কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ৪
___________________
কু ঝিক ঝিক রেলগাড়ি শব্দ মনে করিয়ে দেয় ভ্রমণের কথা। নিঝুম রাত। চারিদিকে স্তব্ধতা। দূর থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। এমনিতেই শীতকালে শিয়ালদের চঞ্চলতা বেড়ে যায়। গ্রামবাংলায় বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় শীতকালে তাদের বেশি দেখতে পাওয়া যায়।গাঢ় কুয়াশার বুক চিরে ট্রেন দ্রুতগতিতে ছুটে চলছে। ট্রেনের তীক্ষ্ণ শব্দ স্নেহা আর বিক্রমের সখ্যতা ব্যাঘাত ঘটায়। ঘরের জানালা আঁটোসাঁটো করে বন্ধ। তবুও মনটাকে ঘরের মধ্যে বন্দি রাখতে চাইলো না। জানালার পর্দা সরিয়ে ট্রেনের ছুটে চলা দেখল। কুয়াশার মধ্যে ট্রেনের আলো ছাড়া তেমন কিছু দেখতে পেল না। তবুও মনটা মুগ্ধ হল। তাদের বাড়ির সামনে ট্রেন লাইন। ছোটবেলা থেকে ট্রেনের যাওয়া-আসা দেখে বড় হয়েছে। সকাল বেলায়, ট্রেন আসার সময় হলে লাইনের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। রাতে দূরে যেতে পারে না,জানালার পর্দা সরিয়ে দেখে। দিনের তুলনায় রাতের ট্রেনকে দেখতে বড্ড অনুপম লাগে। কেমন নিঝুম একটা পরিবেশ। কত অচেনা অজানা মানুষ ট্রেনের মধ্যে বসে আছেন। কেউ আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে বহু দূরে চলে যাচ্ছে, তাই তার মন ভারি। আবার কেউ গন্তব্য থেকে নিজের বাড়ি ফিরছে, তার মন চঞ্চল। দূরপাল্লার ট্রেন গুলোতে মানুষ দুই তিন দিন ধরে জার্নি করে। ট্রেনের মধ্যে খাওয়া-দাওয়া, স্নান করা,ঘুমানোর সবকিছু ব্যবস্থা রয়েছে। কত সুন্দর একটা পরিবেশ। যাত্রীদের মধ্যে ক্লান্ত বিষণ্ণ থাকে, তবুও মনটা থাকে প্রফুল্ল। স্নেহা কখনো ট্রেনে যাত্রা করেনি। খুব ইচ্ছা আছে ট্রেনে করে ভ্রমণ করা। আবার ট্রেনের প্রতি একটা সূক্ষ্ম ভয়ও আছে। ভয় নিরাময়ের ওষুধ, বিক্রম আছে। বিক্রম তার হাত ধরে ট্রেনে তুলে দেবে। তারপর একসঙ্গে বসবে। যাত্রীরা ট্রেনে ভ্রমণ করার সময় ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু তারা দুজন ঘুমোবে না। একে অপরের হাত ধরে গল্প করবে, যে গল্প কখনো শেষ হবে না। তার কোলে মাথা রেখে ঝিমিয়ে পড়বে। বিক্রম আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। জানালার পাশ দিয়ে প্রকৃতির সৃষ্টি সাজসজ্জা দেখবে। মোবাইলের মধ্যে নিজেদেরকে নিমজ্জিত রাখবে না। তারা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম প্রেমিক প্রেমিকা হবে। স্নেহা কখন বিছানা ছেড়ে উঠে এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছে জানে না। ট্রেন অনেক আগে বেরিয়ে গেছে। সে এখন বাইরের পরিবেশ দেখছে। চারদিকে নিবিড় অন্ধকারের মধ্যে বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের সূক্ষ্ম আলো নিঝুম পরিবেশকে আরও সুন্দর করে তুলেছে। বাড়ির সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছটি সমস্ত পাতা ঝরিয়ে ক্লান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ঘন কুহেলিকায় কেমন একটা বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে