এবং_তুমি পর্ব ২৪

0
1344

গল্পের নাম— #এবং_তুমি❤️
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ২৪.

আমার শশুড়বাড়ীর প্রত্যেকটি লোক আমার স্বামীর এক্সকে চিনেন। অভদ্রমহিলার একটি নাম রয়েছে। নামটি খুব চমৎকার। নিধি! কিন্তু তাকে এ নামে সম্বোধন করতে আমার ভালো লাগে না। ইশানের এক্স বলতেই যেনো আলাদা মজা। এটা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি। অন্যদের ভালো নাও লাগতে পারে। স্বাভাবিক। খুব স্বাভাবিক। সবার এট্রাকশন আমার থেকেও বেশি অভদ্রমহিলার দিকে। তাকে দেখে প্রশ্নের ঝুলি আর অবাকতার শেষ নেই। খুব স্বাভাবিক ভাবে শুধুমাত্র আমার শাশুড়ি আমার কাছে এসেছেন। আমার হাল-চাল প্রশ্ন করলেন। আমি জবাব দিলাম। অপারেশনের ১৮ ঘন্টারও বেশি চলে। শরীর টা একটু একটু ভালো লাগছে। এর মধ্যেই ইশানের ফুফুর ফোন আসলো। ফুফিমা ভিডিও কলে সর্বপ্রথম বললেন,

— বড় হয়ে গেছো? খুব বড় হয়ে গেছো না? মা,মা বলে জান দিয়ে দাও। অথচ এই মাকে একবারও অসুখের কথা বললে না। আমাকে দেশে আসতে দেও একবার, তোর অবস্থার রফাদফা না করলে আমিও হেলেনা নই।মনে রাখিস।
আমি হাসলাম। ফুফিমা বললেন,–তুই খুব খারাপ প্রভাতি।খুব খারাপ।

ফুফিমা কেঁদে দিলেন। চোখমুখ ফোলা ফোলা। এর আগেও কেঁদেছেন হয়তো।

—জানি তো। তোমাকে কে বলেছে এই খারাপ মানুষটাকে নিজের মেয়ে বানাতে? তুমি জানো না এরা কখনো কারো হতেই পারে না।

—আবার তর্ক করা হচ্ছে। গাল লাল করে দিলে তখন টের পাবি?

—কেঁদো না তো। এসব কান্নাকাটি আমার ভালো লাগে না। তোমাকে খুব বিশ্রি দেখাচ্ছে।

—আমি ইচ্ছা করে কাঁদছি নাকি? তুই এমন কাজ করিস কেনো?

—আচ্ছা,আর করবো না। দাদী কই? উনাকে দাও। উনি কেমন আছেন?

—দাদী শুয়ে আছে। উনাকে আর ভালো থাকতে দিলি কই? তুই এখানে না আসা পর্যন্ত শান্তি হবে না বোধহয়। তোর কাগজপত্র দ্রুত ঠিক না করলে আমার কঠিন মাইর হবে। কঠিন মাইর।বুঝলি?

— আচ্ছা। দাও তো উনাকে।

ফুফিমা ফোন দিলেন।দাদী কথা বললেন না। শুধু কঠিন কঠিন দৃষ্টিতে আমাকে শাসালো। আমি হাসলাম। হেসে বললাম,

—দাদী,তোমার নাতি তোমাকে এভাবে দেখলে নির্ঘাত হার্ট এট্যাক করবে। ব্যাটার আবার চরিত্রে সমস্যা আছে। পরে না জানি তোমাকে নিয়ে পালায়। তোমার কি এভাবে আমার কপাল পুড়ানোর চিন্তা?

দাদীমা কঠিন চোখে বললেন,

—একদম রসিকতা করবে না আমার সাথে। আর হাসছো কেনো? হাসা বন্ধ করো। বন্ধ করো।

আমি চুপ করে গেলাম। কেউ দেখলে নিশ্চই বলবে না আমাদের সম্পর্ক টা আপন নয়। বলার কথাও নয়। আজকাল সৎ মায়েদের সাথেই সু-সম্পর্ক থাকে না সেখানে সৎ দাদী তো দুঃস্বপ্ন। ইশানকে কখনো দাদীমার সাথে অসদাচরণ করতে দেখিও নি, শুনিও নি।শাশুড়িমাও খুব ভালোবাসেন দাদীমাকে। কেউ যদি বলে হেলেনা ফুফু ইশানের আপন ফুফু নয়। তখন ইশান রেগে যান। ভয়ংকর রেগে যান। খুব খারাপভাবে ওই লোকটার সাথে আচরণ করেন। একটু সহজ করে বলি, ইশানের দাদা দুই বিয়ে করেছিলেন। তখন অবশ্য দাদার তুলনায় দাদীমার বয়স অনেক কম ছিলো। ইশানের মায়েরও তখন নতুন নতুন বিয়ে হয়েছিলো। হেলেনা ফুফু কিন্তু ইশানের দাদার সন্তান নন, দাদীমার আগের ঘরের সন্তান। অবাক লাগে তাই না? আমারও লেগেছিলো, যখন শুনেছিলাম। এত প্যাচের সম্পর্কগুলোতেও মধুরতা থাকে তা দেখে আরো অবাক হয়েছিলাম। ইশানের বোন দুজনও ফোন দিয়ে খবর নিলেন। তাদের সাথে আমার কথাবার্তা হয় না। হলেও খুব কম। দুজনকেই বিয়ে দিয়ে স্বামীর সাথে বিদেশ পাঠিয়ে দিয়েছেন শাশুড়িমা। আমি অবশ্য সরাসরি তাদের দেখি নি। ফোনেই যতটুকু দেখার দেখেছি। এ ফ্যামিলিতে চোখে লাগার মতো একটি বিষয় আছে। বিষয়টি হলো বি-দেশ। অর্থাৎ সবার ই বিদেশের জন্য এপ্লাই করা। অর্ধেকের বেশি আত্নীয়ও বিদেশে থাকেন। এমনকি ইশানও বিদেশে ছিলেন। ফুফিমার কাছে। এবার ফুফিমা আমাকেও লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছেন। আমার অবশ্য ইচ্ছা নেই। কেনো নেই জানাও নেই। জানতেও ইচ্ছে করে না।

