#অদ্ভুত_প্রেমোমোহ_তুমি
#পর্বঃ২
✍️ তাজরিয়ান খান তানভি
রাতের তমসা দুর করে অক্ষিযুগল মেলে ভোরের সূর্য।জেগে উঠে পৃথিবী।মেতে উঠে সৃষ্টির কল্যানে।তাইতো সূর্য কে পৃথিবীর প্রান বলা হয়।
হালকা হাওয়ার দোদুল্যমান জানালার পর্দার ফাক গলিয়ে ভোরের সূর্য উকি দিচ্ছে আজরাহান এর ঘরে।সকালের মিষ্টি রোদ ছুয়ে দিচ্ছি প্রহর এর মুখচ্ছবি।পিট পিট করে চোখ খুলতে চেয়েও পারে না সে।কারন সতেরো বছরের এই জীবনে এর চেয়ে ভালো ঘুম সে কখনো যায় নি।গায়ের কাথা টা হালকা টেনে গুটি মেরে শুতে গেলেই অনুভব করে তার বিছানা ভেজা।এটা কি করে হলো??এইসব তো ছোটবেলায় হতো।এখন তো সে বড়।তার উপর কাল রাতে তার বিয়ে হয়েছে।তাও রাহান ভাইয়ার বিছানায়!!!ছিঃ ছিঃ এইসব কি ভাবছি।
হকচকিয়ে উঠে বসে প্রহর।আর দেখে পাশেই বুকে হাত ভাজ করে দাড়িয়ে আছে আজরাহান। সাথেই একটা বালতি।
“এইসব কি রাহান ভাইয়া??
“তোর সাহস কি করে হলো আমার বিছানায় ঘুমানোর??
“আপনিই তো বললেন।”
“কখন বলছি??
“রাতে।”
“এখন কি রাত!!!
নাম বলছি আমার বিছানা থেকে।”
“নামবো না।কি করবেন আপনি??
“মেরে তোর পা ভেঙে দিবো।”
“তাহলে দিন।ভেঙে দিন।”
আজরাহান প্রহর এর হাত ধরে টান দিয়ে নিচে নামায়।
“আর কখনো আমার বিছানায় ঘুমাবি না।”
“তাহলে কোথায় শুবো আমি।”
“জানি না।”
বলেই ওকে ধাক্কা মেরে সরায়।
প্রহর ওর পিছন থেকে বলে–
“আপনি একটা পাগল।”
“কি বললি তুই,,,
“পাগল,পাগল,পাগল,,
“তবে রে,,
প্রহর কোনো উপায় না দেখে দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে।
আজরাহান বিছানায় বসে ওকে শাসায়।
“আমি পাগল তাই না !!
একবার বের হ দেখাচ্ছি তোকে।”
আজরাহান হেলান দিয়ে বসে আছে বিছানায়।প্রায় পনেরো মিনিট হলো প্রহর এর কোনো সাড়াশব্দ নেই।
“কিরে বের হবি না আজ??
প্রহর হালকা করে ওয়াশরুম এর দরজা খুলে বাইরে পা টা একটু বের করে।আজরাহার ওর শুভ্র পায়ের দিকে তাকায়।কেনো যেনো ওর পায়ের শুভ্রতাও ওর মধ্যে অন্যরকম অনুভুতির সৃষ্টি করে।আজরাহান পা থেকে চোখ সরিয়ে উপরে তাকায়।
“ফ্রেশ না হয়ে বের হলি কেনো?
“আপনি তো আমাকে পুরো ভিজিয়ে দিয়েছেন।এখন শাওয়ার না নিলে হবে??
“তাহলে গোসল করেই বের হ।”
“আমার জামা কাপড়?
