এবং_তুমি পর্ব ৯

0
931
  • গল্পের নাম— #এবং_তুমি
    লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
    পর্ব– ৯

    ঘন্টাদুয়েক বসিয়ে রাখার পরেও মাদার ইন- লো এর মিটিং করা হলো না। কারণ হলো ইশান। তিনি বাড়ীতে ফিরে আসেন নি। শাশুড়ি মা ১১ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন। আরো অপেক্ষা করতেন, কিন্তু বাচ্চাদের জন্য হয়ে উঠলো না। তিন টা বাচ্চার কান্নাকাটিতে অসহ্য হয়ে মিটিং ক্যান্সাল করা হয়েছে। ভাবীরা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। বড় ভাবী তার মেয়েকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ চলে গেলেন। আমি মেঝ ভাবীর সাথে উনার দুই ছেলের এক ছেলেকে কোলে নিয়ে রুমে পৌঁছে দিলাম। বাচ্চা দুটো খুব দুষ্টু। যেখানে সুই ডুকবে না তারা সেখানে কুড়াল ডুকিয়ে দেয়। হাটার সময় যদি কেউ তাদের পাশ দিয়ে যায়, তারা দুজন কনুই দিয়ে গুতিয়ে সরিয়ে দিবে। বড় ভাবীর বাচ্চা মেয়েকে একা বসতে দেখলে দুজনে আস্তে করে চিমটি কাটবে। বেচারি তিথি গলা ফাটিয়ে কাঁদতে থাকে। আর বাঁদর তখন দুটো থাকে লাপাত্তা। ঘরে কোনো মেহমান আসলে বলবে, ‘–আমাদের ঘরে কোনো খাবার নেই, আপনারা এখন চলে যান। ‘ মেঝ ভাবি কি শরম ই না পান। ঘরের ভেতর বা আশেপাশে কোনো চিপস বা চকলেটের প্যাকেট পড়ে থাকতে দেখলে কাম সারে। যাকে সামনে পাবে তার পেছন পেছন ওই খালি প্যাকেট হাতে নিয়ে বলতে থাকবে,– এটা কে খাইছে? এটা কত? এটার ভেতর কি ছিলো? এটা কই পাওয়া যায়? ইত্যাদি। যতক্ষণ পর্যন্ত জবাব না দিবেন ততক্ষণ পেছন ঘুরতে থাকবে। ঘরের কোনো জিনিস দেখলেই তারা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যায়। মেঝ ভাবী অবশ্য তাদের খুব মারে এসবের জন্য। কিন্তু তারা দুটো এর পুরো ফায়দা লুটে। কাঁদতে কাঁদতে শাশুড়িমার কাছে যেয়ে বলে, —দাদী দাদী, কাল আম্মা ফোনে আপনারে বুড়ি বলছিলো। আবার আমাদের জন্য চিকেন ফ্রাই ও এনেছিলো। আমরা দরজা লাগিয়ে খেয়েছিলাম। জানো, মোটা লাঠি এনে আমাদের সামনে ধরে বলেছিলো আপনাকে যেনো না বলি।

    মেঝ ভাবী তখন চিৎকার দিয়ে এসে বলে, — আম্মা এরা মিথ্যা বলতাছে। টিভির রিমোট ভেঙ্গে ফেলছে দেখে আমি মারছিলাম। তাই এসব বানাইয়া বলতেছে।

    মেঝ ভাবীর ছোট ছেলে আবীর তখন দৌড় মেরে রুম থেকে, চিকেন ফ্রাই এর প্যাকেট নিয়ে এসে বলে, —এই দেখো,দাদী আমরা খাইছিলাম। দেখছেন আম্মা মিথ্যা বলে।

    মেঝ ভাবী দুজনকে চোখ রাঙ্গিয়ে শাসায়। তখন তারা উল্টো বলে,– বলছি না মেরো না,দাদী রে বইলা দিমু। তখন না বললা, যা যা গিয়ে বল। এখন কি হ্যা?

