গল্পের নাম— #এবং_তুমি❤️
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ২২
আমার অপারেশন শুরু হলো। আমি কিছু অনুভব করতে পারছিলাম না। শরীরের নিচের অংশ যেনো প্যারালাইজড। ইশান আমার হাত টি শক্ত করেই ধরেছিলেন। সে একবারও সেদিকে তাকাচ্ছিলো না। সর্বক্ষণ আমার মুখের দিকেই তাকিয়েছিলো। তার শরীর অস্বাভাবিক কাঁপছিলো। তার ব্যাথাগুলো তীব্রভাবে অনুভব করছিলাম অথচ নিজের সাথে কি হচ্ছে তা বিন্দু পরিমাণ অনুভব করতে পারি নি। ইশানের অস্বাভাবিক অবস্থা দেখে একবার ভাবলাম তাকে বাহিরে চলে যেতে বলা হোক। সে কোনোভাবেই নিজেকে সামলাতে পারছে না। তার চিন্তা,কষ্ট,ব্যাথা,উদ্বিগ্নতা, অশান্তি সবকিছু আমাকে ভেতর থেকে অস্থির করে তুলছিলো। কিন্তু ঠিক যখন যখন ডাক্তার নিধি ইশানকে শান্ত্বনা দিচ্ছিলো ঠিক তখন তখন আমার অস্থিরতা চলে গিয়ে একরাশ রাগ আর হিংসা এসে ভর করতো। জিদে আমি ফুলে যেতাম। গভীর ঘুমের রেশ চোখদুটো আচ্ছন্ন হয়ে আসা স্বত্ত্বেও বড়বড় করে মেলে ধরতাম। মন এবং মষ্তিষ্কে শুধু এটাই ঘুরতো আমি চোখ বন্ধ করলেই বুঝি নিধি আমার ইশানের সাথে কিছু করে ফেলবে। ওরা একসাথে চলে আসবে। ওদের চিন্তায় আমি জোরপূর্বক চোখ খোলা রেখেছিলাম। অতিরিক্ত দূর্বলতার জন্য চোখ ঠিকঠাক মেলে ধরতে সক্ষম হচ্ছিলাম না। তবুও আমি সম্পূর্ণ চেষ্টায় শেষ অবধি চোখ খোলা রেখেছিলাম। মনে মনে শুধু এই প্রার্থনা করেছিলাম, ‘হে উপরওয়ালা, প্লিজ আমাকে বাঁচিয়ে রাখো। আমার স্বামীকে রেখে আমি যেতে চাই না।’ যেখানে কদিন আগেও আমি মৃত্যুর জন্য উতলা ছিলাম। পরিস্থিতি মানুষকে কত বদলে দেয়। তা আমার জীবনদশা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো। খুব ভালো করেই বুঝিয়েছিলো।
–
জীবনটা সমুদ্রের উথালপাতাল ঢেউয়ের মতো। হুটহাট শান্ত তীরকে ডুবিয়ে দেয় বাকাত্যাড়া ঢেউয়ের মাধ্যমে। আমার জীবনের শান্ত তীরকেও ডুবিয়ে দিলো টিউমার অপারেশন। ছিনিয়ে নিলো বিশাল খুশি। যেই খুশির জন্য আমি শতশত যুগ কাটিয়ে দিতাম। গভীর দুঃখ ও মুখবুজে সহ্য করতাম। রাতদিন এক করে অপেক্ষায় থাকতাম। সে খুশি কেড়ে নেওয়া হলো। আমার এ ছোট্ট হৃদয়ে বিশাল ক্ষতের সৃষ্টি হলো। মষ্তিষ্ক সুক্ষ ব্যাথার ফোড়ন কাটলো। আমার প্রতিবিম্ব বিশ্রি হেসে আমাকে বলছিলো,’ কোনোদিন,কোনোদিন তুমি মা হতে পারবে না। পারবে না পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অমৃত পান করতে।’ একটা সাকসেসফুল অপারেশনও সেদিন আমার নিকট আনসাকসেসফুল ছিলো। প্রাণে বেঁচে গেলেও জানে বাঁচে নি। মরে গিয়েছিলো আমার অন্তরাত্মা। পঁচাগলা দুর্গন্ধও যেনো আমার নাকে বাড়ি খাচ্ছিলো। বিষাক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিলো চারপাশে।
