#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ১৪
‘ উমমম, মিসেস আহির এভাবে আমার ওপর ঝুঁকে থাকাটা তো স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছি না। ওয়ানা কিস মি বেবিগার্ল?’
কিয়ৎক্ষণ নির্বাক হয়ে রইলাম আমি। যেন নড়াচড়া করতে পুরোপুরি ভুলে গিয়েছি। আনভীরের চোখে এখনও সন্দেহের ছাপ, ঠোঁটে বিদ্যমান রহস্যময় একটি হাসি। উনার কথাগুলো পুনরায় স্মৃতিচারন হতেই আমার চোখ-মুখ লাল রঙে আবির্ভূত হলো। কে বলবে এই মানুষটা গতকাল মাথা ব্যথায় ছটফট করে আমার কোলে মাথা রেখে নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে ছিলো? উনি এবার বলে ওঠলেন,
‘ আরও কিছুক্ষণ এভাবে থাকবে?’
সাথে সাথেই উনার ওপর থেকে সরে খাটে বসলাম আমি৷ এলোমেলো চুলগুলো অপ্রস্তুতভাবে কাটা দিয়ে আটকে নিলাম। আমার চারপাশে তুমুলভাবে বিরাজ করছে অস্বস্তিকর পরিবেশ। কানের কাছে জলতরঙ্গের মতো উনার একেবারে মাত্রাহীন কথাটি বেজে চলছে৷ আমি আমার দিকে কাত হয়ে তাকালেন এবার৷ বলে উঠলেন,
‘ আমি ঘুমিয়ে থাকলে সবসময়ই কি এমন করো?’
উনার চোখেমুখে সন্দেহের আভাস দেখে আমি বিষম খেলাম। মিনমিনিয়ে প্রতিউত্তর দিলাম,
‘ মোটেও না। আমি, আমি শুধু আপনার তাপমাত্রা চেক করছিলাম।’
উনি কিছু বললেন না এতে। বরাবরের মতোই একধরনের মিহি চাউনি নিক্ষেপ করলেন আমাতে। অতঃপর মুখ হাত ধোয়ার জন্য উঠতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম,
‘ এত জলদি উঠছেন কেন আপনি?’
‘ কেন আমার সাথে আরও কিছুক্ষণ টাইম স্পেন্ড করতে চাও?’
উনার কাট কাট কন্ঠে আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না। বললাম,
‘ গতকাল তো আপনার কন্ডিশন খুব একটা ভালো ছিলো না, আজকে নাহয় বাসায় রেস্ট নিন? ‘
উনি এবার তাকালেন আমার দিকে। মৃদু ঠোঁট কাঁপিয়ে বললেন,
‘ এমন কিছু হয়নি যে রেস্ট নিতে হবে। আই এম টোটালি ফ্রি এন্ড ফাইন!’
বলেই উনি কাবার্ড থেকে ড্রেস নিয়ে ফ্রেস হতে চলে গেলেন। আমি এবার নিচে চলে গেলাম নুড়ী আপাকে বলতে উনার জন্য ব্রেকফাস্ট বানানোর জন্য।
__________
নুড়ী আপাকে কিচেনে ব্রেকফাস্ট বানানোর কথা বলে গার্ডেনে গেলাম আমি। দেখি নাহিদ ভাইয়া সবেমাত্র জগিং সেরে কাউচে বসে পড়লো আরামসে। আমি উনার কাছে গিয়ে মিহি কন্ঠে বললাম,
‘ গুড মর্নিং!’
‘ গুড মর্নিং ভাবি!’
‘ভাবি’ ডাকটি শুনে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে থাকতে হলো আমায়৷ নাহিদ ভাইয়ার কোনো ভাবান্তর, নেই। উনি বসে পায়ের স্পোর্টস সু খুলতে মগ্ন হয়ে পড়েছেন৷ আমি চোখজোড়া বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ আপনি আমায় ভাবি বললেন কেনো?’
‘ এআরকে’র ওয়াইফ হলে সম্পর্কে তো আপনি আমার ভাবিই হোন!’
