#এক_গুচ্ছো_কদম
#পর্বঃ৯
লিখাঃসামিয়া খান
দুপুরের মধ্যেই আজ অফিস থেকে ফিরে এসেছে মৃদুল।চেহারাটা একদম মলিন হয়ে আছে।উস্কখুশকো চুল,ঘামে ভেজা শরীর পরনের কাপড়টা এলেমেলো।কোনমতে নিজেকে টানতে টানতে রুমে নিয়ে আসলো।রুমের ভেতরে কেও নেই। রোদসী তো কোনদিনও থাকেনা। আজকে মাদিহাও নেই।হয়তো হিমাদ্রির কাছে আছে।মাদিহাকে নিয়ে মৃদুলের এতো টেনশন নেই।শুধু রোদসীর এরকম ব্যাবহার মৃদুলকে যথেষ্ট ভাবায়।
কোনমতো শাওয়ার নিয়ে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পরলো মৃদুল।শরীর তাপমাত্রা হয়তো বেড়ে গিয়েছে। মুখটা তেতো তেতো লাগছে।হয়তো জ্বর এসেছে। চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে কিছু ভেবে চলেছে।
রোদসী ও মৃদুল একই ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করতো।এবং একই সাবজেক্ট হওয়ার দরুণ দুজনের মধ্যে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠে।একসময় তা প্রণয়ে পরিণত হয়।দুজনেই ছিল সমবয়সী।একটা ছেলের জীবনে বয়স কোন এফেক্ট না থাকলেও একটা মেয়ের জীবনে তার এফেক্ট রয়েছে।বয়স যতো বাড়ে বিয়ের ব্যাপারটা ততো ঘনিয়ে আসে।অর্নাস ফোর্থ ইয়ারে পড়ার সময় রোদসীর বাবা মা রোদসীকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপরে লাগে।আগে মৃদুল বিষয়টা ঠেকাতে পারলেও তখন বিষয়টা আটকানোর মতো পজিশনে ছিলনা।
অবশেষে কোন উপায়ান্তর না পেয়ে মৃদল বাধ্য হয় নিজের পরিবারকে রোদসীর বিষয়টা জানাতে।রোদসীর বাবা ঘুষখোর পুলিশ হওয়ার কারণে মৃদুলের বাবা তাদের রিলেশনটা মেনে নেয়না।এবং মৃদুলকে সব শেষ করে দিতে বলে।মৃদুল কোনদিন তার বাবার অবাধ্য হয়নি।তাই সে সত্যি সত্যি রোদসীর সাথে সবকিছু শেষ করে দেয়।কিন্তু কিছুদিন পরে রোদসী সুইসাইড করার চেষ্টা করে।একবার না তাও বেশ কয়েকবার।ভাগ্য ভালো যে প্রত্যেকবার বেঁচে যায়।শেষবার যখন চেষ্টা করে তখন রোদসীর অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে যায়।রোদসীর বাবা মৃদুলকে ওয়ার্নিং দেয় যদি রোদসীকে না বিয়ে করে তো সে অবশ্যই এমন কিছু করবে যার পরিণাম ভালো হবেনা।অনেকটা তোপের মুখে পরে মৃদুল রোদসীকে বিয়ে করে।রোদসীকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের পরিবারের সাথে খারাপ করে বসে মৃদুল।
এসব পুরোনো স্মৃতিগুলো ভাবতে ভাবতে অচিরেই বুক ফেঁটে একটা আর্তনাদ বের হয়ে আসলো মৃদুলের।শরীর খুব খারাপ লাগছে তার।হয়তো জ্বরটা জেঁকে বসছে তার ওপর।ব্ল্যানকেট গায়ে জরিয়ে পাশ ফিরলো মৃদল।ক্ষীণ কণ্ঠে শুধু একটা বাক্যই মুখ থেকে বের হলো তার।
“এমন কোন কাজ করো না রোদসী যার জন্য আমি একদম টুকরো টুকরো হয়ে যাই”।
,
,
,
দূর থেকে সৃষ্টিকে এক নজরে দেখে চলেছে আহনাফ।বসে বসে দোলনায় দোল খাচ্ছে সে।দুর্জয় মারা গিয়েছে তিন মাস হয়েছে। কিন্তু তাও এখনো অনেকটা চুপ করে থাকে সৃষ্টি। হিমাদ্রির ক্ষেত্রেও তাই।অথচ এদুটো মেয়ে ঠিক প্রাণোবন্ত ছোট কিচিরমিচির করা পাখির ন্যায়।সত্যিই পরিস্থিতি সবসময় অনুকূলে থাকেনা।
“আমি এখানে বসতে পারি সৃষ্টি?”
আহনাফের কথায় মুখ দিয়ে কোন শব্দ করলো না সৃষ্টি। শুধু ঘার এক পাশে এলিয়ে সস্মতি প্রকাশ করলো।অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে তারপর সৃষ্টির পাশে গিয়ে বসলো আহনাফ।
“তোমার শরীর এখন কেমন?”
“জ্বী ভালো।”
“পড়ালেখা ঠিকমতো হয়তো?”
