গল্পের নাম— #এবং_তুমি
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ৫.
গত আধঘন্টার মধ্যে বিশবারের মতো বাথরুমে যাওয়া আসা করেছেন ইশানের বাবা। উনার অবস্থা বর্ণনা করার মতো নয়। বেচারার চোখে পানি চলে এসেছে। আমি দুবারের উপরে স্যালাইন গুলিয়ে খাইয়েছি। তবুও উনার পেট ধরছে না। কোনো দিক না পেয়ে ছুটে গেলাম শাশুড়ি মায়ের কাছে। তাকে যেয়ে সর্বপ্রথম যে খবর টা দিলাম তা হলো, ‘ মাদার-ইন-লো, ফাদার-ইন-লো এর ডায়রিয়া হয়ে গেছে। তার অবস্থা খুবই নাজুক।’
শাশুড়িমা তখন পান চিবুচ্ছিলেন। তিনি পান খাওয়া বাদ দিয়ে রাগান্বিত চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি এর উৎস ধরতে পারলাম না। বুঝেই উঠি নি কেনো তিনি এত রেগে গেলেন।
— আমার কি কোনো ভুল হয়েছে?
শাশুড়িমা জবাব দিলেন না। তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
— কোথায় সে?
— ডানপাশের রুমে।
শাশুড়িমা রাগে গজগজ করতে করতে বিছানা থেকে নেমে পড়লেন। লম্বা লম্বা পা ফেলে ফোঁসফোঁস করে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি যেয়ে সর্বপ্রথম হুংকার দিয়ে ডাক দিলেন শশুড়মশাইকে। শশুড় হুরহুর করে বেরিয়ে আসলেন বাথরুম থেকে। তিনি এক হাতে বদনা আর অন্যহাতে লুঙ্গির গিট ধরে হুশিয়ারি দৃষ্টিতে শাশুড়ির মুখপানে চেয়ে রয়েছেন। আমি হাসার পূর্বে আরো দুজনের হাসির আওয়াজ আসলো। দুজনই সম্ভবত আমার জা হবেন। তারা আমার পেছনেই দাড়িয়ে রয়েছেন।
শাশুড়িমা আমাদের দিকে তাকালেন না। তিনি চোখ রাঙ্গিয়ে বললেন,
— সত্য সত্য কথা বলো। আমার সাথে কিসের মিথ্যা কথা বলেছো?
শশুড় বললেন,
— বিশ্বাস করো, আমি কোনো মিথ্যা বলি নি।
— আবার মিথ্যা! ইশানের বাবা, তুমি জানো তো কখন তোমার ডায়রিয়া হয়? ওহ, তুমি তো এখন জানবে না। দাড়াও,আমি বলছি। যখন আমার সাথে মিথ্যা বলে ধরা খাওয়ার ভয় হয় তখন। ভালোই ভালোই বলে দেও কোন মিথ্যা কথাটা বলেছো?
শশুড়মশাই ভীষণ ইতস্ত করতে লাগলেন। দু হাত আটক থাকায় বেচারা তেমন সুবিধা করতে পারলো না। শাশুড়িমাও রেগে আগুন। খুবই কঠিন কঠিন কথা শুনাচ্ছেন। শশুড়মশাই জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। এর মধ্যেই তার আবার বেগ পেয়ে গেলো। বদনা, লুঙ্গি ফেলে বাথরুমে দৌড় দিলেন। শাশুড়িমা কঠিন সুরে বলতে লাগলেন,
–ইশানের বাবা,দাড়াও বলছি। দাড়াও!
শশুড়মশাই দাড়াতে পারলেন না। তার অবস্থা এমন হলো যে সে বাথরুমের দরজায় দাড়িয়ে অপেক্ষা করে কখন বাথরুম আসবে আর তিনি যাবেন। ইশানের মা হুলস্থুল কান্ড করলেন। ডাক্তার ডাকা হলো চেকআপের জন্য। ইশান আর কাজে গেলো না। অথচ আজ তার খুবই জরুরী মিটিং রয়েছে। সে নিজেই জানিয়েছিলো আমায়। ভাবসাব নিয়ে বলেছিলো,
—শুনো, প্রভাতি। কাল আমি কোনো ফাংশান টাংশান করতে পারবো না। খুবই ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে বুঝেছ। খুবই ইম্পর্ট্যান্ট। সাড়ে সাত লক্ষ টাকার প্রজেক্ট। এটা যে যা তা ব্যাপার নয়, বুঝতেই পারছো?