“ও আচ্ছা।তুই ভিতরে যা আমি নিয়ে আসছি।”
“আপনার আনতে হবে না। আমি নিজেই নিয়ে আসি।”
“এই ভেজা শরীরে বাইরে যাওয়ার দরকার নেই।তুই ভিতরে যা।”
“আচ্ছা।”
কিছুক্ষন পর আজরাহান পাশের রুম থেকে একটা লাগেজ থেকে কিছু জামা কাপড় এনে প্রহর কে দেয়।এই লাগেজটা কাল গুছানো হয়েছিলো প্রহর এর সাথে ওর শশুরবাড়ি যাবে বলে।যা সবই ভেস্তে যায়।
হঠাৎই আজরাহান এর কানে নিচ থেকে হট্টগোলের আওয়াজ আসে।ও বুঝতে পারে যুদ্ধের দামামা বেজে গেছে এখন শুধু অংশগ্রহণ বাকি।
সিড়ি ভেঙে নিচে আসে আজরাহান।এসেই দেখে তার কর্নপিশাচি বোন রাখে অগ্নিশর্মা হয়ে আছে।কর্নপিশাচি এই জন্যই বলে কারন ওর বোন যখনই এ বাড়িতে আসে ওর মায়ের কানের মধ্যে প্রহর আর ওর ভাবির নামে বিষ ঢালে।
সানায়া আহমেহ।ওদের তিন জনের মধ্যে সানায়া মেঝো।বিয়ে হয়েছে সাত বছর।একটা ছয় বছরের ছেলে আছে।আর এখন আবার এক্সপেক্টেড।কথায় ফুলঝুড়ির বদলে ধানি লঙ্কার তেজ ঝড়ে।বিয়ের পরপরই নিজের শশুড় শাশুড়ি কে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে শহরে গোবেচারা স্বামী কে নিয়ে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকেন।গোবেচারা এইজন্য যে আজরাহান এর দুলাভাই ওর বোনের কথায় উঠে আর বসে।তাই এই লোকটা কে ওর একদম ই পছন্দ না।
আজরাহান কে দেখেই চিৎকার করে উঠে সানায়া।
“তুই মানুষ হলি না।শেষ পর্যন্ত ওই রাস্তার মেয়ে টাকে বিয়ে করলি??
“ভদ্রভাবে কথা বলো আপু।”
আজরাহান সামনে রাখা সোফায় আরাম করে বসে।
“তুই আমাকে ভদ্রতা শিখাচ্ছিস??এই বাড়ির মান সম্মানের কথা একবারও ভাবলি না??
“বিয়ে করা কি অন্যায়?
তুমি করেছো,ভাইয়া করেছে।আমিও করে নিলাম।”
“বিয়ের জন্য আর মেয়ে পেলি না।ওই অলক্ষী কে তোর বিয়ে করতে হলো??
আজরাহান ক্ষেপে উঠে।
“প্রহর কে আর একটা বাজে কথা বলবেনা।
কাকে অলক্ষী বলছো??
তুমি তো খুব লক্ষী,,তাহলে তোমার সাথে বিয়ে হওয়ার পর তারাফ ভাইয়ের জীবনটা এমন হয়ে গেলো কেন??
সানায়া নাকি কান্না করে বলে–
“দেখলে মা,দেখলে তোমার ছেলে কি বলল আমাকে??
“তুই ওর কথায় কিছু মনে করিস না।”
“তা মনে করবে কেনো এইসব তোমার আশকারাতেই হয়েছে।”
কুহেলিকা এইবাব ছেলের উপর ভীষন রাগ হয়।
“এইসব কি শুরু করলি তুই।ওই রাস্তার মেয়ের জন্য তুই আমাদের কথা শুনাচ্ছিস??
“শুরু তো তোমরা করেছো।”
সানায়া আজরাহান এর একদম সামনে গিয়ে বলে–
“বুঝতে পেরেছি ওই মেয়ে তোকে জাদু করেছে।দেখেছো মা,একদিনেই আমার ভাইটাকে কিভাবে হাত করে নিয়েছে।”
আজরাহান উচ্চ শব্দে হেসে উঠে।
“তাবিজ আর প্রহর!!!
নো মাই ডিয়ার কর্নপিশাচি।প্রহর আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে।কি করে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসা যায় তোমাদেরও প্রহর এর কাছ থেকে শেখা উচিত।”
এরই মধ্যে সেখানে কারো হাতের তালির আওয়াজ শোনা যায়।
“বাহ,,ভালোই তো বলেছো।অবশ্যই প্রহর আমাদের শেখায় কি করে অন্যের হবু বর কে নিজের করে নিতে হয়।”
আজরাহান ওর ঠোঁটের কোন প্রসারিত করে বলে—
“আমি তো তোমার কথাই ভাবছি।এতো দেরি করলে যে??
