#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#পর্ব_৮
‘তুমি হাতটা শুধু ধরো, আমি হবো না আর কারো…..’
গুনগুন করে গান গাইছি। আজ হঠাৎ এতো আনন্দ কোত্থেকে ছলকে পরছে বুঝতে পারছি না। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। আমি বেলকনির গ্রিলের ফাঁকে হাত দিয়ে বৃষ্টির পানি জমাচ্ছি। নীরব ঘরে। সে কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমে বিভোর। শাশুড়ি মাও ঘুমোচ্ছে। মাত্রই এশার নামাজ শেষ করেছি নীরবের সাথে। হঠাৎ করেই তার সাথে আমার ভাব জমে উঠেছে। কেমন আগলে আগলে রাখে আমায়! আচ্ছা সে তো পহেলা নিশিতে আমায় জানিয়ে দিয়েছিলো আমি ভালোবাসা পাবো না। তাহলে এতো কেয়ারিং কেন আমার প্রতি? উমম, জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে। আজ গিয়েছিলাম শপিংয়ে। নীরব অনেক কিছু কিনে দিলো আমায়। প্রথমেই সে একটা বোরখা কিনলো। তারপর আমার কাছে জানতে চাইলো
— নিলীমা? তোমার কি শাড়ি পরে থাকতে কষ্ট হয়? কিছু থ্রি পিস নিবা?
তার প্রশ্নে আমি না সূচক মাথা দুলিয়েছি। কষ্ট হয় না আমার। একটু অস্বস্তি হয়। কিন্তু শাড়ি পরে সবার অগোচরে ঘূর্ণির মতো একাট চর্কি দেই। মনটা ভয়ানক ফুরফুরে হয়ে যায়। হৃদ নামক যন্ত্রণা যখন হৃদয়ে জেগে উঠে ঠিক তখনই এই কাজটা করি। গান গাইতে গাইতে উড়াল দিয়ে উঠি। ভাবনার মাঝে আরো একটা ভাবনা দোলা দিলো মন কাননে।নীরবের প্রেমিকা কে? ওর সম্পর্কে কিছু শোনা হয়নি আমার।
দৌড়ে ঘরে চলে এলাম। আজ ফড়িংয়ের মতো ফুরফুরে মনে লাফাচ্ছি শুধু। নীরব একহাত মাথার নিচে রেখে ঘুমোচ্ছে। চোখের ভ্রু কুঁচকানো। তার চমৎকার ঠোঁট দু’টোর দিকে নজর দিতেই আমি থমকে গেলাম। শান্ত হতে শান্ত হলো তনু। আনন্দ নুইয়ে পরতে পরতে জেগে উঠছে বুকের ধুকপুক। হঠাৎ মস্তিষ্ক একটা চিরচেনা শব্দ জ্বলজ্বল করে তুলে ধরলো। ‘স্বামী ‘। বিছানার ঘুমন্ত সুন্দর ঠোঁটের মালিকটা আমার স্বামী। নিরদ্বিধায় আপন করার চেষ্টা করে যাওয়া, আগলে আগলে রাখার আপ্রাণ প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া নীরব আমার স্বামী। তিন কবুলের বাঁন্ধন তার আমার। বুঝি আমি ভালোবাসা নেই আমার প্রতি তার তবুও এতো যত্নের কারণ। ঐ দগ্ধ হৃদয়ের জ্বালা দমিয়ে রাখার ছোট্ট একটা কল্পনা।
— কি দেখছো?
হঠাৎ নীরবের কন্ঠে চমকে উঠলাম। ভীষণ বিব্রতকর পরিস্থিতি। আমি দেখছি একটু তার মাঝে আবার তার ঘুম ভাঙতে হবে? তড়িঘড়ি করে তার মুখের উপর থেকে সরে এলাম। হাত পা কাঁপছে। ইশ!
— কিছু না। আসলে…. আসলে আমি আপনাকে ডাকতে এসেছিলাম।
হ্যা আমি তাকে ডাকার জন্যই এসেছিলাম। কিন্তু সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
— আচ্ছা কি বলবে বলো।
শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বলল নীরব। আমি অদূরে দাড়িয়ে কাচুমাচু মুখে বললাম
— বাইরে আসেন।
.
