ব্যবধান ( সপ্তম পর্ব )

শ্রাবন্তী ভট্টাচার্য্য

অফিস থেকে ফেরবার পথে, বিগ বাজারে ঢুকে ছেলের জন্য বেশ সুন্দর একটা ট্রাই সাইকেল কিনে, গাড়িতে উঠে বসল কৌস্তভ। পার্কে এসে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে, ছেলের সাইকেলটা নিয়ে ঢুকে পড়লো। ও জানে এইসময় রণ টুলুমাসির সাথে পার্কে খেলতে আসে। একটু খোঁজাখুঁজির পরেই পেয়ে গেল দুজনকে। ছেলেকে কোলে নিয়ে সাইকেলের উপর বসিয়ে দিতে, কি খুশি রণ। সাইকেলের হ্যান্ডেল নাড়িয়ে, হর্ণ বাজিয়ে, আলো জ্বালিয়ে নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কি বিস্ময় নিয়ে দেখছে সাইকেলটা। যত দেখছে, ততই ওর মুখের অবস্থা এমন হচ্ছে যেন কি সাংঘাতিক জিনিস ও হাতের কাছে পেয়ে গেছে। বিস্ময়াবধি নেই। কৌস্তভ পরম কৌতুকে দেখছে, ছোট্ট শিশুর কান্ড কারখানা। ছেলেকে আরও আনন্দ দিতে, সাইকেলে বসিয়ে পার্কে খানিকটা ঘুরিয়েও আনলো। আড়াই বছরের রণ এখন একটু আধটু কথা বলতে শিখেছে। সাইকেলে ঘুরতে ঘুরতে নিজের আধো আধো বুলিতে মাথা নেড়ে নেড়ে অনেক কথাই বলে নিজের আনন্দ ব্যক্ত করছে সেইথেকে। ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে কৌস্তভ প্রাণভরে দেখছে ছেলের নানান ভঙ্গিমা। সত্যিই ও হতভাগ্য। এত স্বর্গসুখ ফেলে ও আনন্দ খুঁজতে গেছিল নরকের মধ্যে। প্রায় ঘন্টাখানেক ছেলের সাথে কাটাবার পর টুলুমাসি এসে তাড়া দিল—-” এবার আমরা বাড়ি যাব দাদাবাবু। রণর খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আপনিও ঘরে চলুন। অফিস থেকে এসেছেন, দিদিভাই চা করে দেবে আপনাকে।“

মনে মনে কৌস্তভেরও ইচ্ছে, শিখার কাছে যাওয়ার। সামনেই দীপশিখার ভাড়া বাড়ি। কিন্তু সেদিনের ঘটনার পর মন চাইলেও, নিজের আত্মসম্মান, লজ্জা ওর গতিরোধ করছে ক্রমাগত। দীপশিখার মুখোমুখি হওয়া ওর পক্ষে এখন কিছুতেই সম্ভব নয়। নিজের ভালোবাসার মানুষের কাছে এত অপমানিত হয়ে, আবার তার সামনে দাঁড়াবার মনোবল কৌস্তভের নেই।“
বাড়ি যাওয়ার তাড়া আছে বলে আর একমুহূর্তও না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল কৌস্তভ।

রণকে সাইকেলে বসে ঘরে ঢুকতে দেখে, হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে এল দীপশিখা।
—–” কি, এবার খুশি তো? বায়না করা মাত্রই মহাশয়ের সাইকেল এসে হাজির।”
তারপর চকিতে চারদিক একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল টুলুমাসির দিকে। টুলুমাসি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে, মৃদু হেসে বলল—-” যাকে খুঁজছো দিদিভাই, সে আসেনি। চা খেয়ে যেতে বলেছিলাম। আসলোনা দাদাবাবু। কাজ আছে বলে চলে গেল।“
কথাটা শুনে, গভীর দীর্ঘশ্বাসের মত মুখ দিয়ে শুধু একটা কথাই বেরিয়ে এল শিখার—-“আসলোনা?”
মুখে আর কিছু না বললেও, ভেতরে ভেতরে এবার অভিমানের আগুন ধুমায়িত হতে শুরু করেছে দীপশিখার। বারবার খালি একটা কথাই মনে হচ্ছে, ক্ষমা তো আমি চেয়েছিলাম কৌস্তভ। তারপরেও এত রাগ?

