অবশেষে ভালোবাসি (সিজন-২)❤part: 43

অবশেষে ভালোবাসি (সিজন-২)❤part: 43
#writer: নৌশিন আহমেদ রোদেলা❤

.
🍁
.
বউ সাজে সজ্জিত হচ্ছে অদিতি।গায়ে লাল বেনারসী… গা ভর্তি গয়না…ভারি সাজ সব মিলিয়ে যেনো এক মহারানী।।চারপাশে সমবয়সী মেয়েদের ফিসফিসানির শব্দ।হবু দুলাভাইয়ের সাথে অদিতির বাসর নিয়ে থার্ডক্লাস কিছু কৌতূকের মেলা …মাঝে মাঝেই সমস্বরে হাসির রেশ…কিন্তু যাকে নিয়ে এতোকিছু সেই যেনো সব থেকে বাইরের কেউ।এই আনন্দ,, ঠাট্টায় তার যোগসূত্র নেই বললেই চলে।।এমন সময় দরজা ঠেলে ভেতরে এলেন মামনি।।তারসাথে রয়েছেন অদিতির মা। মামনি ভেতরে ঢুকতেই ইশারায় সব মেয়েকে বেরিয়ে যেতে বললো অদিতির মা।।সবাই বেরিয়ে গেলে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে আবারও অদিতির মায়ের হাতদুটো নিজের হাতে নিলেন উনি।।
.
আপা? আমার কথা শুনে এইটুকু প্রাইভেসি দিয়েছেন সেজন্য ধন্যবাদ।আসলে খুবই ইম্পোর্টেন্ট কথা বলার ছিলো আপনাকে।।আপা বলুন তো?ভালোবাসা ছাড়া কি জীবন চলে?
.
অদিতির মা মামনির কোনো কথার অর্থই ধরতে পারছেন না।।মামনি যে কি বোঝাতে চাচ্ছেন ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না উনার।।হঠাৎ করে ভালোবাসার কথা আসলো কোথা থেকে?? আর এসব কথার সাথে অদিতির বিয়ের কি সম্পর্ক?? মামনি এবার উনার হাত ছেড়ে অদিতির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।অদিতির চোখের দিকে স্থিরদৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই অদিতি চোখ নামিয়ে নিয়ে নিলো ঝটপট।।মামনি শীতল কন্ঠে বলে উঠলেন-
.
তুমি যদি আমায় মায়ের চোখে দেখো…আমাকে একজন মা হিসেবে এতটুকুও সম্মান করে থাকো…আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে অদিতি?জাস্ট একটা প্রশ্ন!!মিথ্যা বলবে না প্লিজ…কি দেবে?
.
অদিতি অবাক হয়ে উনার চোখের দিকে তাকিয়ে আবারও চোখ নামিয়ে নিলো।।তারপর মাথা নেড়ে জানালো হ্যা সে উত্তর দেবে।।মামনি মুচকি হেসে সরাসরিই বলে উঠলেন –
.
আয়ানকে ভালোবাসো?
.
মামনির প্রশ্নে চমকে উঠলো অদিতি।।মামনি এমন কিছু জিজ্ঞেস করবে ভাবতেই পারে নি সে।।অদিতির চোখদুটো ভরে এলো জলে।অদিতির মা ও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে..কি বলছে ফাহিমের মা?ভালোবাসা আর আয়ানকে??মামনি আবারও একই প্রশ্ন করায় অদিতি মাথা নাড়লো…ধীর কন্ঠে বললো-
.
হ্যা বাসি।
.
বাসো!! তাহলে আমার ছেলেটাকে কেন এতো কষ্ট দিচ্ছো অদিতি?জীবনে কম কষ্ট তো পায়নি সে….আমার ছেলের কথা না হয় বাদই দিলাম।তুমি নিজের কথাও ভাবছো না।।আর আদনান?সে ছেলেটা কি দোষ করেছে অদিতি?তুমি নিজের জেদের জন্য তিনটি জীবন শেষ করে দিচ্ছো।।আয়ান তোমাকে না পেলে মরে যাবে অদিতি।আর তুমি হয়ে যাবে মরা লাশ।।জীবনের সবকিছুকে সমঝোতা করে চলে অদিতি?এভাবে রোবটের মতো বেঁচে থেকে কি আদনামকে খুশি করতে পারবে তুমি?বিয়ে মানে শুধু শারীরিক চাহিদা নয় অদিতি….দুটো আত্মার মিলন……সুখ-দুঃখ,,হাসি-কান্নার, রাগ-অভিমানের ভাগাভাগি।। তুমি কি পারবে আদনানের সাথে অভিমানে মন ভাসাতে??মন খোলে আদনানের সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে পারবে তো?তোমার নিস্তব্ধতা ধীরে ধীরে কি আদনানকেও নিস্তেজ করে দিবে না?মানুষ বিয়ে মানুষিক শান্তির জন্য করে কিন্তু তুমি তো আদনানকে অশান্তি ভরা জীবন উপহার দিতে যাচ্ছো।।এটা কি তার প্রাপ্য??
