#ভালবাসা_বাকি_আছে – ১১
Hasin Rehana – হাসিন রেহেনা
বুশরার জ্বরটা উঠানামা করছে দুইদিন ধরে। রায়হান ফোনে বারবার বলেছিল জ্বর যেহেতু যাচ্ছেনা একবারে তাই দুয়েকদিন রেস্ট নিতে। সকালেও আসার সময়ও বেশ ভালই ছিল শরীর। তাই নিষেধ কানে নেয়নি বুশরা। কিন্তু এখন কিছুটা খারাপ লাগছে। বাসায় চলে যেতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু ঘন্টা দুয়েক পরে একটা সেমিনার আছে। বুশরা সাধারণত এসব সেমিনার বাদ দেয় না। তাই কষ্ট করে থেকে গেল ক্লাসের পর। তাছাড়া আরিশকে আজ কয়েকটা টপিক বুঝানোর কথা। ছেলেটাকে ক্লাস শেষে দেখেনি বুশরা। দেখলে আজ নিষেধ করে দিত। অগত্যা পূর্বপরিকল্পনা মত বাস্কেটবল কোর্টের ওদিকে এগুলো বুশরা। ক্যাটকেটে হলুদ রঙের মার্কামারা জ্যাকেটের কারনে দূর থেকেই সিড়িতে আরিশের দেখা পেল বুশরা।
এই রঙের পোষাকে যেকোন ছেলেকে জঘন্য দেখাবে। কিন্তু অদ্ভুত, ছেলেটাকে এই উৎকট রংটাও মানিয়ে যায় অবলীলায়। ক্লাসে অনেক শেতাংগী মেয়েও আরিশকে ফ্লার্ট করার চেষ্টা, তবে আরিশের চোখের তারায় আপাতত বাঁধা পড়েছে সাদামাটা দেশি গোলগাল চেহারায় শ্যামসুন্দরী বুশরা। আর তাইতো একটু আধটু চেষ্টা করে দেখা। বিদেশ বিভুইয়ে একলা একটা মেয়ে কতদিন ইস্পাতকঠিন থাকবে? বিরহ, একাকিত্ব দূর করার জন্যও তো সাময়িক একটা কাধ চাই। আর যেকয়দিন টাইমপাস করা যায় সেটাই লাভ আরিশের। আর তাছাড়া বাংগালী, বিবাহিত মেয়ে, কয়দিন পর এমনিই কেটে পড়বে, কমিটমেন্টের ঝামেলা করবে না। সবদিক থেকেই বুশরা একটা জ্যাকপট। আর তাকে বাগাতে একটু তো চেষ্টা করাই যায়। কাছাকাছি আসতেই হাত নেড়ে “হাই” জানালো আরিশ।
“সরি একট দেরি হয়ে গেল।”
“তোমার জন্য কয়েক ঘন্টাও দেরি করতে অপেক্ষা নাই বুশরাসোনা”, মনে মনে বললো আরিশ। কিন্তু মুখে বললো, ” ইটস ওকে। আমিও মাত্রই আসলাম।”
“আচ্ছা শুরু করি তাহলে।”
কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ থেকে ক্লাসনোটস আর বলপেন বের করলো বুশরা। টপিকগুলো বুঝিয়ে দিতে লাগলো একে একে। মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকালে মেয়েটা দেখতে পেত আরিশের মোহগ্রস্ত দৃষ্টি। শুরুতে বুশরার মায়াবী চেহারায় মেতেছিল আরিশ। কিন্তু আজ এই ঘন্টাখানেকে ওর কথা বলা, হাত নেড়ে নেড়ে বুঝানো, চেহারার এক্সপ্রেশন, সবকিছুর উপর মেয়েটার স্ট্রং ব্যাক্তিত্বে বুকের মধ্যে একটা হালকা কাঁপন অনুভব করে আরিশ। এরকমটা তো আগে কখনো হয়নি। মনে মনে ভাবে কয়েকদিন নয়, অন্তত কয়েক মাস চাই মেয়েটাকে ওর। তবে তার জন্য পা ফেলতে হবে সাবধানে। বেহায়ার মত তাকিয়ে থাকলে আজই শেষদিন হবে ভেবে চোখ ফিরিয়ে খাতার দিকে নিয়ে আসলো আরিশ।
“ইজ ইট ক্লিয়ার আরিশ? নাকি রিপিট করবো?”
