#সম্পর্কের_মারপ্যাঁচ
পর্ব-১০(শেষ)
#tani_tass_ritt
রিয়া দেখলো রুদ্র ফ্লোরে পরে আছে। মাথার কাছে রক্ত।
রিয়ার চিৎকার শুনে বাসার সবাই রুদ্রের রুমে এসে পরলো।রুদ্রকে কোনোরকম বিছানায় শুইয়ে রিয়া ডাক্তারকে ফোন দিলো।রুবি বেগম তো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন।প্রভাতি স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে।
ডাক্তার এসে রুদ্রের ট্রিটমেন্ট করলো।
“উনি খুব স্ট্রেসে আছেন।আর উনার বিপি হাই হয়ে গিয়েছিলো।খাবার দাবার ও তো ঠিক মতো হচ্ছে না মনে হচ্ছে।আবার ঘুমও কম হচ্ছে।উনার শরীর অনেক বেশি দুর্বল হয়ে গিয়েছে।তাই মাথা ঘুরে পরে গেছেন এবং তখনি কোথাও বারি খেয়েছেন।উনি কোনো কিছু নিয়ে খুব চিন্তিত। উনার খেয়াল রাখবেন। বেশি স্ট্রেস দিবেন না।”
ডাক্তার যাওয়ার পর রুদ্রের আস্তে আস্তে জ্ঞান ফিরলো।
“এখন ভাইয়াকে একা থাকতে দাও।সবাই চলে যাও।ভাইয়ার রেস্ট দরকার।সবাই রিয়ার কথা মেনে চলে গেলো।রিয়া রুদ্রের পাশে বসে আছে।”
সবাই যাওয়ার পর রিয়া দরজাটা আটকে দিলো।
“কেমন আছিস ভাইয়া? ”
রুদ্র মলিন একটা হাসি দিলো।
“মাথায় ব্যথা করছে?”
রুদ্র তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে,
“মনের ব্যাথাটাই কেউ দেখলো না আবার মাথার ব্যাথা।”
“তুই এমন কেন করছিস? শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস।”
“শুধু শুধু না রে কপালটাই আমার এমন।”
“কপালের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমি সব জেনে গিয়েছি মায়ের কাছ থেকে।তোর মনে হচ্ছে না তুই খালামনির কথা শুনে ভুল করছিস?”
“মায়ের কথা না শুনে উপায় কি।আর প্রভাতি ঐ মেয়েটা কোনোদিন মায়ের আদর পেয়েছে? পায়নি।আর আমার মা ওকে কোনোদিন মেনে নিবে না।সালমা আন্টি খুব ভালো রে জানিস।আর তৌকিরও তো খুব ভালো।ও সুখে থাকবে।আর ওর বয়স ও কম। ঠিক মানিয়ে নিবে।”
“তুই তোর মনের কথা ওকে কোনোদিন বলবিনা?”
“না”
রিয়ার কষ্টে কান্না আসছে।সে কিছু না বলেই সেখান থেকে উঠে যেতে নেয়।
“জানিস কাল রাতে মায়াপরী আমাকে তার মনের কথা বলেছে।সে আমার কাছে কাল তার ভালোবাসার দাবি নিয়ে এসেছিলো।জানিস পিচ্চিটা এটাও বুঝে না সে আমাকে ভালোবাসে।”
এটা শুনে রিয়া থমকে গেলো।
“তুই ওকে…..”