.
অদিতি চুপচাপ শুনে যাচ্ছে।কোনো কথা নেই তার মুখে।। সত্যিই কি আদনানের মানসিক শান্তি ছিনিয়ে নিচ্ছে সে??অদিতির মা এতোক্ষণ চুপচাপ থাকলেও এখন নড়েচড়ে উঠলো।।বিস্ময় আর রাগ নিয়ে বলে উঠলেন –
.
আপা?কি বলছেন এসব??আজ অদিতির বিয়ে আর আপনি ওকে এসব বুঝাচ্ছেন?প্লিজ চলে যান এখান থেকে।।
.
মামনি এবার ওঠে দাঁড়িয়ে অদিতির মার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।। হাসিমাখা মুখে বলে উঠলো –
.
আপা?আপনি যেমন আপনার মেয়ের সুখ চান আমিও আমার ছেলের সুখ চাই।।আজ যদি শুধু আয়ান অদিতিকে ভালোবাসতো তাহলে আপনার সামনে এভাবে এসে দাঁড়াতাম না আমি।।নিজের মেয়ের দিকে একবার তাকান।।আমি জানি মেয়ের জন্য সর্বোচ্চ ভালো ছেলে খুঁজে বের করেছেন আপনি।।আদনান নিঃসন্দেহে ভালো ছেলে কিন্তু মনের শান্তি বলেও তো একটা কথা আছে আপা।।আপনি বলবেন বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে….আপনিও এভাবেই বিয়ে করেছেন।।আমিও আপনার সাথে একমত এরেঞ্জ ম্যারেজ এই দেশে অহরহ হচ্ছে…..অদিতিও মানিয়ে নিতে পারবে….কিন্তু আপনি ভুল…অদিতির মন যদি খালি থাকতো….ওর মনে যদি আয়ান না থাকতে তাহলে সে পারতো।।কিন্তু যেখানে অলরেডি অন্যকাউকে বসিয়ে রেখেছে সেখানে কিভাবে পারবে বলুন?কিভাবে?আর যদি বিয়েটা হয়েই যায়।। আপনাদের মানসম্মান আর নিজের জেদের তাড়নায় অদিতি যদি বিয়েটা করেই নেয়….তাহলেও কি সুখী হতে পারবেন আপনারা??মেয়ের মলিন মুখ দিন দিন আরো মলিন হয়ে যাওয়াটা সহ্য করতে পারবেন আপনারা??
.
মামনিকে থামিয়ে দিয়ে আবারও বলে উঠলো অদিতি-
.
বাবা-মার কোনো দোষ নেই আন্টি।।উনাদের ব্লেম করা বন্ধ করুন।। আমি আমার নিজের ইচ্ছেই বিয়ে করছি। নিজের সুখের জন্য স্বার্থপর হয়ে যাওয়ার মতো মেয়ে নই আমি।।কয়টা বছর বাঁচবো আর?সে দিনগুলো নাহয় মানিয়ে নিয়েই বেঁচে যাবো।।
.
বাহ…সমাজদরদী।।সবার কথা ভাবছো…সবাইকে সুখী করতে চাইছো…কিন্তু তোমার চোখেই পড়ছে না।।সবার ভালো করতে গিয়ে সবাইকে এক নরকীয় যন্ত্রনার মাঝে ঠেলে দিচ্ছো তুমি।।আজকের বিয়েটা হয়ে গেলে সে যন্ত্রণায় পুড়বে প্রতিটি মানুষ।।আমার ছেলে তোমাকে না পাওয়ার জ্বালায় মরবে…. আর তার মরনে আমি মরবো প্রতিটি মুহূর্তে …মরবে ফাহিম,,রিয়া।।তোমার নিস্তেজতায় মরবে আদনান।।তার অশান্তিতে মরবে তার বাবা মা….আর তোমার বাবা মা মরবে তোমার মুখের মলিনতায় মলিন হয়ে।।এতোকিছুর পরও তোমার মনে হয় তারা ভালো থাকবে??আর সবচেয়ে বড় কথা…কাল যদি খবর পাও আয়ান আর নেই….আদনানের প্রশান্তিও আর নেই তাহলে কি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে তুমি??
.
মামনির কথায় ডুকরে কেঁদে উঠলো অদিতি।তার সবকিছু উলোটপালোট লাগছে….সত্যিই কি এমনটা হবে??ওর জন্য সবাই কি এতোটা কষ্ট পাবে??অদিতির মা এবার এগিয়ে এলেন…অদিতির কাঁধে হাত রেখে বলে উঠলেন –
.
চলে যা অদিতি!!আপা হয়তো ঠিকই বলছেন।।তুই চলে যা।এই মুহূর্তে বিয়েটা ভাঙা যেমন সম্ভব নয় মা…তেমনি তোর খুশিকে জলাঞ্জলি দেওয়াও সম্ভব নয়।। তাই একটা পথই আছে…চলে যা।আয়ানের কাছে চলে যা।
.
