ধ্রুবতারা
পর্ব_২৪
পুষ্পিতা_প্রিমা
আদিম যুগের মানুষের মতো বসবাস সেন্টিনেল অধিবাসীদের। প্রয়োজনীয় স্থান ঢাকা ছাড়া প্রায় নগ্ন অবস্থায় থাকে তারা। বর্শা ছুঁড়ে শিকার করে তারা। তীরের ফলা ছুঁড়ে শিকার করে পশু, পাখি। এই নিষিদ্ধ দ্বীপে ভ্রমণ তো দূরে থাক এই দ্বীপের কাছাকাছি কোনো ট্রলার কিংবা জাহাজ দেখা গেলে ও সেন্টিনেলরা তীর ছুঁড়তে থাকে। তারা তাদের ইচ্ছেমতো থাকতে চায়। সাধারণ মানুষের হস্তক্ষেপ তাদের যেন রুচিতে বাঁধে। কিন্তু এত বিশাল একটা বিমান পড়লো তাদের দ্বীপে সেন্টিনেলদের কোনো হুশ নেই? ব্যাপারখানা বুঝে উঠতে পারলো না বাংলাদেশ থেকে সুইজারল্যান্ডে ফিরে যাওয়া ক্ষুদে সাইনটিস্ট ডিকাডো। তবে যখন ব্যাপারটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো বুঝতে পারলো তাদের বিমানটি এসে পড়েছে সেন্টিনেল দ্বীপের পরিত্যক্ত জায়গায়। বলা হয় এই জায়গাটাকে ওরা ওদের সৃষ্টিকর্তার শত্রুর উৎপত্তি স্থল মনে করে কোনো একটা কারণে। যার কারণে জায়গাটার আশেপাশে কোনো বসতি গড়ে উঠেনি। কোনো প্রকার মানুষের বসবাস নেই।
বাংলাদেশের কোন একটা বিশেষ প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য ডিকাডোদের একটা টিম এসেছিল। সেখানে ছিল দুইজন ডক্টর, একজন সাইনটিস্ট, দুইজন রাইটার, কয়েকজন বিজনসে ম্যান এন্ড ওমেন । দেশে ফেরার সময় এমন দুর্দশা হবে কে জানতো?
একজন রাইটার মৃত্যুর সাথে লড়ছে। বিমানের ঝাঁকুনিতে আর ত্যাড়ছাভাবে পড়ায় সবার সিটবেল্ট খুলে গিয়ে মারাত্মক ভাবে সামনের দিকে ঝুঁকে আহত হয়েছে সবাই। কারো মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত প্রবাহিত হওয়ায় সাথে সাথেই মারা গিয়েছে। তবে যাদের ভাগ্য ভালো তারা একদমই আহত হয়নি। বিমানে যা খাবার মজুদ ছিল তা ফুরিয়ে আসছে। আহতদের চিকিৎসা সরঞ্জাম ও নেই। ফলে তাদের অবস্থা মারাত্মক হচ্ছে। এমতাবস্থায় কোনো সংস্থার সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার রাস্তা বন্ধ। নেটওয়ার্ক নেই। তবে সাইনটিস্ট ডিকাডো আশ্বাস দিল টেলিযোগাযোগ করা যাবে। তাও দুই তিনদিন অপেক্ষা করতে হবে কারণ তিনি ক্যাবল আর ভাঙা নষ্ট যন্ত্রাংশ দিয়ে যে যন্ত্রটি বানাতে যাচ্ছেন সেটি দিয়ে নেটওয়ার্কের দেশের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করা যাবে। পরে তাদের রক্ষা করার জন্য হেলিকপ্টার পাঠাতে পারবে।
তখন রাত। কয়েকদিন ধরে আশেপাশে সেন্টিনেলদের দেখা যাচ্ছে। তারা অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ করে ঘুরে বেড়ায়। শিকার করে। তাদের নিজস্ব ভাষা সেন্টিনেল ভাষা। সবাই বিমানে উঠে বসলো সতর্ক হয়ে। সব ডোর বন্ধ করে দিয়ে ভেতর থেকে দেখতে লাগলো সেন্টিনেল অধিবাসীদের কর্মকাণ্ড। তখনই গোঁ গোঁ শব্দ ভেসে এল ভেতরের একটি জায়গা থেকে। মার্কো দৌড়ে গেল। একজন বাংলাদেশী আবার বমি করছে। তিনি সামলে নিলেন দ্রুত। জঙ্গলে পাওয়া একপ্রকার টকজাতীয় সুগন্ধি পাতা কচলে নাকের কাছে ধরলো। ছেলেটির বমি বন্ধ হয়ে এল। পেটে বেশি কিছু না থাকায় তেঁতো পানি বের হলো। ক্ষতস্থানে লাগানো সবুজ পাতার রস লেগে আছে। চোখমেলে নিজেকে একই শার্টে দেখে নাকমুখ কুঁচকে হেলে পড়ে রইলো রোয়েন। বলল
‘ আমি শাওয়ার নিতে চাই মিঃ মার্কো।
মধ্যবয়স্ক মার্কো হাত বুলালো রোয়েনের মাথায়। বলল
‘ নো প্রবলেম বিউটিফুল চাইল্ড। এখানে শাওয়ার নিতে পারবে। তবে পানি একটু কম খরচ করো। যা আছে তা দিয়ে আমাদের কোনোমতে তিনচারদিন পার করতে হবে। যতদিন না আমাদের উদ্ধার করতে আসছে। রোয়েন বলল
‘ ওকে। আমাকে কি ওয়াশরুম অব্ধি পৌঁছে দিতে পারবেন?
মিঃ মার্কো সমর্থন জানালো। এলিজা এসে মার্কোকে ডাকলো
‘ ডক্টর মার্কো সেন্টিনেলরা বিমানের দিকে অগ্নিবর্শা ছুঁড়ছে। তারা বুঝে গিয়েছে এখানে মানুষ আছে।
রোয়েন বলল
‘ কেন? ওরা কি জানেনা আমরা আঘাত পেতে পারি এতে?
মার্কো বলল
‘ ইয়োর নেম প্লিজ।
‘ রোয়েন। রোয়েন আহম্মেদ।
মার্কো বলল,
‘ ইয়েসে রোয়াইন। সেন্টিনেলরা স্বাভাবিক নয়। ওরা আমাদের মতো মানুষদের পছন্দ করে না। ওরা ওদের রাজ্যে কারো আগমন পছন্দ করে না।
রোয়েন সবটা শুনলো। পরক্ষণেই নিজের অসুস্থ টলমলে শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এলিজা বলল
‘ নিঃ আহামাদ আর ইউ ওকেই? কোথায় যেতে চাও?