–
হসপিটালের বেডে শান্ত জলাধারের মতো নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছি। উপরওয়ালার বিশেষ রহমতে আমি বেঁচে গিয়েছি। তবে এর জন্য কম খরচা-পাতি করতে হয় নি। ঔষধপত্র, ভিজিট সব মিলিয়ে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা লেগে গিয়েছে। কই থেকো জোগাড় হয়েছে এসব আমার জানা নেই। ঘন্টাখানেক আগেই আমার ঘুম ভেঙ্গেছে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি তাও জানা নেই। চারপাশ একদম শান্ত, প্রকৃতি যেনো আজ নিরব শান্তশিষ্ট বাচ্চা। কি সুন্দর ঝলমলে রোদ আমার কেবিনের উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। ঝিলিক মেরে উচ্ছ্বাস দিচ্ছে। আমার ঠিক পাশেই ইশান ঘুমিয়ে আছেন। তার এক হাত আমার অন্য হাতে মুষ্ঠীবদ্ধ। আমার মনে আছে, চোখ বন্ধ করার পূর্বে আমি বিড়বিড়িয়ে ইশানকে বলেছিলাম সে যেনো না যায়। তখন ঠিক যেভাবে তার হাত ধরে রেখেছিলাম, এখনও ঠিক সেভাবেই আছে। ইশানের বোধহয় মাত্রই চোখ লেগে এসেছিলো। কেননা তার কপাল টা বেকে রয়েছে। আমাকে ওটি থেকে কেবিনে শিফ্ট করা হয়েছে। আমার সামনেই রয়েছে কিছু পরিচিত মুখ। সবাই কেমন কাতর দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। শুধুমাত্র আমি ইশারায় চুপ থাকতে বলায় তারা কথা বলছেন না। এরমধ্যে আমি ইশারায় বলেওছিলাম যে আমি ঠিক আছি। আমার বাবা কাঁদছেন, আপুও কাঁদছেন। তবে এ চোখের জল দুঃখের নয় সুখের তা স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম। আমার শশুড়বাড়ীর লোকজন কেউ আসেন নি। সবাই হয়তো এখনো এসে পৌঁছাতে পারেন নি।
.
মিনিট দশেক বাধে একহাতে রিপোর্ট নিয়ে কেবিনে আসলেন ডক্টর নিধি। তার চোখদুটো ছিলো ইশানের ঘুমন্ত মুখের দিকে। আমার জ্বলে উঠলো। তেল আর বেগুন একসাথে ভাজলে যেমন জ্বলে ঠিক তেমন। ইশান এই মুহূর্তে ঘুমে না থাকলে আমি তার এক্সের সামনে চুমু খেতাম। একটা না একশ টা। তাহলে নিশ্চই এই মেয়ে আর চোখ তুলেও তাকাতো না। আমার এত কেনো জ্বলে?হোয়াই?
ডক্টর নিধি মিষ্টি হেসে বললেন,
— মিস প্রভাতি, এখন কেমন ফিল করছেন?