“ঠিক ধরেছিস। আমি ওকে ফিরিয়ে দিয়েছি।ওকে গ্রহণ করার ক্ষমতা যে আমার নাই।বাচ্চাটা বড্ড কষ্ট পেয়েছে।”
রিয়ার এবার রাগে গা কাঁপছে।মনে হচ্ছে সবকটাকে মেরে তক্তা বানাতে পারলে তার ভালো লাগতো।ঢং শুরু করেছে এক এক জন।
রিয়া উঠে সেখান থেকে যেই দরজা অব্দি এলো
“রিয়া শুন”
রিয়া পিছে ফিরে তাকালো।
এক তরফা ভালোবাসায় নিজেকে বুঝ দেয়া যায় যে অপর মানুষটা আমাকে ভালোবাসে না।কিন্তু যখন অপর মানুষটাও আপনেকে ভালোবাসে কিন্তু ভাগ্যের কারণে আপনের থাকে হারাতে হচ্ছে এমনকি আপনি তাকে নিজের মনের কথাও বলতে পারেননি তখন নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার উপায় জানিস? আমার খুব দরকার রে।
রুদ্রের কথা শুনে রিয়া কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে গেলো।
প্রভাতি জানার কাছে দাড়িয়ে ভাবছে,
তার উপস্থিতি রুদ্রকে এতোটা কষ্ট দেয়।সে যত তাড়াতড়ি সম্ভব এই বাসা থেকে চলে যাবে।
রুদ্রের সুস্থ হতে হতে বিয়ের দিন এসে পরলো।কিন্তু রুবি বেগম রিয়াকে নিয়ে বেশ চিন্তায় আছে।তার মতিগতি একদম ভালো লাগছেনা।তার মনে হচ্ছে রিয়া কোনো একটা ঝামেলা পাকাবে।তাই যথাসম্ভব সে রিয়াকে চোখে চোখে রাখছে।
বিয়ের এক দিন আগে রুদ্রের বাবা শরিফ সাহেব এসে পরলেন।তাকে দেখে রুবি বেগম যে তেমন একটা খুশি হলেন না তাকে দেখে। তিনি রুদ্রের রুমে গেলেন।
“কেমন আছিস বাবা?”
রুদ্রের আজ তার বাবাকে দেখে রাগ লাগছে। সে তার বাবার সাথে একটা কথাও বললো না।শরিফ সাহেব কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলেন।
তিনি রুমে এসে,
“প্রভাতির বিয়ে আর তুমি আমাকে আজ কাল জানিয়েছো? ব্যাপারটা একটু বেশি বেশি হলো না?”
“তুমি আমাকে প্রমিজ করেছিলে প্রভাতির দায়িত্ব আমার।আর আমি যা বলবো তাই হবে।”
শরিফ সাহেব তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন।তার আজ খুব অপরাধ বোধ হচ্ছে। তার পরিবারের আর তার জন্যই রুবি বেগম এমন কঠিন হয়ে গিয়েছেন।
“তুমি রুদ্রকে সব বলে দিয়েছো তাইনা? রুদ্র যে প্রভাতিকে পছন্দ করতো এটা তুমি জানতে না? ওকে আটকাতে সবটা বলে দিয়েছো?দেখো আবার নিজের জীবনের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ো না।”
শরিফ সাহেবের কথা শুনে রুবি বেগম স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আজ বিকেলে প্রভাতির বিয়ে ।দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলেই কাজীসাহেব প্রভাতি-তৌকিরের বিয়ে পড়িয়ে দিবেন ।এ কথাগুলো ভাবতেই রুদ্রর চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে লাগলো ।জীবনের সমস্ত কষ্ট যেন আজ জড়ো হয়ে রুদ্রর বুকে ভেতর গেথে যাচ্ছে ।
হঠাৎ রুদ্রর মা একটা কাজে রুদদ্রের রুমে এলেন।