গাছটিকে। মনে হচ্ছে, গাছটি তাদের বাড়িকে দৃষ্টিকটু করে তুলেছে। গাছটি না থাকলে ভালো হতো। স্নেহা দ্বিতীয়বার একই কথা ভেবে কেঁপে ওঠে। তার মন কতটা নিচু। কৃষ্ণচূড়া গাছ যখন গ্রীষ্মকালে ফুলে ভরিয়ে দেয়, তাদের বাড়িকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলে। তখন তো ইচ্ছে করে না গাছটিকে কেটে ফেলতে। মনে হয় যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকুক। যার কাছ থেকে কিছু পাব, শুধু তাকেই ভালবাসবো। পাওয়া যখন সম্পূর্ণ হয়ে যাবে তখন দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেবো,এ কেমন ভালোবাসা? এটাতো ভালোবাসা নামক শব্দটি কে অপমান করা। হঠাৎ নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে। এখন তার রূপ যৌবন উভয় আছে। কিছু সময়ের পর তা বিলীন হয়ে যাবে। তখন কি বিক্রম সমানভাবে ভালবাসবে -না দূরে ঠেলে দেবে! স্নেহা আর বেশি কিছু ভাবতে পারল না।বিক্রমের কথা মনে পড়তে ছুটে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। বিক্রমের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিল। হঠাৎ ট্রেন চলে আসায় অন্যমনস্ক হয়ে যায়। বিক্রম রেগে গেছে, বুঝতে বাকি থাকলো না। ফোনটি কানের কাছে নিয়ে লেপ মুড়ে শুয়ে পরল। খুব আস্তে গলায় বলল “হ্যালো।”
“সরি।”
স্নেহা সম্পূর্ণ হতভম্ব। সরি তো তার চাওয়ার কথা। সেখানে বিক্রম…। আড়ষ্টতা কাটিয়ে খুব দ্রুতগতিতে বলল,”হঠাৎ।”
“সরিটা তুমি বলতে। তাই তোমার হয়ে আমি বলে দিলাম। রোজ এমন কর। কেন এত কল্পনায় ডুবে থাকো? বাস্তবে থাকতে অসুবিধা কোথায়? কল্পনা ছাড়া মানুষের বেঁচে ওঠা কঠিন, কিন্তু সবসময় কল্পনায় পড়ে থাকাও বোকামি।”
“না তো, আমিতো ট্রেন দেখতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।”
“জানি, কিন্তু সেই অন্যমনস্কতা এক সুদর্শন পুরুষ ছিল। যার গভীরতা তুমি ডুবে গিয়েছিলে।”
“কিন্তু আমিতো কোনো অন্যায় করিনি। প্রিয় মানুষের কল্পনায় ডুবে যাওয়া কি অন্যায়?”
“আমি একবারের জন্যও বলিনি বিষয়টি অন্যায়।তবে সব সময় এমন ভাবে চলতে পারে না। একটু সিরিয়াস হওয়ার প্রয়োজন। বিষয়টি অত্যন্ত জটিল নয়, তবে জটিল হতে কতক্ষণ?”
স্নেহা মুচকি হেসে ওঠে। তার মনের কথা কি করে বোঝে বিক্রম? সে কি ভাবছিল? কোথায় দাঁড়িয়ে ছিল? বিক্রম দূরে থেকেও বুঝে গেল। এটা কি নিত্য দিনের অভ্যাস, না কি একটা মানুষকে সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পেরে যাওয়া! আদৌ কি একটা মানুষকে সম্পূর্ণরূপে কখনো বোঝা সম্ভব! আবেগের বয়স, বিষয়টিকে বেশি প্রাধান্য দিল না স্নেহা। বিক্রম ভালো মানুষ। তাদের মধ্যে সত্যিকারে ভালোবাসা আছে। বিক্রম তাকে বোঝে। তার মন প্রেমের জোয়ারে ভাসতে শুরু করেছে। এখন সবকিছু বাধা পেরিয়ে যেতে রাজি। স্নেহা প্রসঙ্গ বদলে বলল,” বিয়ের পর আমি কতটুকু স্বাধীনতা পাবো?” বিক্রম এমন প্রশ্নের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। একটু আশ্চর্য হলেও যথাযথ উত্তর দিল।
“যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই।”
“সবটা দিলে অসুবিধা বোঝি?”
“হ্যাঁ,পৃথিবীতে প্রত্যেকটি জিনিস একটি নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধে মধ্যে নিবন্ধন। সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে গেলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।” খানিকক্ষণ চুপ থাকল স্নেহা। কোনো কথা বলল না। বিপরীত মানুষটিও চুপ। কিছুক্ষণ নিরবতা থাকার পর স্নেহা আবার বলল,”স্ত্রী হিসেবে আমার কাছ থেকে কি চাও?”
“সবকিছু।”
“মানে?”
“আমরা একে অপরের পরিপূরক। আমরা কখনও এমন কিছু করব না যাতে উভয়ই অসম্মানিত হই। সমস্ত কথা অকপট ভাবে বলতে পারি। কখনো কোনো কিছু গোপন রেখো না। তাতে সম্পর্কের মধ্যে জটিলতা বাড়বে। আমাদের ভুলটিকে ‘ভুল’ নেব আর ‘সঠিক’ টাকে সঠিক নেব, আমি কিছু বলেছি মানে তা সঠিক তেমনটা কিন্তু নয়।আর আমার বলা ভুলটি যদি তুমি সঠিক বলে মনে কর তাহলে কিন্তু একসময় আমাদের নিজস্বতা বলতে কিছু থাকবে না।”
স্কুলে পাঁচিলের ওপর বসে স্নেহা আর আদ্বিতিয়া খোশগল্পে মেতে আছে। ছোটবেলার বন্ধু নয়, স্কুলে পরিচিত। দুজন বেশ ক্লোজ। বেস্ট ফ্রেন্ড। দুজনকে দেখতে ততোটা সুদর্শন নয়, তবে নিজেদের আচরণ নিজেরকে অনন্য করেছে। আদ্বিতিয়া, যাকে স্কুলের বেশিরভাগ বন্ধুরা নিজের নামে না ডেকে,তার ঠাম্মি নাম ধরে ডাকে। নামটি শুনলেই সে ভীষণ বিরক্ত হয়ে যায়। একদম পছন্দ করে না। বন্ধুরাও নাছোড়বান্দা। তাকে রাগাতে ভালোবাসে। সে যত রাগতে থাকে তাকে তত বেশি তার দিদার নাম ধরে ডাকতে থাকে। তারা পাঁচিলের ওপর বসে একে অপরকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, জীবনে যাই হোক না কেন -তারা কখনো আলাদা হবে না। সারাজীবন যোগাযোগ রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। স্নেহার চাইতে আদ্বিতিয়া একটু বেশি বাস্তববাদী এবং বুদ্ধিমতি। স্নেহার মতো পাঠ্যবই তেমন একটা পড়াশোনা করতে পারে না তবে বাহ্যিক জ্ঞান প্রচুর। স্নেহার মতো অতটা চঞ্চল নয়। স্নেহা তার জীবনে সমস্ত গোপন কথা আদ্বিতিয়া সঙ্গে অকপটে স্বীকার করে। তার জীবনে বিক্রমের আগমন আদ্বিতিয়া ছাড়া কেউ জানে না।সে সবকিছু প্রথম শোনার পর বিষয়টিকে সহজ নেয়নি। মুখের উপর বলে দিয়েছিল, এই বয়সে এইসব ঠিক না। প্রত্যেকটা জিনিসের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। সেই সময়ের জন্য অপেক্ষা করা ভালো। এখন আবেগের বয়স,এই বয়সে যদি কোনো কঠিন ধরনের মানসিক আঘাত পায় তাহলে সেখান থেকে ফিরে আসা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া এই বাংলায় এমন কয়জন প্রেমিক প্রেমিকা রয়েছে, স্কুল জীবনের প্রেমকে বিবাহ আবদ্ধ করেছে? হাতেগোনা দু-চারজন। স্নেহা মনঃক্ষুন্ন হয়। সে মানতে পারে না আদ্বিতিয়ার কথা। বিক্রম অনেক ভালো ছেলে। সে কখনো ঠকাবে না। ঠকানোর প্রসঙ্গ উঠতেই পারে না। তাদের ভালবাসার গভীরতা অনেক। স্নেহের কথা শুনে সেদিন আদ্বিতিয়া বলেছিল, মেনে নিলাম বিক্রম ঠকাবে না। কিন্তু এমনটাও হতে পারে, তুই তাকে ছেড়ে দিতে পারিস। হা হা করে হেসে উঠে ছিল স্নেহা। বাচ্চার মত কথা বলছে আদ্বিতিয়া। সে কখনো কাউকে ঠকাবে না। বিক্রমের মায়ায় আবদ্ধ। তাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকা কঠিন। ওই দিন আদ্বিতিয়া আর কোনো কথা বলেনি। শুধু অপেক্ষায় আছে সময়ের। সময় সবকিছুর বিচার করবে। তবে সে মন থেকে চায়, তার বন্ধুর ভালোবাসা পূর্ণতা পাক। কষ্ট যেন তার জীবনকে ঘিরে না ধরে। আলোকময় উজ্জ্বল হয়ে থাকুক সবসময়। আদ্বিতিয়া টিফিনের কৌটো খুলে লুচি বের করল। কেমন একটা ফ্যাকাশে গন্ধ ভেসে আসছে। গন্ধটা নাকে পেতে স্নেহা তাড়াতাড়ি বলল,”তুই আবার বাসি লুচি নিয়ে এসেছিস?”
“কালকে রাতে আমাদের বাড়িতে হয়েছিল। লুকিয়ে রেখে ছিলাম, স্কুলে নিয়ে আসবো বলে। ঠিক করে রেখেছিলাম ক্লাসে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে খাব , কিন্তু সুযোগ পেলাম না।”
“তুই এখন প্রাইমারি স্কুলে পড়িস না, হাই স্কুলে পড়িস। এখনো বাচ্চা স্বভাব কাটেনি। আমি খাব না। শরীর খারাপ করবে।”
“ঠিক আছে খেতে হবে না। একা খাব।”
কোনো কারন ছাড়াই দুজন আবার হেসে ওঠল। স্নেহা প্রথমে না বললেও, ঠিক খেলো। এই লুচির কোনো স্বাদ নেই, কিন্তু তৃপ্তি রয়েছে। আনন্দ আছে। যা অন্য কোথাও বেশি দামে খাবারের মধ্যে পাওয়া যাবে না। তাইতো স্কুল জীবন এত রঙিন এত আলোকময়। লুচি খাওয়ার সময় আর্যকে লক্ষ করল স্নেহা। ছাদে একটা পাশে দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব আনমনা। কিছু ভাবছে সে। স্নেহা আদ্বিতিয়াকে আর্যকে দেখতে বলে। আদ্বিতিয়া মুখ ঘুরিয়ে দেখল।
“ছেলেটাকে চিনিস?”স্নেহা প্রশ্ন করল।
“একই ক্লাসে পড়ি চিনব না! তাছাড়া, তার সাথে তোকে বেশি মিসতে দেখা যায়। আর সবাই কি ভাবে জানিস?”
“জানি। ছেলেটা অনেক ভালো তাই নারে !”
“ভালো না ছাই। সবার মধ্যে আগুন থাকে, দেশলাইয়ের কাঠি মারার জন্য একটা মানুষের প্রয়োজন। তারপর তার আসল রূপ বেরিয়ে আসবে।”
“তোর কাছে সবাই খারাপ। তুই একা ভালো। যা তো…।” দুজন খানিকক্ষণ হাসাহাসি করল। তারপর একে অপরকে বিদায় জানিয়ে নিজেদের ক্লাসের উদ্দেশ্যে গেল। স্নেহা সাইন্স আর আদ্বিত্য আর্টসের স্টুডেন্ট। স্বাভাবিকভাবে দুজনের ক্লাস আলাদা। স্নেহা আর্যর কাছে এসে উপস্থিত হলো। তাকে কিছু বলতে চাইছিল। এমন সময় কেউ একটা জোর গলায় বলল,”এই আর্য, টমেটো কত করে রে?” আর্য দ্রুত মুখ ফিরে আশ্চর্য হয়ে যায়। তার পাশে স্নেহা দাঁড়িয়ে আছে। আর পাশে কয়েকটা ছেলে বেশ হাসাহাসি করে হেঁটে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছে। ছেলেগুলো খুব পরিচিত। তার ক্লাসের স্টুডেন্ট। ভীষন অপমানিত আর লজ্জিত হয়ে আর্য মুখ নিচু করে ফেলল। আজ প্রথম যখন স্কুলের গেটে প্রবেশ করেছিল, তখনো একটা ছেলে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল। তখন ঠিক বুঝতে পারছিল না কেন বলছে কথাগুলো। এখন খুব স্পষ্ট ভাবে বুঝে গেছে। স্নেহা আরও কাছে এগিয়ে আসলো।
“তোকে টমেটোর দাম জিজ্ঞেস করছে কেন?” স্নেহার গলা ভারী। আর্য কোনো উত্তর দিল না।
“বলবি না তো!” সহজ সরল ছেলেটি মিথ্যা কথা বলতে পছন্দ করে না। সত্য কথা বলে যদি নিজের বিপদ বাড়ে, তবে তাই হোক। কিন্তু মিথ্যা বলবে না। পরে মিথ্যা কথাটি যখন সবার মাঝে সত্যতা প্রকাশ পাবে, নিজেই অপমানিত হবে।আর্য পুরো ঘটনাটি সংক্ষেপে বলল। গত পরশু তাদের ক্ষেতের জমিতে টমাটো তোলা হয়েছিল। বাবা অসুস্থ। বাজারে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই আর্য টমেটো নিয়ে বাজারে যায়। বিক্রি করে। হয়তো,বন্ধুরা বাজারে তাকে টমেটো বিক্রি করতে দেখে ফেলেছিল।তাই এখন ইয়ার্কি ফাজলামি করছে। বিষয়টিকে খুব সহজ নিয়েছে আর্য। কিন্তু স্নেহা সহজ ভাবে নিল না।
“এতে তো কোনো অন্যায় নেই। তাদেরকে কিছু বলছিস না কেন?”
“বন্ধু হয় ইয়ার্কি করছে। কিছু বলার কি আছে!”
“এটা ইয়ার্কি নয়! তোর বাবার পেশা নিয়ে তারা মজা করছে। সবার মাঝে তোর ইমেজকে ছোট করে দিচ্ছে। আত্মসম্মান বলে কিছু নেই?” স্নেহার কথা শুনে মৃদু হাসল আর্য। সামান্য কথায় এত উত্তেজিত হওয়া ঠিক নয়। আর্য তার ভালো বন্ধু, বন্ধুকে কেউ অপমান করবে,তা মানতে পারে না। কিন্তু বিষয়টি অপমানের নয়, স্নেহার জানা দরকার। আর্য একগাল হেসে বলল,”আত্মসম্মানে লাগলে অবশ্যই প্রতিবাদ করতাম। আত্মসম্মানের মানে অন্য কিছু। যারা কিছুক্ষণ আগে হেঁটে গেল তাদের প্রত্যেকের বাবা কিন্তু কৃষক। তোর কথা মতো তারা যদি পরোক্ষভাবে আমার বাবাকে অপমান করে, তাহলে প্রত্যক্ষভাবে নিজের বাবাকেও অপমান করেছে। একজন বৃদ্ধ বাবা সারাদিন রোদে পুড়ে কাজ করবেন, আর তাঁর আঠারো বছর বয়সী ছেলে বাড়িতে বসে আয়েস করবে। বিষয়টি কি শোভনীয়? বাবাকে কিছুটা হলেও সাহায্য করা উচিত। হয়তো কাজটি দ্রুত শেষ হবে না, একই সময় লাগবে। কিন্তু বাবার কাজ করার প্রতি আগ্রহ বাড়বে। বাবার বিশ্বাস বাড়বে। খুশি হবেন। মনের তৃপ্তি পাবেন। আমি তাই করেছি। এতে আত্মসম্মানে আঘাত লাগেনি। বরং ভালো লেগেছে, সবার থেকে কিছু আলাদা করতে পেরে।” স্নেহা প্রতুত্তর দিতে চাইছিল। তার আগে সেখানে নিলেশ হাজির হলো। দুজনেই চুপচাপ। নিলেশ হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,”স্নেহা, তোমাকে ওই লম্বা হয়ে স্যারটি ডাকছেন।”
“লম্বা হয়ে তো অনেক স্যার আছেন। স্যারের নাম বল?”
“নাম তো জানি না, বলল টুয়েলভের স্নেহাকে ডেকে দিতে।”
“ক্লাস এইটে পড়িস আর স্যারের নাম জানিস না! স্কুলে কি করতে আসিস রে? তোর মাকে বলতে হবে দাঁড়া।”
“ওই স্যার আমাদের কখনো ক্লাস নেয় না। কি করে চিনবো?” স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকল নিলেশ।স্নেহা বুঝতে পেরে যায়, তাকে কোন স্যার ডাকছেন। দ্রুত অফিস ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বেশ কিছুক্ষণ পর একটা বড়ো খাম হাতে নিয়ে রুমের মধ্যে প্রবেশ করে। ক্লাস রুমের মধ্যে আর্য একা বসে বইয়ের পৃষ্ঠা গুলো উল্টে যাচ্ছে। তার কাছে এসে বসল স্নেহা। চটপট করে আর্য বলল,”খামের মধ্যে কি আছে?”
“মেডিকেল রিপোর্ট?”
“কিসের?”
“আমি থালাসেমিয়া ক্যারিয়ার।” স্নেহার গলা গম্ভীর।
“সিরিয়াসলি।”
“হ্যাঁ।”
দুজন একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। কোনো কথা নেই। দুটো চঞ্চল মন মুহুর্তের মধ্যে ফ্যাকাসে হয়ে উঠছে। এতে দুঃখ পাওয়ার কি আছে! এই রোগ জিনগত। চাইলেও কিছু করা যাবে না। উপায় একটা, যাকে বিয়ে করবে সে যেন কিছুতেই থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার না হয়। ভুলবশত যদি হয়ে যায় তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তাদের জীবনের আলো নিভতে বেশি সময় লাগবে না। সবকিছুই জানে স্নেহা। তবুও মনটা হতাশায় ভরে গেল। বেশ কয়েক মাস আগে স্কুলের তরফ থেকে শুধুমাত্র মেয়েদের থ্যালাসেমিয়া চেক আপ হয়েছিল। গত পরশু রিপোর্ট দিয়েছে সবাইকে। স্নেহা উপস্থিত না থাকায় তাকে দেওয়া হয়নি। তাই স্যার আজ তাকে ডেকে ছিলেন। অনেক বুঝিয়ে বলেছেন, বিয়ের আগে খুব সিরিয়াস হতে। কোনো ভাবে যেন পাত্রের থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার না হয়। বাড়ির ফোন নাম্বার নিয়ে,বাবাকে সব বুঝিয়ে বলেছেন।
প্রায় আট দশ জন ছাত্র-ছাত্রী সমষ্টি ভাবে বায়োলজি প্রাইভেট পড়ে। এরমধ্যে আর্য এবং স্নেহা রয়েছে। আজ কোনো কারণে পাঠ্যপুস্তকের তুলনায় বাহ্যিক বিষয়ে বেশি আলোচনা হতে থাকল। জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। তবে একসঙ্গে খোশগল্পে মেতে থাকায়, শীত তেমন অনুভব করছে না কেউই। রাত বেড়ে চলেছে। কোনো এক কথার ফাঁকে সবাই জানতে পারল আর্য ব্রাহ্মণ। খোশগল্প মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে গেল। তারা যেন কেউ কথাটি বিশ্বাস করতে পারছে না। সবার চোখ তার দিকে। শিক্ষকও হতভম্ব। কিন্তু এতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে, তা বুঝতে পারছে না আর্য। অন্তত তার টাইটেল দেখে এতদিনে বুঝে যাওয়ার কথা, সে ব্রাহ্মণ। শিক্ষক প্রশ্ন করলেন,”পুজো করতে পারিস?”