আমি কাঠ কাঠ গলায় বললাম,
—আমি মিসেস প্রভাতি। ইশান আমার হ্যাজব্যান্ড।
অভদ্রমহিলার মুখশ্রী থমথমে পানসে হয়ে গেলো। যেনো তার বুকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছি। তাও লাইটার,ম্যাচকাটি দিয়ে নয় পাথরে পাথর ঘষে। যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে বেশ করেছি। আমার বলা উচিত ছিলো আপনার প্রাক্তনের বর্তমান। আহা কি শান্তি শান্তি ফিলিংস হতো। কিন্তু বলা হলো না। একটা কথা আমি বলতে না চাইলেও বলতে হচ্ছে মেয়েটা খুব চমৎকার। কি সুন্দরভাবে আমার খোঁচাটাকে এড়িয়ে মিষ্টি হেসে বললো,
—ওহ,ইয়েস। একচুয়েলী সবাইকে মিস মিস করে বলতে বলতে ভুলে তোমাকেও মিস বলে ফেলেছি। তোমাকে ‘তুমি’ বলছি কারন তুমি ইশানের বউ। আর ইশান যেহেতু আমার ক্লাসমেট ছিলো তাই তোমাকে তুমি বলে সম্বোধন করা ই যায়। আফটার অল আমার ফ্রেন্ডের বউ তুমি।
আমি সৌজন্যতামূলক হাসিটাও দিলাম না। মরতে এসেও শান্তি নেই। জামাই এর উটকো ঝামেলা নিয়ে টেনশন। নিধি ইশানের দিকে তাকিয়ে বললো,
— দেখোছো,এখানেই ঘুমিয়ে গিয়েছে। এখনো সেই জেদ রয়েই গেছে। কতবার বললাম আমার কেবিনে এসে রেস্ট নিতে শুনলোই না। থম মেরে এখানেই বসেছিলো। দেখো সাহেব গভীর ঘুমে। ইশশ কীভাবে যে শুয়েছে। এভাবে তো শোল্ডার ব্যাথা হয়ে যাবে।
আমি চোখদুটো বড় করে ফেললাম। সন্দেহবাতিক হয়ে বললাম,
—সত্যি যায় নি তো?
ডক্টর নিধি অপ্রস্তুতভঙ্গিতে হাসলো। কপাল খানিকটা কুচকে মাথা নাড়ালো। বুঝলাম সে হয়তো জানে না যে আমি তাদের ব্যাপারটা জানি। আমি কথাটা ঘুরিয়ে বললাম,
— মানে বলতে চাইছি,এভাবেই ছিলেন? কি বলেন তাহলে তো উনার শরীর খারাপ করবে। আমিই বা কি বলবো বলুন,লোকটা এমন পাগল যে আমার থেকে এক সেকেন্ডও দূরে থাকতে পারেন না। সারাদিন আমার পেছনে লেপ্টে থাকেন। আমি একটা কাশি দিলেও তার চিন্তার শেষ নেই। দিন-রাত মানে না, লাইট ফ্যান নিয়ে বসে থাকে আমার পাশে। ইদানীং তো উনি আগের থেকেও বেশি রোমান্টিক হয়ে গেছেন। সুযোগ পেলেই কিস করে বসেন। লজ্জার কথা কি আর বলি বলুন?
লজ্জায় যেনো পানিতে ডুবে মরছি। আমার রিয়েকশন ঠিক এমন। মুখ টা লাল,নীল,গোলাপি টোলাপি সব রঙের করে ফেললাম। অন্য হাত দিয়ে বারবার মুখ ঢেকে লজ্জা সংবরণের চেষ্টায় আছি। এমন ভান করলাম। মেয়েটা নিশ্চই জ্বলে পুড়ে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। হয়ে যাক। যদি নিরুদ্দেশও হয়ে যায় তাতেও আমার সমস্যা নেই। মোদ্দাকথা এ মেয়ে যেনো আমার ইশানের আশেপাশে না ঘেষুক। তাদের আগেকার সম্পর্ক আগেকার। এখন ইশান আমার, আমার স্বামী। হু হু! মাধবি আপা অবাক হয়ে আমার কাছে আসলেন। বাবা বাহিরে গেছে খাবার আনার জন্য। আমার আপা বোধহয় এই মুহূর্তে আমাকে এসে জ্ঞান দিবে। হলোও তাই। তিনি বললেন,
—তোর মাথা ঠিক আছে তো প্রভা? কিসব উল্টাপাল্টা বকছিস। চুপ কর।
আমি পাত্তা দিলাম না। ডক্টর নিধি বললেন,
—ইট’স ওকে। ও বোধহয় মিশুক টাইপের। সেজন্যই হয়তো মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। এত হেসিটেইট ফিল করবেন না প্লিজ। বাই দ্যা ওয়ে আপনি কে?