    মেঝ ভাবী অসহায় কন্ঠে আমার কাছে এসে বলে, —-দেখছোস, দুইটা কত বড় শয়তান। আম্মা এসব দেখলে বকাবকি করেন তাই বলছিলাম আম্মারে না কইতে। বলতেন এসব খেলে নাকি অসুখ হয়। এখন আমার ভাই কাল আবীরের বাপকে বাজারে পেয়ে তার ভাগ্নেদের কিনে দিছিলো, এতে আমি কি করবো বল?
    অথচ দেখ আম্মা, ‘আজ আমারে বললো, শুনো বউমা আমার নাতির খাবার দেখে হিংসা করার মতো দাদী না আমি। তুমি যেসব শিখাচ্ছো তা ছোটলোকদের স্বভাব। ‘ বিশ্বাস করো আমার মনে এসব কোনো কিছুই ছিলো না। ইশশ, আম্মার মনে কত কষ্ট গিয়েছে।
    মেঝো ভাবী কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে রুমে চলে যান।

    আবীরকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। বাহিরে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। আমি জানালার পাশে দাড়ালাম। আজ মনটা খারাপ। ভীষণ খারাপ। কারণ হলো ফুফিমা চলে গিয়েছেন। কালকেই ফ্লাইট,তাই আজ রওনা দিয়েছেন। উনার সাথে দাদী শাশুড়িও গিয়েছেন। ফুফিমার সাথে লন্ডনে তিনিও থাকেন। এই কয়দিনে উনার প্রতি আমার আলাদা মায়া জন্মে গিয়েছিলো। আমার মনে হয়েছে সত্যিকার অর্থেই মা পেয়েছি। অথচ কপাল দেখো পেতে না পেতেই হারিয়ে ফেলেছি। যাবার সময় কি কান্না টা ই না করেছিলাম। আমার জীবনে ভালো মানুষের স্থায়ীত্ব কাল রৌদ্দুরের বৃষ্টির মতো। তাদের ক্ষণিকের জন্য আসা হয়। বাহিরের বৃষ্টিফোটা গুলো আমায় চম্বুকের মতো টানছে। হঠাৎ করেই অদ্ভুত ইচ্ছা দেখা দিলো। এই মাঝ রাতে বৃষ্টিতে ভেজার। অথচ এমন ইচ্ছা আমার স্বপ্নেও ভাবা উচিত নয়। কিন্তু আমি নিজেকে আটকালাম না। দু হাত প্রসারিত করে ভিজতে লাগলাম। আজ নির্ঘাত জ্বর সর্দি বাঁধিয়ে ফেলবো। আমি জ্বর টর একদম সহ্য করতে পারি না। জ্বর হলে নাক দিয়ে পানি পড়ে, কোনো কিছু মুখে দিলে তেঁতো লাগে। ছিঃ,কি বিশ্রি ব্যাপার!

    ভেজা জুবুথুবু শরীর নিয়ে রুমে আসলাম। ইশান আয়নার সামনে দাড়িয়ে শার্ট বদলাচ্ছেন। মাত্রই ঘরে এসছে। অথচ একবারও খেয়াল করে নি বাহিরেই আমি বৃষ্টিতে ভিজছিলাম। আমি সরাসরি ইশানের সামনে যেয়ে দাড়ালাম। ইশান তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে বললো,

    —তুমি এখানে কেনো? ওয়াশরুমে যাও। তোমার পোশাক খুবই এলোমেলো হয়ে আছে।

    আমি শুনলাম না। ঠাঁই দাড়িয়ে রইলাম। ইশান চোখ খুলে আমায় একই ভঙ্গিতে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,

    —কি হলো যাও বলছি।

    আমি গেলাম না। ইশানের হাত থেকে শার্ট টা কেড়ে নিয়ে ফেলে দিলাম। শরীর থেকে শাড়ী টা ফেলে দিয়ে ব্লাউজের দু তিনটা হুক খুলে ফেললাম। ইশান আতঙ্কিত গলায় বললো,