আমি দুষ্ট হাসি দিলাম এবার। ঠোঁট কামড়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ আনভীরের গতকালকের ঝাড়িতে ভয় পেয়ে গেলেন মিঃ নাহিদ রেজওয়ান? দিস ইজ নট ফেয়ার!’
আমার কথা শুনে নাহিদ ভাইয়া দাঁতে দাঁত চেপে তাকালেন আমার দিকে। পারছেন না শুধু আনভীরের ভয়ে আমায় উল্টাপাল্টা কিছু কথা শুনিয়ে দিতে। আমিও সুযোগটার সৎ ব্যবহার করলাম তাই। বললাম,
‘ আর কতদিন উনার ভয়ে আমারে ভাবি ডাকবেন! এবার আনভীরের জন্যও একটা ভাবি নিয়ে আসেন?’
‘ সময় হলে ভাবি আনবো ইনশাআল্লাহ, আপনার তা ভাবতে হবে না। এখন কৃপা করিয়া আপনার বরের কাছে যাবেন বেগম? অন্যথায় আপনার বরসাহেব যদি তার বেগমকে আমার মতো অবলা বান্দাকে গল্প করতে দেখে তাইলে আজ আমার কানের নিচে ঠাসিয়ে কয়েকটা মারবে।’
‘ যাবো, তবে একটা শর্তে!’
উনি পুনরায় তাকালেন আমার দিকে। জিজ্ঞেস করলেন,
‘ কি শর্ত?’
‘ ওই ডায়নীটা, আই মিন উনার বর্তমানে যেই সেক্রেটারি আছে সেটার জায়গায় আপনি আবার ফিরে যান। এতদিন তো আপনিই ছিলেন, এখন ওই উড়ে এসে জুড়ে বসা মেয়েটাকে কিছুতেই আপনার জায়গা আমি নিতে দিবো না, বুঝেছেন?’
নাহিদ ভাইয়া খুব ভালোমতোই জানেন যে কেনো আমি উনাকে ফিরে যেতে বলেছি। বলা বাহুল্য একটু আগে আমি যা যা বললাম সেগুলো সব বাহানা মাত্র। নাহিদ ভাইয়া তপ্তশ্বাস ছাড়লেন। বলে ওঠলেন,
‘ উনি যেহেতু এখন বলেছে আমাকে আপনার দেখাশোনা করতে হবে আমি তাই এক পাও উনার কথার হেলফেল করতে পারবো না৷ ওই কথা ভুলে যান, যতদিন এআরকে আমায় না বলছে ততদিন আমি যাচ্ছি না।’
রাগে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলাম আমি। ভদ্রতার খাতিরে শুধু পারছি না এই ছেলেটাকে পানিতে ছুঁড়ে মারতে। আমি ঝুকে এলাম উনার দিকে। দৃষ্টি প্রগাঢ় করে বললাম,
‘ তাহলে শুনুন, আপনি যদি আমার কথা না শুনেন আমি খুন করে ফেলবো আপনার৷ ওই ডাইনীটা সারাক্ষণ আনভীরের পাশে ঘুরঘুর করবে এটা দু-চোখে সহ্য করতে পারবো না আমি। আমার কথা আপনাকে তাই শুনতে হবে বুঝেছেন? একটা কথা অমান্য করবেন, ডিরেক্ট আনভীর মহাশয়ের কাছে বিচার। আর উনি যে আপানর সাথে কি করতে পারেন সেটা তো আপনারই ভালো জানা আছে।’
বলেই আমি একটা শয়তানী হাসি দিলাম। বেচারা নাহিদ ভাইয়া একেবারেই চুপসে গিয়েছে। উনি হয়তে ভাবতেও পারেননি আমি উনাকে এত অসহায় বানিয়ে ফেলবো। তাই দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠলেন,
‘ আপনারা দুই মিস্টার মিসেস আমারে পাগল বানিয়ে ফেলছেন আস্তে আস্তে৷ উফফ!’
