সুখের_সন্ধানে পর্ব_২৭

0
457

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_২৭

বিন্দুকে বিয়ে করার কথা বলার সাথে সাথে প্রিয় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। মিথিলার উপরে চরম ক্ষেপে গিয়ে বলল,

– আর ইউ ক্রেজি? ওকে আমি বিয়ে করব এ কথা বলার সাথে সাথেই তো নাচতে নাচতে ছুটে এসে আমার গলায় ঝুলে বসবে। ও তো এটাই চাচ্ছে যে আমি এই মিথ্যে ব্লেমের ভয়ে বিয়েতে রাজি হই। এজন্যই এই ক’দিন ধরে আমাকে নানানভাবে ব্ল্যাকমেইল করছে।

– মাথা ঠান্ডা করো , ভাইয়া। আগে আমার কথা শোনো। তুমি ওর যে বর্ণনা দিলে তাতে আমার মনে হয় না যে ও তোমাকে বিয়ে করবে। এই বিয়ে করানোর প্রেসার ক্রিয়েট করে ব্ল্যাকমেইল করা এটাও ওদের এক ধরনের ব্যবসা। আমারতো কেন যেন মনে হচ্ছে এই প্রেগনেন্সির ব্যাপারটাও ভুয়া। এ ধরনের মেয়েরা খুবই চালাক। ওরা এত অসচেতনভাবে চলাফেরা করবে বলে মনে হয় না। যখন দেখছে তোমাকে কোনোভাবেই আটকানো যাচ্ছে না তখন এই শেষ অস্ত্রটাই ও তোমার উপর প্রয়োগ করতে চাচ্ছে।

– – তুই বিন্দুকে চিনিস না । ওকে যদি সামনাসামনি দেখতি তবে তুই বুঝতে পারতি যে কেন আমি ওকে ভয় পাচ্ছি। আমার এতটাই ব্যাডলাক যে প্রথমে কিছুতেই ওর ইনোসেন্ট আর কেয়ারিং লুক দেখে ওর আসল রূপ আমি চিনতে পারিনি।

– এ টাইপের মেয়েরা ডেঞ্জারাস টাইপেরই হয়। এজন্যই ওরা এ ধরনের কাজ করতে পারে। উপর একটা ইনোসেন্ট লুক নিয়ে ঘুরে কিন্তু ভেতরে হচ্ছে শয়তানের আস্তানা। তাই এদের ভয় পেলে চলবে না। এদের সাথে টেকনিক্যালি ডিল করতে হবে। এদেরকে যত ভয় পাবে এটা ততটাই ভয় দেখাবে। তুমি খুবই সাদাসিধা। সবকিছু সহজে নাও এজন্যই তোমাকে পেয়ে বসেছে।

– তুই এতো কনফিডেন্ট এর সাথে কি করে বলছিস যে ও শুধু ব্লাকমেইলিং এর জন্যই এসব করছে? তুই মানুষ ছোট হলেও বুদ্ধি আমার থেকে বেশি মনে হচ্ছে।

– হা, হা! বুদ্ধির সাথে বয়সের কোনো সম্পর্ক নেই, ভাইয়া। এই যে দেখো তুমি ব্যবসা-বাণিজ্যের কত কিছু বোঝো আমি এসবের কিছুই বুঝি না। একেকজনের বোঝার ক্ষমতা একেক দিকে বেশি থাকে। আচ্ছা, কাজের কথায় আসি। আমার কাছে কেন যেন মনে হচ্ছে ও তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করার জন্যই এসব করছে। সমস্ত বিয়ে-শাদী, বাচ্চাকাচ্চা সব ভাওতাবাজি । তুমি এত ভয় পেও না। ভাওতাবাজি না হলেও সত্যিও যদি ও প্রেগন্যান্ট হয় সে চাইলেই জোর করে তোমার গলায় আরেকজনের পাপ চাপিয়ে দিবে আর অমনি তুমি ফেঁসে যাবে সেই যুগ আছে নাকি? এখন আধুনিক যুগ। এসবে ভয় পাওয়ার কোনো মানে নেই। তুমি যদি সত্যিই কোনো দোষ করে না থাকো তবে একদমই চিন্তা করো না। আর এসব মেয়েকে হারানোর কষ্টে ছাইপাশ খেয়ে নিজের লাইফটাকেও বরবাদ করো না। ও যাই করছে টাকার জন্য করছে। তুমি আরো আল্লাহকে ধন্যবাদ দেও। যা হয়েছে ভালোর জন্য হয়েছে।