কৌস্তভ এখন অফিস ফেরত, প্রায়দিনই পার্কে গিয়ে ছেলের সাথে অনেকখানি সময় কাটায়। তবে শিখার কাছে যাওয়ার ব্যাপারটা অবশ্য সন্তর্পনে এড়িয়ে যায়। শিখাকে সপ্তাহে একদিন ফোন করে সাধারণ কিছু কথাবার্তা বলা, সুবিধা-অসুবিধা জিজ্ঞেস করা, শরীর স্বাস্থ্যের খবর নেওয়া, এই ফর্মালিটিগুলো করতে কখনোই ভুল হয়না কৌস্তভের। ফোনে শিখার সাথে যোগাযোগটা বজায় রেখেছে। কিন্তু ব্যস ওইটুকুই। এর বেশি আগ্রহ কৌস্তভ এখন আর দেখায়না।

কৌস্তভের এই ঘরে না আসা, অসম্ভব এই শীতল ব্যবহারে, শিখারও অভিমানের পারদ ক্রমশ ঊর্ধ্বোমুখী। যেটুকু কথা ফোনে কৌস্তভ বলে, শুধু সেইটুকুরই উত্তর দিয়ে শিখা তার দায়িত্ব শেষ করে। ঘরে আসবার অনুরোধটুকুও রাখেনা কৌস্তভের কাছে।

অথচ দুজনেই কিন্তু ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে, একেঅপরের সান্নিধ্য পাওয়ার। কিন্তু অদৃশ্য এক অভিমানের নাগপাশে দুজনেই বন্দী। আর যেখানে ব্যক্তিবিশেষের ক্ষোভ, অভিমানটা বড় হয়ে ওঠে, সেখানে সম্পর্কটা নেহাতই তুচ্ছ হয়ে যায় তখন।

এই মান-অভিমানের লুকোচুরি খেলায়, পেরিয়ে গেল আরও কয়েকটা মাস। রণ এখন কৌস্তভকে ভালোমতোই চিনে গেছে। পার্কে গিয়ে সে রোজ বাবার আসার অপেক্ষায় থাকে। কৌস্তভ এলেই দুহাত বাড়িয়ে টলটল করে দৌড়ে এসে, ঝাঁপিয়ে উঠে পড়ে কোলে। বাবার কাছে বেশ কিছুক্ষণ আদর খেয়ে, তবে তার শান্তি। ছেলের আদুরে গলায় ‘বাবা’ ডাকটা শোনবার জন্য কৌস্তভও এই সময়টার অপেক্ষায় সারাদিন ব্যাকুল হয়ে থাকে। একদিন যদি কৌস্তভ পার্কে না আসে, রণকে সামলান টুলুমাসির পক্ষে ভীষণই মুশকিল হয়ে পড়ে। কেঁদে কেটে চিৎকার করে ধুন্ধুমার কান্ড বাঁধিয়ে দেয় রণ।

রবিবারের সকাল। শিখার স্কুল ছুটি। তাই ঘরের কাজের তাড়াও সেভাবে নেই। রণ ঘুমোচ্ছে। সকালের চা বানিয়ে খবরের কাগজটা নিয়ে সোফাতে অলসভাবে গা এলিয়ে বসল শিখা। বেশ কিছুক্ষণ কাগজের পাতা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে, বেশ জুতসই একটা খবরে সবে মনোনিবেশ করেছে, সুরেলা একটা গানের মূর্ছনায় পাশে রাখা ফোনটা বেজে উঠল। কৌস্তভ ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করে শিখা বলল—” হ্যাঁ, বল।“
ওপাশ থেকে একটা মৃদু গলাখাঁকারি দিয়ে কৌস্তভ বলল—–” আজ ছুটির দিন। ভাবছিলাম তোমায় আর রণকে নিয়ে কাছাকাছি কোথাও একটু ঘুরে আসব। খুব বেশি দেরি করবোনা। সকালে বেরিয়ে বিকেলের মধ্যেই ফিরবো। তোমার কী সময় হবে? যাবে শিখা?”