” হ্যাঁ করার চেষ্টা করি।”
“ভালো।মোটা হয়েছো একটু”।
” সাতমাস রানিং তো মোটা হওয়া স্বাভাবিক।”
“ছেলে হবে না মেয়ে হবে তা কী জানো?”
“না।ডক্টর বলেছে টুইনস হবে”।
টুইনস কথাটা শুনে খুশীতে আহনাফের চোখ চকচক করে উঠলো।
” সত্যি টুইনস হবে!”
“জ্বী।”
“বাহ আমার তো তাহলে দ্বায়িত্ব বেরে যাবে”।
“আপনাকে একটা কথা বলি আহনাফ। ”
“বলেন। ”
“কেনো শুধু শুধু একটা ঘটনা তৈরী করতে চাচ্ছেন।আমাকে বিয়ে করে কোনদিনও সুখি হবেন না।আবার সমাজ কী বলবে তা একবার ভেবে দেখেছেন।”
“সমাজ নিয়ে আমি কখনো পরে থাকিনা সৃষ্টি। সমাজ!এই একটা শব্দের জন্য অনেক মানুষের তার স্বপ্ন গুলো বিসর্জন দিতে হয়।বিনিময়ে সমাজ তাকে শূন্য ঝুলি উপহার দেওয়া ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনা”।
” আর পরিবার?আপনার বাবা মা কখনো আমাকে মেনে নিবেনা।আপনার ভাইয়ের যা স্বভাব দেখলাম তাতে আপনার বিয়ে তার স্ত্রীর বোনের সাথে দেওয়ানো হয়তো তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।”
“তুমি হিমকে তো অনেক কাছে থেকে দেখেছো।তাতে কী তোমার কোথাও মনে হয়েছে ওর মধ্যে চিমটি পরিমাণ নেগেটিভিটি রয়েছে। নেই তো!!আসলে বাবা,মা যে পথ দিয়ে যায় সন্তান ও সে পথ দিয়ে যায়।বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন যেমন আমার বড় ভাই।কিন্তু আমি ও হিম আমাদের বাবা, মায়ের মতো হয়েছি।হিম যেরকম কথা শুনে কোন নেগেটিভ রিয়াক্ট করেনি।তেমন আম্মু,আব্বু ও করবে না।”
“আমি যদি না রাজী থাকি তাহলে তো আর জোর করতে পারবেন না আপনি।”
“হয়তো করতে পারবো না। জানো সৃষ্টি তুমি আমার থেকে পুরো এগার বছরের ছোট।এখনও একটা ছোট মেয়ে তুমি।তাই সমাজের এতো ভয়।আরোও বড় হও দেখবে এতো ভয় থাকবেনা।”
“মেয়ে অথবা ইতিম হয়ে জন্ম নিয়ে দেখতেন কেনো আমি এতো সমাজের ভয় করি”।
” মেয়ে হওয়া এখন আর পসিবল না।আচ্ছা আমি এখন সিগারেট খাবো।তাই উঠছি পরে কথা হবে।”
আহনাফ দোলনা থেকে উঠে চলে যেতে নিলে সৃষ্টি বেশ মিনমিনে গলায় বললো,,
“দুর্জয় কখনো সিগারেট খেতো না।”
কথাটা শুনে থমকে গেলো আহনাফ। সৃষ্টির সামনে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দাড়ালো।নিজের ডান হাতের তর্জনি সৃষ্টির থুতনীতে ঠেকিয়ে মুখটা উপরে তুলে ধরলো।
“আমি দুর্জয় না সৃষ্টি। আমি আহনাফ। আমাকে দুর্জয়ের সাথে মিলাবেনা।যেদিন তুমি এই আহনাফকে গ্রহণ করতে পারবে সেদিন আমিও তোমাকে গ্রহণ করবো।যদি তার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করতে হয় তাও করতে আমি একটুও দ্বিধাবোধ করবো না।”
,
,
,
বর্তমানে মাদিহার বয়স হলো আটমাস।এখন পর্যন্ত দাড়াতে শিখেনি।কিন্তু হামাগুড়ি দিয়ে বসতে পারে।রোদসী প্রায় সময় বাসার বাইরে থাকে।এজন্য হয় হিমাদ্রি তা না হয় মেহেলতার কাছে থাকে মাদিহা।সৃষ্টিও অনেক আদর করে ওকে।
একটু আগে মাদিহাকে খাইয়ে মেহেলতার কাছে দিয়ে এসেছে হিমাদ্রি। মৃদুল ফিরেছে অনেকক্ষণ কিন্তু এখন পর্যন্ত খেতে আসেনি বলে তাই হিমাদ্রি ডাকতে এসেছে।কিন্তু এসে মৃদুলের এতো জ্বর দেখে একদম ভড়কে গেলো হিমাদ্রি।
“মৃদ তোমার এতো জ্বর অথচ তুমি কাওকে কিছু না বলে এমন মরার মতো পরে আছো।”
কোন কথা বলে হিমাদ্রির ডান হাত নিয়ে নিজের কপালে রাখলো।
