মন_গহীনের_গল্প পর্ব ৪০ রূবাইবা_মেহউইশ

মন_গহীনের_গল্প
পর্ব ৪০
রূবাইবা_মেহউইশ
💞
দরজা,জানালা এমনকি বেলকোনির দরজাটাও লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ঘরের। যতটুকু অক্সিজেন আর কার্বনডাইঅক্সাইড আসা যাওয়া করছে তা বোধহয় ওই দেওয়ালের উপর ঘুলঘুলির ফাঁক বেয়েই৷রাতের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে বিনিদ্র কোন প্রাণী কি আছে কক্সবাজারের বালুভূমিতে! মেহউইশ মৃদু আলোতেই আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ । তার দৃষ্টি সামনে থাকলেও সে দেখতে পাচ্ছে না কিছুই। চোখের পাতা অনড় আর ঝাপসা। ঝপাৎ ঝপাৎ পানি ছিটিয়ে মুখ,হাত,পা ধুয়ে তবেই বাথরুম থেকে বের হলো রিশাদ। হাসির দমকে সোজা দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছিলো না একটু আগেও৷ কি বোকা মেয়ে সেই সকালে ব্রাশ না করে চা খেয়েছিলো। ধরেই নিয়েছে রিশাদ আর দাঁতই মাজেনি। দুপুরেই তো গোসলের আগে সে ব্রাশ করেছে,শেভ করেছে তারপরই গোসল। বাথরুম ছেড়ে বেরিয়েই সে মুখ হাত মুছে বিছানায় বসলো। তখনো মেহউইশ আয়নার সামনে তবে এখন আর অন্যমনস্ক নেই। হাতের চুড়ির ঝনাৎ ঝনাৎ শব্দ তুলে হাত নাচিয়ে লোশন মাখছে৷ রিশাদের একবার মনে হলো বলে, এত শব্দ করলে ছেলেটা উঠে যাবে। পরক্ষণেই মনে হলো থাক, আজ নির্জনও জানুক তার আধ পাগল মা এই মাঝরাতে কেমন পাগলামি করছে৷ মেহউইশের মনের খবর রিশাদের অনেক আগেই পড়া হয়ে গিয়েছে তবুও সে আগ বাড়িয়ে ধরা দেয়নি।ইচ্ছে হয়নি তা নয়, বরং তীব্র আকাঙ্ক্ষা জেগেছিলো ঝড় বাদলের রাত গুলোতে বুকের কাছে জড়িয়ে রাখতে তাকে৷ মনের মধ্যে শুঁয়োপোকারা কুটকুট করে কামড়ে ধরে উত্যক্ত করতো মেহউইশকে ছুঁয়ে দেখতে৷ ঘুম ভাঙানিয়া পাখিরাও পাহাড়ি বাড়িতে যন্ত্রণা দিতো মেহউইশের কাছে ক্ষমা চাইতে। কোনটাই করা হয়নি রিশাদের এ পর্যন্ত৷ সুযোগ এসেও আসেনি কখনও মন খুলে কথা বলার। স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর মতো আচরণ তারা লোক সম্মুখে অনেক আগে থেকেই করছে কিন্তু কখনও আড়ালে তাদের ভাব হয়নি। আজকে মেহউইশের আচরণ অন্যরকম। সন্ধ্যেবেলায় মেহউইশ যে নাক ফুলিয়ে, গাল ফুলিয়ে কেঁদেছে খুব তা রিশাদ বুঝতে পেরেছে।

‘নির্জন কে ঘুমানোর আগে খাইয়েছিলে কিছু? সন্ধ্যায় তো কিছুই খায় নি।’

-‘ আপনার কি মনে হয়! ‘

-‘সোজা করে বললেই হয় খাইয়েছো।’

-‘না, আমি সোজা কথা বলতে পারি না।’

-‘কবে থেকে?’

-‘যবে থেকে আপনি এসেছেন আমার জীবনে’ কথাটা বলেই চোখ মুখ বন্ধ করে জ্বীভে কামড় বসালো। কথাটা এভাবে না বললেও হতো।হঠাৎ করেই ঘরের আবহাওয়াটা ভারী হয়ে গেল। মেহউইশ যে কথাটা বাজে ইঙ্গিত করে বলেনি তা যেন রিশাদ বুঝে গেল। সে কথা ঘোরাতেই ফটাফট বিছানা ছেড়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ ঘরে কি কিছু খাওয়ার মত আছে?’