শেষ বিকালের ঝলমলে আলো ধীরে ধীরে নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছিলো। সময়গুলোও হাওয়ায় মিলে যাচ্ছে। খাতিরযত্নের মাঝেই কেটে গেলো মাসখানেক। আমার অবস্থা এখন বেশ ভালো। বলতে গেলে একদম ভালো। এ অবস্থায় আমার পুরো ট্রিটমেন্ট করেছেন ডক্টর নিধি। হ্যা, ইশানের এক্স নিধি। কেননা তার সাথে এ সংসারের প্রত্যেকের বেশ সু-সম্পর্ক। সবাই ইশানকে তার ফ্রেন্ড হিসেবেই চিনেন। কারো জানা নেই,কখনো তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিলো কি না। ইশান বললেন,’তিনি কখনো তাদের এ বিষয়ে জানান নি।জানানোর পূর্বেই নাকি সম্পর্ক ভেঙ্গে গিয়েছিলো।’ তাদের সম্পর্ক ভাঙ্গার কারণ টা ছিলো সাধারণ। খুব সাধারণ। ডক্টর নিধির ‘ডক্টর’ পদবি ই এর কারণ। মিস নিধির জন্য তার ক্যারিয়ার ইম্পরট্যান্ট ছিলো। যা ইশানের সাথে থাকলে পসিবল হতো না। তাই তারা মিউচুয়াল ব্রেকআপ করে নেন। সেজন্যই এখন অবধি তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বিদ্যমান। ডক্টর নিধি ডিবোর্স প্রাপ্ত মহিলা। তার প্রথম বিয়ের ডিবোর্সের পর তিনি এখন পর্যন্ত বিয়ে করেন নি। ডক্টর নিধির ব্যাপারে এর বেশি কিছু আমার জানা নেই। জানার ইচ্ছাও নেই। এমন নয় যে আমার জানার কৌতুহল ছিলো না। ছিলো। এবং সেটা গায়েব হয়ে যায় যখন ইশানের অনুভূতি জেনেছিলাম। কীভাবে জেনেছি সেটা একটু বিস্তারিত বলি।এইতো কয়দিন আগে ডক্টর নিধি আমার শশুড়বাড়ী আসলেন। সে অবশ্য এসেছে আমাকে দেখার অজুহাতে। তখন আমি ঘুমাচ্ছিলাম। ইশান আমার পাশেই বসে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিলেন। সে অবশ্য চায় নি, আমি জোরপূর্বক এভাবে করতে বলেছি। তার ধারনা ছিলো আমি ঘুমিয়ে পড়েছি,কিন্তু তখনো আমি পুরোপুরি ঘুমাই নি। ডক্টর নিধির আওয়াজ পেয়ে কীভাবে যেনো আমার পুরো ঘুমের রেশ ই চলে যায়। ইশান তাকে দেখে নিজের অবস্থার কোনোরুপ পরিবর্তন ঘটান নি। ডক্টর নিধি কড়া আওয়াজে বললেন,

—‘ বাহ, বউয়ের দেখি ভালো সেবা করা হচ্ছে।’

—একমাত্র বউ। তার সেবা করবো না, কার করবো?

— একসময় কেউ একজন বলেছিলো, ‘তুমি বদলে যেতে পারো,আমি কোনোদিন বদলাবো না।’

ইশান জবাব দেন নি। ডক্টর নিধি তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে পুনরায় বললেন,

—তাহলে এখন কী? সে তো কোনোদিন বদলাবার ছিলো না। আজ কেনো বদলে গেলো? সে কি এক কথার মানুষ ছিলো না নাকি কচি মেয়ে বউ হিসেবে পেয়ে? অবশ্য বুড়ো ছেলেদের সামনে কচি মেয়ে ঘুরলে যার তার মাথা নষ্ট হয়ে যয,,,