– এখন কী করব তাই বল! আমিও জানি এসব মিথ্যে অভিযোগ দিয়ে আমাকে ফাঁসাতে পারবে না। কিন্তু তারপরেও কথা উঠলে আমার ইমেজের উপর যে একটা কালো পর্দা পড়বে সেটা তো সত্যি তাই না! তাছাড়া আমি যে এতদিন ওর সাথে একটা গুড রিলেশানে ছিলাম এটা তো আর মিথ্যে না। একথা আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের অনেকেই জানে।

– সবই বুঝলাম । তবে আমার মনে হয় কি জানো ওকে কিছু টাকা পয়সা দিলেই মনে হয় বিদায় হয়ে যাবে। এসব বিয়ের নাটক এ জন্যই সাজিয়েছে।

– তাইলে আবার বিয়ের কথা বলছিস কেন?

– বলছি এ জন্য যে তুমি যখন ওকে বিয়ের কথা বলবে ও ভয়ে তোমার সাথে ডিল করতে চাইবে। এমনিতে তো সরাসরি টাকা পয়সা চাইতে পারছে না। এজন্য এই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কৌশলে কাজ করছে মেই বি!

– কিন্তু আমি তো ওকে আর একটা ফুটো কড়িও দিতে রাজি না। আমি কোনো অন্যায় করিনি। কেন আমি ওকে টাকা দিব। এমনিতেই এতদিনে ওর পেছনে আমি বহু টাকা খরচ করেছি। ওকে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করা মানেই হল এটা মেনে নেওয়া আমি ওর বাচ্চার বাবা।

– এটাই তো! দিয়ে দিয়ে লোভ বাড়িয়ে দিয়েছ। এটা ঠিক বলেছ ওকে টাকা দিলে তোমার অন্যায় মেনে নেওয়া হয়।

– কি করতাম তুই বল! তার বাড়িতে এই সমস্যা সেই সমস্যা বলে বলে নিজের ফিন্যান্সিয়াল প্রবলেম শেয়ার করত। সেমিস্টার ফি দিতে পারছে না , বাসা ভাড়া দিতে পারছে না আরো কত কাহিনী! আমি এই দেড়টা বছর ওর সব খরচ চালিয়েছি। বরং প্রয়োজনের থেকে আরো অনেক বেশি বেশি নিয়েছে। ওকে আমি নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করেছি, ভালোবেসেছি। সেখানে ওর সমস্যাগুলো কি আমার সমস্যা ছিল না?

– আচ্ছা, যা দিয়েছ তো দিয়েছ ।এখন সেসব ভেবে লাভ নেই।

– এজন্যই তো বলছি ওকে আর এক টাকাও দিব না। কত বড় চালবাজ! এতদিন ধরে আমার সাথে কী নিখুঁত অভিনয় করে গেল। অথচ আমি গাধা টেরই পেলাম না। উলটো এখন আমাকে নিয়ে কীসব অপবাদ দিচ্ছে।

– মিথিলা খানিকক্ষণ ভেবে বলল, একটা বুদ্ধি আছে। তুমি কালকে বাইরে যাবার আগে ওর নাম্বারটা আমাকে দিও।

– কী করবি?