-ইয়ে মানে, আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইলো মেহউইশ, রিশাদ তাকে থামিয়ে দিলো।

-‘আচ্ছা আমি রেস্টুরেন্টে দেখছি। তুমি কিছু খেলে বোলো।’

‘শুনুন’ রিশাদ দরজা খুলতেই ডেকে উঠলো মেহউইশ । মাথা নত করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সে রিশাদের দিকে। কন্ঠস্বরও ভারী হয়ে এসেছে তার। ধরা গলায় আবার বলল, ‘ আমি অন্যকিছু মিন করে বলিনি কথাটা শুধু মজা করে’ থেমে গেল মেহউইশ। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই রিশাদ দরজা আবার লাগিয়ে ফিরে এসেছে তার কাছে। মুখোমুখি, চোখাচোখি হলো দুজনের। অল্প আলোয় অস্পষ্ট দেখছে দুজন দুজনকে। ঘরময় নিস্তব্ধতার রেখায় আচর কাটছে দুজনের নিঃশ্বাস। পা থেকে মাথা পর্যন্ত মন ভরে দেখার ব্যর্থ চেষ্টা রিশাদের। নিজের একটা হাত সামনে তুলে ধরে ইশারা করলো। আধো আলোয় ইশারাটুকু বিফলে গেল না। নিঃশব্দে মেহউইশ হাত বাড়িয়ে ধরে নিলো রিশাদের বাড়িয়ে দেওয়া হাত। হাতে হাত রেখেই দুজন এগিয়ে গেল বেলকোনিতে। কাঁচের স্লাইডিং ডোর খুলতেই এক দমকা হাওয়া ছিটকে দুজনের চোখেমুখে। বেলকোনির সবগুলো কাঁচ লাগানো নেই বলেই হয়তো মধ্যরাতের বাতাসের গর্জন কানে এসে তালা লাগিয়ে দিলো। রিশাদ গ্রিলের সামনের পর্দা সরিয়ে কাঁচ লাগালো৷ দেয়াল হাতড়ে বাতি জ্বালালো আর মেহউইশ এগিয়ে পর্দা টানলো। এখন আর বেলকোনিটাকে আগের মত লাগছে না। রূপ বদলেছে তার। বেলকোনিটাকে এখন ডিম্বাকৃতি একটা ঘরই মনে হচ্ছে । রিশাদ মনে মনে প্রস্তুতি নিলো, এই তো সময় ক্ষমা চাওয়া নিভৃতে মনের সকল কথা বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে দেওয়ার। ভুল শুধরে মেহউইশকে আপন করে একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার অনুমতি নিতে এখনই সময়।

আলোয় আলোয় পূর্ণ হয়ে উঠেছে বেলকোনি রূপী কক্ষটা। মেহউইশের চোখের কাজল,ঠোঁটের লিপস্টিক, কানের দুল এমনকি গলায় থাকা পাতলা চিকন চেইনটাও ঝকমকিয়ে চোখ ধাঁধালো রিশাদের। চোখ বুঁজে গুছিয়ে নেওয়া কথাগুলো নিঃসীম প্রায় তাকে ছেড়ে পালিয়ে গেল বহুদূরে। ফ্লোরে পাতা ম্যাট্রেসের উপর আলতো করে বসে পড়লো মেহউইশ যেন সে বসতে গেলেই ফ্লোর কাঁপবে, ধূলো উড়বে! মুখোমুখি রিশাদ যেন বলতে চায় হাজারো কথা অথচ তার চোখ বলছে চুপিসারে সময় যাক স্রোতের মত।হাতের তালুতে হাত মিলিয়ে কাছে টেনে আনলো মেহউইশকে। গুছিয়ে রাখা কথারা নেই আর ধারেকাছে, গুছিয়ে রাখা কল্পনাটা ঠিকই আছে মস্তিষ্কে।

