ধ্রুব অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ১৫

# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৫

মেহমানদের সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে আমি ধ্রুবকে খুঁজছিলাম। অনেক্ষন যাবত ওকে দেখতে পাচ্ছি না। মিস করছিলাম! দোতলার সিঁড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম রাফি ভাইয়ার সাথে নিচে নামছে। হাতের ছোট একটা ব্যাগ। আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,”এটাতে আমার ক্যামেরা আর ফোনের চার্জার আছে। তোমার কাছে রাখো।”
আমি হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা নিলাম। রাফি ভাইয়া সরে গেলেন। ধ্রুব আমার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ সীমা সুমাইয়াসহ আরো তিনচারটা মেয়ে এসে ধ্রুবকে বললো,”আপনার সাথে তো ছবি তোলা হয় নি, ভাইয়া।”
ধ্রুব অবাক হয়ে বললো,”হয় নি?” জবাবের অপেক্ষা না করে রাফি ভাইয়ার নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠলো। রাফি ভাইয়া ঘুরে ঘুরে সবার ছবি তুলছিলেন। ডাক শুনে এগিয়ে এলেন। ধ্রুব ব্যাগ থেকে ক্যামেরাটা বের করে রাফি ভাইয়ার হাতে দিয়ে বলল,”আমাদের কয়েকটা ছবি তুলে দে তো।”
মেয়েরা সবাই যার যার পজিশন নিয়ে নিলো। ধ্রুব সোজা গিয়ে মেয়েগুলোর মাঝখানে দাঁড়ালো। আমার দিকে তাকালো না পর্যন্ত! আমি ‘তোমার খবর আছে’ টাইপ দৃষ্টি নিয়ে ওর কান্ড দেখে গেলাম। রাফি ভাই আমার মুখ দেখে ধ্রুবকে খোঁচা মেরে বললো,”নিশাত আজকে তোর বারোটা বাজাবে।”

ধ্রুব বিড়বিড় করে বললো,”কঠিন জিনিস ভাই! আমি একশোটার সাথে ঘুরলেও পাত্তা দেয় না!”
তারপর সীমা সুমাইয়া ওদের দিকে তাকিয়ে খুব খুশিখুশি টাইপ মুখ করে বললো,” ওদের দাবি সবার আগে। আমি তো ওদেরই! ঠিক বলেছি না গার্লস?”

ওর কথা শুনে সবগুলো মেয়ে একসাথে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। আমি রাগে কটমট করে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। প্রতিউত্তরে ও সচরাচর যা করে আজও তাই করলো। আমার সারা গা জ্বালিয়ে বিশ্রী একটা হাসি দিলো।”

রাফি ভাই ক্লিক করার আগে ধ্রুব ক্যামেরার ব্যাগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আবার চলে গেলো। আমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছু বলতেও পারছিলাম না সহ্য করতে পারছিলাম না। ক্যামেরা দিয়ে ওর মুন্ডুটা ফাটিয়ে দিতে মন চাইছিলো!

ছবি তোলা শেষে ধ্রুব রাফি ভাইকে নিয়ে চলে গেলো। ওরা চলে যেতেই মেয়েগুলো ধ্রুবকে নিয়ে একে অন্যের সাথে হাসাহাসি শুরু করে দিলো। আমি জানি আমার কথাটা হয়ত সম্পূর্ণ হাস্যকর এবং ভিত্তিহীন শোনাবে কিন্তু তবুও কোথাও না কোথাও যেন কিঞ্চিৎ ঈর্ষাবোধ করছিলাম! মেহমানদের পাশ থেকে সরে ধ্রুবকে মেসেজ করলাম,”এক্ষুনি আমার সাথে দেখা করো!”

মিনিটপাঁচেক অপেক্ষা করার পর ধ্রুব এলো। হাতের ছোট একটা কোকের বোতল। আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কোক খেতে খেতে বললো,”তোমার চেহারার এমন বারোটা বেজে আছে কেন?”

আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,”এখন তো আমার চেহারায় তুমি বারোটা, বারো দুগুণে চব্বিশটা, চব্বিশদুগুণে আটচল্লিশটা আরো কতকিছু দেখবে!এটাই স্বাভাবিক। তুমি তো এখন সার্বজনীন হয়ে গেছো!”

ধ্রুব খাওয়া থামিয়ে আমার দিকে চোখবড় বড় করে চেয়ে থেকে বললো,”কি হয়েছে তোমার? ”

আমি জ্বালাভরা কন্ঠে বললাম,”আমার কি হয়েছে সেটা পরে জানলেও চলবে। তুমি আগে বলো তোমার কি হয়েছে? তুমি কয়জনের?”

—“মানে?”

—“মানে তো আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি?”

ধ্রুব উল্টোদিকে ঘুরে হাঁটা শুরু করলো। বললো,”তোমার মাথা গরম হয়ে আছে। আমরা পরে কথা বলবো!”