রুদ্র চুপ করে খাটে বসে আছে।রুবি বেগম তার ছেলের কাছে যেতেই সে উঠে দাড়িয়ে তার মায়ের সামনে গিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“মা, ভালোবাসার থেকে কি জিদটাই বড়? আর মা দেখো তোমার আমার সাথে কতো মিল, তোমার ছোটবেলাও নিদারুন কষ্টের মাঝে কেটেছে, আর আমার জীবনটাও দেখো, কষ্টের বোঝা দিন দিন বেড়েই চলছে ।আমি আর সইতে পারছি না, মা ।” বলেই রুদ্র তার মাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেদে দিলেন ।
রুবি বেগমের বুকে কেমন ধক করে উঠলো।সে কোনো অন্যায় করছে না তো।রুদ্রের দঃখের বিপরীতে তার ছেলে আর প্রভাতির সুখময় জীবন ভেসে উঠলো।পরোক্ষনেই তার মনে পরে গেলো তার সাথে ঘটে যাওয়া সেই নির্মম দিনের কথা।প্রভাতি যদি তার ছেলেকে তার থেকে কেড়ে নেয়।আবার তার মনে হচ্ছে সে তার ছেলেকে জীবনের সব থেকে বড় কষ্ট দিচ্ছেন না তো।সে এক ধরনের দোটানায় পরে গেলো।তার সব কিছু উলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে।
রুদ্রর কথার কোন উওর না দিয়েই রুবি বেগম ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন ।চোখমুখ মুছে রুদ্রও ঘর থেকে বের হলো ।দুঃখের বোঝার ওপর আজ তার কাজের বোঝাও আছে। প্রভাতি-তৌকিরের বিয়ের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব ।নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে অন্যের বিয়ের আয়োজনের এমন গুরুদায়িত্ব পাবে,এমন কল্পনা তার মাথায় কোনকালেই আসেনি ।কিন্তু এই অকল্পনীয় কাজই আজ তার করতে হচ্ছে। ভেবেই বুকের ভিতর চিন চিন ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো।
হঠাৎ প্রভাতির ঘরের দিকে রুদ্রর চোখ পড়লো ।কিছুটা এগিয়ে রুদ্র দেখলো, লাল বেনারশি আর পায়ে লাল আলতা দিয়ে প্রভাতি আজ বিয়ের সাজ সেজেছে।দুনিয়ার অনেক মানুষকেই এমন না সাজার সাজে সাজতে হয়,দুঃখভরা মন নিয়ে ভালো থাকার অভিনয় করতে হয়; পরিবার কিংবা সমাজের আনন্দের জন্য নিজের ইচ্ছা-আনন্দকে বিসর্জন দিতে হয় ।
এদিকে দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেল ।বর যাত্রি এসে পরলো।ঘরোয়া ভাবে বিয়ে হওয়ার খুব বেশি মানুষ আসেনি।তৌকিরের মা বাবা আর তৌকিরের দুজন বন্ধু এসেছে।তৌকির এসেই সোফায় বসে দাঁত কেলাচ্ছে তৌকির কে দেখে রিয়া এসে তার পাশে বসলো।দুজনের মধ্যে কি যেনো কথা চলছে।আস্তে আস্তে বলছে বিধায় কেউ কিছু বুঝতে পারছে না।রুবি বেগমের মনে খটকা লাগছে এখন।
তৌকিরকে দেখে রুদ্রর মনে হলো,
“আহ বেটা শাহানশাহ বসে রয়েছে ।”
আর নিজেকে কেমন যেন চোর চোর মনে হচ্ছে তার ।কিছু চুরি করার পর চোর যেমন এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে, পালানোর পথ খুঁজতে থাকে; রুদ্র আজ জীবন থেকে পালানোর পথ খুঁজছে ।
কিন্তু সুখ-দুঃখের ফ্রেমবন্দি জীবন থেকে কেউ কোনদিন পালাতে পারেনি, রুদ্রপালাবে কোথায় ।আর এভাবেই অসহায় মানুষের চিরকাল অসহায় থাকতে হয় । আর এই অসহায়ত্ব নিয়েই রুদ্র বরপক্ষের মেহমানদারি করেই চলছে ।তাদের খাবার সার্ভ করা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই রুদ্রর করতে হচ্ছে