– সেটা কালকেই দেখবে। এখন ঘুমাতে গেলাম। তুমিও চলো। মাথাটাকে ভালো করে একটু বিশ্রাম দেই। বড় একটা প্লট সাজাতে হবে।

– হা হা। আজকাল দেখছি তুই বড় বুদ্ধিজীবী হয়ে যাচ্ছিস। আচ্ছা যা তুই আমাকে বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে পারলে তুই আমার কাছে যা চাইবি তাই পাবি।

– ঘুষ দিচ্ছ নাতো! আমার ঘুষ এর দরকার নেই। তুমি নিরপরাধ স্বীকার করেছ এজন্য তোমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। আমি গেলাম। বাই, বাই।

মিথিলা নিচে যাওয়ার জন্য উঠতে গেল তখন ওকে হাত ধরে টান দিলো প্রিয়। এত জোরে টান দিলো যে আরেকটু হলেই মিথিলা প্রিয়র বুকের উপরে যেয়ে আছড়ে পড়তো।

– কি করছ? ব্যথা পাচ্ছি তো!

– আমি তোকে ইচ্ছা করে থাপ্পড় দেইনি। বুঝতে পারছিস তো মাথার মধ্যে কী সব চলছে। এসব দুশ্চিন্তা করতে করতে মাথাটা কেমন যেন করে উঠল আর সাত পাঁচ কোনো কিছু না ভেবেই ওই বেয়াদবটার রাগ তোর উপরে ঝেড়ে দিয়েছি। ভেরি সরি।

– আরে ছাড়ো তো! সে সব তো আমি কখনই ভুলে গিয়েছি। নতুন করে আবার মনে করিয়ে দিচ্ছ কেন?

– থ্যাংক ইউ সো মাচ। তুই যে আমার কত বড় চিন্তা দূর করতে যাচ্ছিস তুই নিজেও জানিস না। লাভ ইউ। বলেই প্রিয় মিথিলাকে হুট করে বুকের মধ্যে চেপে ধরল।

মিথিলা খানিকক্ষণের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলল যেন। প্রিয়র এমন আচরণে খুব লজ্জা পেল সে। তাড়াতাড়ি নিজেকে প্রিয়র বাহু বন্ধন থেকে মুক্ত করে সিঁড়ির দিকে রওনা হলো।

– কিছুটা লজ্জাবনত মুখে বলল, আমি চললাম। তুমি সকাল পর্যন্ত থাকো এখানে। মশার কামড় খাও।

মিথিলা সিঁড়ি থেকে নামতে নামতে শুধু ভাবছে প্রিয় হয়তো সে যেমনটা করে ভাবছে তেমন করে ভাবেইনি।
কিন্তু ব্যাপারটা মিথিলাকে কেন যেন খুব আন্দোলিত করছে। তার খুব লজ্জা হচ্ছে ভাবতেই।

সেলিমকে দেখলেই কেন যেন শুধু আসিফের চেহারা ভেসে উঠে আমার চোখের সামনে। কী এক জ্বালায় পড়লাম। নিজেই না নিজের পায়ে কুড়াল মারি! সেলিম এর এখন আসিফের প্রতি কোনো টান অনুভব হয় না। কারণ সে আসিফ নামে কেউ আছে কি নেই সেটাও জানে না। কিন্তু একবার যদি জানতে পারে রক্তের টানে ঠিকই দেখা করবে আর দেখা করলেই ওকে নিয়ে আসতে চাইবে। তাছাড়া আমি এই ব্যাপারে জানি এটা জানলে ওর ভয় আরো ভেঙ্গে যাবে। আল্লাহকে ডাকছি আমি যেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এ কথা আমার শাশুড়ি জানলে তো আরো বিপদ। সেলিমের আরেকটি বাচ্চার জন্য উনি কত কীই না করেছেন। আমাকে নিজেই বারবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছেন । আমার অক্ষমতার জন্য আর বাচ্চা হয়নি এটা সবার জানা। উনার আরেকজন নাতী দেখার শখ এখনো রয়েই গেছে। তাই যে করেই হোক এই গোপণ কথা গোপণই রাখতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে হবে। সিলেটে বেশি সময় থাকলে না জানি কখন কোথা থেকে সেলিম আসিফের ব্যাপারে জেনে যায়। খুব টেনশানে আছি। হেলেনকে বলে এসেছি মাহাতাবকে এখান থেকে চাকরি ছাড়ার জন্য অনুরোধ করতে। না হলে তার ছেলেকে নিয়ে অসুবিধা হবে। আসল কথা হলো আমি আমার স্বার্থের আর নিরাপত্তার কথা ভেবেই মাহাতাবকে সরানোর জন্য বুদ্ধি দিয়েছি।