রোয়েন বলল
‘ আ’ম ওকে। আমাকে কি আমার ফোনটা দেওয়া যাবে?
এলিজা রোয়েনের ফোনটা নিয়ে আসলো। রোয়েন বিমানের জানালা ভাঙা অংশে চোখ রাখলো। দেখলো অর্ধ নগ্ন মানুষরূপী সেন্টিনেল তীর ছুঁড়ছে অনবরত। এভাবে চলতে থাকলে কিছুক্ষণের ভস্ম হয়ে যাবে পুরো বিমান। রোয়েন অদ্ভুত শব্দগুলো মনযোগ দিয়ে শুনলো। ফোনের রেকর্ডার অন করে রেকর্ড করলো শব্দগুলো। বিজ্ঞানী ডিকাডো এসে বলল
‘ কি করছেন ডক্টর আহামাদ?
রোয়েন বলল
‘ হাই বলিউম সাউন্ড সিস্টেম আছে আপনার কাছে?
ডিকাডো মাথা নাড়িয়ে বলল
‘ ইয়েস। ওয়েট করো। আমি আনছি।
রোয়েন মাথা নাড়ালো। ফোন দিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে নিল সাথে।
ডিকাডো এসে একটা কালো বক্স জাতীয় কিছু ধরিয়ে দিয়ে বলল
‘ নাও রোয়াইন আহামাদ।
রোয়েন নিল। রেকর্ড করা সাউন্ড,, বক্সে দিয়ে বলিউম হাই করে দিল। সেন্টিনেলদের করা সেই ধ্বনি আবার পুনরায় বেজে উঠলো সাথে সাথে। সবাই ভাঙা অংশ দিয়ে দেখতে লাগলো সেন্টিনেলদের প্রতিক্রিয়া। সবাই বুঝে উঠতে পারলো না রোয়েন কি করতে চলেছে।
তবে মিনিট পার হতেই সেন্টিনেলরা দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়লো যেন। এদিকওদিক তাকাতে লাগলো শুধু। হয়তো ভাবছে তাদের মতো করে কথা কে বলছে? তা ও এত আওয়াজ করে? মনের মধ্যে ভয় কাজ করলো তাদের। শয়তানের ডাক বোধহয় এমন হয়? পরিত্যক্ত জায়গা থেকে হঠাৎ এমন শব্দ ভেসে আসায় বর্শা ফেলে পালালো সেন্টিনেল অধিবাসীরা। সবাই রোয়েনের বুদ্ধির প্রশংসা করলো। রোয়েন ফ্রেশ হতে চলে গেল।
ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো সবাই বাইরে আগুন জ্বালিয়ে বসেছে। কনকনে ঠান্ডা চারপাশে। যারা আহত তাদের কেউ কেউ রোয়েনকে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করলো। বাঁচার স্বপ্ন দেখতে লাগলো। আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। ক্ষতস্থানে পানি লাগায় জ্বালা শুরু হলো রোয়েনের। মিঃ মার্কো রোয়েনকে দেখে দৌড়ে আসলেন। আগুনের কাছে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলেন একটি বিরাট পাতার উপরে। ছোটখাটো রুমালে আগুনের আভা লাগিয়ে লাগিয়ে দিতে লাগলো ক্ষতস্থানের আশেপাশে। হাতের বাহু, কপালে। রোয়েনের এতে আরাম বোধ হতে লাগলো। হঠাৎ মামা আর বাবাইয়ের কথা মনে পড়লো। মনে পড়লো বোনটার কথা। মনে পড়লো মামুনি, ফুপী আর নানু দাদুর কথা। তখন সবেমাত্র কলেজে উঠেছে। টাইফয়েড জ্বরে মারাত্মক ভাবে অসুস্থ হয়ে সে ভর্তি হয়েছিল হসপিটালে। সে কি বাজে অবস্থা সবার? তাননা তো নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়ে ভাইয়ের সাথে সাথে। কি পাগল মানুষ গুলো? আরেহ রোয়েন কি এত সহজে হার মেনে নেওয়ার ছেলে? বোনটাকে রেখে সে কোথা ও যাবে নাকি? উপরওয়ালা স্বয়ং রাখিবন্ধনের জোর শক্ত করে বেঁধে দিয়েছেন সেখানে এই সামান্য দুর্ঘটনা তো কিছুই না।
আগুনের পাশে বসে থাকতে থাকতে রোয়েনের চোখ গেল দূরে। একজন পুরুষ একটি মহিলার গায়ে শাল জড়িয়ে দিচ্ছে।
রোয়েন চোখ সরিয়ে নিল। এলিজা এসে পাশে বসলো। হাসিমুখে বলল
‘ হেইই জেন্টলম্যান। আর ইউ ম্যারিড?
রোয়েন ভুরু কুঁচকে এলিজার দিকে তাকালো। লাল সাদা মেশালো চুলের বাহার। গায়ে রঙ ধবধবে সাদা। গলার হাড় ভেসে উঠেছে কয়েকটা। গলার হাড় ভেসে তোলাটা কি ফ্যাশন নাকি মেয়েদের? রাহার ও একি অবস্থা? এর ও? আশ্চর্য?
রোয়েন থেমে থেমে জবাব দিল।
‘ ইয়াহ। ম্যারিড।
এলিজা গাল এলিয়ে হাসলো। বলল
‘ আমি ও। তোমার ওয়াইফের ছবি আছে? দেখাও।
রোয়েন বলল
‘ সরি। ফোনে চার্জ নেই।
এলিজার হাসি চলে গেল। রোয়েন বলল
‘ সুযোগ পেলে দেখাবো৷ ওকে?
এলিজা হাসি ফিরিয়ে এনে বলল
‘ ওকে ডক্টর আহামাদ ।
ডিকাডো এল তখুনি। হাঁপানো অবস্থায়। হাতে একটি বর্শা, সেন্টিনেলদের ফেলে যাওয়া। অন্য হাতে একটি মরা পাখি৷ সাদা পালক। সে নাকি সেটি আগুনে ছেঁকে খাবে। রোয়েন বলল
‘ এভাবে কি কেউ খায় নাকি?