কিছুক্ষন চুপ করে থেকে শিখা বলল—–” দেখ কৌস্তভ, রণর সাথে দেখা করবার জন্য আমি তোমায় কোনদিনও বাধা দিইনি। আর দেবোওনা। তাহলে ছেলের সাথে দেখা করবার জন্য এত অজুহাত খোঁজো কেন? তুমি যদি রণকে কোথাও নিয়ে যেতে চাও, অবশ্যই নিয়ে যেতে পার। শুধু শুধু চক্ষুলজ্জার খাতিরে আমাকে টানাটানি করবার কী প্রয়োজন?“

—–” এসব তুমি কী বলছো শিখা? এখন আমার সব কথাতেই একটা নেগেটিভ কিছু ধরে নাও কেন তুমি? আমি তোমাদের দুজনকেই তো নিয়ে যেতে চাইছি। এরমধ্যে আবার ছেলেকে দেখবার অজুহাতের কী আছে? ছেলেকে দেখবার হলে তো আমি পার্কে গিয়েই দেখে আসতে পারি। তার জন্য তো কোন অজুহাতের প্রয়োজন নেই?“

কৌস্তভের কথাগুলো শুনে চুপ করে গেল শিখা। ঠিকই তো বলছে কৌস্তভ। ওর যে এখন কী হয়েছে? কৌস্তভের সাথে কারণে-অকারণে খালি ঝগড়া করতে ইচ্ছে হয় ওর। কৌস্তভ ফোন করলেই একটা কথাকাটাকাটি হয়েই যাবে। অথচ কৌস্তভ ফোন না করলেও ওর রাগ হয়। নিজের মনের এই অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণ নিজেই ঠিক বুঝতে পারেনা শিখা। ওর মন যে ঠিক কী চায়, সেটা ও নিজেই উপলব্ধি করতে পারছেনা এখন।

শিখাকে চুপ করে থাকতে দেখে, কৌস্তভ আবার জিজ্ঞেস করলো—-” কী হলো শিখা, উত্তর দিলেনা? যাবে ঘুরতে আমার সাথে?”
—–” না, কৌস্তভ। স্কুলের পরীক্ষার খাতা অনেক জমে আছে, দেখা হয়নি। আজ সেগুলো দেখতে হবে। আমার যাওয়া হবেনা।“
—-” ঠিক আছে। তবে যেওনা।“—- বলে আরেকবারও অনুরোধ না করে, ফোনটা কেটে দিল কৌস্তভ।

ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ আনমনা হয়ে বসে রইল দীপশিখা। কী যে হয় ওর, এখন নিজেই নিজেকে সংযত রাখতে পারেনা। মন চায় অন্যকিছু, কিন্তু করে ফেলে তার ঠিক উল্টোটা। আজ তিনজনে ঘুরতে গেলে, বেশ ভালোই তো হত। কিন্তু নিজের ঠুনকো দম্ভের বশে, তা নাকচ করে বসে রইল। নিজের ইচ্ছে, অনিচ্ছে, ভালোলাগা, আনন্দগুলো সব বিসর্জন দিয়ে, তুচ্ছ জেদ ও অভিমানের বাঁধনে, কেন যে নিজেকে এভাবে আষ্টপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে, সেটা এখন ওর নিজের কাছেও রহস্য।

রণ সকালে ঘুম থেকে উঠলে, রণকে খাইয়ে, একটা ভালো জামা পরিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে, টুলুমাসিকে ডাকলো শিখা। টুলুমাসি রান্না ছেড়ে ঘরে ঢুকলে, রণকে কোলে দিয়ে বলল—-” তুমি রণকে নিয়ে ওই বাড়িতে আজ দিয়ে এসো। সকালে ওখানে কিছুক্ষণ থাকুক। তারপর লাঞ্চের সময় নাহয় নিয়ে আসবে।“
রণকে কোলে নিয়ে, একটা অটো ধরে, টুলুমাসি বেরিয়ে গেলে, শিখা বসল স্কুলের খাতাগুলো চেক করতে।