এগারোটার দিকে অডিট টিমের সাথে একটা মিটিং আছে আমার আর সেলিমের। সেলিম আগেই চলে গেছে অফিসে। আমিও যাচ্ছি । মিটিং এ মন দিব কী করে ভেবে পাচ্ছি না। মাথা থেকে এসব চিন্তা ঝাড়তেই পারছি না। শুধু ভয় হয় কখন না মুখ ফসকে সেলিমের কাছে সব বলে ফেলি। সিলেট থেকে ঢাকায় না ফেরা পর্যন্ত মনে হচ্ছে এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি নেই।

আমরা মিটিং রুমে পৌঁছে দেখি পুরো অডিট টিম অপেক্ষা করছে। যদিও ফাইনাল রিপোর্ট এখনো রেডি হয়নি। তবে খসড়া রিপোর্ট দিয়েই আপাতত অনেক কিছু ক্লিয়ার আমাদের সামনে। আমিই ঢাকায় ফেরার তাগাদা দিয়েছি সেলিমকে। সেখানে প্রিয় কীভাবে না কীভাবে সামলাচ্ছে সব এসব বলে বলে কিছুটা কনভিন্স করেছি। তাছাড়া মাসের বেশি পেরিয়ে গিয়েছে সিলেটে। সেলিমেরও ঢাকায় ফিরতে মন চাচ্ছে খুব। তাই সে আমার কথাটা এবার আমলে নিয়েছে।

সাজিদও আছে মিটিং রুমে। ছেলেটা খুব কাজের। ও সহ ওর পুরো টিম খুব পরিশ্রম করেছে এ ক’দিনে। অডিট রিপোর্টের সব ইনফরমেশান যাচাই বাছাই করে কোম্পানীর কোথায় কী ভুল হচ্ছে , আগের অডিটে কী ঘাপলা ছিল সব আমাদের সামনে জলের মতো পরিষ্কার । মাহাতাবের মতো আরো অনেকেই মালিকের অনুপস্থিতির সুযোগে নানান ভাবে যে যার জায়গা থেকে লুট করে যাচ্ছে। বেশিরভাগ কর্মকর্তাদের মাঝেই দায়িত্বহীণতার প্রমাণ মিলেছে। অডিট রিপোর্ট থেকে সবকিছু ক্লিয়ার হবার পরে বিকেলেই জরুরীভিত্তিতে একটা বোর্ড মিটিং ডাকা হলো সব কর্তা ব্যক্তিদের নিয়ে। মাহাতাবও থাকবে সেখানে। আবার অডিট টিমের কয়েকজন সিনিয়র মেম্বারও থাকবে সবকিছু আবার ক্লিয়ার করার জন্য।