এইবার তোমাদের তিনজনকে একসাথে দেখে পরানটা আমার জুড়িয়ে গেলো।তুমি এসে ষোলোকলা পূর্ন করলে।”
নুরাইসা,যার সাথে আজরাহান এর দু’মাস আগে এংগেজমেন্ট হয়েছিলো।
” কি করে পারলে এমন করতে তুমি??
“কি করে করেছি তার লাইভ ভিডিও আছে আমার কাছে।ওয়েট,,এখনই সেন্ট করে দিচ্ছি।”
“তুমি আমার সাথে মজা করছো??
আজরাহান খপ করে নুরাইসার হাত ধরে এংগেজমেন্ট রিং টা খুলে নেয় আর বলে–
“মজা তো তুমি আমার সাথে করেছো।সুইসাইড এর ভয় দেখিয়ে জোর করে এংগেজমেন্ট করেছো।নাউ দ্যা লাষ্ট শো ইজ কমপ্লিট।এখন আমি বিবাহিত।তোমার মতো শিক্ষিত মেয়ে অবশ্যই আমার দ্বিতীয় স্ত্রী হতে চাইবে না।আর চাইলেও তা সম্ভব নয়।আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড অন ইউ।গট ইট।”
আজরাহান ওর পকেটে হাত দিয়ে একলক্ষ টাকা বের করে কুহেলিকা বেগমের হাতে দেয় আর বলে–
“মাত্র একলক্ষ টাকার জন্য তুমি ওই অর্ধবুড়োর সাথে প্রহর এর বিয়ে দিতে চেয়েছিলে তাই না??
এই নাও তোমার টাকা।এইবার খুশি তো??
কুহেলিকার চোখ ছানাবড়া।আজরাহান দের টাকা তো
আছে কিন্তু টাকা অযথা সে খরচ করে না।আর আত্নসম্মানবোধ তার অনেক।এইটাকা তো সে তার বাবার কাছ থেকে নেয়নি।বন্ধুদের কাছ থেকেও নয়।কারন তা যদি হতো অনেক আগেই ও প্রহর কে এ বন্দিশালা থেকে মুক্ত করতো।
“এই টাকা কই পেলি??
“আম খাও আটি গোনার কি দরকার।
আর আজকের পর আমার স্ত্রী কেউ যদি আর একটা কথা শোনায় তার জন্য ভালো হবে না।”
উপস্থিত থাকা সবাই বুঝতেই পারছেনা এক দিনের মধ্যে এমন কি হলো আজরাহান এমন বদলে গেলো।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরের কোনায় দাড়িয়ে সব শুনছিলো প্রহর।ওকে দেখেই আজরাহান বলে–
“এখানে কেনো এসেছিস??