।আর কিছুক্ষণ পরই কাজীসাহেব আসবেন তৌকির প্রভাতির বিয়ে পড়ানোর জন্য ।রুদ্র কষ্টে পাগলের মতো নিজের সাথে নিজেই আস্তে আস্তে প্যানপ্যান করতে লাগলো ।ভেতরকার অসহায়ত্ব ও কাপুরুষত্বের প্যানপ্যানানি নিজের কাছেই অসহ্যের মতো লাগছে তার।রুদ্র আর কিছুতেই বাড়িতে টিকতে পারছে না ।
মনের দুঃখ তার বেড়েই চলছে ।নিজের বাড়িতে বেড়ে ওঠা,খুব কাছ থেকে স্নেহ দিয়ে গড়া, সেই ছোটবেলা থেকে আগলে রাখা তার প্রাণপ্রিয় ছোট্ট মায়াপরি কিছুক্ষণ পর রুদ্ধশ্বাসে চাপা কষ্টের অজস্র অশ্রুমালা ভেদ করে কবুল বলবে; সেই মুহুর্তটা কল্পনা করতেই রুদ্রর ভেতরটা চিৎকার দিয়ে উঠলো ।রুদ্র এখন কি করবে কিছুই বুঝতেছেনা ।সে আকাশের দিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস নিলেন,বোধহয় সেই দীর্ঘশ্বাসের মাধ্যমে নিজের মনের সমস্ত আকুতিগুলো বিশাল আকাশের মালিকের কাছে জমা করে দিলো ।দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া ভেতরের আর্তনাদকে সামাল দিতে না পেরে সকলের অগোচরে রিক্তহস্ত পথিকের বেশে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে এক দৌড়ে রুদ্র বের হয়ে গেল ।বাড়ির পেছনের রাস্তাটা রুদ্রর মনের মতই ক্ষতবিক্ষত,অর্ধ কিলো এগোলেই সেই রাস্তাটা মিলিয়ে যায় ছোট এক নদীর কূলে ।তাই এই রাস্তা দিয়ে নদীর ঐপাড়ের লোকজন ব্যতীত আর তেমন কেউ আনাগোনা করে না।
তাই বিয়েবাড়ির লোকচক্ষুর দৃষ্টি এড়াতে এই নির্জন পথ দিয়েই রুদ্র আগালো ।
প্রভাতি জানালার কাছেই দাড়িয়ে ছিলো।তার ভেতরটা দুমরেমুচরে যাচ্ছে।কোনো কিছু হারানোর তীব্র কষ্ট হচ্ছে তার।তার মন বার বার জানান দিচ্ছে সে রুদ্রকে ভালোবাসে।নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসে।এতোদিন না বুঝলেও আজ সে বুঝতে পারছে সে রুদ্রকে কতক্ষানি ভালোবাসে।আর রুদ্র তাকে ভালো না বাসলেও তার একার ভালোবাসাই যথেষ্ট রুদ্রের জন্য। সে নিজের অনুভুতি বুঝতে বড্ড দেরি করে ফেলেছে।তার এখন পাগল পাগল লাগছে। প্রভাতি তার এই জীবন থেকে পালাতে চাচ্ছে।তার মনে হচ্ছে দৌড়ে রুদ্রের কাছে ছুটে যাক।
হঠাৎ সে দেখতে পেলো রুদ্র কোথাও যাচ্ছে।একা একা কেমন এলোমেলোভাবে হাটছে।রুদ্রকে দেখে তার ভেতর অন্যরকম এক সাহস কাজ করছে।সে পালিয়ে যাওয়ার এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো।তার মনে হলো আল্লাহ রুদ্রের মাধ্যমেই তাকে পথ দেখাচ্ছে।তার কেনো যেনো মনে হচ্ছে রুদ্রতাকে আজ ফিরিয়ে দিবে না।আর দিলেও সে ফিরে আসবে না।জোর করে হলেও সে রুদ্রের কাছেই থাকবে।ভালোবাসার মানুষটাকে পেতে এতোটুকু যে তার করতেই হবে।
প্রভাতি যখনি পেছনের দরজা দিয়ে বের হবে তখনি রুবি বেগম তাকে দেখে ফেললেন।রুবি বেগমকে দেখে আজ তার ভয় হচ্ছে না।আজ কেউ তাকে বাঁধা দিতে পারবে না।রুবি বেগম তাকে টেনে ঘরে নিয়ে গেলেন।রিয়া তা দেখে ফেললো।দেখার সাথে সাথে সে তৌকির কে কল দিলো।
“কই যাচ্ছিলি তুই?”
