এবং_তুমি পর্ব ২৫

0
1718
  • গল্পের নাম— #এবং_তুমি❤️
    লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
    পর্ব– ২৫.

    গুমট, নিস্তব্ধ আকাশে বিচরণ করছে কালো কালো মেঘের ভেলা। সে ভেলায় ইশানের সাথে আমি ভেসে বেড়াচ্ছি। চারদিকে বইছে শিরশিরে মৃদু বাতাসের আনাগোনা। বলতে গেলে ইশানের সাথে একপ্রকার লেপ্টেই ছিলাম আমি। বরফের মতো ঠান্ডা আমার শরীর। থেকে থেকে হালকা কেঁপে উঠছি। আমার কাঁপাকাপি রোগ টা আগে ছিলো না। ইদানীং ইশানের হালকা সংস্পর্শে আসলেই এই রোগ দেখা দেয়। ইশান বোধহয় তখন খুব মজা পান। তৎক্ষণাৎ আমাকে নিয়ে খিল্লি উড়ান। যা আমায় একরাশ অস্বস্তি আর লজ্জা ফেলে দেয়। সে কিন্তু সেই সময় টা বেশ উপভোগ করেন। আমি লক্ষ্য করেছি এর বেশ কিছু সময়পরেও তার মুখে লেগে থাকে হাসির জোয়ার। আমি উপরে উপরে রাগ দেখালেও মনে কিন্তু ভীষণ খুশি হই।এর পেছনে অবশ্য কারণ রয়েছে। কারণ টা হলো তখন আমার মনে হয় সে আমার সাথে সুখী। আমার ভেতরের চাপা অশান্তি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। তাকে নিয়ে আমার নানান অভিযোগ থাকে। কিন্তু আমাকে নিয়ে তার কোনো অভিযোগ থাকে না। কারণ সে ইন্ট্রোভার্ট। কথা কম বলে। যে দু-চারটা বলবো সেগুলো হবে জরুরী কথা।
    এইযে এই মুহূর্তে তার এত কাছে রয়েছি তার জরুরী কথা শুনতেই। সম্ভবত বাবার বিষয়ে বলবেন। এজন্য তার এত সংকোচ আর অস্বস্তি। আজ আমার বাবার বিয়ে। জোরপূর্বক বিয়ে। বাবা রাজি নন। কিন্তু আমরা দু-বোনের কারণেই বাধ্য হয়েছেন। বাবার নতুন স্ত্রী বছরখানেক থেকেই অপেক্ষা করে আসছেন। উনাকে অবশ্য আমাদের দু-বোনের পছন্দ। নম্রভদ্র, স্বভাব টাও ভালো। ভদ্রমহিলার শুধুমাত্র দুটো খুঁত রয়েছে। এক নম্বর তিনি ট্যারা। একদিকে তাকালে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে এমন মনে হয়। দু নম্বরে তিনি বন্ধ্যা।
    বাবার অবশ্য এ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হলো লোকলজ্জা। তিনি বলেন, ‘এ বয়সে বিয়ে লোকে কি বলবে?’ কিন্তু উনার কথার গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। তাই আজ ছোটখাটো বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। আয়োজন ও বলা যায় না। শুধু কাজি এসে বিয়ে পড়িয়ে খেয়ে যাবেন,ব্যাস এটুকুই।

    —আপনি বলবেন নাকি আমি চলে যাবো?

    ইশান বললো,

    — বলছি তো। একচুয়েলী তোমার বাবা..

    —তারপর

    — তোমার বাবা বাড়ী বন্ধক রেখে যাদের থেকে টাকা নিয়েছিলেন তারা এসেছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, কথাটা উনাকে কীভাবে বলবো। একচুয়েলী উনার সামনে পড়লে আমার লজ্জা লাগে,উনারও লজ্জা লাগে। তাই তুমি যদি….

    আমি অবাক হয়ে বললাম,

    —বাবা বাড়ী বন্ধক রেখেছেন? কেনো?

    —হ্যা,পরপর দুবার। উনারাই তো বললো। আমি উনাদের ঘরের সামনে বসিয়েছি।

    বিষ্ময়ে হতভম্ব আমি। বাবা বাড়ী কেনো বন্ধক রেখেছেন? বাসার সামনে তিনজন অর্ধ বয়স্ক পুরুষ দাড়িয়ে আছেন। আমি সরাসরি তাদের প্রশ্ন করলাম,

    —আমার বাবা বাড়ী বন্ধক রেখেছিলেন কেনো?