মিটিং শেষ করার একপর্যায়ে হঠাৎ মাহাতাব উঠে সবার সামনে তার গাফিলতির জন্য ভুল স্বীকার করে রিজাইন করার কথা বলল। আমি তো অবাক! এত তাড়াতাড়ি কাজ হবে চিন্তাও করিনি। হেলেন তো দেখছি বেশ কাজের! আসলে মাহাতাবেরও হয়ত বাচ্চা আর সংসার নিয়ে টেনশান আছে। সে কারণেই হয়ত হেলেনের কথায় রাজী হয়েছে। তাছাড়া এ পর্যন্ত কম তো সরায়নি মালপানি। এতদিনে আখের গুছিয়েছে বেশ ভালো মতোই। এখানে চাকরি বাকরি না করলেও বসেবসে খেলেও বেশ ভালোই চলে যাবে। সিলেটের এক বাড়ি দিয়েই যে ভাড়া আসে তাতেই বহুত।যাই হোক আপাতত আপদ তবে বিদায়। মাহাতাবের রিজাইনের নিউজ শুনে মনে হলো সেলিমও বেশ খুশি। সেও মনে মনে এই আপদ বিদায় করার পায়তারায় ছিল হয়ত। মাহাতাব এতদিন তাকে চাইলেই ব্লাক্মেইল করতে পারত। এখান থেকে চলে গেলে এত আর হয়ত করার সাহস পাবে না। আমি সেলিমের চেহারা দেখে অনেক কিছুই আন্দাজ করলাম। এটা ভেবে ভালো লাগল যে সেলিম তবে আমার ভয়েই সব লুকিয়েছে। সে সংসারটাকে আসলেই বাঁচাতে চায়। যাক, কিছু গোপণ কথা গোপণ থাকাই ভালো। সেলিম জানে আমি কিছু জানি না। ওকে, আমিও ধরে নিলাম আমি কিছুই জানি না। জানতে গেলেই বিপদ। যে করেই হোক এবার নিজের মুখ বন্ধ রাখতে হবে। এত বড় নিষ্ঠুর সত্য চাপাতে যতই বেগ পেতে হয় আমি সামলাতে আপ্রাণ চেষ্টা করব। কয়েকটি জীবনের শান্তির জন্য না হয় হোক না এতবড় একটা সত্যের অপমৃত্যু।

মিথিলা বারবার বিন্দুর নাম্বারে ফোন দিয়েই যাচ্ছে। প্রিয় পাশে বসে আছে।

– ভাইয়া, ফোন তো ধরছে না বেয়াদব টা!

– আচ্ছা, এক কাজ কর! আমার ফোন দিয়েই তবে ট্রাই কর। এটা দিয়ে করলে ধরবে। আননোন নাম্বার দেখে হয়ত ধরছে না। বাটপাররা বাটপারি থেকে সাবধানে থাকার উপায় জানে।

– আচ্ছা, কল দাও।

সত্যিই মাত্র একবার রিং বাজতেই ফোন রিসিভ করল, বিন্দু। মিথিলা ইশারায় কল স্পিকারে দিতে বলল।

– হ্যালো! এতবার তবে তুমিই কি কল দিচ্ছিলে?

– না তো! আমি তো মাত্রই দিলাম। কেন কেউ কী কল দিয়েছিল?

– তবে হয়ত অন্য কেউ।

– দেখো, হয়ত নতুন কোনো ক্লায়েন্ট তোমার!

– বাজে কথা রাখো। আমি কোনো ব্যাবসায়ী না যে আমার ক্লায়েন্ট থাকবে। আচ্ছা, বলো! কী সিদ্ধান্ত নিলে? সময় কিন্তু আর দু’দিন। আমি আমার বাচ্চার অধিকারের জন্য কী করতে পারি সে কথা কিন্তু তুমি বুঝতেই পারছ। মা হয়ে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে পারি না আমার সন্তানের ফিউচার।

– হুম, বুঝতে পারছি। পারব না কেন? তোমার মতো মেয়ের মুখে মা সন্তানের এসব সস্তা সেন্টিমেন্ট খুবই বেমানান লাগে, বুঝেছ। আচ্ছা, শোনো! আমি আম্মু আব্বুর সাথে কথা বলেছি।

– সিরিয়াসলি? কোনো নাটক করবে না। আমি কিন্তু এসব ছেলেভোলানো কথায় এবার পটে যাচ্ছি না।

– আমি তোমার মতো বাটপার না। নাটক করব কেন?

