাদীমা! সিস একদম ঠিক কথা বলেছে। আমিও তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছিনা।

ওদের দু’বোনের কান্ড দেখে ত্রয়ীর পেট ফেটে হাসি আসছে। তবে সে সেই হাসিটা সংযত রেখে ওদের উদ্দেশ্যে বলে,
– দাদীমা বললেন, আমাদের তিন বোনের জন্য রাজপুত্র আসবে।
এবার হিমা খানিকটা লাজুক স্বরে বলল,
– আমার রাজপুত্র এসে গেছে দাদীমা।

হিমার কথা শুনে ঝুমা বেশ অবাক হলো। কারন, হিমা ঝুমার থেকে দু’বছরের বড় হলেও কখনো ঝুমার কাছ থেকে কোনো কথা লুকোয় না। আর এতো বড় কথাটা ঠিক চেপে গেলো ঝুমার কাছ থেকে। হিমার উপর ঝুমার খুব রাগ হচ্ছে।

সে রাগি কন্ঠে বলল,
– কে সে সিস? তুমি কীভাবে পারলে আমার কাছ থেকে কথাটা লুকাতে?
হিমা ঝুমার গালে একটা কিস দিয়ে বলে,
– কোথায় লুকালাম? এই তো বলে দিলাম দেখিস না?
ত্রয়ী একটু কেশে বলল,
– হিমাপ্পা! তোমার রাজপুত্রের নামটা কী? হুম?
হিমা মৃদু হেসে বলে,
– ইনান।
কন্ঠে লজ্জা।

হিমার কথা শুনে ত্রয়ীর বুকের ভেতর ছ্যাত করে উঠে। বিব্রতকর কন্ঠে বলে,
– আর ইউ সিরিয়াস?
হিমা এবার ত্রয়ীর হাত ধরে বলল,
– হ্যাঁ রে, সেদিন যখন ইনান আমাদের সাথে লাঞ্চ করতে এসেছিলো সেদিনই আমার ওকে ভালো লেগে গিয়েছে। ওর ওই ব্রাউন আই আমার মন কেড়ে নিয়েছে। ওর কপালে আচঁড়ে পড়া চুলগুলো আমার রাতের ঘুমকে বরবাদ করে দিয়েছে।

ত্রয়ী হিমার হাত থেকে ওর হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে সেখান থেকে উঠে চলে যায়। খুব জেলাস ফিল হচ্ছে ত্রয়ীর। আপন মনে প্রশ্ন করছে, কেন ইনান ছাড়া কি দুনিয়াতে আর কোনো ছেলে নেই? হিমাপ্পা কেন ওর ভালোলাগার মানুষকেই পছন্দ করলো?
ত্রয়ীর মনে প্রশ্ন হাজার। কিন্তু উত্তর কোথায়?

__________________________________________________________

রাত দশটার বেশি বাজে। ত্রয়ী আর ইফতিহাকে এক রুমে থাকতে দিয়েছে। হিমা ও ঝুমা অন্য রুমে। ইনানের সাথে তিসান আর নিশানকে রুম শেয়ার করতে বলা হয়েছে। কিন্তু তিসান কারো সাথে রুম শেয়ার করতে পারবে না বলে দিয়েছে। কারন কারো সাথে রুম শেয়ার করলে ওর গার্লফ্রেন্ডের সাথে প্রেমালাপ কর‍তে পারবেনা যে। নিশান ইনানের সাথে রুম শেয়ার করেছে। সাধারণত গ্রামের মানুষ সন্ধ্যা নামতেই ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়।

নিশানের এতো তাড়াতাড়ি ঘুম আসেনা বিধায় উঠোনে পায়চারি করছে। ইনান রুমে একা। এই সুযোগে ত্রয়ী ইনানের রুমে আসে। দরজাটা ভেতর থেকে লক করা না তবে হালকা ভেজানো আছে। ত্রয়ী দরজায় গিয়ে টোকা দেয়। তখন ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে মাতাল করা সেই কন্ঠ,
– আসুন।

ত্রয়ী রুমে প্রবেশ করে দেখে ইনান ডায়েরিতে আনমনে কিছু লিখছে। গলা খ্যাঁক করে ত্রয়ী বলে,
– কী লিখছেন ভাইয়া?
ত্রয়ীর কন্ঠ শুনে ইনান ডায়েরি থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলে,
– বোকাপাখি, এতো রাতে তুমি এখানে?
ত্রয়ী বলে,
– ঘুম আসছিলো না, তাই ভাবলাম একটু এদিকটায় ঘুরে যাই।
ইনান আবার লিখাতে মনোযোগ দিয়ে বলে,
– ওহ।

