এক গুচ্ছো কদম পর্বঃ৮

0
1377

#এক_গুচ্ছো_কদম
#পর্বঃ৮
লিখাঃসামিয়া খান

মৃদুল সহজে হিমাদ্রির উপর রাগ করেনা।যদি কোনদিন দেখায় যে রাগ করেছে তা মূলত নিছক মজা ছাড়া আর কিছু হয়না।কিন্তু এবার মনে হয় সত্যি সত্যি রাগ করেছে হিমাদ্রির ওপর।সেদিন হিমাদ্রির স্কলারশিপ এক্সাম দিতে চাওয়া নিয়ে বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছে তাদের মধ্যে।হিমাদ্রিও নাছোড়বান্দা। সে এক্সাম দিবেই যা মৃদুল করতে দিবেনা।এই প্রথম হিমাদ্রি মৃদুলের ইচ্ছার বাইরে কোন কাজ করতে চেয়েছিল কিন্তু মৃদুল তা মেনে নিতে পারেনি।সেদিনের পর থেকে হিমাদ্রির সাথে কথা বলেনা মৃদুল।তাই বলে যে হিমাদ্রির সামনে আসেনা তা কিন্তু নয়।রোজ এক ঘন্টা করে হিমাদ্রির সাথে বসে থাকে।কিন্তু মুখ দিয়ে একটা কথাও বলেনা।শুধু হিমাদ্রি কোন কিছু জিজ্ঞেস করলে তার জবাব দেয়।

মৃদুলের মায়ের কন্ডিশন কিছুটা উন্নতির দিকে।এসময় যদি কোন প্রপার ট্রিটমেন্ট পায় তাহলে সুস্থ হতে খুব বেশী সময় লাগবে না। তাইতো বিজয় আর তার বাবা মিলে তাকে ভারতের মাদ্রাজ নিয়ে গিয়েছে পরর্বতী চিকিৎসার জন্য।সেজন্য সব দ্বায়িত্ব মৃদুলের কাঁধে এসে পরেছে। তার জন্য আরোও হিমাদ্রির সাথে কথা হয়না মৃদুলের।

হিমাদ্রি প্রায় হাঁপিয়ে উঠছে মৃদুলের থেকে এমন বিহেভিয়ার পেয়ে।একটু কথায় এমন রাগ। এত বছরে একদিনও মৃদুলের তার প্রতি রাগ দেখেনি।এই প্রথম দেখতে পেলে। যদিও মৃদুলের রাগ সম্পর্কে অবহিত সে।আবার মৃদুলের জন্য খারাপও লাগে ওর।এতো কষ্ট করতে হচ্ছে কাজের জন্য।ইদানীং মৃদলের প্রতি রোদসীও কেমন যেনো উদাসীন।মৃদুল কী করে না করে, কখন খাওয়া দাওয়া করে এগুলোর কোন কিছুর খেয়াল রাখেনা।শুধুমাত্র মেহেলতা আছে তাই ঠিকঠাক মতো খায়।তা না হলেও তাও খেতো না।

অনেক যত্ন করে মৃদুলের জন্য চকলেট ক্যারামেল পুডিং বানিয়েছে হিমাদ্রি। এ জিনিসটা মৃদুলের অনেক প্রিয় কিন্তু হিমাদ্রির উল্টো।আগে যখন মৃদুলের মা বানাতো এই পুডিং তখন সারাদিন মৃদুলের থেকে পালিয়ে বেড়াতো হিমাদ্রি। একবার দেখতে পেলে হিমাদ্রিকে জোর করে গিলাবে এই পুডিং। যার ফলাফল হিমাদ্রি বমি করে ভাসিয়ে দিবে।তাও সবসময় জোর করে খাওয়াতো।সেই কথাগুলো এখন মনে হলে হাসি পায় হিমাদ্রির।কতো সুন্দর ছিল দিনগুলো।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাটিতে করে পুডিং নিয়ে মৃদুলের রুমের দিকে এগিয়ে চললো।

