প্রেমের_উড়ান পর্বঃ২

#প্রেমের_উড়ান
#পর্বঃ২
#লেখিকাঃদিশা_মনি

সুহানি তৈরি হয়ে নিচ্ছে ঢাকায় যাওয়ার জন্য। গতকাল রাতেই মেইল পেয়েছে সে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের এয়ার হোস্টেজ হিসেবে এখন সে যোগদান করতে পারে। সুহানির খুব ভালো লাগছে আজ। স্বপ্ন পূরণের আনন্দ সত্যিই অনেক বেশি।

সুহানির পরনে লাল রঙের একটি টপস এবং জিন্স। মিরা থানায় যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিল৷ তার আগে সুহানির সাথে দেখা করতে এলো৷ সুহানির রুমে এসে তাকে তৈরি হতে দেখে বলল,
‘তোমার ভাইয়াকে মিথ্যা বলা কি ঠিক হলো? তুমি চাইলে ওকে সত্যটা বলতে পারতে।’

সুহানির মনটা খারাপ হয়ে গেল৷ সেও তো চায়নি এভাবে মিথ্যা বলতে। এক সপ্তাহ আগে বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার পর থেকে সে নানাভাবে সীমান্তকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে তার ব্যাপারটা। কিন্তু সীমান্ত প্রচণ্ড একরোখা। সে কিছুতেই সুহানির এয়ার হোস্টেজ হওয়ার ব্যাপারটা মেনে নেয়নি। সেই কারণেই বাধ্য হয়ে সুহানি বলেছে সে ঢাকায় একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে জবের অফার পেয়েছে এবং আজ থেকে সেখানে জব করবে। সীমান্ত এতে আপত্তি জানায় নি। কারণ সুহানির চাকরি করা নিয়ে তার কোন আপত্তি নেই, আপত্তি শুধু এয়ার হোস্টেজের জব নিয়ে।

সীমান্ত মনে করে এয়ার হোস্টেজ খুব নি’ম্নমানের একটি জব এবং তাদের খুব সহজেই কু’প্রস্তাব দেওয়া যায়। সুহানি তার ভাইয়ের এই নিম্ন মানসিকতার জন্যই বাধ্য হয়ে মিথ্যা বলেছে।

মিরা সুহানির পাশে এসে দাঁড়ায়। সুহানি মিরাকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘তুমি তো জানো ভাবি, আমি মিথ্যা বলতে চাইনি। কিন্তু সত্যটা বললে যে ভাইয়া কোনদিন রাজি হতো না।’

‘তোমার অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি সুহানি। কিন্তু সত্য কোনদিন চাপা থাকে না। তোমার ভাইয়া একদিন না একদিন সব সত্য ঠিকই জানতে পারবে। সেদিন তুমি কি করবে?’

‘সেটা পরে ভাবব। এখন আমার কাছে আমার লক্ষ্য পূরণই একমাত্র উদ্দ্যেশ্য। তুমি আমার জন্য দোয়া করিও।’

‘অবশ্যই করব।’

দুজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। রুমের বাইরে থেকে সীমান্ত বলে ওঠে,
‘ভেতরে আসব?’

সুহানি অভিমানী সুরে বলল,
‘অনুমতি নেওয়ার কি আছে ভাইয়া? এসো।’

সীমান্ত ভিতরে এসেই সুহানিকে উদ্দ্যেশ্যে করে বলল,
‘তুই তৈরি তো? তাহলে চল তোকে আমি ঢাকার বাসে তুলে দিয়ে আসি।’

‘হ্যাঁ, আমি একদম তৈরি।’

মিরার দিকে তাকিয়ে সুহানি হেসে বলল,
‘এখন তোমার ননদিনী রায় বাঘিনী বিদায় নিলো। নিজের স্বামীর সাথে জম্পেশ রোম্যান্স করো। এরপর যখন আমি নারায়ণগঞ্জে ফিরব সেদিন যেন খুশির খবরটা পাই।’

