বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :৪৮

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৪৮

দিন গিয়ে রাতে মিলছে ।ঋতু বদল হচ্ছে।প্রকৃতি বসন্তের রূপ পাল্টে গ্রীষ্মের প্রখর তাপ ছড়াচ্ছে।ইদানীং সূর্যি মামা ভীষণ ক্ষিপ্ত ,নিজের সম্পূর্ন তেজ নিয়ে পৃথিবীর বুকে অগ্নিতাপ নিক্ষেপ করছে। সবকিছুর পরিবর্তন হলেও আরহাম সেহেরের সম্পর্ক সেই এক জায়গায় থেমে ।সেহের বরাবরের মত আরহামকে ঘৃণা করে। সুযোগ পেলে অপমানের কোন সুযোগ হাত ছাড়া করে না।তিক্ত বুলি দিয়ে আরহামের বুকে ধারালো অস্রের মত প্রহার করে।আরহাম ভেতরে ভেতরে হাজার দফা ক্ষতবিক্ষত হলেও সেহের সামনে শান্ত থাকে! সর্বদা এড়িয়ে যায়। যেন কিছু হয় নি!
প্রেগন্যান্সির চার মাস চলছে । সেহেরের পেট ফুলেছে । গালে মাংস বেড়েছে । গায়ের রঙ আগের থেকে আরো বেশি উজ্জ্বল হয়েছে।সময়ের সাথে পাল্লা ধরে যেন তার সৌন্দর্য দিন দিন বেড়ে- ই চলছে।আরহাম সেহেরের বেশ খেয়াল রাখছে কোনকিছু চাইবার আগেই তা সামনে হাজির। হসপিটাল থেকে বাড়ি ফেরার পর সেহেরের হাত পায়ে আর শিকল বাঁধে নি।এই কয়েক মাসে দুবার বাবা মায়ের সাথে দেখা হয়েছে।মাঝেমাঝে আরহামের মোবাইল থেকে বাবাকে ফোন করে কথা বলে।সেহেরের মন ভালো থাকার জন্য সবরকম ব্যবস্থা আরহাম করে রেখেছে । কাজের লোকের সংখ্যা আগের তুলনায় আরো বেড়েছে ।দিনের বেশিরভাগ সময় বাড়িতে কাটাচ্ছে । অফিসের কাজও কমিয়ে এনেছে । খুব প্রয়োজন না হলে অফিসে পা বাড়ায় না।টাইম টু টাইম ডক্টরের চেকআপ,খাওয়া দাওয়া কোনটাই বেখেয়ালি করতে দেয়না। সেহের না খেতে চাইলে আরহাম জোর করে মুখে তুলে দেয়। আরহাম এসব ভালোবেসে করলেও সেহেরের কাছে উচ্চমাত্রা বিরক্তির কারণ! সবটাই অভিনয় পাগলামো ।