    — তুমি পাগল হয়ে গেছো প্রভাতি। এক্ষুণি ওয়াশরুমে যাও।

    আমি এবারও শুনলাম না। জেদ দেখিয়ে পুরো ব্লাউজ খুলে ফেললাম। ইশান তখন জোর করে আমায় কোলে নিয়ে রাথরুমে ডুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। আমি অনেকবার দরজা খুলতে বললাম, কিন্তু সাড়া পেলাম না। ক্লান্ত হয়ে ফ্লোরে বসে পড়লাম। আমি শান্ত হতেই সে দরজা খুলে দিলো। বেশ কয়েক মিনিট ভেতরে কাটিয়ে বেরিয়ে আসলাম। ইশান রুমে নেই। বোধহয় বাহিরে গিয়েছেন। আমি ভেজা কাপড়সহ বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আমার এত পরিমাণ লজ্জা লাগছিলো যা বলার বাহিরে। ছিঃ,কি করতে গিয়েছিলাম আমি। স্যারের সামনে কীভাবে যাবো? তিনি নিশ্চই আমায় বাজারের মেয়েছেলে ভাবছেন। লজ্জায় কেঁদে ফেললাম। মনে মনে ঠিক করলাম ইশানের সামনে যাবো না।

    সকাল সকাল ঘুম ভাঙ্গতেই রান্নাঘরে চলে আসলাম। আজ নাস্তা বানাবো। রান্নাঘরে পড়ে থাকলে নিশ্চই ইশানের সম্মুখীন হতে হবে না। এ ই ঢের। বড় ভাবী এসে দেখলেন রুটি বানানো শেষ। চায়ের লিকার ও চুলোয় করে রাখা। তিনি ভীষণ খুশি হলেন। আনন্দিত গলায় বললেন, — ওমা সব হয়ে গেছে। খুব ভালো করেছিস রে। কাল মিথির বাবার সাথে কথা বলতে বলতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো। বেচারা ডিউটি করে আজ একটু সময় পেয়েছিলো, বুঝিস ই তো। তাই আজ উঠতে দেরী হয়েছে। বাবা নিশ্চই এক্ষুণি এসে নাস্তা চাইবেন। টেনশনে আমার কান্না পাচ্ছিলো। থ্যাংকইউ রে।

    — থ্যাংকইউ দিচ্ছো কেনো? এসব কি আমার কাজ নয়? আমাকে নতুন বলে তোমরা সব কাজ করে ভালো সাজো।

    — তুই ভুল ভাবছিস। আমাদের মনে কেনো কল্পনায়ও এসব আসে নি। তোর নতুন বিয়ে হয়েছে, আর এ সময়ে নতুন বউদের সকালে উঠতে দেরী হয়। তোর আবার ডায়বেটিস। ঠিকঠাক না ঘুমালে অসুস্থ হয়ে যাস। এসবের জন্যই বারণ করেছি রে। বিশ্বাস কর আমরা এসব কোনোকিছুই ভাবি নি।

    বড় ভাবীর চোখ ছলছল হয়ে উঠলো। মনে হচ্ছে এক্ষুণি কেঁদে দিবেন। আমি দুই হাতে তাকে ঝাপটে ধরলাম। মাথাটা উনার বুকে মিশিয়ে বললাম, — তুমি থ্যাংকইউ বলেছো দেখে আমি মজা করে বলেছিলাম। এত্তগুলো, সরি!
    তুমি, তোমরা সবাই এত ভালো কেনো? কেনো এত এত ভালো? সবাই কেনো আমাকে এত ভালোবাসো? আমি এসবের যোগ্য?

    খুশিতে আমি কেঁদে ফেললাম। বড় ভাবী হাত উঠিয়ে বললেন,
    — এবার কিন্তু আমি মেরে দিবো? চোখের পানি মুছো বলছি। এক্ষুণি মুছো! খবরদার আমার সামনে আর কোনোদিন যাতে কাঁদতে না দেখি।

    #চলবে…

    ®সোনালী আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here