ডিকাডো হাসিমুখে বলল
‘ ইয়াং ম্যান তুমি জাস্ট দেখো। তোমার ও খেতে মন চাইবে।
রোয়েন সরে পড়লো দ্রুত। অমৃত বললে ও তো সে খাবেনা। ইয়াকক।
রোয়েন দূরে দাঁড়িয়ে দেখলো ডিকাডো কিভাবে পাখিটার পালক ছাড়িয়ে ধুঁয়ে আগুনে ঝলসে ফেললো। তারপর ইয়াম্মি ইয়াম্মি বলে বলে তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে খেল। রোয়েনকে বলল
‘ দেখলে তুমি তো খেতেই চাওনা। খেতে পারলে না।
রোয়েন মনে মনে বলল
‘ ওহ আল্লাহ এসব খাওয়ার আগে তুমি আমার মৃত্যু দিও।
_________
ডিকাডোর বানানো যন্ত্রটা কাজে লাগলো প্রায় চারদিনের মাথায়। এটি একটি নেটওয়ার্ক রাউটার হিসেবে কাজ করবে। শুধুমাত্র একটি ডিভাইসে কাজ করবে। ডিকাডো তার ফোন ব্যবহার করে বার্তা পাঠালো বাংলাদেশ বিমানবন্দরে। বিমানবন্দর থেকে শীঘ্রই হেলিকপ্টার এসে পড়ছে। হেলিকপ্টারের ঘুূর্ণায়মান পাখার বাতাস সেন্টিনেল দ্বীপে পড়ায় দলে দলে সেন্টিনেল অধিবাসী এসে পড়লো বর্শা হাতে। হেলিকপ্টার থেকে পড়া শুকনো খাবার, পানির বোতল, জামাকাপড়, নানা ধরণের মেডিসিন নিতে পারলো মার্কো আর ডিকাডো। সেন্টিনেলদের বর্শার আঘাতে হেলিকপ্টার টিকে থাকতে পারলো না বেশিক্ষণ। ল্যান্ড করার ভাবতে ও পারছেনা। তা দিয়ে চললো আর প্রায় সপ্তাহ খানেক। হেলিকপ্টার কোনোভাবেই ল্যান্ড করতে পারছেনা। আবার ল্যান্ড করলে তারা বুঝে যাবে ধসে পড়া বিমানের ভেতর মানুষ আছে। আক্রমণ চালাবে তারা। তাই ঝুঁকি নিল না কেউ। তবে রোয়েন ভাবলো এভাবে চলতে পারেনা। আর কতদিন এভাবে এখানে পড়ে থাকবে তারা? ফেরা দরকার।
তাই এক সন্ধ্যার দিকে দলসহ সবাই বেরিয়ে পড়লো জঙ্গলে। সেন্টিনেলদের ফেলে যাওয়া বেশ কয়েকটা বর্শা ফেল তারা। সেগুলো দিয়ে শিকার করলো বেশ হরেক রকম পাখি। মস্ত বড় একটি হরিণ শিকার করে বসলো মার্কো। কি খুশি!
রোয়েনের খারাপ লাগলো। কিন্তু কি আর করার?
সেন্টিনেল অধিবাসীদের এভাবে বশ করতে হবে। হেলিকপ্টার যেকোনো ভাবে ল্যান্ড করতে হবে নাহলে ফেরা যাবেনা। মোক্ষম সুযোগ এল তার ভোররাতে। ছোটখাটো একটি হেলিকপ্টারকে দেখা গেল কয়েকবার মাথার উপরে ঘুরঘুর করতে। বেশ উপরে আছে। ডিকাডো যোগাযোগ করে জানতে পারলো হেলিকপ্টারটি ল্যান্ড করার সুযোগ খুঁজছে। রোয়েনা বুদ্ধি আঁটলো। মরা হরিণ আর পাখিগুলোকে তারা ঝুলিয়ে দিল একটি কাটা গাছের সাথে। বহুকষ্টে ঝুলাতে সক্ষম হলো। গাছটির মোটা ডাল। তার উপর বাঁকা হয়ে শুয়ে থাকায় হরিণটিকে ঝুলাতে বেশি অসুবিধা হলো না। পরপরই যখন হেলিকপ্টার ল্যান্ড করলো তখন দলেদলে সেন্টিনেল সৈন্যরা ছুটে এল। সবাই মানুষ দেখে হিংস্র পশুর মতো ছুটে আসতে লাগলো। রোয়েন সাউন্ড জোরে ছেড়ে দিল তারপর ঢিল ছুঁড়লো ঝুলিয়ে রাখা হরিণটির দিকে। সবাই শব্দ আর এভাবে তরতাজা হরিণ আর পাখি দেখে দিশেহারা হয়ে পড়লো কি করব কি করব বুঝে উঠতে না উঠতে রোয়েন একে একে সবাই উঠে যেতে বলল হেলিকপ্টারে। সবাই একে একে উঠে পড়লো। শেষমেশ হেলিকপ্টারের পাখা ঘুরতে শুরু করলো আবার। সেন্টিনেলদের হুশ ফিরলো
সবাই ডাক দিল রোয়েনকে। ডিকাডোকে উঠতে সাহায্য করার সময় ডিকাডোর পিঠে এসে তীর বিঁধলো। রক্ত ছিটকে এসে পড়লো রোয়েনের মুখে। রোয়েনে ডিকাডোকে তুলে দিয়ে কোনোমতে নিজে উঠতে না উঠতেই আর ও একটও তীর এসে বিঁধলো তার পিঠে। মার্কো প্যারাসুটে কর নেমে এসে তুলে নিল রোয়েনকে। গলগল করে রক্তের স্রোত বইছে। রোয়েন চোখবন্ধ করে নিল। ডিকাডোর চোখ দিয়ে জলের প্রবাহ। কাঁপা-কাঁপা গলায় সে আওড়ালো
‘ গড সেভ মাই লাইফ। ওহ গড সেভ মাই লাইফ।
মার্কো আর বাকিরা দিশেহারা। তীর বিষ থাকে। বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে বাঁচানো যাবে না ওদের। হেলিকপ্টার যাত্রা করলো বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে।
সারাদেশে টিভির সামনে বসে বাংলাদেশের উদ্দেশ্য আসা হেলিকপ্টারটিকে দেখছে জনগণ। এ যেন বিস্ময়কর কিছু! কি হবে এরপর? দুজন তীরের আঘাতে বিদ্ধ হয়েছেন৷ একজন বিদেশি অন্যজন বাংলাদেশী। সেই বিমানের ভেতর থেকে পাঠানো ছবি দুটো আবছা,আবছা দেখালো নিউজে।
টিভির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সোফায় বসে রইলো তাননা। চোখের জলে ঈশানের শার্টের একপাশ ইতোমধ্যে ভিজে উঠেছে। চিৎকার করে কেঁদে উঠতে পারছেনা সে। ঈশান শক্ত করে ধরে রেখে বলল
‘ জিন্নাত আমাকে তো যেতে হবে এয়ারপোর্টে। আপনি এরকম করলে তো কিচ্ছু হবে না। দেখুন রোয়েন হয়ত ফিরছে আপনারই জন্য। এবার দোয়া করুন যাতে কিচ্ছু না হয় ওর।
তাননা ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিল আবার। জায়িদ এসে ধরলো তাননাকে। বলল
‘ তুমি যাও ঈশান। আমরা তাননাকে নিয়ে যাচ্ছি।
ঈশান পা বাড়াতেই তাননার গলার আওয়াজ ভেসে আসলো।
‘ আমার ভাইকে নিয়ে ফিরে আসবেন। আমার ভাই ছাড়া ফিরবেন না।
ঈশান চলে গেল। নাহিল ও বেরিয়ে পড়লো দ্রুত। জায়িদ তাননাকে বলল
‘ দেখো তোমার বাচ্চা কাঁদছে। এরকম কেউ করে? আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে আমাদের মুননা বেঁচে আছে।
তাননা কেঁদে উঠে বলল
‘ ওর পিঠে তীর লেগেছে। ও আবার চলে যাবে। নাহ নাহ এ হয়না। আমার ভাই। আল্লাহ কেন এত কষ্ট দিচ্ছে ওকে? কেন এত পরীক্ষা নিচ্ছে?