কলিংবেলের আওয়াজে দরজাটা খুলেই, সুলেখাদেবী একেবারে হতবাক। দরজার বাইরে রণকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে টুলুমাসি। আনন্দে আত্মহারা হয়ে টুলুমাসির কোল থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিলেন নাতিকে।
টুলুমাসি হেসে বলল—” দিদিভাই বলেছে, কিছুক্ষণ রণ আপনাদের এখানে থাকবে। দুপুরে ওর খাওয়ার সময় হলে, আমি এসে নিয়ে যাব।“

বাইরে কথাবার্তার আওয়াজে কৌস্তভ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখে, রণকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকছেন সুলেখাদেবী। ছেলেকে দেখেই তিনি হাসিমুখে বললেন—-” দেখ দেখি, আজ আমাদের বাড়িতে কে বেড়াতে এসেছে। আজ ঠাম্মি আর নাতি দুজনে মিলে খুব খেলবো।“

কৌস্তভ ভালোই বুঝতে পারছে, শিখা কেন আজ রণকে এই বাড়ি পাঠিয়েছে। কৌস্তভের সব কথারই এখন উল্টো মানে করে শিখা। ওর ইচ্ছে করছে, রণকে এইমুহূর্তেই আবার পৌঁছে দিয়ে আসে শিখার কাছে। কিন্তু মায়ের আনন্দ দেখে, রণকে আর তাঁর কোল থেকে কেড়ে নিতে ইচ্ছে হলোনা কৌস্তভের। আজ কতদিন বাদে মানুষটা নাতিকে পেয়ে একটু প্রাণখুলে হাসছে।

কৌস্তভ একটু মৃদু হেসে বলল—-” এবার নাও, এই বুড়ো বয়সে নাতিকে নিয়ে সারা ঘর দৌড়ে বেড়াও।“

নাতির দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে সুলেখাদেবী বললেন—–” দৌড়াব বৈকি? নাতিকে দেখলে ঠাম্মিদের বয়স যে অনেক কমে যায় রে। যৌবন ফিরে আসে আবার । সারা ঘর কেন নাতিকে নিয়ে সারা পৃথিবী দৌড়ে বেড়াতেও আমার কোন আপত্তি নেই।“—- বলে রণকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন সুলেখাদেবী।

কৌস্তভ নিজের রুমে গিয়ে, অফিসের কিছু কাজ করবার জন্য ল্যাপটপটা খুলে বসল। কিন্তু মন বসছে না কাজে। বেখেয়ালে অনেক খেয়ালই আনাগোনা করছে মনের ভেতর। নিজের আর শিখার সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ হতাশ কৌস্তভ। কোন আশার আলোই দেখতে পাচ্ছেনা ও। ক্রমশ জটিলতা বেড়েই চলেছে। কথায় কথায় শিখার অভিমানটাও মাত্রা ছাড়াচ্ছে। ওদের সম্পর্কটা কী কোনদিনও আর জোড়া লাগবেনা? ছেলেটাকে সম্পূর্ণ নিজের করে ওর কী পাওয়া হবেনা কোনদিনও? নিজের ঘরেই ছেলেটা অতিথির মত ঘুরতে আসবে এইভাবে? খেয়াল নেই ল্যাপটপটা খুলে কতক্ষণ এভাবে ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছে। সম্বিৎ ফিরলো মায়ের ডাকে। শুনতে পাচ্ছে, সুলেখাদেবী নিজের ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলছেন—” কৌস্তভ, শিখাকে একটা ফোন করে দে, আজ রণ আমার কাছে চান করে, খেয়ে তারপর যাবে।“ ( ক্রমশ )

https://www.facebook.com/107986137690507/posts/298469518642167/
ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্ক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here