বুশরা পড়াশুনার ব্যাপারে খুব ডেডিকেটেড। বুঝায়ও অস্থির। তবে বাস্তবতা হলো আরিশ খুব একটা মনোযোগ দিতে পারেনি। তবে সেটা প্রকাশ করা যাবে না। সিরিয়াস মেয়ে স্টুডেন্টরা আবার আতেল হয়। মনযোগ দেয়নি বুঝলে পরেরবার গ্রুপস্টাডির জন্য রিকুয়েষ্ট করা যাবে না। আর তাহলেই সাড়ে সর্বনাশ হবে। কারন এই মেয়েকে অত সহজে কফি ডেটে নেওয়া সম্ভব না, গ্রুপস্টাডিই ভরসা।
মাথা নেড়ে আরিশ বললো, “হ্যাঁ, বুঝেছি। বাসায় গিয়ে আরেকবার দেখলে ক্লিয়ার হয়ে যাবে।”
একবার ভাবলো বলবে, “যদি আটকে যাই ফোন করবো।”
কিন্তু বললো না। কারন বুশরার নম্বর নেই ওর কাছে। আর এখনই ছ্যাচড়ার মত ফোন নম্বর চাওয়া যাবে না কিছুতেই। এমন সিচুয়েশন ক্রিয়েট করতে হবে যাতে না চাইতেই ফোন নাম্বার চলে আসে শুড়শুড় করে।
“আজ উঠি তাহলে।”, বলে উঠে দাড়ালো বুশরা। তবে সিড়ি ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই পৃথিবীটা যেন দুলে উঠলো ওর। সবকিছু ঝাপসা হয়ে এল মুহুর্তেই। আরিশ পুরো ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই ঘাসের উপর লুটিয়ে পড়লো মেয়েটা। মাথাটা সিড়ির কোনায় ঠুকে যাওয়ার আগে কোন মতে ধরে ফেললো আরিশ। জ্বরে যা পুড়ে যাচ্ছে বুশরার। আজ রোদও পড়েছে খুব বেশি। দীর্ঘ সময় রোদে থাকার কারনে গরমে ব্রহ্মতালু ফেটে যাচ্ছে মেয়েটার। চেহারা একদম ফ্যাকাসে। হুট করে উঠে দাঁড়াতেই আর শরীর সাপোর্ট দেয়নি। জ্ঞান হারানোর আগে বুশরার মনে হলো ও রায়হানের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে, ঠিক ধলতা নদীর পাড়ে যেভাবে শুয়ে ছিল কোন এক বিকেলে৷
ঘটনার আকস্মিকতায় একটু থমকে যায় আরিশ। বুশরার মাথাটা কোলে টেনে নেয়। আলতো করে ডাকে, ” বুশরা, এই বুশরা।” কোন সাড়া না পেয়ে দ্রুত চিন্তা করে কি করবে। ওর এপার্টমেন্টটা কাছেই। কিন্তু রাইসা বাসায় থাকলে খুব রাগ করবে। মাসখানেক ধরে মেয়েটার সাথে লিভইনে আছে আরিশ। কিন্তু মেয়েটা বড্ড বেশি পজেসিভ। গত সপ্তাহেও শপিংমলে একটা মেয়েকে সামান্য ফ্লার্ট করায় ঝগড়া করে নিজের ডর্মে চলে গেছিল মেয়েটা। গেল যাক, মানাতে যায়নি আরিশ। কিন্তু বেটি কাল সন্ধ্যায় ফেরত এসেছে। আরিশের খুব আফসোস হয়। বুশরার বাসার এড্রেসটা জানলে ভালো হতো। চাবি নিশ্চয়ই ব্যাগেই আছে। আর নাহলে ফিঙারলক, সমস্যা হতো না। এমন সুযোগ লাখে একবার আসে। কিন্তু এসব ভেবে লাভ নাই।
দুহাতে বুশরার গাল ধরে ঝাঁকায় আর ডাকতে থাকে আরিশ। তবে কোন সাড়া পায়না। পানির ছিটা দেওয়া দরকার। কিন্তু ব্যাগে পানি ক্যারি করেনা ও। তাই বুশরার ব্যাগে হাত দিল। তবে পানি পেল না। বরং ভাইব্রেট করতে থাকা ফোনটা হাতে লাগলো। ফোনটা বের করে দেখলো, ” চেয়ারম্যান সাহেব কলিং”। নামটা কনফিউজিং হলেও স্ক্রিনে বুশরার সাথে ক্লোজ এংগেলে তোলা কাপল ছবি দেখে বুঝতে বাকি রইলো না যে ফোনের ওপাশের মানুষটা কে।
একটু চিন্তা করে ফোনটা ধরলো আরিশ।
“হ্যালো কে বলছেন?”
