এক গুচ্ছো কদম পর্বঃ১৪

0
1390

#এক_গুচ্ছো_কদম
#পর্বঃ১৪
লিখাঃসামিয়া খান

হিমাদ্রি হাতটা ভালোভাবে হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ধুয়ে নিলো।পুরো হাতটা রক্তে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিলো।সময়টা এখন গৌধূলী আবিরমাখা বিকেলের শেষভাগ।তারপরও গরমকাল হওয়ার দরুণ কেমন যেনো ভ্যাপসা একটা গরম লাগছে।এ টাইপের ভ্যাপসা গরমে কেমন যেনো শরীর একটু পর পর ভিজে উঠে।ঠিক যেমন একটা গ্লাসে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করলে গ্লাসের গায়ে বিন্দু বিন্দু পানি জমে উঠে।

বেডের কাছে এসে হিমাদ্রি কিছুক্ষণ একমনে ঘুমন্ত মাদিহার দিকে তাঁকিয়ে রইলো।কতো শান্তিতে ঘুমাচ্ছে।একটু আগে বেশ কান্নাকাটি করেছে।খুব কষ্টে ঘুম পাড়াতে পেরেছে মাদিহাকে হিমাদ্রি।আর মেয়েটাও কেমন যেনো একরোখা স্বভাবের হচ্ছে।রাগ উঠলে হয় শরীরে আঁচড় কাঁটবে তা নয় দাঁত বসিয়ে দিবে।

মাদিহার থেকে চোখ সরিয়ে হিমাদ্রি পাশে শুয়ে থাকা মৃদুলের দিকে চোখ দিলো।চোখ বন্ধ করে কপালের উপরে ডানহাত দিয়ে রেখেছে।বাম হাতে ব্যান্ডেজ করা। অনেকটা কেঁটে গিয়েছে।প্রায় তিনটা স্টিচ লেগেছে কাঁটার জায়গায়।হিমাদ্রি জানে মৃদুল ঘুমাইনি।অবশ্য ঘুম আসার কথাও না।একটু আগে রোদসীর সাথে ওর বেশ বড় একটা ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়া এক পর্যায়ে রোদসী মৃদুলকে খুব জোরে ধাক্কা দেয়।তাল সামলাতে না পেরে মৃদুল পরে যায় এবং হাতে বেশখানিকটা জায়গা কেঁটে যায়।মৃদুলের হাত দিয়ে গলগল করে রক্ত পরা দেখে হিমাদ্রি দৌড়ে গিয়ে মৃদুলের কাছে গেলেও রোদসী কোন তোয়াক্কা না করে বাইরে নিজের কাজে চলে যায়।

কপালে কারো হাতের স্পর্শে চোখ মেলে তাঁকায় মৃদুল।হিমাদ্রি দাড়িয়ে আছে মৃদুলের দিকে করুণার দৃষ্টি নিয়ে।কিন্তু মৃদুলের দৃষ্টি খুব শান্ত! মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি।অথচ হিমাদ্রি জানে মৃদুলের বুকটা এখন সব জ্বলে পুড়ে গিয়েছে।

“কিছু বলবি হিম?”

“তুমি তো কিছু খাওনি মৃদ।চলো কিছু খেয়ে নেও।”

“তুই খেয়েছিস?”

“হুম খেয়েছি।”

“ওহ। “বলে মৃদুল আবার চোখ বুজলো।মৃদুলেকে এভাবে দেখে কান্নাগুলো উপচে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে হিমাদ্রির।সবসময় ঢোলাঢালা কাপড় পরা,,,মুখে এক ছাঁটের দাড়ী।কোনদিন জেল পরেনি চুলে, যে কোন স্টাইল জানেনা।সবসময় সবার কথা এক বাক্য মেনে নেওয়া সহজ সরল মৃদুল।মৃদুলকে এ অবস্থায় দেখে বুকের ভেতর কেমন যেনো চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে হিমাদ্রির।ঠিক যেমন চার বছর আগে হতো।হঠাৎ মৃদুলের ডাকে স্তম্ভিত ফিরে পেলো হিমাদ্রি,,,

“জানিস হিম আমার আসল পরিচয় হলো আমি একটা এতিম।ঠিক সৃষ্টির মতো।”

“ছিঃ মৃদ। এগুলো বলতে হয়না?তুমি কোন এতিম না।তোমার মা, বাবা,ভাই সবাই আছে।এবং একটা পরিবার আছে।তুমি কীভাবে এতিম হলে?”