ঘরে যা।”
ঘরের কাজের মেয়েকে বলে যেনো প্রহর এর খাবার টা ওর ঘরেই দিয়ে আসে।
হনহন করে বেরিয়ে যায় আজরাহান।নুরাইসা,সানায়া আর কুহেলিকা যেনো পারলে এখন ই প্রহর কে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়।
প্রহর এর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।সে তার রাহান ভাইয়ার কথা মতো ঘরে চলে যায়।
,
,
,
বিশাল বড় হলরুম।দুধারে বড় বড় থাই গ্লাসের জানালা।কিন্তু তা পর্দার গহীনে ঢাকা।বাহিরের আলো প্রবেশের অধিকার নেই এই রুমে।দেয়ালের একপাশে দরজা ঠিক তার বিপরীত পাশের দেয়ালে কারো হাতের নিপুন কাজে করা একটা দেয়াল পেইন্টিং।ঠিক এইরকম আর একটা একটা পেইন্টিং আছে যা তুলিতে আঁকা।কিন্তু বিশাল দেয়ালের এই পেইন্টিং বিখ্যাত চিত্রকর মারশিয়াদ আরজান তার নিজের হাতে রঙের ছোয়ায় বানিয়েছেন।গত দু বছর ধরে তার রোজকার কাজ ঘুম থেকে উঠেই এই পেইন্টিং টিকে মন ভরে দেখা।
মারশিয়াদ আরজান।বাঙালি বংশোভূত এক আমেরিকা প্রবাসী।তার মা বাবার মৃত্যুর পর একমাত্র আপনজন তার দাদা তাকে নিয়ে আমেরিকা পাড়ি জমায়।সেখানেই তাদের সবকিছু।সিটিজেনশীপ পেয়ে সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল বিজনেস এর পাশাপাশি মারশিয়াদ এর শখ পেইন্টিং করা।তার বেশিরভাগ চিত্র নারীভিত্তিক।তাই দুইবছর আগে নিজের পেইন্টিং এর জন্য নতুন প্লট খুজতেই বাংলাদেশে আসে।আর এখানেই দেখা পায় তার বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘কাজলচোখী’ র সে কাজল চোখের কন্যাকে।
যার কিছুই সে জানে না।যানে শুধু তার দুই চোখ কে।সেদিন ই সে তার এই চিত্রকর্ম টি তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়।টানা একমাসের পরিশ্রমের বিনিময়ে সে তার চিত্রকর্মটি বানায় যার নাম দেয় “কাজলচোখী”।এটিই তাকে দেশখ্যাত সম্মান এনে দেয়।তার প্যাশন কে তার ক্যারিয়ার বানিয়ে দেয়।কিন্তু সব কিছুর আড়ালে সে এখনো তার ‘কাজলচোখী’ কে খুজে বেড়ায়।
দেয়াল পেইন্টিং টির সামনে দাড়িয়ে বলে–
“শোনো,কাজল চোখের মেয়ে আমার দিবস কাটে বিবশ হয়ে তোমার চোখে চেয়ে।”
—–সাদাত হোসাইন।
“কোথায় হারিয়ে গেলেন আপনি কাজলচোখী?আমি কি কখনো আপনাকে খুজে পাবো না?
আমার ভালোবাসাকে এইভাবে বৃথা করে দিবেন না আপনি।প্লিজ আরেকবার আমার সামনে আসুন।প্লিজ।”
রোজ ই এই কথা বলে মারশিয়াদ তার কাজলচোখীর স্মৃতিচারণ করে।আদৌকি সে খুজে পাবে তার কাজলচোখী কে??
রুম থেকে বেরিয়ে ফ্রেশেন আপ হয়ে খাবার টেবিলে বসে মারশিয়াদ।পাশেই দাড়ানো ইব্রাহিম।মারশিয়াদ এর দেখাশোনা করে।
“জানবাবা,একটা কথা ছিলো।”
“বলুন চাচা।”
“আউট হাউজে একটা মেয়ে এসেছে।আপনার সাথে দেখা করতে।”
“আপনি আমাকে আগে কেনো বলেন নি??
মারশিয়াদ ছুট লাগায় আউট হাউজে।কোনো মেয়ে দেখা করতে এলে মারশিয়াদ সময় নষ্ট করে না।
আউট হাউজে যেতেই দেখে একটি মেয়ে সোফায় বসে আছে।ওর উপস্থিতি টের পেতেই উঠে দাড়ায় মেয়েটি।হাসি হাসি মুখ।চোখের ঠিক নিচে গালের উচু অংশে একটা ছোট্ট তিল।মারশিয়াদ এক নজর দেখলো মেয়েটির চোখের দিকে।না,,সে তার কাজলচোখী নয়।
চোখ সংযত করে মারশিয়াদ।
মেয়েটি এখনো ওকে দেখে যাচ্ছে।সুবিশাল বক্ষদেশের এক সুদীর্ঘ সুপুরুষ।অধরের স্মিত হাসি।চুলের রঙ লালচে বাদামি।গাঢ় লাল অধর এর কোন হালকা প্রসারিত করতেই বামগালে ডিম্পল পড়ে যা কোন নারীর হৃদকম্পন বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট।
চলবে,,,