মা!!কি বলছো তুমি?(অবাক হয়ে) বাবার মানসম্মানকে জলাঞ্জলি দিয়ে আমি নিজের সুখ খুঁজতে পারি না মা।
.
তোকে পারতে হবে অদিতি। পারতেই হবে।নিজের সাথে সাথে এতোগুলো জীবন নষ্ট করিস না মা।।চলে যা..
.
মামনিও অদিতির মাথায় হাত রেখে বলে উঠলেন –
.
তোমার বারান্দার ওপারেই আয়ান দাঁড়িয়ে আছে…..যাও অদিতি।নিজেকে এবং ছেলেটাকে বাঁচার আর একটা সুযোগ করে দাও মা।।যাও…
.
অদিতি হুট করেই মামনিকে জড়িয়ে ধরলো।।তারপর দৌড়ে গিয়ে পেছনের দরজাটা খুলে ফেললো সে।।বারান্দার দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়ান গায়ে সবুজ পাঞ্জাবি…. ফর্সা গায়ে কি সুন্দর মানিয়েছে রঙটা।।আয়ানকে দেখেই নিশ্বাস ভারি হয়ে এলো অদিতির।।চোখ থেকে নেমে এলো দু’ফোটা জলের রেখা।।আয়ানও টলমলে চোখে তাকিয়ে আছে…. এই বুঝি ঝরে পড়বে তার নিস্তব্ধ কান্না!!
.
🍁
.
গায়ে বোরকা জড়িয়ে আয়ানের হাত ধরে গেইট দিয়েই বেরিয়ে এসেছে অদিতি।।গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ফাহিম আর রিয়া।।গেইটের বাইরে গাড়ি রাখা নেই…কেউ সন্দেহ করতে পারে তাই এখান থেকে দশ মিনিট হাঁটার পর যে মোড়টা সেখানে গাড়ি রেখে এসেছে ফাহিম।।অদিতিকে আসতে দেখেই দৌঁড়ে গিয়ে তাকে জাপটে ধরলো রিয়া।।রিয়ার বাচ্চামোতে হেসে উঠলো ফাহিম।।
.
হয়েছে ম্যাডাম। এবার ওকে ছাড়ুন।যেভাবে দৌড় দিয়েছো…তাতে তো নিজেই উল্টে পড়তে।।আয়ান?তাড়াতাড়ি চল….একটু পরই মেয়ের খোঁজ পড়বে….তখন আবার ঝামেলা বেঁধে যাবে….চল জলদি।।
.
আয়ানও মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে অদিতির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে হাঁটা দিলো সে….রিয়াও ওদের পেছনে হাঁটতে নিলে একটানে তাকে কোলে উঠিয়ে হাঁটা দিলো ফাহিম।রিয়া অবাক চোখে তাকিয়ে আছে….ফাহিম সামনের দিকে তাকিয়েই মিষ্টি হেসে বলে উঠলো –
.
আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকি তা কি আপনার মনে আছে টুনটুনির মা? বিয়ের দিন কথা দিয়েছিলাম এইদিনে তোমায় নিয়ে পালাবো….এই দেখো পালাচ্ছি।শুধু বউ নয় এবার তো ভবিষ্যৎ বাচ্চাকে সহ নিয়ে পালাচ্ছি আমি।।
.
রিয়া ফাহিমের মুখের দিকে কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে তার গলা জড়িয়ে নিলো।।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফাহিমের বুকে মুখ লুকালো।।কিছুক্ষণ হাঁটার পরই হঠাৎ থেমে গেলো অদিতি।।আয়ান প্রশ্নবোধক চোখে অদিতির দিকে তাকাতেই অদিতি করুণ স্বরে বলে উঠলো –
.
আমি পারবো না ডক্টর আয়ান!!আমি রিয়াদের মতো স্বার্থপর হয়ে নিজের ঘর সাজাতে পারবো না।।আদনানকে ধোঁকা দিতে পারবো না আমি।।আমায় ক্ষমা করবেন প্লিজ।।
.
কথাটা বলে আয়ানের হাতটা ছুটিয়ে উল্টো পথে দৌঁড় লাগালো অদিতি।। তাকে পৌঁছোতে হবে।।সঠিক সময়ে পৌঁছোতে হবে।।হবেই হবে….আয়ান পুরো ব্যাপারটা যতক্ষণে বুঝতে পারলো ততক্ষণে অদিতি দৃষ্টির বাইরে।।ফাহিমও আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে আছে।।এমন কিছু হবে ভাবতেই পারে নি সে।।রিয়াও অবাক….আয়ান ধপ করে রাস্তার মাঝেই বসে পড়লো….চোখ দুটো জ্বলছে খুব।।শেষের কাব্যগুলো বুঝি এমনই জ্বালাময় হয়??আশার আলো মেলার পর ধমকা হাওয়ায় সব বাতিগুলো বুঝি এভাবেই নিভে যায়??
.
#চলবে🍁

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here