“হ্যাঁ আছে আমার পরিবার। কিন্তু সত্যতা হলো আমি এতিম।আমার যখন দুই বছর তখন আমার বাবা মা মারা যায়।তারা ধানের মিলে সামান্য শ্রমিক ছিলো।একদিনের আগুনে পুড়ে দুজনেই মারা যায়।

“মৃদ এসব কথা বাদ দেও।খাবে চলো।”

হিমাদ্রির কথা কর্ণকুহর করলো না মৃদুল।আপনমনে বলে যেতে লাগলো,,,

“আমার বর্তমান যে বাবা সে ছিলো ধানের মিলের মালিক।তার ওপর যেনো কেও আঙুল না তুলতে পারে তাই আমাকে দত্তক নিয়ে নিলো।শুরু হলো তাদের সাথে জীবন। তারা অনেক ভালো মানুষ।মা,বাবা হিসেবে আর্দশ।কিন্তু পালক বাবা, মা আর আপন বাবা,মার মধ্যে একটা তফাৎ আছে।রোদসীকে যখন বিয়ে করলাম তখন আমাকে বাড়ী থেকে বের করে দেওয়া হলো।কারণ কী ছিলো আমার মা মেজর এট্যাক করেছিলো।অথচ জানিস আসল কাহিনী কী?মা এক মেডিসিন দুবার নিয়ে নিয়েছিলো যার কারণে তার এট্যাক এসেছিলো।ডক্টর যখন একথাটা বললো কেও বিশ্বাসও করলো না। সবার কথা আমার জন্য মা মরতে বসেছিলো।বাবা বাড়ী থেকে বের করে দিলো।অথচ নিজের যদি ঔরসজাত সন্তান হতো তাহলে হয়তো এত সহজে বাড়ী থেকে বের করতে পারতো না।

“মৃদ পুরনো কথা বাদ দেও।”

“বাদ দিতে বললেও বাদ দেওয়া যায় না রে হিম।রোদসীর সাথে বিয়ে করেও শান্তি পেলাম না।ওর আত্নহত্যার ভয়ে বিয়ে করলাম।তারপরও এরকম কেনো?আমি হয়তো ভবিষ্যতে কী হতে চলেছে তার ধারণা করতে পারছি।”

“কিছুই হবেনা মৃদ।তুমি এখন আমার সাথে চলো খাবে।”

মৃদ উঠলো না। সেভাবেই আবার চোখ বন্ধ করলো।হিমাদ্রি বড্ড বেহায়ার মতো একটা কাজ করতে মন চাইলো।মৃদুলের বুকে মাথা দেওয়া হয়তো জঘন্য নির্লজ্জতার কাজ হবে।খুব কষ্টে হিমাদ্রি নিজের এই ইচ্ছাটাকে দমন করলো।

,
,
,
রোদসীর হাতে ক্ষত জায়গাটা তুলো দিয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছে আহাদ।একটু আগে রোদসী খুব জোরে রেগে টেবিলে হাত দিয়ে একটা বারি দিয়েছিলো।টেবিলের ওপরে আহাদ সার্জারী ব্লেড রেখে দিয়েছিলো।যা রোদসীর হাতে লেগে হাত কেঁটে গিয়েছে।রোদসী একহাত আহাদ ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে আরেক হাত দিয়ে অনবরত চোখের পানি মুছে চলেছে সে।

“রোদসী কান্না করা অফ করো।ঠিক হয়ে যাবে তো।”

“ঘোড়ার ডিম হবে।আমাকে কতো বড় একটা ধোকা দিলো মৃদুল।মৃদুল ওই বাড়ীর ছেলে না।আমি এটা কয়দিন আগে জানতে পেরেছি।জানো তুমি তাও আমি ওকে কিছু বলিনি।অথচ আজকে ও আমার সাথে কেমন করলো।আমি কী ওর মায়ের দাসী যে তার সেবা করবো।আমাকে তোমার কাছে আসতো দিতে চেয়েছিলো না।”

“বুঝলাম রোদসী এখন কান্না বন্ধ করো।মুখটা তো একদম লাল হয়ে গিয়েছে।”

“হোক তাতে তোমার কী?”

“আরে পাগলী আমারই তো সব।”

“ভালো।”

“আচ্ছা তোমার প্রেগন্যান্সির কী হলো।”

কথাটা শুনে রোদসী কান্না অফ করলো।একটু এগিয়ে এসে আহাদের বুকে মাথা রাখলো।তারপর মিনমিনে গলায় বললো,,

“আমি এবোর্শন করিয়েছি। ”

রোদসীর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে আহাদ জিজ্ঞেস করলো,,

“মৃদ জানে এ ব্যাপারে?”

“নাহ।”

“বাচ্চাটা তো মৃদের ছিলো।তাহলে ওকে জানাওনি কেনো?”