জায়িদ তাননাকে ধরে রাখলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বিলি কেটে বলল
‘ আম্মা আব্বাকে হারিয়ে যারা বুকে পাথর জমিয়ে বড় হয় তাদের জীবনটাই তো একটা যুদ্ধক্ষেত্র মা । আমরা হারতে শিখায়নি তাননা মুননাকে। তাননার জন্য মুননাকে ফিরতে হবে। মুননা ফিরবে।
এয়ারপোর্টে পৌঁছে হসপিটালে শিফট করাতেই ডিকাডোর মৃত্যু হলো। মার্কো আর এলিজা পাগলের মতো হন্য হয়ে দৌড়ে গেল রোয়েনের অপারেশন থিয়েটারের কাছে। ঈশান আর নাহিল আসলো মাত্রই। ডিকাডোর মৃত্যুর খবর শুনে বুক কেঁপে উঠলো তাদের। মার্কো কপাল চাপড়ে বললো
‘ নো নো ইয়াং বয়, তোমাকে আমি অনেক সেবাযত্ন করে সুস্থ করেছি৷ তুমি এখন আবার চলো যেতে পারোনা।
রোয়েনের অপারেশন হলো। বিষে ছেয়ে গিয়েছিল তার শরীর। ডিকাডোর শরীরে বিষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণে মৃত্যু হয়েছে। রোয়েনের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ছুটায় বিষ স্থায়ী হতে পারেনি। তাই বেঁচে গেল এই যাত্রায়।
পুরো পরিবার ছুটে আসলো হসপিটালে। জাহেদা আর সালেহা বেগম ও বাদ যায়নি। তাননা তো পাগলের মতো হন্য হয়ে এল। ততক্ষণে রোয়েনের জ্ঞান ফিরেনি। তার শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রচুর। রক্ত যোগাড় করতে গিয়েছিল জায়িদ আর নাহিল। ততক্ষণে ডাক্তাররা জানিয়ে দিয়েছে রক্ত যোগাড় হয়ে গেছে। সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। জাহেদা আর সালেহা বেগম উপরওয়ালার দরবারে শুকরিয়া জানালো। তাদের ভাইকে আল্লাহ ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন অপেক্ষা ভাই কবে চোখ খুলবে, কবে দাদু ডাকবে? কবে নানু ডাকবে? কবে আগের মতো রাগ দেখাবে? বকাঝকা করবে। তাদের হাত দুটো নিয়ে মাথায় ছুঁয়ে বলবে
‘ একটু বেশি করো দোয়া করে দাও তো।
একটা লাল টুকটুকে বউ আনবে এবার। বউয়ের আঁচলে বেঁধে দিবে যাতে আর কোথায় ও না যেতে চায় ভাই ।
_____________
সকাল নয়টা কিংবা দশটার দিকে রোয়েনের জ্ঞান ফিরলো। এত ব্যাথা বেদনার শরীর নড়াতে পারলো না সে। কিন্তু বুকের উপর ভার অনুভব হওয়ায় দেখলো মাথা রেখেছে একটা মেয়ে। নড়েচড়ে উঠতেই মেয়েটি মাথা তুললো। হু হু করে কেঁদে দিয়ে ডাকল
‘ ভাই? মুননু?
একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো রোয়েন৷ তাননা ডুকরে কেঁদে উঠে বলল
‘ তুই আমাকে এত কাঁদাস কেন? আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার ভয় দেখাস কেন? আমার সাথে এমন করিস কেন? তোকে ছাড়া আমার কি হাল হবে জানিস না?
রোয়েন কথা বললো না৷ তাননা তার মাথার উপর হাত বুলালো। ব্যান্ডেজের উপরে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলল
‘ তুই কথা বলছিস না কেন? আমাকে কাঁদতে দেখলে খুশি লাগে না?
রোয়েনের ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা দেখা দিল একটুখানি। তাননা বলল
‘ সুস্থ হ। এমন মাইর দিব?
রোয়েন আবার ও হাসলো। হাতটা নাড়ালো কোনোমতে। একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো বোনকে। বলল
‘ আমি সুস্থ হই আগে। এত কাঁদিস কেন সেটার জন্য মাইর চলবে।
তাননা কাঁদলো। খুশির কান্না।
রোয়েন চোখ ফিরালো দরজার কাছাকাছি। একে একে আসলো সবাই। জাহেদা আর সালেহা বেগম দোয়াদরুদ পড়ে ফু দিয়ে গেল। আদর করে গেল। সোরা, আনহা, নাহিল আর জায়িদ এসে বেশ খানিক্ষন কথা বলে গেল। এই মানুষগুলোর চোখেমুখে এতটা হাসি তাকে ফিরতে দেখে। অথচ সে কিনা তাদের রেখে চলে যাচ্ছিল? থেকে যাওয়ার জন্য কি এই একটা কারণ যথেষ্ট নয়? আর কি চায়?
সপ্তাহ খানেক পরই হসপিটাল থেকে রিলিজ দেওয়া হলো রোয়েনকে। পিঠের ক্ষত পুরোপুরি শুকোয়নি। তবে শীঘ্রই রিকোভার করবে৷ সে বাড়ি ফিরায় বাড়িটা যেন প্রাণ পেল নতুন করে। বাড়িতে পা রাখার পর পরই রোয়েন তাকালো সবার দিকে। প্রত্যেকটা আপনজনের দিকে। কত খুশি তারা!