বেলকনিতে বসার কোনো ব্যাবস্থা নেই। আমি দাড়িয়ে আছি গ্রিল ধরে। দূর অন্ধকারে তাকিয়ে উপভোগ করছি বৃষ্টির ঝপ ঝপ ধ্বনি। এমন ক্ষণে নীরবের ঘুম ঘুম কন্ঠস্বর।
— কি হয়েছে বলো।
আমি গ্রিলের ফাঁকের হাতে জমা পানি নীরবের দিকে এগিয়ে দিলাম। ঝকঝকে একটা হাসি দিয়ে বললাম
— এটা কি বলুন তো?
নীরব বোধ হয় বেশ অবাগ হলো। সরু চোখে তাকিয়ে রইল মুহূর্তকাল। অতঃপর মনের ভাবনা মনে রেখেই বলল
— পানি
আমি আবার শুধালাম
— কেন জমিয়েছি বলুন তো!
— কোনো উদ্দেশ্যে। এমনি এমনি নিশ্চয়ই নয়।
নীরবের কথায় আমি ভুবন ভুলানো একটা হাসি দিলাম। হাতের পানি অবলীলায় ফেলে দিলাম মেঝেতে। তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম
— ইয়েস। আমার বৃষ্টির পানি হাতে জমাতে ভালো লাগে। ছোট বেলার অভ্যাস। আর এখন যে আপনাকে ঘুম থেকে তুলেছি তারও একটা উদ্দেশ্য আছে।
নীরব আমার কথার পিঠে ঢুলুঢুলু চোখে চাইলো। ইশ! বেচারা গত রাতে ডিউটিতে ছিল। তাই তো সে আমার মতো ঘুমে যেখানে সেখানে কাত হতে চাইছে।
— কি জন্য ডেকে তুললে? বলো। আমার ঘুম পাচ্ছে।
— আপনি আমাকে বাসর রাতে জেরিন আপুর কথা বলেছিলেন মানে আপনার এক্স।
নীরবের তেমন ভাবান্তর হলো না আমার কথায়। সে নির্বিঘ্নে বলল
— তার সম্পর্কে তুমি এখন সব জানতে চাইছো?
আমি চুপটি করে মাথা উপর নিচ করলাম। নীরব হাসলো। সুন্দর ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে বলল
— তোমার অধিকার। বউ বলে কথা।
বাণীটা শুনিয়ে সে চলে গেলো ঘরের ভেতরে। একটু পর হাতে একটা ডায়েরি নিয়ে আমার নিকট আসলো। ডায়েরিটা আমার হাতে হস্তান্তর করতে করতে বলল
— এটা পড়লে বুঝতে পারবে।
কথাটা বলে ঘুরে দাড়িয়ে আবার মুখ ফেরালো আমার পানে। এবার অত্যন্ত আদর্শ স্বামীর ন্যায় আচরণ করে বলল
— আচ্ছা নিলীমা তুমি কি লেখাপড়া বিসর্জন দিলে? এইচএসসি ক্যান্ডিডেট তুমি। অথচ একবারও তোমাকে পড়তে বসতে দেখলাম না।
আমি নীরবের কথার পিঠে বেহায়ার মতো একটা হাসি দিয়ে বললাম
— বই তো বাসায়।
সে যেন আমার কথায় পিঠে প্রচন্ড রাগে বাঁকহারা হলো। যেন আমি খুব বেকুব একটা কথা বলেছি। কিছু না বলে হনহন করে চলে গেলো। আমার ঠোঁটও কিছু না বুঝে উল্টে উঠলো। স্ক্রু ঢিলা ডাক্তার!
.
নতুন দিন শুরু হলো। সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যাস্ত হয়ে পরবে। শুধু বাসায় আমি আর আমার প্রাক্তন পরে থাকি। আমি নিজ রুমের দরজা লক করে বিভোর হয়ে ঘুমোই। আর হৃদ কখনো বাইরে যায় তো কখনো দেখি নিজের রুমে। নীরব একটু আগেই চলে গেছে। শাশুড়ি মাও গেছে স্কুলে। আমি বেলকনিতে চেয়ারে বসে সম্মুখের বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। কঠোর সত্যি হলো বিয়ের পর পড়ালেখার উপর থেকে মন উঠে যায়! সকলের চোখের প্রচন্ড ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট নিলীমা আজ নীরবের ঘরে আসার পর থেকে অলস হয়ে গেছে পড়াশোনায়। শুধু ঘুম আসে!