___________
আনভীর ব্লু জিন্স আর গ্রে শার্ট পড়েছেন আজ। শার্টের কলারে ঝুলছে একটি কালো রঙের চশমা। উনার একজন পার্সোনাল গার্ড যে সবসময়ই উনার আশপাশে ঘুরঘুর করে সে আপাদত দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। আনভীর ব্যাক্তিগতভাবে এসব গার্ড নিয়ে ঘোরাফিরা করতে অস্বস্তিবোধ করেন। তবে এই কাজটি করেছেন উনার বাবা। লন্ডন থেকে বাংলাদেশে আসার পরপর আজ পর্যন্ত গার্ড ছাড়া বাইরে বের হতে পারেননি আনভীর। আমি জানিনা এর কারন কি। তবে উনি যেহেতু এত বড় একজন সিঙ্গার, তাই গার্ড নিয়ে ঘোরাফেরা করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
আজকে নাহিদ ভাইয়ার মনটাও ফুরফুরে, অনেকদিন পর এআরকে’র সাথে ‘স্টার হিট’ এ যাচ্ছেন উনি। যদিও সেটা শুধু সাময়িক সময়ের জন্য। কেননা আনভীর স্পষ্টভাষায় বলে দিয়েছেন যে নাহিদ যদি কোনোভাবে আমার ওপর দেখভালের দায়িত্ব থেকে চোখ সরিয়ে নেয় তবে উনার কপালে শনি আছে। এতেই নাহিদ ভাইয়া চুপ।
আমি ডাইনিং টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করছিলাম ওমন সময়ে আনভীরকে আমার সামনে বসতে দেখে অবাক হলাম আমি। আনভীর গলা উঁচিয়ে নুড়ী আপাকে বললেন,
‘ আজকে খাবার এখানে খাবো আপা। আমায় এখানে দাও।’
আমার বিস্ময়ের অবকাশ রইলো না। কেননা এ পর্যন্ত কখনোই আমার সাথে খাবার খাননি আনভীর। হয়তো উনার রুমে খেয়েছেন বা ওই রুমটাতে যেখানে সবার যাওয়া মানা। আমায় তাকিয়ে থাকতে দেখে আনভীর বলে ওঠলেন,
‘ আপাদত ব্রেকফাস্ট খাও মিসেস আহি। আমায় খাওয়ার জন্য যথেষ্ট টাইম আছে।’
একথাটি শুনে আমি ভীমড়ি খেলাম। খাওয়া রীতিমতো গলায় আটকে গিয়েছে। ক্রুদ্ধ গলায় বললাম,
‘ নিজেকে প্রিসিয়াস কিং ভাববেন না এআরকে। আমি শুধু দেখছিলাম যে…’
‘ আমি হ্যান্ডসাম, তাইতো?’
ইচ্ছে হলো এই লোকটার মাথায় প্লেটের সব খাবার ঢেলে দেই। আমায় কথার মাঝে উনি এমন সব কথা বলেন যে স্তব্ধ না হয়ে আমি যেন পারিনা।তাই বললাম,
‘ আপনার ধারনা ভুল মিস্টার। আপনি আজ এখানে ব্রেকফাস্ট করছেন যে? এমনিতে তো ভুতের মতো রুমে খাবার খান। আজ এখানে এলেন যে!’
উনি আহাজারি কন্ঠে বললাম,
‘ আগে সিঙ্গেল লাইফ লিড করতাম তো! একা একা টেবিলে খেতে কষ্ট হতো। এখন ভাবছি বউ আছে, তাই কষ্ট করে আলাদা খাবো কেনো?’
আমার কথা শুনে মিটমিটিয়ে হাসলেন নাহিদ ভাইয়া৷ পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা এক্সপ্রেশনলেস গার্ডের ঠোঁটকোলেও যখন আমি রম্য হাসি দেখলাম আমার গা রি রি করে উঠলে অস্বস্তিতে। এই লোকটা আস্ত অসভ্য। কখন, কিভাবে, কি ধরনের কথা বলা উচিত পরোয়ার লেশমাত্র নেই। নুড়ী আপা প্লেট আনতেই আনভীর আর কথা বললেন না৷ খাওয়ার শেষে আনভীর নুড়ী আপাকে বললেন,
‘ আজকে বাসায় এসে আপনাকে একটা ডায়েট চার্ট দিবো। নেক্সট টাইম থেকে ওই অনুযায়ী খাবার রেডি করবেন। আমার নেক্সট কাজের জন্য ওয়েট একটু কমাতে বলেছে ইন্ডাস্ট্রি থেকে।’
আমি শুধু চুপচাপ শুনলাম। আনভীর এবার আমার দিকে তাকিয়ে ডাক দিলেন,
‘আহি!’
