প্রবাসীর বউ পর্ব-৩

0
3816

#ধারাবাহিকগল্প
#প্রবাসীর বউ
পর্ব-তিন
মাহাবুবা বিথী

অবশেষে অনাদরে আর অবহেলায় রহিমা পুত্র সন্তান প্রসব করলো।শাশুড়ী সালেহা বেগম প্রচন্ড খুশী।বড় ছেলে আলালের ঘরে মেয়ে রিতা এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে।সালেহা বেগমের নাতির বড় শখ ছিলো।আল্লাহর কাছে শোকরিয়া,যে একটা নাতি হইছে।

রহিমার ছেলে হওয়াতে আলাল আর জরিনার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো।হেলালের টাকা দিয়ে আলাল নিজের নামে কিছু জমি কিনেছে।কিন্তু হেলালের নামেও বেশ কিছু জমি আছে।আর কিছু কেনা হয়েছে মা সালেহা বেগমের নামে।এখন যদি ছেলে একটু বড় হওয়ার পর রহিমা হেলালের ভাগের অংশ বুঝে চায় তাহলে বেশীর ভাগ জমি রহিমাকে দিয়ে দিতে হবে।

এদিকে রহিমার মা রহিমাকে আবার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।রহিমা বিয়েতে রাজি হয় না।রহিমা ওর শাশুড়ী আর আলালের কাছে ওর ভাগের অংশ বুঝে চায়।তখন ওর ভাসুর আলাল বলে,
—-তোমাকে এখন কোনো জমি বুঝিয়ে দেওয়া হবে না।ছেলে বড় হলে ওকে ওর আমানত বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
রহিমা ওর ভাসুরকে বলে,
—-আমি চলবো কিভাবে।আমার নিজের তো একটা খরচ আছে।
ওর ভাসুর বলে,
—-এখানে থাকলে সংসার থেকেই তোমার খরচ মিটানো হবে।তোমাকে জমি দেওয়ার পর তুমি যদি বিয়ে করে ফেলো তাহলে তো আমাদের লোকসান হবে।

রহিমার ছেলেকে সবাই আদর করে। কিন্তু রহিমার জীবন কাজের বুয়ার মতো সারাদিন সংসারের কাজ করে কাটাতে হয়।এর মাঝে রহিমার জীবনে এক ঘটনা ঘটে যায়।জরিনার ভাই রতন বোনের বাড়ি বেড়াতে আসে।ও স্থানীয় কলেজে ডিগ্রী পড়ে।রহিমাকে ও বোনের মতই সম্মান করে।সেদিন রহিমার ছেলেটার প্রচন্ড জ্বর আসে।সারা রাত রহিমা ছেলের মাথায় পানি দেয়।এ বাড়ির একটা মানুষ রহিমার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে না।ছেলেটা কেমন আছে কেউ খোঁজ নেয় না।ভোররাতে রতন ছেলেটার খোঁজ নেয়।এবং জ্বরের ওষুধ নিয়ে আসে।সে সময় আলাল ঘুমের থেকে উঠে দেখে রতন রহিমার ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।তখন আলালের মাথায় শয়তানী বুদ্ধি আঁটে।রহিমার চরিত্রের নষ্টা মেয়ের তকমা লাগিয়ে দেয়।
রহিমাকে ওর বাপের বাড়ি চলে যেতে বলে।তা না হলে গ্রামে শালিস ডেকে রহিমাকে জুতা পেটা করবে।
এদিকে লজ্জায় অপমানে রতন বোনের বাড়ি থেকে চলে যায়।জরিনা আলালকে বলে,
—-আপনি আমার নিরপরাধ ভাইটার গায়ে কলঙ্ক দিলেন কেন?
আলাল বলে,
—-বোকা মেয়ে ছেলে কোথাকার।বেডা মানুষের শরীরে কালিমা লাগে না।বেডা মানুষ হইতেছে হাসের লাহান।ময়লা পানিতে ডুইবা থাকবো।ডাঙ্গায় উইঠা ডানা ঝাপটা দিলে সব ময়লা পানি ঝইরা পড়বো।শোন জরিনা এই সুযোগে রহিমারে বাড়ি ছাড়া করুম।তোর আমার আমাগো মাইয়া রিতার ভবিষ্যত এখানে জড়িত।
এরপর রহিমার ভাইকে খবর দিয়ে আনা হয়।রহিমার আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ থাকলো না।
রহিমা আর ওর ছেলে বেলালকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়।
কুটবুদ্ধি সম্পন্ন আলাল হাঁফ ছেড়ে বেঁচে যায়।অল্প শ্রমেই পথের কাঁটা দূর হয়।এদিকে আলালের মা সালেহা বেগম বিবেকের কাছে দংশিত হতে থাকে।হেলালের ছেলেটার কথা ভেবে মনের ভিতরে কষ্ট হয়।কিন্তু আলালের ভয়ে মুখে কিছু বলতে পারে না।
আলালকে বিশ্বাস করতে পারে না তাই সালেহা বেগম ভাইয়ের কাছে চলে যায়।কারন হেলালের টাকা দিয়ে এই জমি গুলো কেনা হয়েছে।