,
,
,
এতো কাজের ধকল সত্যি সামলাতে খুব কষ্ট হয় মৃদুলের।কিন্তু কিছু করার নেই।সে না দেখলে সব এলোমেলো হয়ে যাবে।আজোও ঘরে ফিরে রোদসী কে দেখতে পেলো না মৃদুল।আগে জিনিসটা খারাপ লাগতো কিন্তু এখন বিষয়টা তার কাছে ডাল ভাত।বিছানার মাঝখানে হাত পা চারদিকে দিয়ে আরাম করে ঘুমিয়ে রয়েছে মাদিহা।মাদিহার শোয়ার স্টাইল দেখে হেসে দিলো মৃদুল।একটু ঝুঁকে কপালে ছোট করে একটা চুমো এঁকে দিলো।একটু নড়েচড়ে উঠলো মাদিহা।মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদুল বললো,

“একদম ঠিক আমার হিমের মতো “।

” আমার মতো হয়ে লাভ কী”?

কথাটা শুনে মাদিহার থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাঁকালো মৃদুল।ট্রেহাতে দাড়িয়ে আছে হিমাদ্রি।

“জানিনা কী লাভ”।

” ওহ আচ্ছা।তোমার ফেভারিট পুডিং বানিয়েছি। খাবে?”

“ডিভানের ওখানে রাখ আমি আসছি”।

হিমাদ্রি গিয়ে ট্রে টা ডিভানের ওপরে রাখলো।পাশে গিয়ে মৃদুল বসে ট্রে টা নিজের দিকে টেনে নিলো।কিছুনা বলেই চামচ দিয়ে কেঁটে কেঁটে পুডিং খাওয়া শুরু করলো। পাশ থেকে এক দৃষ্টিতে মৃদুলের খাওয়া দেখতে লাগলো হিমাদ্রি। সে ভেবেছিল মৃদুল হয়তো ওকে খাইয়ে দিবে।কিন্তু না অভিমান এবার খুব প্রকোটভাবে জমাট বেঁধেছে।

হিমাদ্রির মুখের সামনে চামচ উঠিয়ে ধরলো মৃদুল।কিন্তু সে হিমাদ্রির দিকে তাকায়নি।একটু হেসে পুডিং সহ চামচটা মুখে পুরে নিলো হিমাদ্রি। বেশ কয়েকবার মুখে দেওয়ার পর অবাক হয়ে হিমাদ্রির দিকে তাকালো মৃদুল।

“তুই পুডিং এতো সহজে কীভাবে খেলি?বমি আসলো না!”

“না তো। আমি পুডিং খাওয়া শিখে গিয়েছি”।

” ওয়েল ডান।এতো চেঞ্জ মানুষ হয় তা তোকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না”।

“মৃদ তুমি জানো এই পৃথিবীর সবকিছু পরিবর্তনশীল। কিন্তু তাই বলে মানুষ যে পরিবর্তনশীল তা কিন্তু নয়।মানুষ কখনো চেঞ্জ হয়না।যদি কোন কিছু চেঞ্জ হওয়ার থাকে তা হলো মানুষের স্বভাব, আচার আচরণ,মনুষ্যত্ব।”

“ভালো দার্শনিক হয়েছিস তো”।

” দার্শনিক হতে চাইনা। কারণ দার্শনিক মানুষ সবকিছুতে তার যুক্তি খুঁজে।আর আমার মতে সবকিছু যুক্তি দিয়ে পরিমাপ করা যায়না।এর বাইরেও কিছু রয়েছে “।

“ভালো এভাবেই চেঞ্জ হতে থাক।কয়দিন পরে তো ভুলেই যাবি মৃদুল নামের কেও ছিল তোর জীবনে”।

” সিনেমার ডায়ালগ দেও?”

“কই না তো”।

” এখনো রাগ করে রয়েছে “।

” আমি রাগ করিনি”।

“তাহলে অভিমান? ”

“জানিনা”।

” আমি যদি এক্সাম না দেই তো আমার ওপর তোমার রাগ কমবে?”

কথাটা শুনে তড়িৎবেগে হিমাদ্রির দিকে তাকালো মৃদুল।

“সত্যি তুই এক্সাম দিবিনা?”