“হিম আমার কপালে নিজের হাতটা রেখে আমার পাশে বসে থাক।তোর ছোঁয়া পেলে কেমন যেনো শান্তি লাগে।”
“হ্যাঁ আমি তো শান্তি দেওয়ার মেশিন।জ্বর এসেছে ঠিকমতো মেডিসিন নিবে তা না যতোসব উদ্ভট কথা বার্তা।”
“এমন কেনো করিস।আগে ছোট বেলায় জ্বর আসলে কেমন যত্ন করতি।মা ও করতো।কিন্তু গত চার বছর ধরে যতোবার এই জ্বর এসেছে কারো যত্ন পায়নি।নিজে নিজে ঠিক হতে হয়েছে। ”
মৃদুলের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে হিমাদ্রি জিজ্ঞেস করলো,,
“কেন রোদসী সেবা করেনি।”
“কে,রোদসী!রোদসী তো নিজের জীবন নিয়ে এতো বিজি যে আমার খবর রাখেনা।বিয়ের পর থেকে এরকম করে।জানিস মাদিহা কেও রাখতে চায়নি।জন্ম নেওয়ার আগেই মেরে ফেলতে চেয়েছিল।আমার জন্য তা পারেনি।”
কথাগুলো শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো হিমাদ্রি। সে এতোদিন জানতো রোদসী অনেক খেয়াল রাখে মৃদুল আর মাদিহার কিন্তু এখানে তো ব্যাপারটা পুরো ভিন্ন।এদিকে মৃদুল কথা বলেই চলেছে,,
“আমার জানিস মনে হয় ও আর আগের মতো আমাকে ভালোবাসেনা।যদি সবসময় ভালো নাই বাসে তো এতো ডেসপারেট কেনো ছিল বিয়ের জন্য?(লিখাঃসামিয়া খান)বিয়ের পর থেকেই আমার সাথে এমন করে।আমার কোন খবর রাখেনা। কেনো আমার কী চেহারা খারাপ হয়ে গিয়েছে। নাকী ঠিকমতো টাকা দিতে পারিনা।কোনটা একটু বলবি হিম?”
মৃদুল যে এসব কথা জ্বরের ঘোরে বলে চলেছে তা বেশ বুঝতে পারলো হিমাদ্রি। তা নয় মনের কষ্টের কথা মৃদুল কাওকে বলে না। এমনকি হিমাদ্রি কেও না।
,
,
,
ফোনটা রেখে বিরস মুখে বসে রইলো রোদসী।হিমাদ্রি কল করেছিল।মৃদুলের নাকী জ্বর এসেছে।এবং ওকে তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে বলেছে।
“আচ্ছা আমি কী ডক্টর নাকী যে আমি গেলেই জ্বর ঠিক হবে।জ্বর এসেছে তো নাপা বা প্যারাসিটামল নিয়ে ঘুম দিক। একাই জ্বর চলে যাবে।না আমার যেতে হবে যতোসব আদিখ্যেতা।”
রোদসীর কথাগুলো শুনে মাইক্রোস্কোপ থেকে চোখ উঠালো আহাদ।
“মৃদুর জ্বর এসেছে নাকী?”
“তাইতো বললো হিমাদ্রি। ”
“তাহলে যাও হয়তো তোমার দরকার।”
“আজব তো।আমার কী দরকার।ওহ বুঝেছি বিরক্ত করছি আমি তাইনা?তাহলে চলে যাচ্ছি আমি।”
রোদসী যেতে নিলে হাত ধরে থামিয়ে দেয় আহাদ।এবং রোদসীকে নিয়ে ডিভানে গিয়ে বসলো।
“এতো রাগ তোমার বার্বি ডল! নেও পানি খাও এবং ঠান্ডা হও।”
“আমি ঠান্ডা আছি।”
“তাহলে তো ভালোই।আর প্রজাপতি কল করেছিল?”
“হ্যাঁ তোমার প্রজাপতি কল করেছিল।এতো ভাব ওই হিমের।”
“সুন্দরী মেয়েদের ভাব একটু বেশীই থাকে।”
“কই আমিও তো সুন্দরী। আমার তো ভাব নেই।নাকী আমি দেখতে ভালো না?”
“সুন্দর হলেই হয়না।চেহারায় মায়া থাকতে হয়।যাদের চেহারায় মায়া আছে তারা ভাব ধরেনা।যেমন তুমি।”
কথাগুলো বলে আহাদ রোদসীর গাল টেনে দিলো।প্রায় একবছর ধরে রোদসীর সাথে যোগাযোগ আহাদের। রোদসীর জন্য মূলত আহাদ এতোদিন দেশে রয়েছে।
“ভালো পাম দিতে পারো”।
” ওহ ইউ হার্ট মি মাই এঞ্জেল।আই এম নট পেম্পার ইউ।”
“ওহ রেলী?”
“ইয়েস,মাই এঞ্জেল”।
আহাদের কথাগুলো শুনে বেশ উচ্চস্বরে হেসে দিলো রোদসী।জনমানবহীন ল্যাবে তা আরো প্রকটভাবে ধ্বনিত হলো।
চলবে,,
বিঃদ্রঃআজকের পর্ব পড়ে কার কী অনুভূতি হলো তা একটু জানাবেন।