তবে এই দেয়াল ওই দেয়াল ভেদ করলেও কেউ একজনের সামান্য অবয়ব ও দেখা গেল না। আশ্চর্য হলো না রোয়েন। তবে কোথাও একটা খুব করে পুড়লো যেন। আর সেই পোড়া পোড়া গন্ধে যেন ছেয়ে গেল পুরো শহর।
চলবে,,#ধ্রুবতারা
#পর্ব_২৪
#পুষ্পিতা_প্রিমা
আদিম যুগের মানুষের মতো বসবাস সেন্টিনেল অধিবাসীদের। প্রয়োজনীয় স্থান ঢাকা ছাড়া প্রায় নগ্ন অবস্থায় থাকে তারা। বর্শা ছুঁড়ে শিকার করে তারা। তীরের ফলা ছুঁড়ে শিকার করে পশু, পাখি। এই নিষিদ্ধ দ্বীপে ভ্রমণ তো দূরে থাক এই দ্বীপের কাছাকাছি কোনো ট্রলার কিংবা জাহাজ দেখা গেলে ও সেন্টিনেলরা তীর ছুঁড়তে থাকে। তারা তাদের ইচ্ছেমতো থাকতে চায়। সাধারণ মানুষের হস্তক্ষেপ তাদের যেন রুচিতে বাঁধে। কিন্তু এত বিশাল একটা বিমান পড়লো তাদের দ্বীপে সেন্টিনেলদের কোনো হুশ নেই? ব্যাপারখানা বুঝে উঠতে পারলো না বাংলাদেশ থেকে সুইজারল্যান্ডে ফিরে যাওয়া ক্ষুদে সাইনটিস্ট ডিকাডো। তবে যখন ব্যাপারটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো বুঝতে পারলো তাদের বিমানটি এসে পড়েছে সেন্টিনেল দ্বীপের পরিত্যক্ত জায়গায়। বলা হয় এই জায়গাটাকে ওরা ওদের সৃষ্টিকর্তার শত্রুর উৎপত্তি স্থল মনে করে কোনো একটা কারণে। যার কারণে জায়গাটার আশেপাশে কোনো বসতি গড়ে উঠেনি। কোনো প্রকার মানুষের বসবাস নেই।
বাংলাদেশের কোন একটা বিশেষ প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য ডিকাডোদের একটা টিম এসেছিল। সেখানে ছিল দুইজন ডক্টর, একজন সাইনটিস্ট, দুইজন রাইটার, কয়েকজন বিজনসে ম্যান এন্ড ওমেন । দেশে ফেরার সময় এমন দুর্দশা হবে কে জানতো?
একজন রাইটার মৃত্যুর সাথে লড়ছে। বিমানের ঝাঁকুনিতে আর ত্যাড়ছাভাবে পড়ায় সবার সিটবেল্ট খুলে গিয়ে মারাত্মক ভাবে সামনের দিকে ঝুঁকে আহত হয়েছে সবাই। কারো মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত প্রবাহিত হওয়ায় সাথে সাথেই মারা গিয়েছে। তবে যাদের ভাগ্য ভালো তারা একদমই আহত হয়নি। বিমানে যা খাবার মজুদ ছিল তা ফুরিয়ে আসছে। আহতদের চিকিৎসা সরঞ্জাম ও নেই। ফলে তাদের অবস্থা মারাত্মক হচ্ছে। এমতাবস্থায় কোনো সংস্থার সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার রাস্তা বন্ধ। নেটওয়ার্ক নেই। তবে সাইনটিস্ট ডিকাডো আশ্বাস দিল টেলিযোগাযোগ করা যাবে। তাও দুই তিনদিন অপেক্ষা করতে হবে কারণ তিনি ক্যাবল আর ভাঙা নষ্ট যন্ত্রাংশ দিয়ে যে যন্ত্রটি বানাতে যাচ্ছেন সেটি দিয়ে নেটওয়ার্কের দেশের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করা যাবে। পরে তাদের রক্ষা করার জন্য হেলিকপ্টার পাঠাতে পারবে।
তখন রাত। কয়েকদিন ধরে আশেপাশে সেন্টিনেলদের দেখা যাচ্ছে। তারা অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ করে ঘুরে বেড়ায়। শিকার করে। তাদের নিজস্ব ভাষা সেন্টিনেল ভাষা। সবাই বিমানে উঠে বসলো সতর্ক হয়ে। সব ডোর বন্ধ করে দিয়ে ভেতর থেকে দেখতে লাগলো সেন্টিনেল অধিবাসীদের কর্মকাণ্ড। তখনই গোঁ গোঁ শব্দ ভেসে এল ভেতরের একটি জায়গা থেকে। মার্কো দৌড়ে গেল। একজন বাংলাদেশী আবার বমি করছে। তিনি সামলে নিলেন দ্রুত। জঙ্গলে পাওয়া একপ্রকার টকজাতীয় সুগন্ধি পাতা কচলে নাকের কাছে ধরলো। ছেলেটির বমি বন্ধ হয়ে এল। পেটে বেশি কিছু না থাকায় তেঁতো পানি বের হলো। ক্ষতস্থানে লাগানো সবুজ পাতার রস লেগে আছে। চোখমেলে নিজেকে একই শার্টে দেখে নাকমুখ কুঁচকে হেলে পড়ে রইলো রোয়েন। বলল
‘ আমি শাওয়ার নিতে চাই মিঃ মার্কো।
মধ্যবয়স্ক মার্কো হাত বুলালো রোয়েনের মাথায়। বলল
‘ নো প্রবলেম বিউটিফুল চাইল্ড। এখানে শাওয়ার নিতে পারবে। তবে পানি একটু কম খরচ করো। যা আছে তা দিয়ে আমাদের কোনোমতে তিনচারদিন পার করতে হবে। যতদিন না আমাদের উদ্ধার করতে আসছে। রোয়েন বলল
‘ ওকে। আমাকে কি ওয়াশরুম অব্ধি পৌঁছে দিতে পারবেন?
মিঃ মার্কো সমর্থন জানালো। এলিজা এসে মার্কোকে ডাকলো
‘ ডক্টর মার্কো সেন্টিনেলরা বিমানের দিকে অগ্নিবর্শা ছুঁড়ছে। তারা বুঝে গিয়েছে এখানে মানুষ আছে।
রোয়েন বলল
‘ কেন? ওরা কি জানেনা আমরা আঘাত পেতে পারি এতে?
মার্কো বলল
‘ ইয়োর নেম প্লিজ।
‘ রোয়েন। রোয়েন আহম্মেদ।
মার্কো বলল,
‘ ইয়েসে রোয়াইন। সেন্টিনেলরা স্বাভাবিক নয়। ওরা আমাদের মতো মানুষদের পছন্দ করে না। ওরা ওদের রাজ্যে কারো আগমন পছন্দ করে না।
রোয়েন সবটা শুনলো। পরক্ষণেই নিজের অসুস্থ টলমলে শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এলিজা বলল
‘ নিঃ আহামাদ আর ইউ ওকেই? কোথায় যেতে চাও?