অনেকখন ধরে বুশরাকে ফোন করছে রায়হান। শেষমেশ যখন ফোন রিসিভ হলো স্ত্রীর অপরিচিত পুরুষ কন্ঠ শুনে অবাক ও। অবাক তো হওয়ারই কথা। ভয় কিংবা সন্দেহ আসাটাও বাড়াবাড়ি নয়।
“রায়হান বলছি। কিন্তু আপনি কে? বুশরা ঠিক আছে?”, কন্ঠের উদ্বিগ্নতা চাপা থাকলো না খুব একটা।
“আমি কে সেটা ইম্পর্ট্যান্ট না। আমার নাম আরিশ। আমি ভুল না হয়ে থাকলে বুশরা আপনার স্ত্রী। রাইট?”
“জি। ঠিকই ধরেছেন।”, বিষ্ময় চেপে বললো রায়হান।
“বুশরা আমার সাথেই ছিল ঘন্টাখানেক। আমি বুঝতে পারিনি যে অসুস্থ। একটু আগে প্রচন্ড জ্বরে জ্ঞান হারিয়েছে। আপনি চিন্তা করবেন না প্লিজ, আমি ওকে বাসায় পৌঁছে দেব।”
সাংঘর্ষিক অনুভূতিতে দিশেহারা রায়হান। একদিকে বুশরা জ্ঞান হারিয়েছে সেই চিন্তা, অন্যদিকে তৃতীয় ব্যাক্তির অযাচিত পদচারণা।
যথাসম্ভব শান্ত কন্ঠে রায়হান জিজ্ঞাসা করলো, “বাসার ঠিকানা জানেন আপনি?”
“না মানে….”, ধরা পড়ে গেলেও শেষ তীরটা ছোড়ে আরিশ, ” আপনি যদি এড্রেসটা টেক্সট করে দেন তাহলে পৌঁছে দিতে পারি। নাহলে বুশরার জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করবো। সমস্যা নাই।’
“অনেক কষ্ট করেছেন অলরেডি, বাকিটা আমি দেখছি। আপনারা কি ক্যাম্পাসে? লোকেশনটা আমাকে একটু শেয়ার করুন আমি ব্যাবস্থা করছি।”
ফাটা ফাটা বেলুনের মত চুপশে আরিশ বললো, “আচ্ছা।”
ফোনটা কেটে তানিয়ার নম্বর ডায়াল করলো রায়হান।
“আসসালামুআলাইকুম ভাইয়া। ভালো আছেন?”
“আমি ভালো আছে আপু। একটা সমস্যা হয়েছে। হেল্প লাগতো। আপনি কি ক্যাম্পাসে?”
“হ্যাঁ ভাইয়া।”
“বুশরা হঠাৎ জ্ঞান হারিয়েছে। প্রচন্ড জ্বর ওর। ওকে একটু আপনার বাসায় নিয়ে যাবেন কষ্ট করে? এই অবস্থায় একা থাকা নিরাপদ না।”
“হ্যাঁ অবশ্যই। কালই তো মেয়েটার সাথে কথা হলো। কিছু বললো না তো।”
“ও শরীর খারাপের কথা একদম চেপে যায়। আমি লোকেশন পাঠাচ্ছি। একটু প্লিজ….”
“হ্যাঁ প্লিজ”
রায়হান লোকেশন ফরওয়ার্ড করে দিল তাড়াতাড়ি।
চলবে…
#ডাক্তার_মিস – সিকুয়েল
#ভালবাসা_বাকি
আপনাদের কমেন্ট পড়তে বড় ভালবাসি। করবেন একটু কমেন্ট?