আরহামের উপর হাজার রাগ জেদ ঘৃণা থাকলেও গর্ভে বেড়ে উঠা সন্তানকে ঘৃণা করতে পারেনি।আরহামের সামনে বরাবর ঘৃণার প্রকাশ করলেও আড়ালে এই সন্তান নিয়ে তার হাজার স্বপ্ন ।এই কয়েকমাসে মাতৃত্বের অনুভূতি বেশ গভীরভাবে অনুভব করেছে।সন্তানের ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা করে সেহের নির্ঘুম চিন্তামগ্ন রাতদিন কাটাচ্ছে । সে আরো একটা সেহের চায় না। আর যাই হোক নিজের সন্তানের এমন বন্দি জীবন সে চায় না।এই চার দেয়ালের বাহিরে খোলা আকাশে্র নিচে মুক্ত স্বাধীন হয়ে বাঁচবে। এর জন্য তার যা করতে হয় সেসবটা করবে শুধু একটু সুযোগের অপেক্ষা ।
দূর দিগন্তে সূর্য মিলিয়ে এসেছে।এই তো আর কিছুটা সময় এরপর পৃথিবীর বুকে ঘুটঘুটে আঁধার দৈত্য নামবে।সেহের ভারি পেট নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে ফোঁসফোঁস করে বড় বড় শ্বাস ফেলছে।আজকাল অল্পতেই ভীষণ ক্লান্ত হয়।খাওয়া দাওয়ায় তার ভীষণরকম অরুচি ।খাবারের ঘ্রাণ নাকে আসলে গা গুলিয়ে আসে।ফলের জুস স্যুপ খেয়ে কোন রকম বেঁচে আছে।এ নিয়ে আরহাম ঝামেলা কম করে নি। ডক্টরদের ভাজাভাজা করে ছেড়েছে। ডক্টরের শত যুক্তিতেও সে মানতে নারাজ ।তার ভাষ্যমতে প্রেগন্যান্সিতে এমন অরুচির হবে কেন? নিশ্চয় সেহেরের কোন হেলথ প্রব্লেম আছে যা ডক্টর ধরতে পারছেনা। যার জন্য তাদের ভালাবুরা কম শুনায় নি!
ড্রইং রুমে আসতেই আরহামের দেখা মিলল।টেবিল ভর্তি আচার সাজিয়ে বসে।সেহের আড়চোখে দেখেও না দেখার ভান করে দূরে গিয়ে অন্য সোফায় বসে। মুখের সামনে ম্যাগাজিন খুলে মন দিয়ে পড়ছে । যেন এই মুহূর্তে ম্যাগাজিন পড়াটা অতি গুরুত্বপূর্ন কাজ।আরহামের পাশে দুজন মহিলা মেইড দাঁড়িয়ে।আরহাম প্রত্যেকটা আচারের ডিব্বা খুলে বিচক্ষণ ভাবে পরিক্ষা করছে।পাশে থাকা একজন মেইটকে উদ্দেশ্য করে বলল,”এসব স্বাস্থকর তো? ”
মেইড জড়সড় স্বরে উত্তর দিলো ,” জি স্যার , হোমমেইড! প্রসেসিং কাজ সতর্কতার আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে করা হয়েছে।”
আরহাম সেহেরের দিকে তাকিয়ে উৎসাহিত স্বরে বলল,”তোমার কোন আচার পছন্দ? এখানে সব রকম আচার আছে আমড়া ,চালতা ,আম ,তেঁতুল ,কড়মজা, বেল,জলপাই বড়ই আরো অনেক! ”
সেহের কোন কথা বলল না । আরহামের কথা না শুনার মত ভঙ্গিমা করে বসে রইল।আরহাম বলল, ” কি বললে না যে? কোনটা পছন্দ? ”
আরহাম সেহেরের উত্তরের আশায়তাকিয়ে । সেহের সেদিকে কোনরূপ পাত্তা না দিয়ে । ম্যাগাজিনে মুখ ডুবিয়ে বলল,” এখানে আমার পছন্দের কথা আসছে কেন? আসামিদের আবার ভালোলাগা মন্দলাগা থাকে নাকি! ”
সেহেরের ত্যাড়া উত্তরে আরহামের রাগ হয় ।কোন প্রকার প্রত্যুত্তর না করে চোয়াল শক্ত করে সোফা থেকে উঠে যায়।
রাতে সেহের ঘুমানোর প্রস্তুতি- ই নিচ্ছিল।এমন সময় আরহাম কোলে মাথা রেখে সটান করে শুয়ে পরে।সেহের বিরক্তির সাথে কপাল কুঁচকে ফেলে।তেজি স্বরে বলে,” ছাড়ুন আমাকে! ঘুম পাচ্ছে, ঘুমাবো । ”
কে শোনে কার কথা আরহাম ঠাই কোমড় চেপে শুয়ে। ফোলা পেটটায় অনবরত চুমু দিচ্ছে।সেহের আবারো বিরক্তির কন্ঠে বলল,”আমি ঘুমাবো ,ছাড়ুন! “”
আরহাম তোয়াক্কা না করে পেটে কান রেখে বলে ,”জানো বেবি তোমার মা ভীষণ পাজি ,ভীষন।বাবাকে একটুও ভালোবাসে না।খুব জ্বালায়। তুমি আসো দুজন মিলে মাকে খুব জ্বালাবো! কেমন? ”
আরহাম নিজে নিজেই বিরবির করছে।মাঝে মাঝে পেটে কান ঠেকিয়ে প্রত্যুত্তর শুনার চেষ্টা করছে।কি জানি শুনছে কিনা! পাল্টা প্রশ্ন করছে।
সেহের শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ।আরহাম বাচ্চা সুলভ আচরণ করছে । কে বলবে এই মানুষটার হাত অসংখ্য মানুষের রক্তে রঞ্জিত! এই মুহূর্তে আরহামকে দুনিয়ার সবচেয়ে নিষ্পাপ ভালো মানুষ মনে হচ্ছে।
এখন আরহামকে ভীষণ ভয় হয়। রেস্ট হাউসের সেই দৃশ্য মনে করে অসংখ্য বার চিৎকার করে ঘুম ভেঙেছে। দিনের পর দিন বন্দি আসামিদের মত কাটিয়েছে।
কি এমন ক্ষতি হতো ,যদি কোনদিন সত্যিটা সামনেই না আসতো।আরহাম আগের মত থেকে যেত। শান্তিময় ভালোবাসা পূর্ন সংসার হতো!