রোয়েন বলল
‘ আ’ম ওকে। আমাকে কি আমার ফোনটা দেওয়া যাবে?
এলিজা রোয়েনের ফোনটা নিয়ে আসলো। রোয়েন বিমানের জানালা ভাঙা অংশে চোখ রাখলো। দেখলো অর্ধ নগ্ন মানুষরূপী সেন্টিনেল তীর ছুঁড়ছে অনবরত। এভাবে চলতে থাকলে কিছুক্ষণের ভস্ম হয়ে যাবে পুরো বিমান। রোয়েন অদ্ভুত শব্দগুলো মনযোগ দিয়ে শুনলো। ফোনের রেকর্ডার অন করে রেকর্ড করলো শব্দগুলো। বিজ্ঞানী ডিকাডো এসে বলল
‘ কি করছেন ডক্টর আহামাদ?
রোয়েন বলল
‘ হাই বলিউম সাউন্ড সিস্টেম আছে আপনার কাছে?
ডিকাডো মাথা নাড়িয়ে বলল
‘ ইয়েস। ওয়েট করো। আমি আনছি।
রোয়েন মাথা নাড়ালো। ফোন দিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে নিল সাথে।
ডিকাডো এসে একটা কালো বক্স জাতীয় কিছু ধরিয়ে দিয়ে বলল
‘ নাও রোয়াইন আহামাদ।
রোয়েন নিল। রেকর্ড করা সাউন্ড,, বক্সে দিয়ে বলিউম হাই করে দিল। সেন্টিনেলদের করা সেই ধ্বনি আবার পুনরায় বেজে উঠলো সাথে সাথে। সবাই ভাঙা অংশ দিয়ে দেখতে লাগলো সেন্টিনেলদের প্রতিক্রিয়া। সবাই বুঝে উঠতে পারলো না রোয়েন কি করতে চলেছে।
তবে মিনিট পার হতেই সেন্টিনেলরা দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়লো যেন। এদিকওদিক তাকাতে লাগলো শুধু। হয়তো ভাবছে তাদের মতো করে কথা কে বলছে? তা ও এত আওয়াজ করে? মনের মধ্যে ভয় কাজ করলো তাদের। শয়তানের ডাক বোধহয় এমন হয়? পরিত্যক্ত জায়গা থেকে হঠাৎ এমন শব্দ ভেসে আসায় বর্শা ফেলে পালালো সেন্টিনেল অধিবাসীরা। সবাই রোয়েনের বুদ্ধির প্রশংসা করলো। রোয়েন ফ্রেশ হতে চলে গেল।
ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো সবাই বাইরে আগুন জ্বালিয়ে বসেছে। কনকনে ঠান্ডা চারপাশে। যারা আহত তাদের কেউ কেউ রোয়েনকে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করলো। বাঁচার স্বপ্ন দেখতে লাগলো। আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। ক্ষতস্থানে পানি লাগায় জ্বালা শুরু হলো রোয়েনের। মিঃ মার্কো রোয়েনকে দেখে দৌড়ে আসলেন। আগুনের কাছে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলেন একটি বিরাট পাতার উপরে। ছোটখাটো রুমালে আগুনের আভা লাগিয়ে লাগিয়ে দিতে লাগলো ক্ষতস্থানের আশেপাশে। হাতের বাহু, কপালে। রোয়েনের এতে আরাম বোধ হতে লাগলো। হঠাৎ মামা আর বাবাইয়ের কথা মনে পড়লো। মনে পড়লো বোনটার কথা। মনে পড়লো মামুনি, ফুপী আর নানু দাদুর কথা। তখন সবেমাত্র কলেজে উঠেছে। টাইফয়েড জ্বরে মারাত্মক ভাবে অসুস্থ হয়ে সে ভর্তি হয়েছিল হসপিটালে। সে কি বাজে অবস্থা সবার? তাননা তো নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়ে ভাইয়ের সাথে সাথে। কি পাগল মানুষ গুলো? আরেহ রোয়েন কি এত সহজে হার মেনে নেওয়ার ছেলে? বোনটাকে রেখে সে কোথা ও যাবে নাকি? উপরওয়ালা স্বয়ং রাখিবন্ধনের জোর শক্ত করে বেঁধে দিয়েছেন সেখানে এই সামান্য দুর্ঘটনা তো কিছুই না।
আগুনের পাশে বসে থাকতে থাকতে রোয়েনের চোখ গেল দূরে। একজন পুরুষ একটি মহিলার গায়ে শাল জড়িয়ে দিচ্ছে।
রোয়েন চোখ সরিয়ে নিল। এলিজা এসে পাশে বসলো। হাসিমুখে বলল
‘ হেইই জেন্টলম্যান। আর ইউ ম্যারিড?
রোয়েন ভুরু কুঁচকে এলিজার দিকে তাকালো। লাল সাদা মেশালো চুলের বাহার। গায়ে রঙ ধবধবে সাদা। গলার হাড় ভেসে উঠেছে কয়েকটা। গলার হাড় ভেসে তোলাটা কি ফ্যাশন নাকি মেয়েদের? রাহার ও একি অবস্থা? এর ও? আশ্চর্য?
রোয়েন থেমে থেমে জবাব দিল।
‘ ইয়াহ। ম্যারিড।
এলিজা গাল এলিয়ে হাসলো। বলল
‘ আমি ও। তোমার ওয়াইফের ছবি আছে? দেখাও।
রোয়েন বলল
‘ সরি। ফোনে চার্জ নেই।
এলিজার হাসি চলে গেল। রোয়েন বলল
‘ সুযোগ পেলে দেখাবো৷ ওকে?
এলিজা হাসি ফিরিয়ে এনে বলল
‘ ওকে ডক্টর আহামাদ ।
ডিকাডো এল তখুনি। হাঁপানো অবস্থায়। হাতে একটি বর্শা, সেন্টিনেলদের ফেলে যাওয়া। অন্য হাতে একটি মরা পাখি৷ সাদা পালক। সে নাকি সেটি আগুনে ছেঁকে খাবে। রোয়েন বলল
‘ এভাবে কি কেউ খায় নাকি?