আমি হা না কিছুই বলি নি। অথচ আমার বলা উচিত ছিলো,’ স্যার, আমিও যাবো আপনার সাথে অফিসে। আরো জানা দরকার ছিলো যে আমি কি আর আপনার সাথে চাকরী করতে পারবো কি না?’ কিন্তু কিছুই বলা হলো না। স্যারের আকস্মিক বদলে যাওয়ায় আমি মুখ দিয়ে কথাই বের করতে পারি নি। বিষ্ময়ে হাত পা কাঁপছিলো। ধারনা ই করি নি যে আমাকে কাঁদতে দেখে লোকটা আর এগুবে না আমার দিকে, ভোগ করবে না লালসা আর ক্রোধে। আমি সবসময় কাঁদতে চাইতাম না। কারন আমি কাঁদলেও যা হবার তাই হতো,না কাঁদলেও তাই হতো। কেউ কখনো সিদ্ধান্ত বদলাতো না। তাই নিজেকে বুঝিয়েছিলাম যে শুধু শুধু কেঁদে কষ্ট পাবো না। এই চেষ্টার ফলেই কাঁদতাম না, কান্না আসলেও কাউকে দেখাতাম না। অথচ, অথচ, দেখো আমার কান্নার কারণে জীবনের খুব বড় একটা কঠিন অংশ থেকে রেহাই পেয়ে গেলাম।
ইশান স্যারের মাঝারি অবস্থার একটা অফিস রয়েছে। ওয়েডিং ডিজাইনিং এর। সেখানে চাকরী করি আমি। আসলে বাবার দোকান টা বেঁচার কারণে সংসারে টাকার টান দেখা দিচ্ছিলো। তাই আপুর মতো আমিও চাকরী খুঁজতে বেরিয়ে ছিলাম। এবং সৌভাগ্যবশত স্যারের অফিসে চাকরী পেয়ে যাই। আমি অফিস বলছি দেখে বড় কোনো দালান-টালান ভাববেন না আবার। খুবই ছোটখাটো একটা রুম। এখানে স্যারসহ আটজন কাজ করি। বিভিন্ন বিয়ের ফাংশনে কাজ করি। মজার ব্যাপার কি জানেন, আপুর বিয়েতেও আমিই সাজিয়েছিলাম এবং মেইন দায়িত্বে আমি ছিলাম। সবসময় কিন্তু স্যার মেইন দায়িত্বে থাকতো, কিন্তু এবার আমি দায়িত্বে ছিলাম। অবাক হচ্ছেন না,আমিও অবাক হয়েছিলাম। তাইতো বোকার মতো প্রশ্ন করেছিলাম, স্যার কেনো দায়িত্বে থাকবেন না?
নিশা মেয়েটা আমার উপর উপহাস করলো। ফোকলা দাঁত বের করে হেসে বললো,
—আরে গাধী,স্যারের তো নিজের বিয়ে, তিনি কীভাবে দায়িত্বে থাকবেন?
অতিরিক্ত এক্সাইটমেন্টের কারণে স্যারের বিয়ের কথা মাথা থেকে চলে গিয়েছিলো। ভাগ্যিস ইশান তখন সেখানে ছিলো না। নাহলে নিশ্চই রাগ করে রিডিকুলাস বলে হনহন করে হাটা ধরতেন।
দুপুরের দিকে হসপিটালে এডমিট করানো হলো ইশানের বাবা কে। তার অবস্থা ভালো নয়। বাড়ীর সবার সাথে আমিও গেলাম। সেখানে যেয়ে শুনলাম, তিনি এখানের রোজকার কাস্টমার। মাসেই নাকি দু-একবার জ্বর,ডায়রিয়া ইত্যাদি হুলস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে এখানে এসে এডমিট হন। ডাক্তার রা গা ছাড়া ভাব নিয়ে তাকে বিছানায় শুইয়ে রেখেছেন। যেনো এটা নিত্য দিনের কর্মকান্ড। আমার খুব রাগ হলো। ইচ্ছা হলো তাদের যেয়ে বলি, আপনারা এভাবে রোগীদের সেবা করেন। এমন হলে তো রোগী এমনিতেই মারা যাবেন। কিন্তু বলা হলো না। ইশান কই থেকে এসে আমাকে ডাক দিলেন। আমি সচেতন চোখে তাকালাম।
—ও মাই গড, ও মাই গড! প্রভাতি, তোমার চোখ এত লাল কেনো? তুমিও বাবার মতো আবার কোনো মিথ্যাটিথ্যা বলো নি তো?’ ইশান কথা থামিয়ে আবারো বললো, এই, এই তুমি মাথায় হাত দিয়ে রেখেছো কেনো? কি হয়েছে?কি হয়েছে?
আমি শান্তস্বরে বললাম,
— কিছুই হয় নি।
ফুফুমনি ও এগিয়ে এসে বললেন,
— কিছু হয় নি মানে? আলবাত কিছু হয়েছে। দেখো তোমার চোখ কত লাল।
আমি আবারো বললাম কিছু না, এমনিতেই। কিন্তু কথা শেষ করতে পারলাম না। শরীর নাড়া দিয়ে উঠলো। সবাইকে দুবার দেখতে লাগলাম। ইশান আমাকে ধরে ফেললেন। ধমক দিয়ে বললেন,
—কিছু হয় নি বলছো, তাহলে এবার মাথা ঘুরাচ্ছে কেনো?
আমি ইশানের থেকে সরে যেতে চাইলাম। ইশান ছাড়লেন না। উল্টো আমায় কোলে নিয়ে নিলেন। ফুফুমনির দিকে তাকিয়ে বললেন,
— আমি ডাক্তারের চেম্বারে যাচ্ছি ফুফু। তুমি টেনশন নিও না। মাথা ব্যাথা করছে বোধহয়। তুমি সবার সাথে বাবার পাশে থাকো।
আমি বারণ করলাম। ইশান শুনলেন না। আমায় কোলে নিয়ে বাবার কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি মোটেই রোগা-পাতলা মেয় নই, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। পরনে ভারী শাড়ী এবং অর্ণামেন্টস ও রয়েছে। আমি জানি ইশানের কষ্ট হচ্ছে। খানিকটা সন্দেহ হচ্ছে সে হয়তো দু-এক মিনিটের বেশি রাখতেও পারবে না। আশেপাশের ডাক্তার আর নার্সরা সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। হসপিটালে এমন সুস্থ জলজ্যান্ত মানুষকে কোলে নিলে তো তাকাবেই। আমি অতিরিক্ত লজ্জা বা অস্বস্তি কিছুই অনুভব হলো না। আমার কি যে হলো, বুঝতে পারলাম না। ইশানকে একবারও বললাম না আমাকে নামিয়ে দিন। স্বাচ্ছন্দ্যে কোলে রইলাম। ইশান ও নামালেন না। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে ওয়ার্ড নাম্বার ৯০২ এর দিকে নিয়ে যেতে লাগলেন।
#চলবে….
®সোনালী আহমেদ