অদ্ভুত প্রেমোমোহ তুমি পর্বঃ২৭

0
1784

#অদ্ভুত_প্রেমোমোহ_তুমি
#পর্বঃ২৭
✍️ তাজরিয়ান খান তানভি

” মৃত্যু সে তো অমোঘ সত্য
করতে হবে তার স্বাধ গ্রহন
মিথ্যে মায়ায় পৃথিবীর আস্বাদন
মানুষ ভুলে যায় তার ভাগ্য নির্ধারণ।”

পূর্নতা অপূর্নতা নিয়েই মানুষের জীবন।জীবন সে তো কন্টকময়।তবুও তাকে ফুলের বিছানার মতো সাজাতে হয়।কখনো নিজের জন্য কখনো আপন মানুষদের জন্য।

সেপ্টেম্বর মাসের শেষ।ধুপ ধুপ বৃষ্টি।যখনই ইচ্ছে হয়।আকাশ ফুড়ে নেমে আসে।কারো তোয়াক্কা সে করে না।আজকাল ঋতুও তার মর্জি মতো চলে।

পাতলা কাথা জড়িয়ে শুয়ে আছে আজরাহান।ঘুমের ঘোরেই শুনতে পায় কিঞ্চির মিষ্টি কন্ঠের মিও মিও আওয়াজ আর সাথেই প্রহর এর হাসি।আজরাহান একটু নড়ে চড়ে আবার পাশ ফিরে শোয়।একজন নয় একের অধিক মানুষের হাসির আওয়াজ শুনতে পায় আজরাহান।চোখ বন্ধ অবস্থায় ঘুম কাতুরে কন্ঠে বলে—

“প্রহর একদম আমার কিঞ্চির গায়ে হাত দিবি না তাহলে তোর খবর আছে।”

হাসির আওয়াজ তীব্র হওয়ায় আজরাহান উঠে বসে।প্রহর খিলখিলিয়ে হাসছে সাথে যুক্ত হয়েছে সারাফ আর সূর্য্যি।
কিঞ্চি ফ্যাল ফ্যাল করে আজরাহান কে দেখছে যেনো অচেনা কেউ।

“এখানে হাসার কি হলো???

তিনজন মুখে হাত চেপে হাসতে থাকে।আজরাহান বিরক্ত হয়।উঠে গিয়ে প্রহর এর সামনে দাড়ায়।সূর্য্যি আর সারাফ ওর পিছনেই দাড়িয়ে মুখে হাত রেখে হেসেই যাচ্ছে।

“এই কি হয়েছে তোর।জ্বীনে ধরেছে তোকে !!
সকাল সকাল হাসছিস কেনো এতো??

প্রহর হাতে রাখা আয়না ওর মুখের সামনে ধরে।আজরাহান পুরো ঘুমন্ত মুখ কাজলে লেপ্টে দিয়েছে প্রহর আর তা দেখে হেসে চলছে ওরা।

“কি করলি এইসব তুই??

“ভ্যা।”

“তবে রে।”

প্রহর দৌড়ে ঘরের কোনায় যেতেই আজরাহান ওকে ধরে ফেলে।

“এইসব কেনো করলি??

“আমার ইচ্ছে।”

“ইচ্ছে না দেখাচ্ছি তোকে ইচ্ছে।”

আজরাহান ওর মুখের সাথে প্রহর এর মুখ ঘষতে থাকে ওর মুখের সব কাজল লেপ্টে যায় প্রহর এর মুখে।

“রাহান ভাইয়া,কি করছেন??

“কেনো,এখন ভালো লাগছেনা???

“আপনি আসলেই একটা হনুপাঞ্জি।”

আজরাহান ওর গাল,কপাল দিয়ে নিজের মতোই পুরো কাজলে লেপ্টে দেয় প্রহর এর মুখ।

সূর্য্যি আর সারাফ বেশ মজা পায়।হাত তালি দিয়ে হাসতে থাকে।
,
,
আয়নার সামনে দাড়িয় টাই এর নব ঠিক করছে আজরাহান।

“কোথায় যাচ্ছেন আপনি??

“আমার শশুড় বাড়ি।”

“আজ আপনি কোথাও যাবেন না।”

“অফিস কি সত্যিই আমার শশুড় বাড়ি নাকি যে দুদিন পরপরই ছুটি দিবে আমাকে??