“রুদ্রের কাছে।”
প্রভাতির এমন উত্তর শুনে রুবি বেগম যেনো আকাশ থেকে পরলেন।সে এই প্রভাতিকে চিনে না।তার চোখে মুখে কি যেনো একটা ফুটে উঠেছে।ততক্ষনে শরিফ সাহেব এসে হাজির।
“দেখো তোমার ভাতিজি পালিয়ে যাচ্ছিলো আমাদের নাক কাটিয়ে।”
“চাচা আমি রুদ্রকে ভালোবাসি।আমি এই বিয়ে করবোনা।” প্রভাতি চোখ মুখ শক্ত করে বললো।প্রভাতির কথা শুনে শরিফ সাহেবের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
তৌকির তার মায়ের কানে কানে কিছু একটা বলে রিয়ার সাথে রুবি নেগমের রুমে এলো।
“কি হচ্ছে এখানে?”
তৌকিরকে দেখে রুবি বেগম চমকে গেলেন।কি বলবে সে। সে কিছু বলতে যাবে তখনি প্রভাতি বলে উঠলো।
“আমি আপনাকে বিয়ে করবো না।আমি রুদ্রকে ভালোবাসি।আর আমি রুদ্রকেই বিয়ে করবো।ও আমাকে ভালো না বাসলেও আমি ওকেই বিয়ে করবো।আপনি প্লিজ চলে যান।”
প্রভাতির এমন কথা শুনে তৌকির কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো।তারপর রিয়ার দিকে তাকালো।তৌকির রিয়া দুজনই হেসে উঠলো।
তাদের হাসি দেখে সবাই অবাক।
“এইতো বাচ্চা মেয়েটা বড় হয়ে গিয়েছে।জানো তোমার মুখ থেকে এই কথাটা শুনার জন্য আজ আমি এই ৫০ কেজি ওজনের শেরওয়ানি পরে এসেছি।উফ কি গরম।”
তৌকিরের কথা শুনে রিয়া বাদে উপস্থিত সবার চোখ কপালে উঠে গেলো।
“এইসব কি বলছো বাবা তুমি?” রুবি বেগম বললেন।”
“আমি যা বলছি ঠিক করছি।বরং আপনি ভুল করছেন।থাংক্স টু রিয়া। ও আমাকে না জানালে আমি জীবনের সব থেকে বড় ভুল করতাম।”
রুবি বেগম রিয়ার দিকে লাগি লুক দিলেন।
“আমার দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। আমি আমার ভাইকে কষ্ট পেতে দেখতে পারবো না।তাই আমি তোমার ফোন থেকে তৌকির ভাইয়ের নাম্বার জোগার করে ৩ দিন আগে সবটা বলে দেই।আমাদের প্ল্যান ছিলো যেভাবেই হোক রুদ্র ভাই আর প্রভাতির বিয়ে দেয়ার।”
“তুই আমার সাথে এমন কেন করতে পারলি?”
“আমি না হয় তোমার পর।কিন্তু তোমার ছেলে তো তোমার আপন।তোমার কি একটুও মায়ালাগেনি।”
এতক্ষনে আয়শা বেগমও চলে এসেছেন।
“বুবু তুই সারাজীবন তোর শাশুড়ীকে দোষ দিয়ে এসেছিস। তোর মনে হচ্ছে না। তুইও ঐ একই কাজ করছিস।তোর আর তার মধ্যে আমি কোনো তফাত পাচ্ছি না।তুইও তার মতোই নিজের সার্থ দেখছিস।নিজের ছেলেকে #সম্পর্কের_মারপ্যাঁচে ফালিয়ে তুইও তো ঐ একই কাজ করছিস।যা অনেক বছর আগে তোর সাথে ঘটেছিলো।তুই ঐ অন্যায়ের পুনোরাবৃত্তি করছিস।”
সবার কথা শুনে রুবি বেগম স্তব্ধ হয়ে গেলো।সে এতো বড় পাপ করছিলো।
“রুবি আমি জানি আমি অনেক অন্যায় করেছি।আমার ফ্যামিলি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছে।তাই বলে তুমি তোমার সাথে অন্যায়ের শাস্তি এই ছেলে মেয়ে দুটোকে দিবে?এমনটা করোনা।এই বোঝা বয়ে বেড়ানো বড্ড কষ্টকর।”