“মন চায়নি তাই।”

“রোদসী আমি আর এভাবে পারছিনা।আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি। আমি চাই তুমি মৃদুলকে ডিভোর্স দেও।”

“দিয়ে দিবো আমি ডিভোর্স। যে ছেলের বংশপরিচয়টা ভিক্ষাতে পাওয়া তার সাথে আমি কোন সংসার করবো না।”

“সত্যি দিবে?কবে?”

“সময় ও সুযোগ আসুক।”

“আর মাদিহা?আমি কিন্তু আগেই বলে রাখছি আমি মাদিহার কোন দ্বায়িত্ব নিতে পারবো না।”

“নিতেও হবে না।”

“সিওর তো।”

আহাদের বুক থেকে মাথা তুলে রোদসী জবাব দিলো,,

“হুম সিওর।আর আমি তোমার সন্তানের মা হতে চাই অন্য কারো না।”
,
,
,
রাত একটা বাজে।সকলে ঘুমে অথচ সৃষ্টির রুমের লাইট এখনো জালানো।আর সৃষ্টি বিছানার বসে বসে গরম গরম বার্গার খাচ্ছে।তার পাশে বসে আছে হিমাদ্রি। এবং সামনের কাউচে আহনাফ আর মৃদুল বসে আছে। আর বিছানার মাঝখানে আরাম করে ঘুমাচ্ছে মাদিহা।

“মৃদ তোর কী খেতে অসুবিধা হচ্ছে?আমি খাইয়ে দিবো?

” তুই আমাকে খাইয়ে দিবি আহনাফ? ব্যাপারটা যেনো কীরকম হলো না?”

“আমার সবকিছু তে প্রশ্নবোধক না বসালে তোর শান্তি নেই তাইনা?”

“আরে ভাই দে খাইয়ে দে।তুইও কী মনে রাখবি।”

“স্লা। কতো ঢং তোর।”

মৃদুলের খাইয়ে দিচ্ছে আহাদ।মূলত বিকাল থেকে মৃদুল কিছুই খাইনি।আহনাফ মৃদুলের ব্যাপারটা জানলো তখন রাত ১১ঃ৩০ টা।তখনি বাইক নিয়ে বের হয়ে মৃদুলের জন্য রেস্ট্রুরেন্ট থেকে খাবার নিয়ে এসেছে।

দূর থেকে মৃদুল আর আহনাফ এর মধ্যে এতো ভালো বন্ডিং দেখে অবাক হয়ে গেলো সৃষ্টি। খাওয়া বাদ দিয়ে হিমাদ্রিকে জিজ্ঞেস করলো,,

“মৃদ ভাইয়া আর তোমার ভাইয়ের মধ্যে অনেকভাব তাইনা আপু?”

বার্গার খেতে খেতে হিমাদ্রি জবাব দিলো,,

“হুম।খুব ভাব।”

“তাইতো দেখতে পারছি।মৃদ ভাইয়ার জন্য এতো রাতে খাবার নিয়ে আসলো আবার এখন তার সমস্যা হচ্ছে দেখে নিজে খাইয়ে দিচ্ছে।”

“আসলে আহনাফ এর সংস্পর্শে আসলে মৃদুলের মন ভালো হয়ে যায়।দুজনে একদম ভাই ভাই।”

“মৃদ ভাইয়ার জন্যও আমারোও খুব খারাপ লাগছে।রোদসী ভাবী কী একটুও মায়া হয়না?

” বলতে পারছিনা। হয়তো হয়না।তাই এমন করছে।”

“মাদিহা কেও তো পাত্তা দেয়না।চুপচাপ রুমের দরজা লাগিয়ে শুয়ে আছে অথচ স্বামী, মেয়ের কোন খবরও নিলো না।”

“মানুষের স্বভাব দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝেনা।রোদসী ভাবীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।”

“একদম।খুব কঠিন সময় দেখতে হবে রোদসী ভাবীর দেখো।”

হিমাদ্রি কোন জবাব দিলো না।শুধু সামনে বসে থাকা মৃদুলের দিকে তাঁকালো।আহনাফের সাথে হেসে কথা বলছে আর আহনাফ পরম যত্নে খাইয়ে দিচ্ছে।মৃদুলের মুখে হাসিটা দেখে হিমাদ্রির বুকে কেমন যেনো শীতলতা বয়ে গেলো।

চলবে,,

আমি আগেই বলেছিলাম আমি ঠিকমতো গল্পটা সাজাতে পারছিলাম না।বাট এখন হয়তো পারবো আপনারা ধৈর্য্য ধরেছেন তার জন্য ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here