চোখের সাটার আর খোলা রাখা সম্ভব হলো না আমার। টুপ করে বন্ধ করে দিলাম। হয়তো তলিয়ে যাচ্ছিলাম ঘুমের রাজ্যে ঠিক তখনই অনুভব দৌড়ে এসে জানান দিলো কয়েলের গন্ধ আমাকে ঘিরে। বেশ অবাক হলাম। হুট করে কৌতুক নিয়ে চোখ খুলতেই দেখি সত্যি! মৃদু ধোয়া চারপাশে। হঠাৎ আমার মনে হলো আমার পেছনে কেউ দাড়িয়ে আছে। আমি ক্ষিপ্রতায় ঘায় ঘুরিয়ে ফেললাম। আগন্তুককে দেখে প্রথমে থমকালেও পরে ঠোঁটে ফুটে উঠলো জয় জয় হাসি। হৃদ অপ্রস্তুত হাসলো। আমি তার আগা গোড়া পরখ করে নিয়ে একটা হাই তুললাম। অতঃপর অতি সাধারণ ভাবে তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললাম
— থ্যাংস্ক ভাইয়া।
ভাইয়া কথায় হৃদের মুখ চুপসে গেলো। বুকের উপর ভাজ করে রাখা হাত দুটো সে ছেড়ে দিলো। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। এই তো সে জ্বলছে।
— l miss you deeply sweetheart.
হঠাৎ করে কানে ফিসফিস করে বলে দিলো হৃদ। আমার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। কাঠ হয়ে গেলাম যেন আমি। কিন্তু আচমকা মন বলে উঠলো, ‘নিলীমা টিট ফর ট্যাট গেম খেলতে এসেছে। জ্বালাতে এসেছে হৃদকে। জ্বলতে নয়।’ মন এ কথা বলার সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে চাইলাম পেছনে। তার কানেও বলে দিলাম
— l hate you deeply toxicheart.
.
— নিলীমা, তোমার কি ফুল পছন্দ?
নীরবের হঠাৎ প্রশ্নে আমি এক ঝাঁক অবাকতা নিয়ে তাকালাম তার দিকে। সেকেন্ড যাচ্ছে, মিনিট গেলো কিন্তু আমার অবাকতা কাটলো না। হঠাৎ এমন প্রশ্নের মানে কি?
নীরব উত্তরের আশায় আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার ধৈর্য যখন শেষ হয়ে গেলো তখন সে তিব্র বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেলল। বলল
— কি সমস্যা তোমার? আমি কিছু বললেই তুমি অবুঝের মতো শুধু তাকিয়ে থাকো। মুখ বন্ধ করো? হা করে আছে।
আমি ঝটপট মুখ বন্ধ করে নিলাম। সে বিরক্তিতে অন্য দিকে ঘুরে আছে। দু’জনেই বিছানায় বসে আছি। আমি বই নিয়ে আর সে ল্যাপটপ নিয়ে। হঠাৎ আমি সেদিনের মতো আরো একটা বেখাপ্পা নির্লজ্জ প্রশ্ন করে বসলাম। বোকা বোকা চাহনিতে বললাম
— আচ্ছা আপনার ঠোঁট যে এতো সুন্দর । জেরিন আপু তো আপনার কন্ঠ দেখে প্রেমে পরেছিল। ঠোঁট দেখে কেন পরলো না?
কথাটা বুঝি আমার মুখ দিয়ে বের হতে দেরি হলো কিন্তু নীরবের রক্তচক্ষুতে তাকাতে দেরি হলো না। আমি সেই ভয়ংকর চাহনির কবলে নিজের নির্বুদ্ধিতার অস্তিত্ব আবারও বুঝলাম। সে তাকিয়েই আছে। আমার ইচ্ছে হলো টুপ করে খাটের নিচে চলে যেতে। ওহ এটা তো বক্স খাট যাওয়া যাবে না। বেকুব ভাবনা রেখে নীরবের মুখ খোলার আগেই দৌড় দিলাম বারান্দায়। উফ! আমি এমন ভয়াবহ কবে থেকে হলাম? শুধু উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করি।
চলবে……..
( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন)