এমনও প্রেম হয় পর্ব:-৩৬

0
1210

#এমনও_প্রেম_হয়
#ইয়ানা_রহমান
#পর্ব:-৩৬

জিয়ান কয়েকদিন হলো দেশে এসেছে। ওর মায়ের অসুখ তাই মাকে দেখতে এসেছে। মায়ের অসুখের খবর না পেলে হয়তো আসতো না।

মায়ের মেডিসিন আনতে ফার্মেসিতে যায়। সেখান থেকে ফেরার সময় দেখে লিয়া পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে। বুকটা ওর ছ্যাৎ করে উঠে।
যার কথা ভুলতে সে বিদেশেই থেকে যাওয়ার প্ল্যান করেছে। আজ সেই কিনা চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে।

পরনে সাদা থ্রিপিস। মুখটা মলিন, গম্ভীর। আগের সেই হাসিমাখা মিষ্টি মুখটা কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চেহারার সেই বাচ্চা বাচ্চা সুইটনেসটা আর নেই। এ কোন
লিয়াকে দেখছে সে। কি হয়েছে ওর।

সেই যে এসএসসি শেষ পরীক্ষার দিন দেখেছিলো লিয়াকে। এরপর আর দেখা হয়নি তার ভালোবাসার হরিনীর সাথে।

লিয়া চোখের আড়াল হলে সে আর সেখানে দাড়ায় নি। মেডিসিন নিয়ে সোজা বাসায় চলে গেছে।

একই ধানমন্ডি এলাকায় বাসা বলে ঘুরে ফিরে দেখা হয়েই যায়। যতবার লিয়াকে দেখেছে সাদা থ্রিপিস পরাই দেখেছে। মুখটা মলিন আর খুব তাড়াহুড়ায় কোথাও যেতে দেখেছে।

জিয়ান ওর সামনে যায়নি বা ওকেও কখনো ডাকেনি। দূর থেকেই দেখতো ওর হারিয়ে যাওয়া প্রেয়সীকে।

.
লিয়া বোনের চোখের পানি মুছে দিলো। ওর সাথে ওর ঘরে নিয়ে গেলো। এখন বুঝতে পারছিস তুই কত বড়
বিপদের মধ্যে আছিস।

আর আমাকেও বিপদের মধ্যে ফেলেছিস।
কারন অপরাধী দেবরটা আমার।

অপরাধী বলছি এই কারণে তুই উচ্ছাস ভাইয়ার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট।
তুই ভুল সিদ্ধান্ত নিলে সেটাতে সে সমর্থন দিলো কিভাবে?
এখন সে এই পরিস্থিতি সামাল দিবে কিভাবে?
এক দিকে আমাদের রাগি আব্বু আর অন্য দিকে উচ্ছাসের প্রেমবিরোধি মা। সে কি জানে না এই ব্যাপারে তার মায়ের মনোভাব?

এখন উচ্ছাস ভাইয়ার সাথে সাথে আমিও আব্বুর চোখে সমান অপরাধী হয়ে গেলাম। আমি ওই বাড়ির বিধবা বউ। এটাই আমার অপরাধ। এখানে অন্য কোন ছেলে হলে আমাকে জবাবদিহি করতে হতো না।

এই ভয়ানক কাজ করার আগে আমার সাথে একটু যদি শেয়ার করে নিতি তাহলে আমরা দুজনেই বেঁচে যেতাম। ভালো বাসিস ভালো কথা। তাই বলে এইভাবে হুট করে কাউকে না জানিয়ে বিয়ে পর্যন্ত যাওয়া তোর ঠিক হয় নি।

এখন যদি বাবা মায়ের ভয়ে উচ্ছাস ভাইয়া তোকে অস্বীকার করে তখন কি হবে?

আর অস্বীকার করতে পারে এই সন্দেহটা অহেতুক না। কারন সে নিজে একজন স্টুডেন্ট। বাবার টাকায় পড়াশুনা করে। হাত খরচ, শখের কেনাকাটা সব বাবার টাকায় চলে। তার নিজের কোন সোর্স অফ ইনকাম নেই।

আব্বু তোকে যেমন বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইছে, তেমন করে যদি বাবা উচ্ছাস ভাইয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়, তখন সে যাবে কোথায়? আর কোথায় থাকবে, খাবে কি?

পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যাবে। ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন সব শেষ হয়ে যাবে। এসব চিন্তা থেকে তোকে অস্বীকার করা ওর জন্য খুব স্বাভাবিক।

সে পুরুষ মানুষ অপরাধ করেও পাড় পেয়ে যাবে। বিপদে পরবি তুই।

আমার শাশুড়ি এমনিতে ভালো মানুষ। সবার জন্য তার মনে অনেক স্নেহ মায়া মমতা আছে। কাউকে সে দিতে খাওয়াতে কম করে না। কারো ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু চাপিয়ে দেয় না। এক কথায় উনি অমায়িক মহিলা।

কিন্তু প্রেমের বিয়ের ঘোর বিরোধী সে। প্রেমের বিয়ে সে কিছুতেই মেনে নিবে না।

তার মতে যে সব মেয়েরা প্রেম করে তারা দুশ্চরিত্রা নষ্টা মেয়ে। উশৃঙ্খল মেয়ে। উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়ে।

এদের বউ করে যারা ঘরে নেয় তাদের সংসারে কখনো সুখ আসে না। সেই সব মেয়েরা সংসারে ফাটল ধরায়।

বাবা মা যেখানে মেয়েকে বিয়ে দিবে তাকে সেখানেই মানিয়ে গুছিয়ে চলতে হবে। তবেই সে হবে খানদানী বংশের মেয়ে।

রাস্তাঘাটে প্রেম ভালোবাসার নামে বেহায়াপনা করে বেরানো মেয়েরা নাকি তার দুচোখের বিষ।

এখন তুই বল, তোর বেলায় কি তার মত বদলে যাবে? মনে হয় না।

উল্টো তোর জন্য এখন আব্বু আম্মুকে অনেক কথা শুনতে হবে।

আর আমাদের আব্বু কি কারো বাজে কথা শুনার মানুষ? আব্বুর জেদ সম্পর্কে তোর ধারণা নেই? আব্বুর মান সম্মানই তার কাছে সব।

যখন তারা আব্বুকে কিছু বলবে, আব্বু কি তাদের ছেড়ে কথা বলবে?

দুই পরিবারের মাঝে একটা সুসম্পর্ক আছে। এখন সেই সুসম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ভেবে দেখেছিস?

.
কি যে হবে কালকে ভাবতেই আমার খুব ভয় করছে, হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।

আল্লাহর কাছে দোয়া কর কোন তিক্ততা যেন না হয় কালকের বৈঠকে।

.
রিয়া লিয়াকে জড়িয়ে ধরে কাদছে। ভাবছে সত্যিই তো এতক্ষণ আপু যা যা বলেছে সেগুলি ফেলে দেয়ার মত কথা না। যদি ওরা এই বিয়ে মেনে না নেয়? তখন আমার কি হবে, কোথায় যাবো?

আপু এখন আমার কি হবে? আমি কি করবো!

.
লিয়া বললো তুই ভুলেও উচ্ছাস ভাইয়াকে কোন কল করিস না, তার কল এলেও রিসিভ করিস না।

ভাইয়া ভয় পেয়ে যদি কালকের বৈঠকে না আসে তাহলে আব্বু তোকে মেরেই ফেলবে। তার কোপ থেকে আমি তোকে বাঁচাতে পারবো না।

এখন আমি যা বলি তুই সেইমত চলবি।
আমি যতটুকু পারি তোর পক্ষে বলবো।
যতটুকু পারি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবো।

যদি আমার কিছু করার সুযোগ থাকে অবশ্যই করবো, কোন ভয় পাবো না।

.
সন্ধ্যার দিকে উচ্ছাসের বাবা মা উচ্ছাস সহ লিয়াদের বাসায় এলো।

উচ্ছাস আসতে চায়নি। ওকে জোর করে আনা হইছে।

.
হঠাৎ রিয়াদের বাসায় তাদের কেনো ডাকা হয়েছে সেটা জানতে উচ্ছাস রিয়াকে অনেকবার ফোন করেছে কিন্তু রিয়া ফোন ধরে নি।

রিয়া দেখেছে বারবার উচ্ছাস কল করে যাচ্ছে। ও ফোন রিসিভ করেনি লিয়া ফোন ধরতে নিষেধ করেছে বলে।

.
আমি গিয়ে আমার শ্বশুর শাশুড়ির সাথে দেখা করলাম কথা বললাম। ওনারা আয়ুশকে বুকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করলো। আয়ুশের সাথে খেলা করতে লাগলো।

.
উচ্ছাস ভাইয়াও আয়ুশের সাথে নাক টেনে গাল টেনে দুষ্টামি করলো, অনেক চুমু দিলো। কোলে নিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো অনেক আদরের ভাতিজাকে।

.
লিয়া ওদের চা নাস্তা সার্ভ করলো। লিয়ার মা আফরোজা বসে সবার সাথে কথা বলছে।

.
লিয়ার আব্বু মিজান সাহেব অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে বসার ঘরে মেহমানদের কাছে এসে বসলো।

.
সবার সাথে বিভিন্ন কথার গল্প জুড়ে দিলো মিজান সাহেব। সে যে ভয়ানক রেগে আছে এটা কাউকে বুঝতেই দিলো না। একদম স্বাভাবিক আচরণ করছে সে।

বললো, আপনাদের ডেকেছি একটা কথা বলার জন্য। আমিই আপনাদের বাসায় যেতাম কিন্তু ইদানিং কাজের চাপ একটু বেশি তাই সময় বের করতে পারছি না।

কথাটা হলো লিয়ার এইচ এস সি পরীক্ষাতো প্রায় এসেই গেলো।

আর কয়েক মাস পরই ওর ফাইনাল পরীক্ষা।

তাই আমি ভাবছি পরীক্ষার পর লিয়ার আবার বিয়ে দেবো।

এভাবে আর কত দিন চলবে। সামনে ওর বিশাল জীবন পরে আছে। আমি না থাকলে কে ওর দায়িত্ব নিবে।

ওরও সুখে শান্তিতে থাকার অধিকার আছে। আমি বেঁচে থাকতে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে ওদের সুখী দেখে যেতে চাই।

আমি যেমন লিয়ার গার্ডিয়ান তেমনি আপনারাও ওর গার্ডিয়ান। তাই বিষয়টা আপনাদের জানালাম।
আমি নিজেও উপযুক্ত পাত্রের খোঁজ করছি। আর আপনারাও
ভালো পাত্র পেলে আমাকে বলবেন।

.
লিয়ার বিয়ে হলে রিয়াকেও বিয়ে দিয়ে দিবো। ওর জন্যও সৎ পাত্রের সন্ধান থাকলে জানাবেন।

.
উচ্ছাসের বাবা মা এই কথা শুনে খুব খুশি হলো। ভাবলো এই বার মনের কথাটা বলেই ফেলবো।

.
উচ্ছাসের বাবা বললো, আমরাও অনেকদিন থেকেই একটা কথা আপনাকে বলবো বলে ভাবছিলাম। কিন্তু কথাটা বলা হয়ে ওঠেনি কখনো।

.
কি কথা! নিঃসংকোচে বলে ফেলেন। আমরা আমরাই তো। আমাদের নিজেদের মধ্যে এতো ফর্মালিটি থাকলে কি চলে??

.
লিয়াকে আমরা উচ্ছাসের জন্য বউ করে নিতে চাই। তাহলে লিয়া আমাদের বাড়ির বউ বাড়িতেই রইলো আর
আয়ুশের লাইফটাও সিকিউর রইলো।তাতে আমাদের দুই পরিবারের সম্পর্কও বজায় থাকবে।

.
মিজান সাহেব বললো, চিন্তাটা ভালোই করেছেন। প্রস্তাবটা ভেবে দেখার মত।

লিয়া এই ব্যাপারটা কিভাবে নিবে সেটা আমি পরে দেখবো, ওর মতামতের দায়িত্ব আমার। আগে উচ্ছাসের মতামত জানা জরুরি।

.
উচ্ছাস বাবা তুমি তো সবই শুনলে, এ ব্যাপারে তোমার কি মত? সামনা সামনি বলো, সরাসরি বললেই আমি খুশি হবো।

লিয়াকে তোমার বাবা মা তোমার সাথে বিয়ে দিতে চায়, এই প্রস্তাবে লিয়ার গার্ডিয়ান হিসেবে আমিও রাজি।

এখন তোমার মত কি? তুমি রাজি আছো কি না বলো,

তোমার কোন কথা থাকলে বলতে পারো।

.
উচ্ছাসের বাবা রফিক সাহেব বললো, ও আবার কি বলবে? ওর মায়ের আর আমার মতই যথেষ্ট।

আমার বড় ছেলে উদয়ের বেলাও আমরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

উদয় আমাদের অবাধ্য হয় নি। উচ্ছাসও তাই করবে। আমাদের মতই ওর মত। ওর আলাদা কোন মত থাকবে না।

.
এটা ঠিক বলছেন না ভাই সাহেব, মেয়ে মানুষ হলে কথাটা মেনে নিতাম, কিন্তু
ছেলেদের বেলায় মতামত নিয়ে নেওয়াটা খুব জরুরি। যেখানে আমার মেয়ের সারাজীবনের ব্যাপার।

উচ্ছাস তুমি বলো,
আমি মেয়ের বাবা, আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই তোমার মতামত।

.
উচ্ছাস কিছুই বলছে না। মাথা নিচু করে বসে আছে।

.
চুপ করে বসে থাকলে তো হবে না। তোমার বাবা আমার কাছে একটা প্রস্তাব রেখেছে। তাকে আমার কিছুতো বলতে হবে।
হ্যা অথবা না কিছু বলো।

.
উচ্ছাসের দুচোখ বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পরছে।

.
তুমি কাঁদলে আমাকে উত্তর দিবে কে? আর এখানে কান্নার কি আছে?

.
উচ্ছাস অনেক সাহস করে বলেই ফেললো,
আমি ভাবীকে না রিয়াকে বিয়ে করতে চাই, কারণ আমি রিয়াকে ভালোবাসি। রিয়াও আমাকে ভালোবাসে। অনেকদিন আগে থেকেই আমাদের সম্পর্ক।

.
বলো কি! আমি তো এই ব্যাপারে কিছুই জানি না।
এই কথাকি লিয়া জানে? তোমার বাবা মা জানে?

.
উচ্ছাস বললো, না কেউ জানে না।

.
মিজান সাহেব রফিক দম্পতির দিকে তাকিয়ে বললো,
আপনারা চুপ কেন কিছু বলেন।

.
উচ্ছাসের মা এবার ছেলের দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বললো এটা কোনভাবেই সম্ভব না। আমাদের পরিবারে প্রেমের বিয়ে অ্যালাউ না। সেটা তুই ভালোভাবেই জানিস।

.
উচ্ছাস বললো, বিয়ে করলে আমি রিয়াকেই বিয়ে করবো, অন্য কাউকেই না।

.
উচ্ছাসের বাবা এবার ক্ষেপে গিয়ে উচ্ছাসকে ধমকে উঠলো। তোর মতামতের কোন মূল্য আমাদের কাছে নেই। আমার মতই মত।

রিয়াকে না লিয়াকেই আমরা বউ করবো তোর জন্য। অনেক আগে থেকেই মনে মনে ঠিক করেছি।

.
তোমাদের কথা মেনে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। রিয়া আর আমি একে অপরকে ভালোবাসি। তাই আমরা তোমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছি।

তোমরা ভাবীকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছিলে বলেই আমি হুট করে এই অন্যায় কাজটা করে ফেলেছি। যদিও কাজটা করা আমার একদম উচিত হয় নি। পারলে ক্ষমা করে দিও।

(বানানের ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন)

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here