“আপনি কোথায় যাবেন না আজ।”

আজরাহান ওকে টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।

“কে আটকাবে আমাকে??

“আমি।”

“তাই নাকি??

“জ্বি,আর আপনি ভাববেন না আমি একা।আমার সৈন্যদলও আছে আমার সাথে।”

“সৈন্যদল!!!

আজরাহান তাকিয়ে দেখে সারাফ তার ছোট্ট ক্রিকেট ব্যাট আর সূর্য্যি ওর ওর খেলনার রুটি বানানোর বেলন পিড়ির বেলন নিয়ে দাড়িয়ে আছে।

“এইসব শিখাস তুই ওদের??

“না মামাই।আম্মু বলেছে তোমাকে বাইরে যেতে না দিতে।আর গেলে এইটা দিয়ে তোমার পা ভেঙে দিতে।”

“সারাফ,বড়দের সাথে এইসব বলেনা।
তুই এমন কেনো করছিস??

“আপনি কোথাও যাবেন না আজ।
আপনার ভাবতে হবে না,আমি আশফিক ভাইয়া কে বলে দিয়েছি উনি সব ম্যানেজ করে নিবে।আপনি বসুন আমি আপনার জন্য স্যুপ নিয়ে আসি।”

আজরাহান প্রহর কে ছেড়ে দেয়।এই মেয়েটার মায়া ওকে দিন দিন আরো আড়ষ্ট করে ফেলছে।

প্রহর স্যুপ নিয়ে এসে দেখে আজরাহান ফ্লোরে বসে আছে।তার দুই পায়ের উপর বসে আছে সারাফ আর সূর্য্যি।ঘাড়টা হেলান দেওয়া বিছানার সাথে।সেখানেই বসে আছে কিঞ্চি।
প্রহর ওর সামনেই স্যুপ নিয়ে বসে।

“হা করুন,আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”

প্রহর ওদের তিনজন কেই খাইয়ে দেয়।

“আমরা আজ পিকনিক খেলবো।
ওকে বাচ্ছা পার্টি!!!

“ইয়েসসসস।”

“রাহান ভাইয়া চলুন।”

“কোথায়??

“বাগানে।আমি সব ঠিক করে রেখেছি।”

“তোকে এইসব করতে কে বলেছে??

“আপনার নানী।”

“তোর না রেজাল্ট দিবে??

“হা তো??

“ফেল করলে তোর ঠ্যাং কিন্তু আমি ভাঙবো।”

“ভাঙলে ভাঙবেন।তখন আপনাকেই আমাকে কোলে নিয়ে ঘুড়তে হবে।”
,
,
বাগানে রান্না বসিয়েছে প্রহর।তিন কোনায় ইট পেতে তা দিয়ে চুলা তৈরি করেছে।রান্না হচ্ছে।আজরাহান এর হাসোজ্জ্যল চেহারা দেখার সৌভাগ্য সবসময় হয় না।মনের অসুখ তাকে সবসময় ঘিরে রাখে।কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম।আজ আজরাহান এর হাসিতে মুখরিত পুরো বাড়ি। জানাল দিয়ে সব দেখে চলছে কুহেলিকা।ছেলের মুখের হাসি তার প্রান জুড়িয়ে দিয়েছে।কিন্তু প্রহর!!!

কিছু একটা আনার জন্য বাড়ির ভিতরের দিকে যাওয়ার সময় হাত আগলে ধরে প্রহর এর সানায়া।

“এইসব কি করছিস তুই?
তুই জানিস না ও অসুস্থ??ওর যদি কিছু হয় তাহলে তোকে আমি,,,

নন্দিতা ওকে থামিয়ে দেয়।

“সানায়া,প্রহর এর ভুল না খুজে নিজের ভাইকে একবার দেখো।আজরাহান কে কতোদিন পর হাসতে দেখেছো??