ডিকাডো হাসিমুখে বলল
‘ ইয়াং ম্যান তুমি জাস্ট দেখো। তোমার ও খেতে মন চাইবে।
রোয়েন সরে পড়লো দ্রুত। অমৃত বললে ও তো সে খাবেনা। ইয়াকক।
রোয়েন দূরে দাঁড়িয়ে দেখলো ডিকাডো কিভাবে পাখিটার পালক ছাড়িয়ে ধুঁয়ে আগুনে ঝলসে ফেললো। তারপর ইয়াম্মি ইয়াম্মি বলে বলে তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে খেল। রোয়েনকে বলল
‘ দেখলে তুমি তো খেতেই চাওনা। খেতে পারলে না।
রোয়েন মনে মনে বলল
‘ ওহ আল্লাহ এসব খাওয়ার আগে তুমি আমার মৃত্যু দিও।
_________
ডিকাডোর বানানো যন্ত্রটা কাজে লাগলো প্রায় চারদিনের মাথায়। এটি একটি নেটওয়ার্ক রাউটার হিসেবে কাজ করবে। শুধুমাত্র একটি ডিভাইসে কাজ করবে। ডিকাডো তার ফোন ব্যবহার করে বার্তা পাঠালো বাংলাদেশ বিমানবন্দরে। বিমানবন্দর থেকে শীঘ্রই হেলিকপ্টার এসে পড়ছে। হেলিকপ্টারের ঘুূর্ণায়মান পাখার বাতাস সেন্টিনেল দ্বীপে পড়ায় দলে দলে সেন্টিনেল অধিবাসী এসে পড়লো বর্শা হাতে। হেলিকপ্টার থেকে পড়া শুকনো খাবার, পানির বোতল, জামাকাপড়, নানা ধরণের মেডিসিন নিতে পারলো মার্কো আর ডিকাডো। সেন্টিনেলদের বর্শার আঘাতে হেলিকপ্টার টিকে থাকতে পারলো না বেশিক্ষণ। ল্যান্ড করার ভাবতে ও পারছেনা। তা দিয়ে চললো আর প্রায় সপ্তাহ খানেক। হেলিকপ্টার কোনোভাবেই ল্যান্ড করতে পারছেনা। আবার ল্যান্ড করলে তারা বুঝে যাবে ধসে পড়া বিমানের ভেতর মানুষ আছে। আক্রমণ চালাবে তারা। তাই ঝুঁকি নিল না কেউ। তবে রোয়েন ভাবলো এভাবে চলতে পারেনা। আর কতদিন এভাবে এখানে পড়ে থাকবে তারা? ফেরা দরকার।
তাই এক সন্ধ্যার দিকে দলসহ সবাই বেরিয়ে পড়লো জঙ্গলে। সেন্টিনেলদের ফেলে যাওয়া বেশ কয়েকটা বর্শা ফেল তারা। সেগুলো দিয়ে শিকার করলো বেশ হরেক রকম পাখি। মস্ত বড় একটি হরিণ শিকার করে বসলো মার্কো। কি খুশি!
রোয়েনের খারাপ লাগলো। কিন্তু কি আর করার?
সেন্টিনেল অধিবাসীদের এভাবে বশ করতে হবে। হেলিকপ্টার যেকোনো ভাবে ল্যান্ড করতে হবে নাহলে ফেরা যাবেনা। মোক্ষম সুযোগ এল তার ভোররাতে। ছোটখাটো একটি হেলিকপ্টারকে দেখা গেল কয়েকবার মাথার উপরে ঘুরঘুর করতে। বেশ উপরে আছে। ডিকাডো যোগাযোগ করে জানতে পারলো হেলিকপ্টারটি ল্যান্ড করার সুযোগ খুঁজছে। রোয়েনা বুদ্ধি আঁটলো। মরা হরিণ আর পাখিগুলোকে তারা ঝুলিয়ে দিল একটি কাটা গাছের সাথে। বহুকষ্টে ঝুলাতে সক্ষম হলো। গাছটির মোটা ডাল। তার উপর বাঁকা হয়ে শুয়ে থাকায় হরিণটিকে ঝুলাতে বেশি অসুবিধা হলো না। পরপরই যখন হেলিকপ্টার ল্যান্ড করলো তখন দলেদলে সেন্টিনেল সৈন্যরা ছুটে এল। সবাই মানুষ দেখে হিংস্র পশুর মতো ছুটে আসতে লাগলো। রোয়েন সাউন্ড জোরে ছেড়ে দিল তারপর ঢিল ছুঁড়লো ঝুলিয়ে রাখা হরিণটির দিকে। সবাই শব্দ আর এভাবে তরতাজা হরিণ আর পাখি দেখে দিশেহারা হয়ে পড়লো কি করব কি করব বুঝে উঠতে না উঠতে রোয়েন একে একে সবাই উঠে যেতে বলল হেলিকপ্টারে। সবাই একে একে উঠে পড়লো। শেষমেশ হেলিকপ্টারের পাখা ঘুরতে শুরু করলো আবার। সেন্টিনেলদের হুশ ফিরলো
সবাই ডাক দিল রোয়েনকে। ডিকাডোকে উঠতে সাহায্য করার সময় ডিকাডোর পিঠে এসে তীর বিঁধলো। রক্ত ছিটকে এসে পড়লো রোয়েনের মুখে। রোয়েনে ডিকাডোকে তুলে দিয়ে কোনোমতে নিজে উঠতে না উঠতেই আর ও একটও তীর এসে বিঁধলো তার পিঠে। মার্কো প্যারাসুটে কর নেমে এসে তুলে নিল রোয়েনকে। গলগল করে রক্তের স্রোত বইছে। রোয়েন চোখবন্ধ করে নিল। ডিকাডোর চোখ দিয়ে জলের প্রবাহ। কাঁপা-কাঁপা গলায় সে আওড়ালো
‘ গড সেভ মাই লাইফ। ওহ গড সেভ মাই লাইফ।
মার্কো আর বাকিরা দিশেহারা। তীর বিষ থাকে। বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে বাঁচানো যাবে না ওদের। হেলিকপ্টার যাত্রা করলো বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে।
সারাদেশে টিভির সামনে বসে বাংলাদেশের উদ্দেশ্য আসা হেলিকপ্টারটিকে দেখছে জনগণ। এ যেন বিস্ময়কর কিছু! কি হবে এরপর? দুজন তীরের আঘাতে বিদ্ধ হয়েছেন৷ একজন বিদেশি অন্যজন বাংলাদেশী। সেই বিমানের ভেতর থেকে পাঠানো ছবি দুটো আবছা,আবছা দেখালো নিউজে।
টিভির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সোফায় বসে রইলো তাননা। চোখের জলে ঈশানের শার্টের একপাশ ইতোমধ্যে ভিজে উঠেছে। চিৎকার করে কেঁদে উঠতে পারছেনা সে। ঈশান শক্ত করে ধরে রেখে বলল
‘ জিন্নাত আমাকে তো যেতে হবে এয়ারপোর্টে। আপনি এরকম করলে তো কিচ্ছু হবে না। দেখুন রোয়েন হয়ত ফিরছে আপনারই জন্য। এবার দোয়া করুন যাতে কিচ্ছু না হয় ওর।
তাননা ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিল আবার। জায়িদ এসে ধরলো তাননাকে। বলল
‘ তুমি যাও ঈশান। আমরা তাননাকে নিয়ে যাচ্ছি।
ঈশান পা বাড়াতেই তাননার গলার আওয়াজ ভেসে আসলো।
‘ আমার ভাইকে নিয়ে ফিরে আসবেন। আমার ভাই ছাড়া ফিরবেন না।
ঈশান চলে গেল। নাহিল ও বেরিয়ে পড়লো দ্রুত। জায়িদ তাননাকে বলল
‘ দেখো তোমার বাচ্চা কাঁদছে। এরকম কেউ করে? আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে আমাদের মুননা বেঁচে আছে।
তাননা কেঁদে উঠে বলল
‘ ওর পিঠে তীর লেগেছে। ও আবার চলে যাবে। নাহ নাহ এ হয়না। আমার ভাই। আল্লাহ কেন এত কষ্ট দিচ্ছে ওকে? কেন এত পরীক্ষা নিচ্ছে?