    — তোমার বাবা বলে নাই? অথচ দুবার টাকা আনলো। এজন্যই তো খোঁজ-খবর নেই। শুনো, সে একবার তোমার বইনের বিয়ের জন্য, আরেকবার তোমার অপারেশনের জন্য টাকা আনছে। বিয়ের টাকা পরিশোধ করছিলো, কিন্তু তোমার অপারেশনের টাকা বইলা যেগুলা নিছিলো ওগুলা দেই নাই।

    আপা ঘরেই ছিলো। শোরগোল শুনে বেরিয়ে আসলো। লোকগুলোর সাথে ক্রমশই আমাদের তর্ক বেড়ে চললো। বাবা বেরিয়ে আসলেন। পরিস্থিতি তখন নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। বাবা হড়বড়িয়ে ঘর থেকে টাকা এনে তাদের বিদায় করলেন। তারা অবশ্য মানতে চাইলো না। উদ্দেশ্য ছিলো বাড়ী হাতিয়ে নেবার। কিন্তু সফল হলো না। ইশান নিতে দিলো না।
    সেদিন রাগে, আমি বা আপা কেউই বাবার সাথে কথা বলি নি। সংসার চালানোর জন্য একে একে সব বেঁচে ফেলেছেন,এখন নাকি বাড়ীটাও বেচতে চলেছিলেন। আপা আর আমার চাকরী করার কারণ ই ছিলো যাতে বাবা আর কিছু না বেঁচেন। অথচ দেখো তিনি সেই আগের মতো রয়েই গেলেন। তখন আমার মনে হলো, বাবা বোধহয় টাকার ব্যবস্থা না করতে পারায় প্রথমে আমার অপারেশনের জন্য চাপ দেন নি। পরে যেহেতু আমার অপারেশনের সব কিছুই ইশান করেছেন তাই টাকাগুলো বেঁচে গেছে। বাবা জানতেন, আমি বা আপা এসব জানলে কখনই রাজি হতাম না। তাই দুজনের অগোচরে এ কান্ড করেছিলেন। সেদিনে আমাদের দু-বোনের ভয়ে মিনমিনিয়ে বিয়ে টা সেরে নিয়েছিলেন বাবা। ইশান সারাক্ষণ রুম বন্দি ছিলো। সে একবার ও বের হয় নি। আমি জানতাম বিষয়টা লজ্জাজনক তাই তাকে এখানে আসতে বারণ করেছিলাম, এমনকি আমার শশুড়বাড়ীর লোকজনকে আমি নিজেই বলেছিলাম বাবার বিয়েটা হয়ে গেলে পরের দিনই চলে আসবো। কিন্তু নাছড়বান্দা ইশান শুনলেন কই? আমাকে সে একা কোথাও যেতে দিবে না। এখন বুঝোক মজা। কত আশা করেছিলাম,আপার সাথে ঘুমাবো। আপাকে জড়িয়ে ধরে একটু কাঁদবো। রাগে হিশহিশ করতে শুতে আসলাম। নির্লজ্জ লোক একহাত মেলে শুয়ে আছেন। আমার রাগ টা আরো বেড়ে গেলো। মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম। আজ আমি তার বাহুতে ঘুমাবো না।কিছুতেই না। রাগে এদিকওদিক চক্কর দেওয়া শুরু করলাম।

    —কি হলো বউ? এভাবে হাটছো কেনো?লাইট নিভিয়ে শুতে আসো তো। অনেক রাত হয়েছে।

    আমি রাগী রাগী চোখে তাকালাম। কঠিন গলায় বললাম,

    — লজ্জা শরম কিছু নেই? ধেই ধেই করে শশুড়ের বিয়ে খেতে চলে এসেছেন। কত আশা করেছি আপার সাথে ঘুমাবো।

    —বাড়ীতে না এ নিয়ে ঝগড়া শেষ হয়েছিলো?

    আমি রাগ করে জানালার পাশে চলে গেলাম। আকাশের গুমটভাব টা কেটে গেছে। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশে এক থালা তারার মেলা। ইশান আমার সাথে এসেছেন এজন্য আমি খুশি।ভীষণ খুশি! সে না আসলে বোধহয় তার শূন্যতায় সারা-রাত ঘুম হতো না। এ তো শুধু তাকে দেখানোর জন্য মিছে রাগ আমার। আমি যে খুশি সে যাতে তা না বুঝে তার ক্ষুদ্র প্রয়াস। স্বামীর কোনো ব্যাপারে মুগ্ধ হলে তা প্রকাশ না করার আলাদা মজা থাকে। ইশান আমার পেছনে পাগল এ বিষয়টা অনুভব করতে চাই। ভীষণভাবে চাই।

    —এভাবে মসৃণ পেট,কোমড় দেখিয়ে দাড়িয়ে থেকে আমাকে পাগল করতে চাও? হু,বলো? তুমি জানতে আমি এখন উঠবো না,তাই এই ট্রিকস করেছো তাই না? বলো?

    ইশান হিশহিশিয়ে বললেন। তার ধীর কন্ঠস্বর আমার কানে কাতুকুতু দিলো। কেঁপে উঠে জানালার আরো পাশে ঘেঁষে গেলাম। ঠিক তখন ইশান আমার শাড়ী টা টেনে ঠিকঠাক করে দিলো। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ভাবলাম কি আর হলো কী?
    তাকে খুবই বিশ্রি গালি দিলাম। ব্যাটা,বুড়ো, আনরোমান্টিক! খাটাস, তোকে গু খাইয়ে দেওয়া উচিত। একদম কাচা গু। তাহলে এত বড় অপরাধের শাস্তি হতো। রাগে গজগজ করলাম। বিরবিরিয়ে অস্পষ্টসুরে বললাম কিছু একটা বলেছিলাম, যা আমার কাছেই স্পষ্ট ছিলো না।