সানায়া আজরাহান এর দিকে তাকায়।সারাফ আর সূর্য্যির সাথে খেলায় মেতে আছে আজরাহান।ওর হাসি হাসি মুখ আজ সবার হৃদয়েয় বোঝা হালকা করেছে।
,
,
,
হসপিটাল এর করিডোর দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে আসে মারশিয়াদ।ক্যাবিনে ঢুকতেই ওর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে ইনশিরাহ।নেত্রনীর মারশিয়াদ এর ব্লেজার এভিজিয়ে দিচ্ছে।
কাল রাতে ইনশিরাহ সুইসাইড এটেম্পট করেছে।ওর বাবা একটা কাজে শহরের বাহিরে ছিলো।রাতের খাবারের জন্য ওসনিয়াত ওকে ডাকতে গেলে দেখে ও ফ্লোরে পড়ে আছে।আর হাত দিয়ে তির তির করে রক্ত বইছে।এতো রাতে কি করবে ভেবে পায় না।কলিং বেল এর আওয়াজ পেয়ে সেখানে গিয়ে দেখে আশফিক এসেছে।একটা ডেলিভারি ছিলো যেটা করা হয়নি।তা ফেরত দিতে এসেছিলো।দ্রুত আশফিক আর ওসনিয়াত মিলে ওকে হসপিটাল নিয়ে আসে।

মারশিয়াদ এর বুকে ইনশিরাহ কে দেখে আশফিক এর বুক চৈত্রের খা খা রোদ্রের মতো ওর বুকটা চিরে ফেলছে যেনো।ভীষন যন্ত্রনা সেখানে।

“আমি তাহলে আসি স্যার।”

মারশিয়াদ আশফিক কে ইশারা করে।

“তোমার সাথে আমার কথা আছে।”

“ওকে।আমি বাহিরে ওয়েট করছি।”

“হুম।”

আশফিক গিয়ে হসপিটাল এর বাইরে দাড়ায়।অস্বস্তি আগ্রাসন করছে তাকে।

“চলো,গাড়িতে উঠো।আমি পৌছে দিচ্ছি তোমাকে।”

গাড়ি চলতে শুরু করে।

“ইনশিরাহ কে পছন্দ করো??

মারশিয়াদ এর করা প্রশ্নে হালকা হোচট খায় আশফিক।

“তেমন কিছু নয়।”

“পুরুষ মানুষ তো।তাই অন্য পুরুষের চোখ পড়তে বেশি সময় লাগেনা।
ইনশিরাহ মেয়েটা বড় একা।ওর কাউকে প্রয়োজন।আর তা যদি তোমার মতো কেউ হয় তা মন্দ হবে না।”

“কিন্তু ও তোমাকে ভালোবাসে।”

“ভালোবাসি বললেই ভালোবাসা হয়ে যায় না।তুমি একটা সুযোগ নিয়ে দেখতে পারো।”

“ও দেবে আমাকে??

“ভালোবাসার অপর নাম বিশ্বাস।তোমাকে ওর বিশ্বাস অর্জন করতে হবে।”

“আর তুমি??
তুমি কি এখনো,,,

“নাহ।ওই অধ্যায় আমি অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছি।আমার কাজলচোখী মুক্ত।
মারশিয়াদ আরজান আর কখনো কাউকে ভালোবাসবে না।কখনো না।”

“কিন্তু,,,

“বাদ দাও এইসব।নির্ধার কি খবর??
ওকে বলো ওর এখন এক নয় দুই ভাই।তাই ওর বিয়ের কোনো কমতি তারা রাখবে না।ওর তো রেজাল্ট আজ।
তাহলে আগামী সপ্তাহে বিয়ের ডেট ফাইনাল করা হোক??

“তুমি যা ভালো মনে করো।”

“বিয়ের সম্পূর্ন অ্যারেঞ্জমেন্ট আমি করবো।আমার একমাত্র বন্ধুর বিয়ে বলে কথা।”

“এজ ইউর উইশ।”

“থ্যাংকস আ লট।”
,
,
,
চারপাশে সবুজের খেলা।হালকা বাতাসের দোল।সবুজ ঘাসের বিছানার উপর পা ভাজ করে বসে আছে নির্ধা।আর তাতে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে শিহরণ।এংগেজমেন্ট হয়েছে বলে এইটুকু অধিকার সে পেয়েছে।

“কি ভাবছেন ডক্টরবাবু??

“মারশিয়াদ এর কি হবে বুঝতে পারছি না।”

“কেনো??

“কাউকে কিছু না বললেও আমি জানি কতো টা চাপাকষ্ট নিয়ে দিন গুনছে ও।”

“প্রহর আজরাহান ভাইয়াকে খুব ভালোবাসে।”

“এই একটাই তো কারণ।নাহলে প্রহর কে তুলে নিয়ে মারশিয়াদ এর সাথে ওর বিয়ে দিতাম।”

“মারশিয়াদ ভাইয়া কে কেনো বলেন না সব ভুলে যেতে।”

“ও আমার কথা শুনবে না পিচ্চি।যদি শুনতো তাহলে এতোদিনে ওই শালার বিয়ে দিয়ে আমি ওর বাচ্চার চাচ্চু হতাম।”

“এভাবে কি জীবন চলে নাকি।কেউ আমার হলো না তাই বলে কি আমার জীবন থেমে থাকবে??