– কী বলেছ তাদের? বলেছ যে বিয়ের আগেই বাচ্চার বাপ হচ্ছো তুমি? নিশ্চয়ই খুব গর্ব হয়েছে তাদের এই ভেবে যে যাক, আমাদের ছেলের ফার্টেইলিটি তবে উচ্চমানের। বংশবিস্তার নিয়ে একদমই চিন্তা নেই। হা হা!

– প্রিয়র মেজাজ এত বিগড়ে গেল। মিথিলার সামনে ভীষণ লজ্জা পেল। কোনোরকম নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, দ্যাটস নট ইওর বিজনেস। আমি যা বলার বলেছি। অবশ্য তোমার মতো নোংরা মেন্টালিটির মানুষের মুখে এমন নোংরা কথাই মানায়। মানুষের ইমোশান নিয়ে যারা বিজনেস করে তাদের মতো নীচ মনে হয় আর কেউ নেই।

– আচ্ছা, আচ্ছা! লেকচার বন্ধ করে কাজের কথা বলো। কী বলেছে উনারা?

– আম্মুকে আমি সব খুলে বলেছি।

– তাই নাকি! তুমি দেখছি একদম মাম্মাস বয়। উহু। এসব হচ্ছে না । বিয়ের পর এই মাম্মাস বয় থাকলে চলবে না। আমি এসব একদমই মেনে নিব না।
আচ্ছা, উনাদের কী সত্যিই বলেছ নাকি আমার কাছে এসব বলে সময় নষ্ট করছ? বুঝো কিন্তু। আমি কিন্তু কল রেকর্ড করছি।

প্রিয় খানিকটা ঘাবড়ে যেয়ে মিথিলার দিকে তাকিয়ে ইশারা দিলো। ইশারার ভাষা এমন, “এ দেখছি বিয়ে করার কথা শুনে কিছুই বলছে না। উলটা আমাকেই থ্রেট দিচ্ছে। “

মিথিলা বুঝতে পেরে হাতের ইশারায় তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলল, আমাকে দাও।

– আমি যে মিথ্যে বলছি না সেই প্রমাণ দিচ্ছি। তুমি আম্মুর সাথে কথা বলো।

– আন্টি? না মানে! তুমি না বলেছ উনি সিলেটে।

– এসেছে গতরাতে। নাও কথা বলো।

মিথিলা ফোন হাতে নিতেই ওপাশ থেকে সালাম দিলো বিন্দু। কী যে ভদ্রসুর! মিথিলাও উত্তর দিয়ে পরিচয় পর্ব আর কুশলাদি শেষ করল।

– দেখো, মা! আমার একটাই ছেলে। অনেক স্বপ্ন তার বিয়ে নিয়ে। সে তোমাকে পছন্দ করে সে কথা আমি আগে থেকেই জানি। অনেক দিন ধরে তোমার সাথে দেখা করব ভেবেও করা হয়নি। যাই হোক কোনো সমস্যা নেই। দেখা এখন হবে সবসময়ই। আমি তোমার আংকেলের সাথে কথা বলে রাজি করিয়েছি। ছেলের মতের বাইরে যেয়ে তাকে কষ্ট দিতে চাই না। একটাই ছেলে, বোঝোই তো। তাই আমি দু’একদিনের মাঝেই তোমার মা বাবার সাথে কথা বলতে চাই।

– সত্যি আন্টি! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি তো খুব ভয়ে ছিলাম আপনারা এত বড় মানুষ ! আমাকে মেনে নেন কী না নেন! অবশ্য সম্পর্কের শুরুর দিক থেকেই প্রিয় বলেছিল কেউ রাজী না থাকলেও আপনি প্রিয়র চাওয়াকে অবমূল্যায়ণ করবেন না। প্রিয়র কথাই তবে ঠিক হলো। এমন মা যেন সব ঘরে থাকে।
কী যে ভালো লাগছে আপনার সাথে কথা বলে!