ত্রয়ীর খুব রাগ হচ্ছে ইনানের উপর। ও রুমে থাকা সত্ত্বেও কেন ইনান ডায়েরি লিখাতে ব্যস্ত? ইনানের উচিৎ এখন ত্রয়ীর দিকে তাকিয়ে কথা বলা। একটু সময় দেওয়া। কিন্তু সে তা না করে বরং ডায়েরি লিখাতে মন দিচ্ছে।
ত্রয়ী নরম স্বরে বলে,
– আমি কি বিরক্ত করে ফেললাম আপনাকে?
– উহু.. না তো।
ডায়েরিতে দৃষ্টি স্থির রেখে ইনান বলল কথাটা।

ত্রয়ী এবার বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,
– তাহলে আমার দিকে না তাকিয়ে এখনও ডায়েরির দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? আমার কথার থেকেও কি ওটার শব্দগুলো বেশি আকর্ষিত করছে আপনাকে?
ত্রয়ীর কথা শুনে ইনান চোখ তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকায় ত্রয়ীর দিকে।

নিজের অজান্তেই এমন একটা কথা বলে ত্রয়ী নিজেই এখন লজ্জা পাচ্ছে। অন্যদিকে ফিরে কপাল চাপড়াতে থাকে আর মনে মনে বলে,
– উত্তেজিত হয়ে লজ্জা শরমের মাথে খেয়ে কী থেকে কী বললাম। ইশ!

ইনান ডায়েরিটা বন্ধ করে বিছানা থেকে নেমে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
– কবিতা লিখছিলাম। আর কবিতা লিখার সময় অন্য কোনো দিকে মন দিতে পারিনা। হ্যাঁ এই কবিতা আমার এক প্রকার আকর্ষণই বলতে পারো।

ইনান কবিতা লিখে এটা শুনে ত্র‍য়ী থ হয়ে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে ইনানের দিকে তাকিয়ে অবাক কন্ঠে বলে,
– আপনি কবিতা লিখতে পারেন?
ইনান মৃদু হেসে বলে,
– ওই আরকি।
– আমি পড়বো আপনার লিখা কবিতা।
– পড়তে পারো তবে আজ নয়, অন্য কোনো দিন।
ঠোঁট উল্টিয়ে ত্রয়ী জিজ্ঞেস করে,
– আজ নয় কেন?
ইনান কিছু না বলে শুধু রহস্যময় একটা হাসি দেয়।

হাসি দেখে ত্রয়ীর বুকে ধক করে উঠে। ইনানের এই হাসিটা শুধুমাত্র হাসি ছিলো নয়, এর পিছনে রয়েছে হাজারো ব্যকুলতা। কাউকে পাওয়ার তীব্র আশা। আবেগ আর ভালোবাসায় মিশ্রিত অনূভুতি। ত্রয়ী এখনো অবুঝ কিশোরী। এতো কিছু ও বুঝে উঠতে পারলোনা।

তবে আবারও বোকার মতো একটা প্রশ্ন করে বসলো সে,
– আচ্ছা প্রেমে পড়ে কীভাবে?
ত্রয়ীর এমন প্রশ্ন শুনে ইনানের চোখ দুটি বড়বড় হয়ে যায়। গলা খ্যাকারি দিয়ে পরিষ্কার করে নেয়। তারপর বলে,
– এখনও অনেক পিচ্চি তুমি। এসব বুঝার বয়স হলে নিজ থেকেই বুঝে যাবে। এখন যাও ঘুমাও গিয়ে।

কাঁদোকাঁদো কন্ঠে ত্রয়ী বলে,
– প্লিজ ভাইয়া বলুন না? আমি জানতে চাই মানুষ প্রেমে পড়ে কীভাবে?

ইনান আবারও হাসলো। বলল,
– সাধে তো আর আমি তোমাকে বোকাপাখি বলিনা।
– সে আপনি আমাকে যাই বলে থাকেন, এখন প্লিজ আমার প্রশ্নের উত্তরটা দিন।

ইনান বুঝে গেছে ত্রয়ী পিচ্চি হলেও খুব জেদি মেয়েও বটে। তাই সে ত্রয়ীর দিকে একবার ভালো ভাবে পর্যবেক্ষন করে বলল,
– আচ্ছা বলছি। কিন্তু তার আগে তুমি চোখ বন্ধ কর।
চোখ বন্ধ করার কথা শুনে ত্রয়ীর মারবেলের মতো চোখ দুটি আরো বড় বড় হয়ে যায়। তা দেখে ইনান বলে,
– চোখ বন্ধ করতে বলেছি। তা না করে চোখ আরো আরো বড় করে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছো? এমন করলে কিন্তু বলব না।