-‘আমি কিছু বলতে চেয়েছিলাম তোমায়’ রিশাদের গলার স্বর নিজের কাছেই অচেনা ঠেকলো। মেহউইশ কিছু বলল না শুধু চুপচাপ এগিয়ে আসলো আরও কাছে। যতোটা আসলে দেহের তপ্ততা অনুভব করা যায়। সেই তপ্তায় অজস্র প্রজাপতি উড়াউড়ি করে ফরফর শব্দ তুলছে রিশাদের কানের কাছে। খেই হারিয়ে ফেলছে সে ধীরে ধীরে। কি বলতে চেয়েছিলো তাই তো ভুলে গেছে এখন। শক্ত পুরুষালী হাতটা রিশাদের আপনাআপনিই উঠে এলো মেহউইশের গ্রীব্রাদেশ ছুঁয়ে গালের কাছে। গা শিরশিরানি উত্তেজনা মেহউইশের পাতলা দুটি ঠোঁটে কাঁপন তুলল। শাড়ির আঁচল সরে গেছে অনেকটা। আবেশে চোখ বুঁজে আছে মেহউইশ, রাতের আঁধার ঘন হোক তারই চোখের পাতায়।কত কথা বলার ছিলো তার নিজেরও । কোথায় গেল সেই কথার ঝুড়ি! স্পর্শের মত্ততায় বিভোর হয়ে কথারা আজ ছেড়ে গেছে তাদের। রিশাদের অবাধ্য হাতের নিষিদ্ধ বিচরণ মেহউইশের অষ্টাদশীতে ফেলে আসা মনটাকে আজ টেনে হিঁচড়ে তেইশে পড়া দেহের ভেতর নতুন করে বসিয়ে দিচ্ছে। ঠোঁটের কাছে ঠোঁটে এনেও থমকে গেছে রিশাদ। গভীর মনযোগে দেখতে লাগলো মেহউইশের রক্ত রঞ্জিত পেলব দুটো ঠোঁট, মেঘের ছাউনির মত ঘন পাপড়িতে ঢাকা বন্ধ দুটি চোখ, আর খাঁজ কাটা চিবুকটাকে। এত মায়াবী এতোটা গভীর এতোই মনোহারিণী রূপ কি সে এই প্রথম দেখলো! থমকে গেছে নিঃশ্বাস তার মেহউইশের এই রূপ দেখে। দম কি আছে তার নিজেকে সামলানোর!

রিশাদের থমকে যাওয়ায় চোখ খুলে নেয় মেহউইশ। চোখে চোখ রেখে বুঝতে চায় রিশাদের চোখের ভাষা। আগ বাড়িয়ে আলতো ছোঁয়ায় রিশাদের ঠোঁটে চুমু খেয়ে যেন আহ্বান জানালো রিশাদকে সে।এই আহ্বানের সুপারিশ ছিলো কাছে আসার যা রিশাদের অগ্রাহ্য করার মত সাধ্য হলো না। নিমেষেই ভুলে গিয়ে সকল ভয়,জড়তা আর নিজের করা ভুল। এই মুহূর্ত একান্তই হঠাৎ পাওয়া প্রেয়সীর লতার মত দেহখানায় নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়ার। তারপরের সময়টুকু কেটেছে তাদের প্রথমবার ভালোবাসায় দেহের খেলায়।রাত গড়িয়ে ভোর নেমেছে জগৎসংসারে মিষ্টিমধুর আদরে মেখে।

ভোর রাতে ঘুমে ঢুলুঢুলু মেহউউশ রিশাদের কানের কাছে মুখ রেখে বলল, ‘ অনেক হয়েছে এবার ছাড়ুন ঘুমাবো।’

ছাইরঙা অন্ধকারে গুমরে থাকা বেলকোনিটায় অনেক আগেই আলো নিভেছে। দুজন মানুষ আচম্বিতেই মেতে উঠেছিলো দেহের ক্ষুুধায় আদিম নেশায়। নগ্ন মেহউইশ শীতের রাতের বালাপোষের মতোই রিশাদকে জড়িয়ে নিয়েছিলো নিজের মাঝে ।

সকাল থেকেই সমুদ্র পাড়ে তানভীর চিন্তিত মুখে হাঁটছে।কালকে সে ঢাকায় ফিরবে সাথে রাইমার বন্ধুরাও। রাইমা থেকে যাবে আরো কিছুদিন তার দাদাভাইয়ের বাড়িতেই।চিন্তার কারণ তার সেটা নয় চিন্তা হলো মাস অনেক হলো মায়ের কাছে শুনেছে ইভান ভাই বিয়ে করেছে। আত্মীয়স্বজন সবাই জানতো ভাইয়া মেহউইশ নামের এক মেয়েকে ভালোবাসে আর তানভীর তো সেই মেয়েকে সামনে থেকেও দেখেছে। রাইমার ভাবী মেহউইশ তার ভাবী মেহউইশ হওয়ার কথা ছিলো। তবে কি ঘটনা সত্যি রাইমার ভাই জোর করে,,