– আরো ভালো লাগবে যখন আমাদের দেখা হবে। আমি আগামী পরশুই তোমার পরিবারের সাথে কথা বলে তোমাকে আংটি পরিয়ে আসতে চাই।

– সত্যি আন্টি।

– হ্যা মা! তবে একটা কথা! তুমি তো আর আমার পর না। তাই তোমার কাছে বলতে আর লজ্জা কী!

– জ্বী আন্টি। অবশ্যই, বলুন না।

– আমি প্রিয়র কাছে কিছু কথা শুনলাম। আমি নাকি না মানে….. আমি কী সত্যিই দাদী হতে যাচ্ছি?

– না মানে! জি………মানে……।

– আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। ভুলতো করেছেই। ভুল তো ভুলই। যাই হোক, কংগ্রাচুলেশানস মা। শোনো মা। এ বাড়িতে বউ করে আনায় তোমাকে আর কেউ বাধা দিতে পারবে না আমাকে । তুমি আমার বংশের প্রদীপ দিচ্ছ। কতটা কৃতজ্ঞ তোমার প্রতি আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না। তবে একটা কথা! প্রিয় কিছু ব্যাপারে আপত্তি তুলেছে। সে বলছে এ বাচ্চা নাকি তার না। আমি এ কথা শোনার পরপরই ওকে ধমক দিয়েছি। আসলে হয়েছে কী মা! এ বয়সের বাচ্চারা এমনই। নিজের ভুল স্বীকার করতে চায় না। সে এটা কেন করছে জানি না , লজ্জায় নাকি ভয়ে সে জানে।
আচ্ছা, বাদ দাও। আমি ওর কথা শুনছি না। আমি আমার বউ মা আর নাতীকে ঘরে তুলবই।

– আপনি আমাকে বাঁচালেন, আন্টি। কী যে চিন্তায় ছিলাম! ওকে বোঝাতেই পারিনি। কতো বলেছি যা গেছে তো গেছে। আমাদের বাচ্চার তো কোনো দোষ না!

– সেটাই তো আমি বলছি। আচ্ছা, তারপরেও মা। এটা তো সংসার তাই না। প্রিয় যার সাথে সংসার করবে তাকে নিয়ে যদি সন্দেহ থাকে তবে সারা জীবনই অশান্তিতে কেটে যাবে। তাছাড়া পুরুষের জাত যে কী রে মা। নিজের ছেলে তাতে কী হয়েছে? পুরুষ তো! তাছাড়া আমার নাতীর জন্ম পরিচয় নিয়ে কেউ সন্দেহ করুক সেটা আমিও চাই না। তাই আমি, তোমার আঙ্কেল আর তোমার দাদী সবশুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামী পরশু আংটি পরিয়েই তোমাকে আমাদের সাথে এ বাড়িতে নিয়ে আসব। তোমার মা বাবাকে নিয়ে তোমার একদমই ভাবতে হবে না। তাদের যা বলার আমিই বলব। আমার উপরে ছেড়ে দাও। আমি চাই আমার নাতী নাতনী যেই আসুক তার বেড়ে ওঠার প্রতিটি ক্ষণও যেন আমরা উপলব্ধি করতে পারি। যেই সেই বংশের সন্তান তো সে না!

– না মানে আংটি পরিয়েই নিয়ে আসবেন মানে বুঝতে পারছি না।

– ব্যাপার হচ্ছে কী যে বিয়েটা আমরা আমার নাতীর জন্মের পরেই করব। আমাদের এসবে কোনো সমস্যা নেই। এমন বিয়ে আজকাল অহরহ হচ্ছে। আমাদের সোসাইটিতে এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতে আসবে না। সবাইকে বলে রাখব রেজিষ্ট্রি করে রেখেছি আগেই।

– তবে রেজিষ্ট্রি এখন করলে কী সমস্যা? অনুষ্ঠান না হয় পরে হলো!