—আমি মাধবি। প্রভাতির বড় বোন।
ডক্টর নিধি বললেন,—ওহ্।
কথাবার্তার মাঝখানেই ইশান জেগে গেলেন। আমাকে স্বজ্ঞানে দেখে তার চোখে খুশির ঝিলিক খেলে গেলো। সে উৎফুল্ল হয়ে আমার দিকে ঝুঁকে বললো,
—তুমি ঠিক আছো?জ্ঞান ফিরেছে কখন? এখন কেমন লাগছে? খারাপ লাগছে?
আমি মাথা নাড়ালাম। সত্যিই এই মুহূর্তে আমার শরীর একদম ফুরফুরে। কিন্তু পরক্ষণেই ডক্টর নিধির কথা মনে পড়তেই বললাম,
— একটু একটু খারাপ লাগছে। মাথাটাও যন্ত্রণা করছে। আর পেটেও কেমন গুডুর গুডুর করছে। ক্ষুধা লেগেছে বোধহয়।
প্রথম দুটি কথা মিথ্যা হলেও শেষের কথাটি নয়। আমার সত্যি ক্ষুধা লেগেছে। ইশান তড়িঘড়ি আমার কপাল টিপতে লাগলেন। মুখে কষ্টের ছাপ ফুটালেও মনে মনে খুশিতে নাচতেছিলাম। মেয়েটা কেমন ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আই উইশ, ওর যাতে কলিজায় লাগে। তখন আমার অন্তরাত্মা আরেকটু বেশি শান্তি পাবে হু,হু!
ডক্টর নিধি আটকে যাওয়া কন্ঠে বললো,
—আমি এতক্ষণ জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বললা না। আচ্ছা যাই হোক, আমি খাবারের ব্যবস্থা করেছি। তোমার জন্যও হেলথি ফুড নিয়ে আসার জন্য বলেছি। ড্রাইভার বোধহয় নিয়েও এসেছে। আমি কি..
আমি তৎক্ষণাৎ তাকে থামিয়ে বললাম,
—তার কোনো দরকার নেই। বাবা খাবার আনতে গিয়েছেন। আই মিন আপনার এত কষ্ট করার কি দরকার ছিলো? বাবা তো গিয়েছেনই।
ভাগ্যিস কথাটা ঘুরিয়ে অন্যভাবে বলেছি নাহলে সবাই কি ভাবতো। ডক্টর নিধি তবুও হাসিমুখে বললো,
—তোমার বাবাকে বারণ করে দাও। আমার ড্রাইভার খাবার নিয়ে অলরেডি চলে এসেছে। আর এখন তোমার হেলথি ফুড খেতে হবে, বাহিরের খাবার স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
ইশান ও ফট করে বললেন,
—হ্যা,হ্যা তাই ভালো হবে। তুমি এখানে নিয়ে আসো। একসাথেই খেয়ে নিবো।
সর্বনাশ! ইশান তার এক্সের হাতের রান্না খাবে? যার অর্থ আমার অর্ধেক সংসার তার দখলে চলে যাবে। ইশান আমায় উঠতে বসতে বলবে, ইশশ নিধির হাতের রান্না কি মজা! তুমি এসব কি রান্না করো? এখনও নিশ্চই হাত চেটেপুটে খেয়ে ডক্টর নিধির সুনামের বন্যা বইয়ে দিবে।ইম্পসিবল! আমি তা কোনোদিন হতে দিবো না। নেভার!নেভার!
#চলবে……
®সোনালী আহমেদ