“হ্যাঁ।” আরো বেশ কয়েক মিনিট শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে কথা হল। আর্য যথাযথ উত্তর দিল। শিক্ষক খুশি হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, সকালের ডেট গুলোতে আর্য দেরি করে আসার কারণ। তখনো কেউ চোখ ফিরিয়ে নেয় নি। স্নেহা কটমট করছে রাগে। সে মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল, তার জন্য খারাপ কিছু অপেক্ষা করে আছে। এমন সময় ছাত্র দের মধ্যে কেউ একজন বলল,” ও নামেই ব্রাহ্মণ। আমি ওকে নিজের চোখে দেখেছি মাছ-মাংস খেতে।” আর্য মুখ ঘুরালো। রাগে মাথা গরম হল। নিজের উপাসনা নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন করে নি। আজ এত বড় একটা অপমান করে দিল। মানতে পারছে না। আবার একটা হৈ চৈ শুরু হলো। শিক্ষক আবার জানতে চাইলেন, ব্রাহ্মণরা কি মাছ-মাংস খেতে পারে না? তিনি সঠিক শাস্ত্রের ব্যাখ্যা চাইলেন। আর্য মুখ উঁচু করল। তারপর শান্ত মাথায় বলল,”এ বিষয়ে শাস্ত্রে কি আছে আমি জানি না। আমার বাবা আমাকে যা শিখিয়েছেন আমি তাই বিশ্বাস করি। বাবা বলেন,এগুলো ধর্মীয় কুসংস্কার ছাড়া অন্য কিছু নয়। ধর্মের চাইতে মানুষের খিদে বড়ো। এক জীবনে এই সমস্ত খাবার থেকে বঞ্চিত হওয়া উচিত নয়। বাবা ছোটবেলা থেকে নিরামিষ খেয়ে আসছেন। তিনি কখনো আমিষ খান না। কিন্তু তিনি কখনও চান না তার ছেলেমেয়ে ধার্মিক হয়ে উঠুক। ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা উচিত গোঁড়ামি নয়।”
“তুই ব্রাহ্মণ, অথচ এতদিন আমি জানি না।”
“এতে জানা অজানার কি আছে? বিষয়টিকে নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কি আছে আমি বুঝতে পারছি না। আমরা আর সাধারন চারটি মানুষের মতো একজন।”
“কিন্তু তুই পূজা-অর্চনা করতে পারিস আমরা পারি না।”
“মন্ত্রপাঠ জানলেন, পূজা পাঠ ব্যাপারটি অন্তত সহজ।”
মন্থর গতিতে চলা সাইকেল একসময় শহরের হাই রোড ক্রস করল। হাই রোড ক্রস করার সময় পাশাপাশি দুটো সাইকেল চালানো অসম্ভব। তাই তারা কিছুটা আলাদা হলো। রাস্তা ক্রস করার পর আবার একটা নির্দিষ্ট জায়গায় জড়ো হলো। এবারে গ্রামের রাস্তা। শীতের রাতে যানবাহন খুবই কম। স্নেহা আর্যকে দাঁড়াতে বলে কিছুক্ষণ। তারপর সে আবার হাই রোডের দিকে এগিয়ে যায়। গ্রাম আর শহরের মিলন ভূমি। সিএনজি স্ট্যান্ড। বেশ কয়েকটা চায়ের দোকানে রয়েছে, দুটো মুদি দোকান, পাশেই এক বৃদ্ধ তেলেভাজা ভাসছেন। দুটো কুকুর ভেলভেল করে তাকিয়ে আছে। জনসংখ্যা খুবই নগণ্য।