মেজাজ আরো বিগড়ে গেলো! রাগে দুঃখে হাতের টিস্যুটাকে হাতুড়ি ভেবে ওর মাথা বরাবর টার্গেট করে সজোরে ছুঁড়ে মারলাম। ওর পিঠে গিয়ে লাগলো। ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে আবারো সেই বিটকেল হাসিটা দিলো। আমার মেজাজ খারাপের মুহূর্তে ওর প্রধান কাজই বোধহয় এটাই! আমার মেজাজ আরো খারাপ করে দেওয়া! ওর হাসিটাকে ইগ্নোর করে মুখ ভার করে নিচে নেমে গেলাম। ওকেও নেমে আসতে দেখলাম। ইচ্ছে করেই ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে চুপসে যাওয়া মুখ করে এদিক ওদিক ঘুরতে শুরু করলাম। ফর্মুলা কাজে দিলো! অনেক্ষন যাবত আড়চোখে আমাকে লক্ষ্য করে অবশেষে ফিরে এলো। ধৈর্যহারা কন্ঠে বললো,”এসব কি নিশাত? তুমি কি পাগলামি শুরু করেছো! আমি জাস্ট ওদের সাথে মজা করেছি! প্লিজ মুখটাকে স্বাভাবিক করো। আমার অস্বস্তি লাগছে।”
আমি জবাব না দিয়ে নতমুখে ওর পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। ও আমাকে আটকে দিলো। ওর চেহারা দেখে মনে মনে খুব খুশি হলাম। বেশ হয়েছে! এবার ঘোরো আমার পেছন পেছন!

ও আমাকে টেনে বারান্দার দিকে নিয়ে গেলো। দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে নিজে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো! ওর তপ্ত নিশ্বাস আমার চোখেমুখে লাগছিলো। নিশ্বাস চেপে দাঁড়িয়ে রইলাম। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছিলো! ধ্রুব আমার আরো কাছে সরে এসে চোখে চোখ রাখলো। ঘোর লাগানো নিঃশব্দ চাহনী! আমি কিছু বলার জন্য খুলছিলাম আমার ঠোঁটে আঙুল রেখে কথা বলতে নিষেধ করে দিলো। ধীরে ধীরে আশেপাশের সবকিছু আমার কাছে ঝাপ্সা হতে শুরু করলো! অ্যান্ড ওয়ান্স অ্যাগেইন, আই ওয়াজ বিয়িং হিপনোটাইজড বাই হিম! চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ঘোরের মাঝেই আন্দাজ করতে পারছিলাম এরপর কি হবে!
কিন্তু অনেক্ষন হয়ে যাওয়ার পরেও ধ্রুবর কোন সাড়া না পেয়ে চোখ খুলে দেখলাম ও হাসছে। ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টু হেসে বলল,”চুমু খাওয়ার খুব শখ হয়েছে না?” লজ্জায় আমার গাল লাল হয়ে গেলো। ও সেটা বুঝতে পেরে সেদিনের ঘটনাকে ইঙ্গিত করে ফের হেসে উঠে বললো,”দাঁড়াও পানি খেয়ে আসি!”
এরপর আর আমার মেজাজ ঠিক রাখা সম্ভব হলো না! ঠেলে ওকে সরিয়ে দিলাম! ও হাসি থামানোর চেষ্টা করছিলো। কিন্তু থামছিলো না। আমি ওর হাতের বাঁধন খুলে সরে আসতে চাইলাম। আমার রাগের পরিমান আন্দাজ করতে পেরেই বোধহয় আশেপাশের সবকিছু ভুলে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো,”সরি। সরি। সরি! আর কখনো এমন হবে না!” আমি আবারো দুর্বল হয়ে গেলাম! রাগ পড়ে গেলো! দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরলাম। ও মিষ্টি করে হাসলো। আচমকা গলা খাঁকারির আওয়াজ শুনে দুজনেই চমকে উঠলাম। ধ্রুব আমাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে গেলো। ছোটচাচু ফোনে কথা বলতে বলতে এদিকে আসছিলেন আমাদেরকে দেখে আবার ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেলেন। আমি তাড়াতাড়ি বারান্দা থেকে রুমে ঢুকে গেলাম। ধ্রুবও বেরিয়ে গেলো! দুজনেই লজ্জা পেয়েছি! আর ছোটচাচু যে কি ভেবেছেন আল্লাহই জানে! আপন মনে সব দোষ ধ্রুবর ঘাড়ে চাপালাম। ও যদি তখন মেয়েগুলোর ঢং করে ছবি না তুলতো তাহলে এসব কিছুই হতো না! আবার গিয়ে মেহমানদের ভীড়ে ঢুকে পড়লাম।যেহেতু এখন বিয়ে হচ্ছে না তাই দুপক্ষের সম্মতিতে এংগেইজম্যান্ট অনুষ্ঠান বেশ বড়সড় ভাবে আয়োজন করা হয়েছে। মেহমানে ভর্তি চারদিক। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারেও একেবারে শাহী আয়োজন!
মেয়েদের খাবার প্রোগ্রাম শেষে অনেকেই বাসায় যাওয়ার জন্য রেডি হতে শুরু করলো। আমিও হালকা পাতলা যেই গয়নাগুলো পরেছিলাম সেগুলো খুলে মেকাপ তুলে ফেললাম। ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই দরজার সামনেই ধ্রুবকে দেখলাম। ওর পুরো পাঞ্জাবি মাংসের ঝোলে মাখামাখি! হাতের ফোন আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিরক্ত মুখে বললো,”দেখোতো,ফোনেও পড়েছে বোধহয়! টিস্যু দিয়ে মুছে দিও!” তারপর গা ভর্তি ঝোলমাখা পাঞ্জাবির দিকে ইঙ্গিত করে বলল,” আমি এগুলো পরিষ্কার করে আসি!”