“খালামনি প্লিজ রুদ্র ভাইয়া আর প্রভাতিকে আলাদা করোনা।আমি চাইনা আর নতুন কোনো রুবি বেগম জন্মাক। তুমি তোমার ছেলেকে আলতাফ সাহেব হতে বাধ্য করো না।”
রুবি বেগমের আজ মনে হচ্ছে সে সত্যি বড় অন্যায় করে ফেলেছেন।তার বড্ড অপরাধবোধ হচ্ছে।এতোদিনে তার চোখ খুলেছে।সে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা পুনরাবৃত্তি করছিলো।নাহ এটা কখনোই হবে না।তার ছেলেকে সে এতোবড় কষ্ট দিবে না।সে আরো একটা আলতাফ জন্মাতে দিবে না।
প্রভাতির কানে কিছুই যাচ্ছে না।সে চিন্তা করছে কখন এখান থেকে ছুটে তার রুদ্রের কাছে যেতে পারবে।
রুবি বেগম হুহু করে কান্না করে দিলেন।তোমরা সবাই আমাকে মাফ করে দাও আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।
শরিফ সাহেব তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলেন।
“আমাকেও মাফ করে দাও।”
আমাদের অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। রুদ্রের কাছে যেতে হবে তো।রুদ্র তো…
তখনি রিয়া তৌকিরের হাত চেপে ধরলো।কেনোনা রিয়া চায় রুদ্র নিজের মুখে তার ভালোবাসার কথা প্রভাতিকে বলুক।
“প্রভাতি চল আমাদের এখনি বের হতে হবে ” প্রভাতি তার চাচির দিকে তাকালেন।তার চাচি তার কপালে একটা চুমু দিলেন।
“যা মা তোর ভালোবাসাকে জয় করে আন। আমাকে মাফ করে দিস এতোদিন আমি তোর সাথে অন্যায় করেছি অনেক।”
“আমি তোমার ছেলের বউ হবো এটা ভেবেই আমি সব ভুলে গিয়েছি।” বলেই হিহি করে হেসে দিলো।প্রভাতির কথা শুনে সবাই হেসে দিলো।মেয়েটা এখনো বাচ্চাই রয়ে গেলো।
তৌকির রিয়া, প্রভাতিকে নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পরলো।
“রুদ্র কোথায় যেতে পারে?”
“আমি ওকে নদীরের পারের রাস্তা ধরে যেতে দেখেছি।” তৌকির গাড়ি নিয়ে সেই রাস্তা ধরে আগালো। হঠাৎ প্রভাতি চিৎকার দিয়ে উঠলো।
“ঐতো রুদ্র।” প্রভাতির এমন চিৎকার শুনে রিয়া আর তৌকির ভয় পেয়ে গেলো।হঠাৎ ব্রেক করায় প্রভাতি মাথায় ব্যাথা পেলো।এটা নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যাথাই নাই। সে গাড়ি থেকে নেমেই এক দৌড় দিলো।কিছুদূর যেয়ে আবার ফিরে এলো। তৌকির আর রিয়াকে ধন্যবাদ দিয়ে আবার বাচ্চাদের মতো দৌড় দিলো রুদ্রের কাছে।
রিয়া তৌকির প্রভাতির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের মনে অদ্ভুত আনন্দ লাগছে।
“তোমার খারাপ লাগছে না? তুমি প্রভাতিকে পেলে না।”
“উহু। প্রভাতিকে আমার ভালো লেগেছিলো।আমি তো একবারও বলিনি আমি ওকে ভালোবাসি। ভেবেছিলাম বিয়ের পর বউকে ভালোবাসবো।প্রভাতি না হলে অন্য কেউ হবে।এমনকি আমার পাশে বসে থাকা মেয়েটাও হতে পারে।” বলেই হোহো করে হেসে দিলো তৌকির।
রিয়া পুরোই বোকা বনে গেলো।তখনি তৌকিরের ফোন বেজে উঠলো।তার ফ্রেন্ড ফোন দিয়েছে।
“হ্যালো””
“কই তুই?কাজি এসে পরেছে তো।”
“কাজি ব্যাটাকে বেধে রাখ।” বলেই ফোনটা কেটে অফ করে দিলো।