জায়িদ তাননাকে ধরে রাখলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বিলি কেটে বলল
‘ আম্মা আব্বাকে হারিয়ে যারা বুকে পাথর জমিয়ে বড় হয় তাদের জীবনটাই তো একটা যুদ্ধক্ষেত্র মা । আমরা হারতে শিখায়নি তাননা মুননাকে। তাননার জন্য মুননাকে ফিরতে হবে। মুননা ফিরবে।
এয়ারপোর্টে পৌঁছে হসপিটালে শিফট করাতেই ডিকাডোর মৃত্যু হলো। মার্কো আর এলিজা পাগলের মতো হন্য হয়ে দৌড়ে গেল রোয়েনের অপারেশন থিয়েটারের কাছে। ঈশান আর নাহিল আসলো মাত্রই। ডিকাডোর মৃত্যুর খবর শুনে বুক কেঁপে উঠলো তাদের। মার্কো কপাল চাপড়ে বললো
‘ নো নো ইয়াং বয়, তোমাকে আমি অনেক সেবাযত্ন করে সুস্থ করেছি৷ তুমি এখন আবার চলো যেতে পারোনা।
রোয়েনের অপারেশন হলো। বিষে ছেয়ে গিয়েছিল তার শরীর। ডিকাডোর শরীরে বিষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণে মৃত্যু হয়েছে। রোয়েনের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ছুটায় বিষ স্থায়ী হতে পারেনি। তাই বেঁচে গেল এই যাত্রায়।
পুরো পরিবার ছুটে আসলো হসপিটালে। জাহেদা আর সালেহা বেগম ও বাদ যায়নি। তাননা তো পাগলের মতো হন্য হয়ে এল। ততক্ষণে রোয়েনের জ্ঞান ফিরেনি। তার শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রচুর। রক্ত যোগাড় করতে গিয়েছিল জায়িদ আর নাহিল। ততক্ষণে ডাক্তাররা জানিয়ে দিয়েছে রক্ত যোগাড় হয়ে গেছে। সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। জাহেদা আর সালেহা বেগম উপরওয়ালার দরবারে শুকরিয়া জানালো। তাদের ভাইকে আল্লাহ ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন অপেক্ষা ভাই কবে চোখ খুলবে, কবে দাদু ডাকবে? কবে নানু ডাকবে? কবে আগের মতো রাগ দেখাবে? বকাঝকা করবে। তাদের হাত দুটো নিয়ে মাথায় ছুঁয়ে বলবে
‘ একটু বেশি করো দোয়া করে দাও তো।
একটা লাল টুকটুকে বউ আনবে এবার। বউয়ের আঁচলে বেঁধে দিবে যাতে আর কোথায় ও না যেতে চায় ভাই ।
_____________
সকাল নয়টা কিংবা দশটার দিকে রোয়েনের জ্ঞান ফিরলো। এত ব্যাথা বেদনার শরীর নড়াতে পারলো না সে। কিন্তু বুকের উপর ভার অনুভব হওয়ায় দেখলো মাথা রেখেছে একটা মেয়ে। নড়েচড়ে উঠতেই মেয়েটি মাথা তুললো। হু হু করে কেঁদে দিয়ে ডাকল
‘ ভাই? মুননু?
একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো রোয়েন৷ তাননা ডুকরে কেঁদে উঠে বলল
‘ তুই আমাকে এত কাঁদাস কেন? আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার ভয় দেখাস কেন? আমার সাথে এমন করিস কেন? তোকে ছাড়া আমার কি হাল হবে জানিস না?
রোয়েন কথা বললো না৷ তাননা তার মাথার উপর হাত বুলালো। ব্যান্ডেজের উপরে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলল
‘ তুই কথা বলছিস না কেন? আমাকে কাঁদতে দেখলে খুশি লাগে না?
রোয়েনের ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা দেখা দিল একটুখানি। তাননা বলল
‘ সুস্থ হ। এমন মাইর দিব?
রোয়েন আবার ও হাসলো। হাতটা নাড়ালো কোনোমতে। একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো বোনকে। বলল
‘ আমি সুস্থ হই আগে। এত কাঁদিস কেন সেটার জন্য মাইর চলবে।
তাননা কাঁদলো। খুশির কান্না।
রোয়েন চোখ ফিরালো দরজার কাছাকাছি। একে একে আসলো সবাই। জাহেদা আর সালেহা বেগম দোয়াদরুদ পড়ে ফু দিয়ে গেল। আদর করে গেল। সোরা, আনহা, নাহিল আর জায়িদ এসে বেশ খানিক্ষন কথা বলে গেল। এই মানুষগুলোর চোখেমুখে এতটা হাসি তাকে ফিরতে দেখে। অথচ সে কিনা তাদের রেখে চলে যাচ্ছিল? থেকে যাওয়ার জন্য কি এই একটা কারণ যথেষ্ট নয়? আর কি চায়?
সপ্তাহ খানেক পরই হসপিটাল থেকে রিলিজ দেওয়া হলো রোয়েনকে। পিঠের ক্ষত পুরোপুরি শুকোয়নি। তবে শীঘ্রই রিকোভার করবে৷ সে বাড়ি ফিরায় বাড়িটা যেন প্রাণ পেল নতুন করে। বাড়িতে পা রাখার পর পরই রোয়েন তাকালো সবার দিকে। প্রত্যেকটা আপনজনের দিকে। কত খুশি তারা!
তবে এই দেয়াল ওই দেয়াল ভেদ করলেও কেউ একজনের সামান্য অবয়ব ও দেখা গেল না। আশ্চর্য হলো না রোয়েন। তবে কোথাও একটা খুব করে পুড়লো যেন। আর সেই পোড়া পোড়া গন্ধে যেন ছেয়ে গেল পুরো শহর।
চলবে,,p