“হুম দিবো না”।

” আমি জানতাম তুই আমার কথা রাখবি”।

“ওহ আচ্ছা”।

” তুই যেখানে খুশী সেখানে এক্সাম দে আমার কোন সমস্যা নেই।শুধুমাত্র এই স্কলারশিপ এক্সাম বাদে”।

“ঠিক আছে দিবো না”।

” হিম তুই আমাকে প্রমিজ কর কোনদিন আমাকে রেখে কোথাও যাবিনা।যতোদিন আমি না বলবো”।

“প্রমিজ,,যদি কোনদিন তুমি চলে যেতে বলো তো সেদিন আমি চলে যাবো”।

” আর আমি তোকে কোনদিনও যেতে বলবো না”।

“দেখা যাবে”।

মৃদুল কথাগুলো শুনে হাসিমুখে পুডিং খেতে লাগলো।মৃদুলের হাসিমাখা মুখটা দেখে বুকটা ছ্যাঁদ করে উঠলো হিমাদ্রির।এই প্রথম মৃদুলকে কোন মিথ্যা কথা বললো সে।হিমাদ্রি এক্সামটা দিবে এবং মৃদুলকে তা না জানিয়ে।যদি এক্সাম ক্লিয়ার করে হিমাদ্রি তারপর মৃদুলকে কী জবাব দিবে সে জানেনা।কিন্তু মৃদুলের এই মুখের হাসির জন্য সব করতে পারে হিমাদ্রি।

,
,
,
পুরো ফুচকাটা মুখে পুরে নিলো সৃষ্টি। কালকে রাতে খুব করে তার ফুচকা খেতে মন চেয়েছিল কিন্তু কাওকে বলতে পারিনি লজ্জায়। তাইতো আজকে কলেজ ছুটির পরে বসে বসে ফুচকা খাচ্ছে।কিন্তু সে একা।একটা ভালো উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে সে পড়াশোনা করে।তবুও তার কোন ফ্রেন্ড নেই।একে তো ইতিম তারমধ্যে এখন আবার অন্তঃসত্ত্বা কেও এটা ভালো চোখে দেখেনা।যদিও সবাই জানে ও বিধবা কিন্তু বিয়ের কাহিনী সবাই শুনলে দূরে দূরে থাকে।আশেপাশে অনেক মানুষ এখানে ফুচকা খাচ্ছে যার যার সহচরী নিয়ে। শুধুমাত্র সৃষ্টি একা বসে রয়েছে। এগুলো দেখে খুব খারাপ লাগে সৃষ্টির। সত্যিই সে বড্ড একা এই পৃথিবীতে।

“তুমি দুর্জয়ের বউ সৃষ্টি তাইনা।”

” হুম কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনতে পারলাম না”।

“আমি তোমাদের প্রতিবেশী। সম্পর্কে তোমার আন্টি লাগি।”

“ওহ আচ্ছা”।

” তুমি এই কলেজে পড়ো?”

“জ্বী ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার “।

” তাই নাকী।হ্যাঁ রে রিনতি তুই ওকে চিনিস?”

পাশ থেকে সৃষ্টির সমবয়সী একটা মেয়ে বিরস মুখে বললো,,

“হ্যাঁ চিনি।থার্ড গার্ল আমাদের ক্লাসের”।

” তাই নাকীরে। তা কয়টা টিউশন পড়ো তুমি”।

“পড়িনা”।

” বাহ! টিউশন না পড়েই এতো ভালো করো।তা ভিতরের কাহিনী কী?”

“মানে বুঝলাম না আন্টি?”

“ন্যাকা বুঝোনা।তোমাদের মতো মেয়ে অবশ্য ন্যাকামী ছাড়া কী পারে।প্রথমে দুর্জয়ের সাথে ন্যাকামী করলে।বেচারাটা মারা গেলো।এখন আবার কার সাথে করো যে সে তোমাকে এতো ভালোভাবে পড়ায়?”

কথাগুলো শুনে বোকাবনে গেলো সৃষ্টি। এবং কথা গুলোর মর্ম বুঝতে পেরে লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে গেলো তার।কথাগুলো বেশ জোরেই বলেছে ভদ্র মহিলা।আশেপাশের মানুষ তা ভালোভাবে শুনতে পারবে।

“কীহলো বলো এতো অভদ্র কেনো তুমি।বড় একজন একটা কথা জিজ্ঞেস করেছে তার উত্তর দেও”।

সৃষ্টি কিছু বলার আগেই পাশ থেকে একটা পুরুষালী কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে আসলো।

” ঠিক সৃষ্টি তুমি এতো অভদ্র কেনো আন্টির কথার জবাব দেও”।

সৃষ্টি তাকিয়ে দেখে আহনাফ দাড়িয়ে রয়েছে। এবং বেশ একটা ফরমাল লুকে।মহিলাটি ভ্রু কুঁচকে আহনাফকে জিজ্ঞেস করলো,

“আহনাফ তুমি এখানে কী করো?”