আমি টিস্যু দিয়ে ওর ফোন ভালো করে মুছে দিলাম। অন করে দেখলাম, ঠিক আছে! ভাবলাম এই ফাঁকে ওর গ্যালারি, ইনবক্স সব চেক করে নেই। যে ভাবা সেই কাজ! লক খুলে প্রথমেই ওর গ্যালারিতে ঢুকলাম। ছবি তেমন নেই। বেশিরভাগ কাগজপত্রের ছবি। আমার সাথে দু একটা পুরোনো ছবিও আছে। হঠাৎ একটা জিনিসে আমার চোখ আটকে গেলো। আমার হস্পিটাল রিপোর্টের ছবি! এক এক করে সব ছবি দেখলাম। ব্লাড টেস্ট, ইউরিন টেস্ট, এলবিউমিন টেস্ট, আইজি ‘ই’ টেস্ট, সব আমার টেস্টের রিপোর্ট!
আনন্দমিশ্রিত শিহরণ বয়ে গেলো শিরদাঁড়া বেয়ে!
আমি দ্রুত ডাটা অন করে ওর ইমোতে ঢুকলাম।ছবিগুলো ডা.সিনহার নাম্বার থেকে এসেছে। হস্পিটালে ডা.সিনহাই আমার কনসালটেন্ট ছিলেন। ধ্রব সাথে যেদিন তরুর বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো ঠিক সেই তারিখেই রিপোর্টের ছবি গুলো পাঠানো হয়েছে। ডা.সিনহার সাথে ওর কনভারসেশন গুলো সব পড়লাম। পড়ে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম ধ্রুব আমার রিপোর্ট নিয়ে উনাকে বেশ জ্বালিয়েছে। আর ভদ্রলোক প্রতিবারই ধৈর্যসহকারে ওকে আশ্বস্ত করে গেছেন। একই কথা ঘুরেফিরে বারবার বলেছেন,রিপোর্টে কোনরকম ঝামেলা নেই। রিপোর্ট পুরোপুরি নরমাল!
ফোন হাতে নিয়ে সম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। অত্যাধিক খুশিতে চোখের কোনে কিছু আনন্দাশ্রু জমা হলো। বেশ বুঝতে পারছিলাম আমার ভেতরের উত্তেজনা ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে! ধ্রুবর ভালোবাসার গভীরতা আমার সমস্ত হৃদয়ে ভরাডুবি লাগিয়ে দিয়েছে! হৃদপিন্ড দুপদাপ আওয়াজে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছে,আমার বিট মিস হচ্ছে! ফোন বন্ধ করে ধ্রুবর বেরোনোর অপেক্ষায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।
ধ্রুব যখন ওয়াশরুম থেকে বেরোলো ওর পাঞ্জাবি প্রায় পুরোপুরি ভেজা। আমার কাছে এগিয়ে এসে বললো,”এদের সার্ভিস খুবই বাজে! আরো দুটো টেবিলে একই ঘটনা ঘটেছে!” আমি আচ্ছন্ন হয়ে ওর দিকে চেয়ে ছিলাম। ওর কন্ঠস্বরে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে মুচকি হাসলাম। ও চুলের গোড়ায় আঙুল চালাতে চালাতে বলল,”হাসছো কেন?”
ওর সেদিনের কথাটাই আমার আজকে মনে পড়লো। মিষ্টি হেসে বললাম,”তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো তা তুমি নিজেও জানো না ধ্রুব! ও প্রথমে বিস্মিত হলেও পরে হেসে ফেললো। চোখ পাকিয়ে আদুরে হেসে বললো,”চুপিচুপি আমার গ্যালারি চেক করা হয়েছে না?” প্রতিউত্তরে আমি হাসলাম। ও কিছুক্ষন ভেবে চিনতে বলল,” লক জানলে কি করে?”
ও লক খোলার সময় আমি প্রায়ই ওর অলক্ষ্যে আড়চোখে লক প্যাটার্ন লক্ষ্য করেছি। খুবই সিম্পল! একটা চতুর্ভুজ! কিন্তু সত্যিটা বললাম না। রহস্যজনক ভাবে হেসে উঠে বললাম,”বলবো না!”
ও হাসলো। ওর হাসিহাসি মুখখানার দিকে চেয়ে থেকে সৃষ্টিকর্তার কাছে একটাই প্রার্থনা করলাম,”হে! খোদা ওর ভাগের সব কষ্ট তুমি আমাকে দিও! কিন্তু ওর হাসিহাসি মুখটাতে কখনো দুঃখের বোঝা চাপতে দিও না। অন্তত আমি বেঁচে থাকতে না!”
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here