ডক্টর নিধি কথাটা শেষ করবার পূর্বেই ইশান তার থুতনি চেপে ধরলেন। অটোমেটিক ডক্টর নিধি থেমে যান। আমার একটি চোখ তখন অর্ধেক খোলা ছিলো। তারা কেউ খেয়াল করেন নি। সেদিনের ইশানের মুখশ্রী মনে পড়লে আজো শরীরের লোমগুলো সজাগ হয়ে যায়। ডক্টর নিধি কি ভয় পাবেন আমি নিজেই ভয়ে তটস্থ ছিলাম। ইশান বললেন,

—তেমার এই নোংরা মুখ দিয়ে যদি আর একবার আমার বউকে নিয়ে বাজে কথা বের হয়, আই সোয়ার আমি তোমার চোয়ালের এমন দশা করবো যে জীবনে কোনোদিন কথা বলতে না পারো।

ডক্টর নিধি ভয় তো পেয়েছিলেন।কিন্তু দমে যান নি। পাল্টা জবাব দিলেন,

—সত্য কথা বললে সবার ই এমন গায়ে লাগে। আমি কি মিথ্যা বলেছি? তোমাদেরকে লোকে বলবে বাবা-মেয়ে। বলবে কি অলরেডি হাসপাতালে গসিপ চলছে।

ইশান বোধহয় কষ্ট পেয়েছিলেন। পাবার ই কথা। আমাদের সমাজের কিছু লোকেদের মেন্টালিটি লেভেল একদম নিম্ন পর্যায়ে। তারা কোনো কাপল, স্বামী-স্ত্রী জানা স্বত্তেও ইচ্ছা করেই এমন মন্তব্য করেন। এতে তাদের বিশেষ লাভ হলো অন্যকে খুচিয়ে কথা বললে তাদের কলুষিত অন্তর শান্তি পায়। তাদের জন্য একজন মানুষ শুধু গুণে কিংবা রুপে পারফেক্ট হলে চলে না। তাকে হতে হবে সুপার পারফেক্ট। শুধুমাত্র সে ধবধবে সুন্দর হলে চলবে না, তার কন্ঠও হতে হবে বাঁশির সুরের মতো। তার সব গুণ থাকলেও চলবে না, তাকে অবশ্যই লম্বা হতে হবে। এই যেমন আমার আপার কথা ই বলি। আমার ফুফু মাঝেমাঝেই বলতেন, —“ইশশ,মাধবি তোর নাকটা যদি আরেকটু চোখা হতো। কিংবা তোর হাইট যদি আরেকটু কম হতো। এত লম্বা আবার সুন্দর লাগে না। বুঝলি। সুপারি গাছ দেখায়। ” আরো কত কি যে বলেন। আপা অবশ্য মন খারাপ করে না। তার কাছে এসব স্বাভাবিক লাগে। কিন্তু আমার কাছে লাগে না। এটা কোনো কথা হলো? আমাকে যেভাবে তৈরি করা হয়েছে, আমি তো সেরকমই হবো তাই না। আমি তো আর নিজে নিজেকে তৈরী করি নি। তাদের যে একশ দোষ থাকে সে বিষয় কিন্তু বলা যায় না, বললে হবে তুমি অভদ্র, বেয়াদপ। আর চুপ থাকলে তথাকথিত ভদ্র। ইশান কিন্তু ডক্টর নিধিকে কড়া কথা শুনিয়ে সেই বেয়াদপ পদবি টা লাভ করলেন। তার জবাব ছিলো,

— ঠিক আছে মানলাম। আমাকে বলো তো, তুমি আর তোমার স্বামী পারফেক্ট এন্ড জোয়ান দম্পত্তি হয়েও কেনো সংসার করতে পারলে না? না মানে লোকে তো তোমাদেরকে একদম পারফেক্ট কাপল বলতো তাহলে কেনো তোমাদের ডিবোর্স হলো? সুখী দম্পত্তিদের আবার ডিবোর্স হয় নাকি? হ্যান্ডসাম ছেলে আর সুন্দরী মেয়ে হয়েও কেনো তোমাদের কাপল টিকলো না? আন্সার মি?

ডক্টর নিধিকে চুপ দেখে ইশান পুনরায় বললেন,

লিসেন, কোন স্বামী-স্ত্রীকে বাবা-মেয়ে লাগে, কোন স্বামী-স্ত্রী কে দাদা-নাতিন লাগে সেসব না দেখে নিজের সংসারের দিকে তাকাও। পারফেক্ট বউ-স্বামী হয়েও কেনো সংসার রইলো না। কেনো ঝগড়া-বিবাদ করে ডিবোর্স নিলে? ডোন্ট ইউ থিংক তোমাদের থেকে আমরা পারফেক্ট? অভিয়েসলি। মনে রেখো, ‘শুধু বয়স দিয়ে কোনো দম্পতি পারফেক্ট হয় না, হয় তাদের বোঝাপোড়ার ক্ষমতার মাধ্যমে। ‘ তাই দম্পতি-দের বয়স নয় তাদের মানিয়ে নেওয়ার ধৈর্য্য দিয়ে বিচার করো। আশা করি, আজকের পর আমার সংসার নিয়ে কথা বলার দুঃসাহস দেখাবে না!

#চলবে….

®সোনালী আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here