“আন্টি ওই পাশের একটা আপার্টমেন্ট তৈরীর কাজে এসেছি। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম আপনাদের দেখতে পেলাম তাই এখানে আসা।নেও সৃষ্টি ডিও খাও।”

সৃষ্টি নিল না ডিও এর ক্যান।ঠায় ফুচকার প্লেটের দিকে তাকিয়ে রইলো।যখন আহনাফ একটা ধমক দিলো তখন সুরসুর করে নিয়ে নিলো।ক্যানটা খুলে একটু মুখে দিয়ে হাতে নিয়ে রইলো।কাঁদছে সৃষ্টি কিন্তু তা নিঃশব্দে।সৃষ্টির প্লেট থেকে আহনাফ একটা ফুচকা খেয়ে নিলো।

“জানো সৃষ্টি আমার একটা রোগ আছে।সেটা সবসময় প্রকাশ পায় না।কখন প্রকাশ পায় যখন আমার থেকে বয়সে বড় এবং সো কল্ড ভদ্র কেও কোন অনুচিত কথা বলে।ছোট ক্ষেত্রে আসেনা কারণ তাদের জবাব দেওয়া যায়।(লিখাঃসামিয়া খান)তো রোগটা হলো যখনি এসব ভদ্র মানুষের মুখ থেকে কারো মান বা ভদ্রতার কথা শুনি পেটের ভিতরে পাক দিয়ে উঠে।আমার রুমে লাগানো একটা ত্যাগস্থান রয়েছে যাকে শুদ্ধ বাংলায় বলি শৌচালয়।তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে পেটের ভিতর থেকে সব বের করে দিয়ে আসি।মনে করি এইযে যে ব্যাক্তি গুলো অন্যের মান,ভদ্রতা,এবং ক্লাস বিচার করে তাদের আমি ফ্লাস করে দিলাম।তাদের মূল্য আমার জন্য পেট থেকে বের করা রাফেজের মতো যা একবার বের করলে আর নেওয়া পসিবল না।তো জাস্ট থিংক যে তোমাকে কেও নেগেটিভ কিছু বললো তো তারা রাফেজ হয়ে গেলো।তখন আর এই কান্নাগুলো আসবে না”।

আহানাফের কথাগুলো শুনে আশেপাশে সবাই হা হয়ে গেলো।এতোসময় পরে সৃষ্টি মুখ খুললো,,

“খাওয়াটা নষ্ট না করলে চলছিল না?”

“খাওয়া নষ্ট হয়েছে বুঝতে পারিনি তো”।

” আহনাফ তুমি এতোটা জঘন্য ছেলে।আমাকে কীসের সাথে তুলনা করলে। তাও আবার এমন মেয়ের জন্য।”

“জ্বী আন্টি আমি জঘন্য। কিন্তু এই জঘন্য ছেলেকে আপনার মেয়ে রাত করে রাস্তায় একা পেয়ে জোর করে জরিয়ে ধরে।অন্যকে জঘন্য বলার আগে নিজের দিকটা একবার দেখবেন।চলো সৃষ্টি “।

ফুঁচকার বিলটা মিটিয়ে সেখান থেকে সৃষ্টিকে নিয়ে এসে পরলো আহনাফ। একটু দূরে এসে আহনাফ জিজ্ঞেস করলো,,

” গাড়ী নিয়ে আসোনি কেনো?”

“বমি আসে গাড়ীতে। রিকশা করে চলে যাবো”।

” তার দরকার হবেনা আমি বাইকে করে দিয়ে আসি চলো।আর নো আরগু উইথ মি।”

মাথা নাড়ালো সৃষ্টি।আহনাফ বাইক আনতে চলে গেলো।আর সৃষ্টি রাস্তায় পাশে সেই জায়গাটায় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো যেখানে রোজ দুর্জয় তার জন্য দাড়িয়ে অপেক্ষা করতো।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here