    আমি ভেবেছিলাম, জানালার পাশে ঘেষে দাড়াবো তখন ইশান ভয়ংকর কাজ করবেন। বড্ড ভয়ংকর। আমার কোমড় হাত দিয়ে আকড়ে ধরে পিঠে নাক ঘষবেন। রোমান্টিক সুরে বলবেন,

    —‘ বউ তুমি তো জানোই,আমার ক্যারেকটারে সমস্যা। তুমিই এ কথা বলো। তারপরেও এভাবো খোলামেলা হাটো কেনো? এভাবে তো নিজেকে কন্ট্রোল করা যায় না।’

    কিন্তু হলো কই? আমার সাধের স্বপ্নে সমুদ্র সমান পানি ঢেলে তিনি হাসিমুখে দাড়িয়ে আছেন। ইচ্ছা করছে দাতগুলো ভেঙ্গে দেই। শালা, কাঠ-তক্তা কোথাকার। কি সুন্দর রোমান্টিক ওয়েদার। মানুষ তো রোমান্টিক কথা শুনলেও হাইপার হয়ে যায়, আর আমার স্বামীকে দেখো। সে এত রাতে আমাকে তারই সামনে পর্দা করাচ্ছে। আরে তোর সামনে এভাবে থাকবো না তো কার সামনে থাকবো?

    —বউ,তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি রেগে আছো। রেগে তো ছিলে কিন্তু এখন বেশি রেগে আছো মনে হচ্ছে। কিছু কি হয়েছে?

    ইশান ভারী অসহায় কন্ঠে বললেন। যেনো তিনি নাদান বাচ্চা, আজ জন্ম হয়েছে। আমি রাগে গজগজ করতে ঠাস করে শুয়ে পড়লাম। ইশান ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। তারপর আপনমনে বিরবির করে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমার সারা রাত ঘুম হলো না। কিন্তু ইশান ভেবেছিলেন আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। সে আমার কপালে চুমু খেলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নরম কন্ঠে বললেন,

    — আমি আনরোমান্টিক না বউ। সব বুঝি, কিন্তু কি করবো বলো? বুঝেও না বুঝার মতো থাকতে হয়। একবার তোমার কাছে আসায় তোমার কত কষ্ট হয়েছে। কত ঝড়ের সম্মুখীন হলে। দ্বিতীয়বার আর সেই ভুল করতে চাই না। কোনোদিন না। তাই তো যতবার তুমি আমার কাছে আসতে চাও,আমি এড়িয়ে যাই। তোমার শরীর নয় তোমার বেঁচে থাকা টা আমার কাছে ইম্পরট্যান্ট। তার জন্য দরকার পড়লে আমি সারাজীবন তোমাকে স্পর্শ করবো না। শুধু তোমাকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে বাকী জীবন টা কাটিয়ে দিতে চাই। তুমি তো জানো না, আমি সেদিন তোমার কাছে গিয়েছিলাম এই ভেবে যে, একবার আমাদের মধ্যে কিছু হয়ে গেলে তুমি নিশ্চই আমাকে ছেড়ে যাবে না। অথচ দেখো সেদিন তুমি আমাকে নয় পুরো দুনিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছিলে।

    ইশান থামলেন। একহাতে চোখের জল মুছলেন। আমার মন টা মিইয়ে গেলো। আমাকে নিয়ে তার এত ভয়? কিন্তু আমি তো এখন সুস্থ। উনি নিশ্চই সেদিনের জন্য নিজেকে দায়ী ভাবেন। সেজন্যই আমার কাছে আসতে চান না। আমি যখন অস্থিরতা আর অশান্তিতে ছটফট করছিলাম। ঠিক তখন ইশান আমার কানের কাছে মুখে এনে বললেন,

    —‘বউ, তোমার জন্য একটা ছন্দ মিলিয়েছিলাম। তুমি জেগে থাকলে তো বলতে পারবো না,তাই তোমার ঘুমের সুযোগ নিচ্ছি। ছন্দ টা বলি কেমন?

    কাঠফাঁটা রৌদ্দুরে একফালি বর্ষা তুমি। বাদলা দিনের ঝিরঝিরে বৃষ্টির সঙ্গী তুমি।
    আমার জগৎ-সংসারের রাণী তুমি।
    সুখ-দুঃখের সাথী তুমি,প্রেমমোহিনী তুমি।
    আমার স্বপ্ন তুমি-কল্পনা তুমি।
    শুধু তুমি এবং তুমি!♥’

    খারাপ হয়েছে না? বেশি খারাপ? আচ্ছা যাও, পরেরবার ভালো ছন্দ বলবো। তুমি সেটা পছন্দ করবে তো?’

    #চলবে….

    [ আজকে শেষ করতে যেয়েও হলো না। পরের পর্ব হয়তো শেষ পর্ব। সবাই টিস্যু নিয়ে বসবেন। এ পর্ব কেমন হয়েছে মন্তব্য করে জানাবেন অনুরোধ রইলো। আসলে মন্তব্য না পেলে পরের পর্ব লেখার আগ্রহ পাই না।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here