“লং ড্রাইভে যাওয়া যায় কি বলো।?”।
রিয়া তখনো হা করে চেয়ে আছে।তৌকির গাড়িতে একটা গান ছাড়লো।
” এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলো তো।”
তৌকির গাড়ি স্টার্ট করলো।হয়তোবা এখান থেকেই এক নতুন ভালোবাসার অধ্যায় আরম্ভ হবে।
নদীর চারপাশে খুব সুন্দর কাশফুল ফুটেছে ।রুদ্র নদীর জলে পা ডুবিয়ে পাড়ে বাধা এক পরিত্যক্ত নৌকাতে বসে রয়েছে ।নদীর মৃদু ঢেউয়ের সাথে প্রভাতির কষ্টের দিনগুলোর কথা রুদ্রর মনে বারবার ঢেউ খাচ্ছে ।
কিন্তু রুদ্রকে না পেলে প্রভাতির কষ্টের যে কোন সীমারেখা থাকবেনা; এমন অবলা মেয়েটার জীবন কি চিরকাল কষ্টেই কাটাবে? আচ্ছা যাদের জীবনের শুরুটা কষ্টের হয় তাদের পুরো জীবনটাই কি কষ্টে কাটে? নাকি কিছু অপদার্থ পুরুষের জন্য এই অবলা নারীদের জীবনে কষ্টের ঝড় নেমে আসে।রুদ্র নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলে।
ঐদিকে গ্রামে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো প্রভাতি আর রুদ্রকে নিয়ে।কথা যেনো বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে যায়।
এইসব গুঞ্জনে রুবি বেগম এবং বাকিদের কিছুই যায় আসছে না।তারা খুব খুশি।তারা এখন রুদ্র আর প্রভাতি আসার প্রতিক্ষায় আছে
ওদিকে প্রভাতি দৌড়ে রুদ্রর কিছুটা কাছাকাছি এসে পরলো ।হঠাৎ লাল শাড়ির কড়া আলোটা রুদ্রর চোখে পড়ে গেলো ।রুদ্রর মনটা আতকে ওঠল এ যে প্রভাতি,প্রিয় মানুষকে দূর থেকে দেখলেই চেনা যায় । ।রুদ্র ক্ষীণ গতিতে কিছুটা এগিয়ে গেলো। কিন্তু প্রভাতি দুর্বার গতিতে রুদ্রর দিকে এগিয়ে আসল ।প্রায় দশ হাত ব্যবধান রেখে দুজনই থমকে দাড়িয়ে গেলো ।
রুদ্র প্রভাতির প্রতি অনঢ় দৃষ্টিতে দিকে তাকিয়ে আছে ।প্রভাতির মমতাময়ী মুখখানা বেশ মলিন হয়ে গিয়েছে, ফুলদানিতে রাখা বাসি ফুল যেমন মলিন হয়ে থাকে সেইরূপ ।
প্রভাতি কিছুই বলতে পারছে না ।চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরছে ।প্রভাতির সেই কান্না দেখে রুদ্র ভেতরের চাপা কান্নাটা সহস্রগুণ বেড়ে গেল ।রুদ্র ভাবছে যেই মেয়েটা সবকিছু ছেড়ে তার কাছে ফিরে এসেছে; সেই মেয়েটাকে যদি আজ সে ফিরিয়ে দেয় তাহলে তার মায়ের সাথে করা আলতাফ সাহেবের মতো বেঈমানদের সাথে তার নামটাও পৃথিবী তার বুকে লিখে নিবে ।আজ সে যদি তার মায়ের কথা রাখতে যায় তাহলে তার মায়ের সাথে যেই অবিচার হয়েছিলো তার পুনরাবৃত্তি হবে ।সে এই অবিচারের পুনরাবৃত্তি ঘটতে দিবে না কেননা সে প্রভাতিকে মনে প্রাণে ভালোবাসে।আজ সে #সম্পর্কের_মারপ্যাঁচে পরে তার ভালোবাসার মানুষটা কে সে হারাতে পারবেনা।
ওদিকে প্রভাতির চোখ দিয়ে অশ্রুর ফোটা টপটপ করে মাটিতে পড়তে লাগলো;ওর চোখটা লাল হয়ে গেছে ।বুকের রক্ত দিয়ে কেউ যখন কারো নাম অন্তরে লিখে ফেলে সেই রক্ত চোখ দিয়েই বের হয় ।