সুহানির কথাটা বুঝতে পেরে সীমান্ত ও মিরা দুজনেই লজ্জা পেলো। মিরা রাগী স্বরে বলল,
‘এবার কিন্তু আমি কান মুলে দেব।’

সুহানি বুকে হাত গুজে বলে,
‘আমি কাউকে ভয় পাইনা।’

‘তবে রে…’

বলেই মিরা সুহানির কান টেনে ধরল। এরপর দুই ননদ-ভাবি মিলে খুনশুটিতে মেতে উঠল। সীমান্তর চোখ জুড়িয়ে গেল দৃশ্যটা দেখে। ননদ-ভাবির এই মিষ্টি সম্পর্ক দেখে তার অনেক ভালো লাগে। অথচ বিয়ের আগে সে এটা নিয়ে শংকায় ছিল যে তার স্ত্রী তার বোনের সাথে কিরকম ব্যবহার করবে। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে তার স্ত্রীই তার থেকে সুহানির কাছে বেশি আপন হয়ে গেছে।

সীমান্ত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাড়া দিয়ে বলে,
‘তাড়াতাড়ি চল সুহানি। আমাকে আবার তোকে পৌঁছে দিয়ে হসপিটালে যেতে হবে।’

সুহানি বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় হঠাৎ করে মিরাকে জড়িয়ে ধরে। সুহানির চোখ থেকে দুই ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। মিরাও আবেগপ্রবণ হয়ে যায়। অবশেষে মিরাকে বিদায় দিয়ে সীমান্তর সাথে চলে যায় সুহানি। মিরাও থানার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়।

★★★
ঢাকায় পৌঁছাতেই বাস থেকে নামল সুহানি। বাসে জার্নি করতে তার ভালো লাগে না। এতক্ষণ কেমন জানি বমি বমি পাচ্ছিল। এখন একটু ভালো লাগছে।

বাসস্ট্যান্ডে নেমেই নিজের বান্ধবী ইশাকে ফোন করে সুহানি। ইশা ফোনটা রিসিভ করতেই সুহানি জিজ্ঞেস করে,
‘কোথায় রে তুই? আমি বাসস্ট্যান্ডে তোর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি আর তোর কোন খবর নেই।’

‘তুই দুই মিনিট অপেক্ষা কর। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।’

বলেই ফোন রেখে দেয় ইশা৷ এদিকে সুহানি বিরক্ত হয়ে মনে মনে হাজারো গালি দিতে থাকে ইশাকে। বরাবরই মেয়েটা এমন।

প্রায় দশ মিনিট যাবৎ বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে সুহানি। কিন্তু ইশার কোন খবর নেই। সুহানির রাগ তড়তড় করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইশাটা বরাবরই এমন লেট লতিফ।

সুহানির অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ইশা হাফাতে হাফাতে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। সুহানি রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইশার দিকে। ইশা সুহানির দিকে তাকিয়ে ভয়ে ঢোক গিলে বলে,
‘আসলে দোস্ত হয়েছে কি…’

‘থাক, তোকে আর কোন এক্সকিউজ দিতে হবে না। এই রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার মাথা এমনিতেই গরম হয়ে গেছে এখন তোর উল্টাপাল্টা অজুহাত শুনলে আমার মাথায় আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত শুরু হবে। তাই তুই কিচ্ছু বলিস না।’

ইশা কিছু বলল না। সুহানি ইশার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
‘আমরা দুজনে মিলে যেই এপার্টমেন্ট কিনেছিলাম সেখানে নিয়ে চল।’

সুহানি কয়েকদিন আগেই ইশাকে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিল শহরে এপার্টমেন্ট কেনার জন্য। ইশাও তার মতো একজন এয়ার হোস্টেজ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে। যেহেতু তাদের দুজনের এই শহরে কেউ নেই তাই ভেবেছে দুজনে এপার্টমেন্টনিয়ে থাকবে।