জন্মের পর থেকেই একজন নারীর বঞ্চিত হওয়ার গল্প শুরু হয়।শৈশব থেকেই আপন ঘরে পর মানুষ হিসেবে বড় হয়।রহিমা এস এস সি পাশ করার পর আর ও পড়াশোনা করতে চেয়েছিলো।কিন্তু ওতো মেয়ে মানুষ।ওকে কষ্ট করে টাকা খরচ করে লেখাপড়া করিয়ে কোনো লাভ নাই।দুদিন পর বিয়ে হয়ে গেলে স্বামীর বাড়ি চলে যাব।বাবা মার কোনো লাভ হবে না।সুতরাং পরিবার থেকে সহযোগিতার অভাবে রহিমার পড়াশোনা হলো না।অথচ ওর ভাইটার পড়াশোনার জন্য ওর বাবা মা অনেক চেষ্টা করেছে।কিন্তু ভাইটা পড়াশোনা করলো না।এখন ছোটো খাট ব্যবসা করে তার দিন চলে।

রহিমা বিয়ের আগে স্বাবলম্বী হতে গার্মেন্টেসে চাকরি নেয়।সেখানেও নিরাপত্তার ঝুঁকি।তাই যখন ওদের বাড়িতে হেলালের পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে ওর মা ভাই আকাশের চাঁদ হাতে পায়।

কিন্তু আজ যখন রহিমা স্বামী হারিয়ে শ্বশুর বাড়িতে বঞ্চিত লাঞ্চিত হয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে আসে তখনও কটুক্তি সহ্য করতে হয়।জন্মদাতা পিতার ঘরকে নিজের ঘর বলে দাবি করতে পারে না।আজও পিতৃ পরিবারে কন্যা অভিশাপ।সদ্য বিয়ে হয়ে রহিমা যখন শ্বশুর বাড়িতে আসে তখনও ওর শাশুড়ী বলে
—-অনেক কষ্ট করে ছেলে মানুষ করেছি।সুতরাং ছেলের সব কিছুতেই আমার অধিকার বেশী।বরং তোমাকে বউ করে এনে তোমার পরিবার কন্যা দায় থেকে মুক্তি পেয়েছে।
রহিমা অবাক হয়।বাবার বাড়িতে ও সে পর স্বামীর বাড়িতেও কোনো অধিকার নেই।নারীদের দ্বারা নারীরাই বঞ্চিত হয়।
ফলে রহিমার মতো নারীরা নিরবে চোখের জল ফেলে আর স্বামীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।তাই রহিমা মা ভাইয়ের বিপক্ষে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চায়।ওর কাছে জমানো কিছু টাকা ছিলো।সেই টাকা দিয়ে একটা সেলাই মেশিন কিনে নেয়।মহিলা অধিদপ্তর থেকে সেলাইয়ের উপর ট্রেনিং নেয়।কিছুটাকা অনুদান হিসাবে পায়।ওই টাকা দিয়ে প্রথমে কাপড় কিনে ব্যবসা শুরু করে।

ছোটো বেলা থেকেই রহিমার স্বপ্ন ছিলো কিছু একটা করার।যদিও মা ভাই চাচ্ছে রহিমার বিয়ে দিতে।কিন্তু রহিমা আর ফিরে যেতে চায় না সেই বঞ্চনার জীবনে।রহিমা জানে,সংসার সমুদ্রের এই উত্তাল সাগর সাঁতরে পার হতে হবে।কোনো নৌকা তার জন্য অপেক্ষা করবে না।

রহিমা আস্তে আস্তে নিজেকে অনেক সাহসী করে তোলে।প্রথমে সে একাই ওর ব্যবসার সব কাজ করতো।কিছুদিন যাওয়ার পর ব্যবসাটা কিছুটা উন্নতি হলে আরও দুজন অসহায় মহিলাকে ও নিজেই ট্রেনিং দিয়ে ব্যবসার উপযোগী করে তোলে।

বাবার বাড়িতে রহিমার কদর বেড়ে যায়।ছেলেটাকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়।ওদিকে জালিয়াতি করে ওর ভাসুর যে সম্পদগুলো হাতিয়ে নেয় সেগুলো সে মদ খেয়ে জুয়া খেলে মেয়ে মানুষ নিয়ে ফুর্তি করে নষ্ট করে ফেলে।রহিমার ভাসুরের মেয়ে রিতার বিয়ে হয়।যৌতুকের কারণে ওকে শ্বশুর বাড়ি থেকে তালাক দিয়ে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।

রহিমার অবস্থা ভালো হওয়াতে মাঝে মাঝে ওর শ্বাশুড়ী ওর কাছে বেড়াতে আসে।ওনার কাছেই ওবাড়ির খবর গুলো রহিমা পায়।রহিমার শাশুড়ী ওর
কাছে মাফ চেয়ে নেয়।

এবার বেশ কিছুদিন পর রহিমার শ্বাশুড়ী ওর কাছে বেড়াতে আসে।রহিমা ওর শাশুড়ীকে বাড়ির সবার কথা জিজ্ঞাসা করে।ওর শাশুড়ী বলে,
—-আলাল স্টোক করছে।একটা পাশ অবস হইয়া গেছে।জমি জমা যা ছিলো সব ওর রোগের পিছনে খরচ হইয়া গেছে।বউ তুমি আমার আলালরে মাফ কইরা দিও।তোমার মতো সতী নারীর চরিত্রে ও কলঙ্ক দিছে।ওর তো শাস্তি হইবোই।
রহিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর শাশুড়ীকে বলে,
—-মা আমি হয়তো মাফ করে দিলাম।কিন্তু আল্লাহপাকের কাছে মাফ পাবে কিনা জানি না।

রহিমা ভাবে পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না।সেদিন রহিমার একটু আশ্রয়ের দরকার ছিলো।স্ত্রী হিসেবে
স্বামীর সম্পত্তির অধিকার নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চেয়েছিলো।সেটাই ওর জীবনের কাল হয়ে গেলো।ওর ভাসুর আর জা মিলে এক জঘন্য খেলা ওর সাথে খেললো।কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here