‘ একা একা ঘুরতে বেরিয়েছো?’ রিশাদের কথায় তানভীরের ভাবনায় ছেদ ঘটল। চমকেছেও খুব আচানক কথা শুনে। খালি পায়ে তীর ঘেঁষে হাটার ছলে দূর থেকে আসা ঢেউয়ে পা ভিজিয়ে নিচ্ছে তানভীর।

‘জ্বী! না মানে সবাই এখনও ঘুমুচ্ছে। ঘুরতে এসে যদি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময় পার করবে তবে আসার কি দরকার ছিলো! তাই আমি একাই বেরিয়ে পড়েছি।’

রিশাদ খেয়াল করেছে তানভীর তাকে দেখে ভরকে গেছে। হয়তো নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতেই ওরকম ফটাফট জবাব দিচ্ছে।

‘হুম, ঘুমাতেই যদি আসা তবে বাড়িতে থেকে ঘুমানোই ভালো।পাহাড়, নদী,সমুদ্র আর জঙ্গল এদের পাশে এসে যদি গভীর ভাবে অনুভবই না করো তবে আসাটাই বৃথা। সমুদ্রের ঢেউ আর গর্জন মন আর মনের ভেতর জমে থাকা সকল ক্লেশ নিংড়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তা তুমি কি নিয়ে পড়াশোনা করছো যেন?’

শেষের কথাটা বলেই রিশাদ তানভীরের দিকে তাকালো। চলতে চলতে কথা হচ্ছিলো দুজনে হঠাৎই যেন পা থেমে গেল। রিশাদের চোখে চাইতে সাহস হয় না তার তবুও একবার চেয়ে দেখলো। রিশাদ কি কিছু আন্দাজ করেছে!

‘কেমিস্ট্রিতে অনার্স লাস্ট ইয়ার।’

– রাইমা খুব ভীতু স্বভাবের, তার ধারণা দাদাভাই শুধু তাকে শাষণই করে। সে কারণেই মন খুলে কখনো মনের সবটা আমায় বলতে পারেনি। অথচ সে জানেই না তার দাদাভাই তাকে শুধু নিজের বোন নয় সন্তানের মতোই ভালোবাসে, স্নেহ করে। তুমি শুধু সিনিয়র হিসেবেই আসোনি কালকে তা আমি আগেই জেনেছি।’

তানভীর জমে গেল নিজের জায়গায়। রিশাদ কি তাকে ওয়ার্ন করতে চায়! অর্থবিত্তের সমতা নিয়েও কি কোন কথা বলবে? সে তো রাইমাকে সত্যিই খুব ভালোবাসে । অর্থের দিকে সে রাইমাদের যোগ্য কখনোই হতে পারবে না কিন্তু সম্পর্কের দিক থেকে সে পরিপূর্ণ সুখী রাইমাকে অবশ্যই রাখতে পারবে।

‘ভাইয়া আমি, আমরা ‘ ইতস্তত করছে তানভীর তা দেখেই রিশাদই আবার বলল, ‘ পড়াশোনা করে ভালো কিছু করো ততদিনে রাইমাও নিজের পড়ালেখায় আরেকটু এগিয়ে যাক। আর হ্যাঁ আমার বোন ঠিক ততদিনই পড়বে যতদিন সে চায়।’ রিশাদের কন্ঠস্বর কঠিন আর গাম্ভীর্যের ধার অতুলনীয়। তানভীর ভয় পাবে না পাবে না করেও যেন ভয় পেল কিছুটা। তবে সে সৎ এই ভেবে আশ্বাসও দিলে নিজেকে। রিশাদের ফোন আসায় সে কথার সমাপ্তি টেনে চলে গেলো হোটেলে।

ঘুম থেকে উঠেই মেহউইশ মাইমুনার পেছন পেছন ঘুরছে সুই সুতা নিয়ে। একটু পরই তারা আবার ফিরে যাবে তাদের পাহাড়ি বাড়িতে। মাইমুনা আর মিহাদ ঢাকায় ফিরবে বলেছে এখান থেকে আজকেই তাই মেহউইশ বলছে, ‘যেতে হয় যাও আটকাবো না আগে আমার নাক ফুরিয়ে দাও।’

চলবে
( দু বার কাটাছেঁড়া করেও লেখাটাকে নিজের মনমতো করতে পারিনি।আপনাদের কেমন লাগলো আর ভুল যা আছে শুধরে দিলে উপকৃত হবো খুব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here