‘ জ্বি? ‘
‘ আজকে হসপিটালের যেতে হবে না তোমায়?’
অবাক হলাম আমি। বুঝে উঠলাম না হঠাৎ যেতে না বললেন কেন। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই উনি বললেন,
‘ আপাদত প্রশ্ন করবে না কেনো? আমি যেহেতু না করেছি, না মানে না। নাহিদ হসপিটালে জানিয়ে দেবে আজকে।’
আমায় কথা বলতে না দিয়ে উনি উঠে দাঁড়ালেন। আমার চোখে একটি নির্বাক দৃষ্টি স্থাপন করে চলে গেলেন নাহিদ ভাইয়ার সাথে। আমি চুপ হয়ে রইলাম। সমীকরণ মিলাতে কষ্ট হচ্ছে উনার হঠাৎ না করার কারন কি।
_________________
তপ্ত রৌদ্দুরের আলোয় খা খা করছে চারিপাশ। যেদিকেই তাকানো যায় সেদিকে শুধু দেখা যাবে ব্যস্ত মানুষ। অপূর্ব ঘড়ি দেখছে আর অপেক্ষা করছে কাঙ্ক্ষিত মানুষটার। যদিও সময় হয়নি এখনও। তবুও কৌতুহল ওকে এতটাই বশভূত করেছে যে ও সময়ের আগে না এসে পারেনি।
অপূর্ব একাই এসেছে আজ। অন্যসময় হলে চার পাঁচ সাঙ্গপাঙ্গ সবসময়ই থাকতো অপূর্বের সাথে। কিন্ত এবার আনতে পারেনি। কারন যার সাথে দেখা করতে এসেছে তার সাফ নিষেধ। যদিও অপূর্ব কখনোই কারও কথা শুনে না। কিন্ত এবার শুনলো। অনেকটা বাধ্য হয়েই শুনলো। এই লোক যমদেবতার মতো ওর পিছে পড়ে আছে আর তাকে যতটা সাধারন অপূর্ব ভেবেছিলো অতটাও সাধারন সে না।
অপূর্ব এসব ভাবতে ভাবতে আবারও ঘড়ির কাটায় তাকিয়ে দেখলো চারটা বেজে গিয়েছে। এরই মধ্যে রেস্টুরেন্টের দরজা খুলে প্রবেশ করলো একজন। একেতো ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা তার ওপর লাঞ্চ টাইম শেষ হওয়ার কারনে মানুষ কেউ নেই৷ আর তাই এ মানুষটাকে দেখে বুঝতে বাকি রইলো না যে কে হতে পারে। কেননা আসার আগে তার সম্পর্কে পুরো ঘাটাঘাটি করে এসেছে ও।
আগন্তুকটা এসে ঠিক বসে পড়লো অপূর্বের বরাবর৷ প্রলুব্ধকর চাউনি, যা সহজেই কাউকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম। সে মাক্স খুলতে খুলতে বললো,
‘ দেরি হয়ে গেলো নাকি মি.অপূর্ব?’
‘ না।’
আগন্তুকটা সামান্য হাসলো। বলে উঠলো,
‘ আপনি আমার জন্য এতক্ষণ ওয়েট করবেন ভাবতে পারিনি। প্রথমেই সরি লেট করে রিপ্লাই করার জন্য। আসলে ইন্ডাস্ট্রিতে কিছু কাজ ছিলো আমার৷ সেগুলো ম্যানেজ করা কতটাই হার্ড, বুঝতেই পারছেন।’
অপূর্ব মিহি হাসলো। এবার সিরিয়াস হলো আগন্তুকটা। হাতের আঙুল নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ তো বলুন! রকস্টার এআরকে’র কাছে আপানর কি দরকার মি.অপূর্ব হাসান?’
.
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ
ভুলক্রটি মার্জনীয়।