ইশা সুহানিকে বলল,
‘হুম, চল। আমি একটি কার ভাড়া নিয়ে এখান অব্দি এসেছি। ঐ কারে করেই এখন ফিরব।’

সুহানি খুশি হয়ে যায় ইশার কথা শুনে। যাক,মেয়েটা অন্তত একটা কাজের কাজ করেছে।

অতঃপর কারে করেই ইশা ও সুহানি তাদের এপার্টমেন্টে পৌঁছে যায়।

সেখানে পৌঁছাতেই বিছানায় শুয়ে পড়ে সুহানি। ক্লান্তি ভড় করে তার মাথায় ফলশ্রুতিতে সে ডুব দেয় ঘুমের মাঝে।

★★★
পরবর্তী দিন বেশ সকালেই ঘুমকে বিদায় জানিয়ে সুহানি ও ইশা পৌঁছে যায় ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।

আজ তারা দুজনেই প্রথমবারের মতো উড়ান দিতে চলেছে আকাশে। এর আগে এয়ার হোস্টেজ হওয়ার ট্রেনিং নিয়েছে দুজনে। তবুও প্রথমদিন হওয়ায় দুজনে এখন বেশ উত্তেজনার মধ্যে আছে। তাদের মধ্যে নার্ভাসনেস কাজ করছে।

আজ তাদের দুজনেরই আলাদা ফ্লাইট। ইশা যাচ্ছে কলকাতার ফ্লাইটে আর সুহানি আরব আমিরাতের ফ্লাইটে করে দুবাইতে।

সুহানিকে প্রথম ডিউটিতেই যে এত দূরে যেতে হবে সেটা সে ভাবতে পারে নি। বেশ ভয় লাগছে তার সাথে বেশ আগ্রহও কাজ করছে মনের মধ্যে।

ফ্লাইটের টাইম হয়ে যাওয়ায় সুহানি ইশাকে বিদায় জানিয়ে চলে আসে। ফ্লাইটের কাছে আসতেই আরো কিছু এয়ার হোস্টেজের দেখা পায়। তারা সবাই দাঁড়িয়ে গল্প করছে৷ সুহানি তাদের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য তাদের পাশে আসে৷ কিন্তু কেউই তাকে পাত্তা দেয়না। সবাই নিজেদের মধ্যে গল্পে মেতে ছিল।

সুহানির নিজেকে একা একা মনে হচ্ছিল৷ ইশা থাকলে তার একটু ভালো লাগত। এর মধ্যে সে শুনতে পেল দুজন এয়ার হোস্টেজের কথা। দুজনেই সুহানির সমবয়সী কিংবা কিছুটা বড় হবে।

তাদের মধ্যে একজন বলছিল,
‘জানো, আজ আমাদের ফ্লাইটের পাইলট কে?’

‘কে?’

‘যার দিকে তাকিয়ে মেয়েরা অনন্তকাল পারি দিতে পারবে।’

সুহানি খুব আগ্রহ নিয়ে তাদের কথা শুনতে থাকে। কিন্তু তারা আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাদের মধ্যে অন্য একজন ঢুকে গল্পের টপিক বদলে দেয়।

সুহানির মনটা খারাপ হয়ে যায়। তার খুব আগ্রহ হচ্ছিল পাইলট সম্পর্কে জানার জন্য। হঠাৎ করে সবার সম্মিলিত কন্ঠস্বরে তার ধ্যানভঙ্গ হয়। সবাই বলছিল,
‘ঐ দেখো এসে গেছেন পাইলট।’

সুহানি সবার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকায়। সামনে তাকাতেই বড়সড় একটা ধা*ক্কা খায়। পাইলটকে দেখেই সে ধাক্কাটা খেয়েছে। সুহানি অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
‘ধ্রুব..’

এহসান ধ্রুবর নজরও আসে সুহানির দিকে। সুহানির দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে মনে মনে বলে,
‘৬ বছর পর তার দেখা পেলাম অবশেষে।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here