“তা বোঝার ক্ষমতা মারশিয়াদ হারিয়ে ফেলেছে।আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না ওর মতো অশান্ত ছেলে কি করে এতোটা শান্ত হয়ে গেলো!!!
নিজেকে ঢেলে দিচ্ছে অন্ধকারের গভীর সমুদ্রে।”
,
,
,
সময় চলে তার আপন গতিতে।তাকে না আটকানো সম্ভব না ফেরানো।

বাইরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে।হিমেল হাওয়া।একদম শান্তভাবে।জানালার পর্দা হুর হুর করে উড়ছে।প্রহর কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে আজরাহান।ওর ঘাড়ে মুখ ঘুজে পেটের উপর হাত দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।আজরাহান এর উষ্ণ নিঃশ্বাস প্রহর এর শরীরকেও উষ্ণতায় ভরিয়ে দিচ্ছে।আছরের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পথে।রক্তিম সূর্য পশ্চিম দিকে তার কমলা রঙের আভা ছড়িয়েছে।অক্ষিপল্লব হালকা ছড়াতেই প্রহর দেখে টুক টুক করে সূর্য্যি বিছানার উপর দু কনুই রেখে তার উপর মুখ রেখে তাকিয়ে আছে।কথা বলতে বলতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে ওরা দুজন দরজা লক করতেও মনে নেই।

আজরাহান এর ঘাড়টা সোজা করে ওর উপর থেকে হাত টা সরিয়ে দেয় প্রহর। আস্তে করে উঠে বসে।হালকা ঠান্ডা পড়ছে।পাতলা একটা কাথা মেলে দেয় আজরাহান এর শরীরে।
ঘুমন্ত আজরাহান কে আরো বেশি মায়াময় লাগে।প্রহর এর ইচ্ছে হচ্ছে আজরাহান এর গাঢ় লাল ঠোঁটে একটা চুমু খেতে।কিন্তু সূর্য্যি এখনো চেয়ে আছে।

প্রহর বিছানা থেকে উঠে সূর্য্যিকে কোমড় ধরে বিছানায় বসায়।

“মিষ্টি,তুমি এখানে এলে যে??

“প্রহরিনী,খেলবে না??

“খেলবো তো।তুমি যাও আমি নামায পড়ে আসছি।”

“আচ্ছা।”

প্রহর নামায শেষ করে উঠে দেখে আজরাহান এখনো ঘুমিয়ে আছে।পাশেই টেবিলে রাখা ওর মোবাইল টা নেয়।
বারান্দায় গিয়ে কাউকে কল করে।
ওপাশ থেকে বলে–

“কেমন আছেন আপনি??

“ভালো।”

“আজরাহান কেমন আছে??

“ভালো আছে।”

“আমাদের হাতে সময় নেই কাজলচোখী।আপনার রাহান ভাইয়াকে রাজী করান।যত দ্রুত সার্জারী হবে ততই সাকসেচফুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।”

“কেমন আছেন আপনি??

ওপাশ থেকে দুটো দীর্ঘশ্বাস আসে।তারপর লাইন কেটে যায়।কোমড় জড়িয়ে ওর ঘাড়ে চিবুক রাখে আজরাহান।

“কার সাথে কথা বলছিস??

প্রহর ঘুড়ে দাড়ায়।

“রেজাল্ট দেখছি।”

“পাশ করেছিস নাকি সেটা বল??

“হুম।”

“বাঁচালি আমাকে রসগোল্লা।”

“রাহান ভাইয়া,ডক্টর কাছে যাবেন??

“কেনো,তুই কি প্রেগন্যান্ট??
কই আমি তো কিছু করি নি!!!

“আপনি পঁচা কথা বলেন কেনো??

আজরাহান ওকে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে।খুব করে জড়িয়ে ধরে।

“আমি লুকাই আপনাকে
আপনাতে হই বিভোর
হৃদয়ের মনি কোঠায় রয়েছো
তুমি অনন্ত প্রহর।”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here