ত্রয়ীর প্রশ্নের উত্তর টা জানা খুব দরকার ওর। তাই আর কথা না বাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,
– আচ্ছা এবার বলুন।

ইনান ত্রয়ীর বন্ধ নয়ন, হালকা গোলাপি আভার ঠোঁট, এলোমেলো ঝাকড়া চুল, মুষ্টি বদ্ধ হাতের আঙ্গুলের দিকে তীর্যকভাবে দৃষ্টিপাত করে কাব্যিক কন্ঠে বলল,
– চোখের তারায়, ঠোঁটের ভাজে, আঙ্গুলের ফাঁকে প্রেম লুকানো থাকে। এলোমেলো চুলের মাঝে প্রেম গোছানো থাকে। হঠাৎ করেই সেই লুকানো প্রেম খুঁজে পেতে হয়। কোনো এক ব্যস্ত বিকেলে হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে যেতে যেতেই বেখেয়ালি মনে প্রেমে পড়তে হয়।

ইনানের কথা গুলো ত্রয়ীর কানে যেতেই ওর মুখে লজ্জার লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে। ঠোঁটে লজ্জামাখা হাসির রেখা ফুঁটে উঠে। হৃদস্পন্দনের গতি তরঙ্গের মতো লম্প ঝম্প করতে থাকে। জোরে নিশ্বাস ছেড়ে চোখ মেলে তাকায় সে।

ইনান তাকিয়ে আছে তার দিকে। এটা দেখে চোখ সরিয়ে নেয় সে। কিছু না বলেই ভৌ দৌড় দেয় ইনানের সামনে থেকে।

তা দেখে ইনান ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসে। বলে,
-হঠাৎ যেন খুব নিস্তব্ধ নদী, আবার হঠাৎই বেশ উত্তাল ঢেউ! অদ্ভুত মেয়ে! না না, মেয়ে না, বোকাপাখি!

_________________________________________________________

সকালে সব ভাই বোন মিলে পুকুর পাড়ের হিজল গাছের নিচে পাটি পেতে বসেছ গানের কলি খেলতে। ইফতিহা এসেছে ওদের সাথে কিন্তু ইনান তখনও আসেনি পুকুর পাড়ে। সবার গান গাওয়া শেষে ত্রয়ীর পালা আসে। ত্রয়ী পিচ্চি হলেও গান গায় খুব সুন্দর। মিষ্টি কন্ঠ দিয়ে নিষ্ঠার সাথে একদম মন থেকে গান গেয়ে সবার মন জয় করে নেয় মেয়েটা। ত্রয়ীকে গান গাইতে হবে ‘এ’ অক্ষর দিয়ে। ত্রয়ী বেশ কিছুক্ষণ ভেবে গান গাওয়া শুরু করল,

” এখন তো সময় ভালোবাসার…
এ দুটি হৃদয় কাছে আসার…
তুমি যে একা…
আমিও যে একা….
ও প্রিয়…ও প্রিয়…
পেয়েছি তোমাকে এতোদিনে
যেও না…..
সরে গো অভিমানে!”

ত্রয়ী গান গাওয়ার মধ্যেই ইনান এসে উপস্থিত হয় সেখানে। তবে এক বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ব্যস্ত সে। ইনান মুখের কতশত ভঙ্গি ধরে বাচ্চাটার সাথে কথা বলছে। আর ওকে দেখেই স্তব্ধ হয়ে যায় ত্রয়ী।
থমকে গেছে ওর কন্ঠ। ভালোবাসার মানুষটাকে সামনে পেয়ে মনটা হুট করেই গতি হারিয়ে ফেললো। ইনান বাচ্চাটাকে নিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরছে এদিক সেদিক। ত্রয়ীর গান বন্ধ করে দেওয়ায় সবাই হা হয়ে তাকালো ওর দিকে। ঝুমা তো জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
-ওও আপু গান কি শেষ? নাকি ভুলে গেলে মাঝখানে?
প্রশ্ন শুনে ইনানও চোখ ফিরিয়ে তাকায় ওদের দিকে। ত্রয়ী বিব্রতবোধ করে। ইনানকে হঠাৎ দেখে কি যে হলো ওর! গলা দিয়ে আর গান বের-ই হচ্ছে না যেন। তখনই আচমকা ত্রয়ী ব্যতীত অন্য কারোর কন্ঠে গানটির দু’টি লাইন বেজে উঠে,

“আমি তোমারি…
ও বুকে নাও টেনে!”

ইনান গানের এই চরণটুক গেয়ে নিজেই ঠোঁটে এক চওড়া হাসি ছড়িয়ে দেয়। সেই সাথে অন্যদের মুখেও ফুটে ওঠে বেশ অবাক করা প্রতিক্রিয়া।
.
.
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here