– ওই যে তোমার আর প্রিয়র সংসারে যাতে কোনো সন্দেহের বীজ ঢুকতে না পারে। এজন্যই। আমি তোমাদের সুন্দর একটা সংসার দেখতে চাই , মা। কোনো অশান্তি হোক আমি চাই না। তাছাড়া আমার নাতীর জীবনের প্রশ্ন!

– বুঝলাম না ।

– বুঝিয়ে দিচ্ছি। আমরা প্লান করেছি আমার নাতী বা নাতনী পৃথিবীতে আসার পরে ওর ডিএনএ টেস্ট করার পরে রিপোর্টটা প্রিয়কে দেখিয়ে ওকে শান্ত করে তারপরেই তোমাকে যথেষ্ঠ সম্মানের সাথে প্রিয়র বউ করে ঘরে আনব। ওকে সবার সামনে সরি বলতে হবে তারপরেই ও তোমার কাছে যেতে পারবে এর আগে নয়।

– এসবের কী দরকার আছে আন্টি। ও হয়ত বুঝতে পারছে না। পরে ঠিকই বুঝবে। ও আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। আমি জানি ও এসব অভিমান করে বলছে। নিজের বাচ্চার ডিএনএ টেস্ট ? মানুষ জানাজানি হলে কী হবে?

– কেউ জানবে না। বাচ্চা প্রয়োজনে বিদেশে যেয়ে জন্ম হবে। আমি তোমাকে নিয়ে যাব। তুমি আমার মেয়ের মতো আমার কাছে থাকবে।

– আন্টি, এসব আমার পরিবার মেনে নিবে না। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। সম্মানটাই আমাদের কাছে অনেক কিছু। যদিও আমি বড় একটা ভুল করে ফেলেছি। কিন্তু তাই বলে বিয়ে না করে আপনাদের বাড়িতে এতদিন আমার পক্ষে থাকা সম্ভব না। ঘুরেফিরে তো সেই একই কথা। তার মানে প্রিয়র মতো আপনারাও আমাকে আর আমার বাচ্চার জন্ম পরিচয় নিয়ে ডাউট করছেন। এটা কত বড় অপমানজনক আপনি বুঝতে পারছেন?

– কেন বুঝতে পারব না , মা। কিন্তু এছাড়া উপায় নেই। তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আমি তো পাচ্ছি না। আমি জানি তুমি সৎ । আমার নাতীর জন্যই আমি যা করার করছি । তোমার পরিবারকে কী করে সামলাতে হয় সেটাও আমার ব্যাপার । তুমি শুধু রেডি থাকো। আগামী পরশু আমরা চিটাগং যাচ্ছি। তোমার মা-বাবাকে শুধু বলে রেখো প্রিয়র মা বাবা আসছে। তোমাকে আর কিছুই ভাবতে হবে না। যা করার আমি করব। এসব নিয়ে একদমই দুশ্চিন্তা করবে না তাহলে আমার বংশ প্রদীপ এর ক্ষতি হবে। ও হ্যা। তুমি কালকে একটু রেডি থেকো। প্রিয় তোমাকে নিয়ে আসবে কালকে। আমাদের ফ্যামিলি ডক্টর আছে ডক্টর শায়লা। আমার খুব কাছের ফ্রেন্ড। ওর কাছে তোমাকে নিয়ে যাব রেগুলার চেকআপের জন্য। এখন থেকে ওনাকেই দেখাবে। তাছাড়া কালকের পর দিন এত বড় একটা জার্নি করবে এটা তোমার শরীরের জন্য ঠিক কিনা সেটাও জানতে হবে।

চলবে…..

পর্ব- ২৬

https://www.facebook.com/111576077291737/posts/364728708643138/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here