প্রভাতির বুকফাটা কান্না দেখে রুদ্রর বুকটা ফেটে যাচ্ছে ।আজ তার মনে হচ্ছে জগতের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে, তার মায়াপরিকে সঙ্গে নিয়ে দুচোখ যেদিকে যায় সেরূপ কোনো দুরদেশে যেতে ।
।সমস্ত বাধাকে দুমড়ে মুচড়ে খোলা আকাশে উড়িয়ে দিয়ে একদৌড়ে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন ।সেই জড়িয়ে ধরায় কত আনন্দ তা শুধু ঐ মানব মানবীই জানে ।প্রিয় মানুষকে ফিরে পাবার আনন্দ সমগ্র সৃষ্টির আনন্দকেও ছাপিয়ে যায় । আজ ওদের দুজনের বুকের অশ্রু চোখের অশ্রুতে মিলিত হয়ে অজস্র অশ্রুর বর্ষণ শুরু হয়েছে ।কিছু অশ্রুর প্রতিটি ফোটায় আনন্দের ঝর্ণাধারা বয়ে মিশে যায় বিস্তৃত সমুদ্রের জলধারায় ।
হঠাৎ নদীতীরের মৃদুময় বাতাস ওদের শরীরে এসে লাগল;সেই বাতাসে ওদের মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল । রুদ্র প্রভাতির দিকে মুখ তুলে বললো
“কাঁদতেছ কেন,আমার মায়াপরি”।
” আমি বুঝতে পেরেছি আমি তোমাকে ভালোবাসি।তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিলে আমি তোমার ঘাড়ে উঠে বসে থাকবো।”
প্রভাতির এমন কথায় রুদ্র হেসে ফেললো।
“আমি আমার মায়াপরিকে খুব খুব ভালোবাসি।আমার মায়াপরিকে আমি কোথাও যেতে দিবোনা।”
প্রভাতি আরো গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরলো রুদ্রকে।
“তুমি আমাকে কত কষ্ট দিয়েছো জানো।ঐদিন আমাকে এমন ফিরিয়ে দিলে কেনো।আজ যদি আমার বিয়ে টা হয়ে যেতো তৌকিরের সাথে।”
এটা শুনে রুদ্র প্রভাতিকে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
“এই পচ্চি তুমি আসলে কিভাবে?”
প্রভাতি এক এক করে সব বললো।
রুদ্রের মা তাদেরকে মেনে নিয়েছেন এটা ভেবেই রুদ্রেএ বুকের পাথরটা নেমে গেলো।আজ তার নিজেকে দুনিয়ার সব থেকে সুখি মানুষ মনে হচ্ছে।
“আচ্ছা তারা যেনো কি বলছিলো আমার বাবাকে নিয়ে বুঝলাম না।”
“তোমার কিছু বুঝতে হবে না।তুমি শুধু এটা বুঝো আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর শুনো আমি কিন্তু আমাদের বাচ্চার নামও ঠিক করে ফেলেছি।”
রুদ্রর এরুপ কথা শুনে প্রভাতি হেসে দিলো;ওর হাসি দেখে রুদ্রর মুখেও হাসি ফুটলো ।ওদের হাসি দেখে উপরওয়ালাও আজ মুচকি হাসলেন ।
সমাপ্ত।
(রুদ্র প্রভাতির মতো এমন হাজারো ভালোবাসার মানুষ আছে যারা এক হতে পারেনা।#সম্পর্কের_মারপ্যাঁচে পরে নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন করতে হয়। রুদ্র প্রভাতির মতো কয়জনের ভাগ্যেই বা থাকে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে পাওয়ার।#সম্পর্কের_মারপ্যাঁচ
উপেক্ষা করার ক্ষমতা আল্লাহ সবাইকে দেয়নি। এই প্যাঁচে যেই পরে সেই বুঝে জীবনটা কতটা অসহায় হয়ে যায়।)
(দুদিন দেড়ি করার জন্য দুঃখিত।আশা করি সবাইকে খুশি করতে পেরেছি।)