বেশ কয়েকদিন কেটেছে । আজ আরহাম সকাল থেকে বাড়িতে । ছাদে কিছু কাজ করাচ্ছে।যদিও এসব নিয়ে সেহেরের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই ।কাজের লোকেদের মুখে সবটা শুনা।সন্ধ্যায় সব কাজের লোকের ছুটি দিয়ে দেয়। বাড়িতে শুধু আরহাম আর সেহের।
রাতে আরহাম রুমে ফিরল।সেহেরের হাত টেনে বলল, ” চলো ”
“কোথায় যাবো? আমার এ মুহূর্তে কোথাও যাবার ইচ্ছে নাই! ”
হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল।আরহাম নাছোড়বান্দা শুনতে নারাজ।সেহেরকে কাছে টেনে জোর করে কোলে তুলে নিলো।ছাড়ানোর চেষ্টা করেও লাভ হলো না। আরহাম কোলে করে ছাদ অবধি নিয়ে গেল। ছাদে যেতেই সেহেরের চোখ ছানাবড়া।উঁচু বাউন্ডারি ঘেরা ছাদ ।আঁধার কাটাতে পুরো ছাদ জুড়ে আলোর মেলা। বড় বড় মোমবাতিতে সাজানো ,চারপাশে বড় বোর্ডে সেহেরের ছবি।যা আরহামের আঁকা।নেটের ধবধবে সাদা পর্দা গুলো উড়ছে।এই প্রথমবার সেহের ছাদে এসেছে।অবাক চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল ,”এসব কেন? ”
আরহাম উত্তর দিলো না।সেহেরকে কোল থেকে নামিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে।সেহেরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল।ঝুকে করুন স্বরে বলল,”আমার একটা সুযোগ চাই সেহের! আবার আগের মত তোমার ভালোবাসায় বাঁচতে চাই। তোমার এই ঘৃণার তীর আমাকে প্রতি মুহূর্ত ক্ষতবিক্ষত করছে। এক নতুন শুরু চাই! তোমাকে আমাদের সন্তানদের নিয়ে । ”
সেহের কোন প্রকার উত্তর দিলো না চুপ রইল। আরহাম আবার বলল, ” আমি চাই তুমি সবটা জানো আমার অতীত আমার বর্তমান অবস্থা, আমার হিংস্রতার কারণ সবটা জানো!
আমি জেনেশুনে জানোয়ার হইনি।আমাকে জানোয়ার বানানো হয়েছে।বিশ্বাস করো আমি কাউকে খুন করিনি! ”
আরহামের কথা গুলো সেহেরের কাছে আজগুবি মনে হচ্ছে।জীবনের এমন সময় এসেও সে মিথ্যা বলছে? সেহের নিজ চোখে আরহামকে খুন করতে দেখেছে তাহলে এসব মিথ্যা কেন?
এক ঝাড়িতে আরহামের হাত সরিয়ে।ক্রুদ্ধ স্বরে বলে,” এখনো মিথ্যা বলছেন? আর কত মিথ্যা বলবেন? আর কত!
আপনার চেহারা দেখতেও আমার ঘৃণা হয় । প্রচণ্ড ঘৃণা!
অতীত যাই হোক আমার ঘৃণার দেয়াল তা ভেদ করতে পারবে না। আমার শুধু আপনার থেকে মুক্তি চাই ,রেহাই চাই আমার! ”
আরহাম সেহেরকে নিজের দিকে টানল।গালে হাত রেখে করুন স্বরে বলল,”কেন এমন করছ? আমি জানি তুমি এখনো আমাকে ,আমাদের সন্তানকে ভালোবাসো ।শুধু জেদ ধরে আছো! ছাড়ো এই জেদ।চলো সব ভুলে আমরা নতুন করে শুরু করি।”
সেহেরের গালে ঠোঁট ছোঁয়াতে গেলে সেহের ধাক্কা দিয়ে দূরে সরে যায়। চিৎকার করে বলে, ” ছুঁবেন না আমাকে। আপনার ছোঁয়া আমার ঘৃণা হয়।নিজেকে পাপী মনে হয়! ”
“আমায় একটা সুযোগ দেও। সবটা ব্যাখ্যা করব! ”
“আবারো আপনাকে ভালোবাসা ,আমার পক্ষে অসম্ভব।আপনাকে ভালোবাসা আর মৃত্যুর মধ্যে বেছে নিতে হলে আমি মৃত্যুকে বেছে নিবো।”
সেহেরের কথায় আরহামের রাগ চরম পর্যায়। আজ সেহেরের উপর তার ভীষণ রাগ হচ্ছে। সে কেন এতো ঘৃণা করে ? সবটা ভুলে নতুন করে শুরু করতে চাইছে না কেন? প্রতিবার আরহামকেই কেন ভালোবাসার প্রমাণ দিতে হবে! আরহামের ভালোবাসাটি মিথ্যা? আরহামের হিংস্রতাকে দেখল। ভালোবাসাটা নাহ! সবটা কি অভিনয় ছিলো?
আরহামে রাগে সবকিছু ভাংচুর করতে লাগল । যেখানে ভালোবাসা নেই ,সেখানে ভালোবাসার মহল তৈরি করে কি লাভ? রাগে সব কিছু তচনচ করছে। সেহের জড়সড় হয়ে এক কোণায় দাড়িয়ে।চোখে বিনাশের ভয়।শরীর থরথর কাঁপছে।
হঠাৎ মোমবাতির আগুন সাদা পর্দা ছোঁয়। সাথে সাথে এক পর্দা থেকে অন্য পর্দা দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠে।পলকেই সেই আগুন পেইন্টিং বোর্ড ঘ্রাস করে।মুহূর্তে চারদিক আগুনে ঢেকে যায়। বের হবার সব পথ বন্ধ!

চলবে….❣️

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টি তে দেখবেন। প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here