হাই রোডের উপর দিয়ে দ্রুত গতিতে গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো পাশের নদীতে গিয়ে পড়েছে। নদীর জল সোনালী লাগছে। নদীর হালকা স্রোত, জ্যোৎস্না আর ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বড্ড মিষ্টি দেখাচ্ছে। স্নেহা কখনো সাইকেল নিয়ে প্রাইভেট আসে না। বেশিরভাগ সময় তার মা স্কুটার করে ছেড়ে দিয়ে যায়। ইলেভেনের প্রথম কয়েক মাস সাইকেলে আসতো, তারপর আর দেখা যায়নি। আজ প্রাইভেট শেষ করে দ্রুতগতিতে বাড়ি ফেরার জন্য উদ্যত হয় আর্য। পিছন থেকে স্নেহা ডাকে। ফিরে এসে অবাক হয়। স্নেহা সাইকেলে এসেছে। কিন্তু কথার ফাঁকে যখন জানতে পারে, স্নেহা তার জন্য সাইকেল করে এসেছে। তখন আরো বেশি খুশি হয়। প্রত্যেকদিন রাতে একা একা সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরে আর্য। বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখে না স্নেহা। সে চাইলেও সাইকেল নিয়ে আসতে পারে। দুজনের প্রাইভেট গুলো পুরো এক। এতে আর্যর অনেক সুবিধা হবে। দুজনে গল্প করতে করতে কখন বাড়ি পৌঁছে যাবে বুঝতে পারবে না। বন্ধুর জন্য এইটুকু ত্যাগ কিছু না। আর্য বেশ ভালো লাগছে। তার জন্য কেউ এতোকিছু ভাবে। সে তো কখনো স্নেহের জন্য তেমন কিছু ভাবেনি। শুধু কারোর জন্য ভালো কিছু ভাবার মানে কি বন্ধুত্ব! না বন্ধুত্বের মানে অন্য কিছু। মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর স্নেহা দুটো হাতে ঠোঙা নিয়ে উপস্থিত হলো। একটা তাকে দিল আর একটা নিজে নিল। ঠোঙা মধ্যে মুড়ি আর তেলেভাজা আছে। তারপর একহাতে সাইকেল আর এক হাতে ঠোঙা। শহর থেকে বেরিয়ে আসার পর প্রায় চার কিলোমিটার রাস্তা পর্যন্ত ল্যাম্পপোস্টের আলো রয়েছে।তাই আলোর সমস্যা হলো না। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে। দুজন মনের কথা বলছে। একজনের মনের শুধুই বন্ধুত্ব আর একজনের মনে উঁকি দিচ্ছে অন্য কিছু। এই বন্ধুত্বের জাল ছিঁড়ে নতুন একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে।একসঙ্গে সাইকেল চালিয়ে রাস্তা এগিয়ে যেতে ভালো লাগছে। এই রাস্তা যেন কখনো শেষ না হয়। চলতে থাকুক মাসের-পর-মাস। তাতে অসুবিধা নেই। ল্যাম্পপোস্টের আলো অতিক্রম করার পর, ঘন অন্ধকারের বুক চিরে হালকা আলোর দিশা দেখালো আর্যর টর্চ লাইট। দুজন এগিয়ে যাচ্ছে।মাঝেমধ্যে কিছু কথা আবার কিছু হাসি আবার কখনো অট্টহাসি ভেসে আসছে অন্ধকারের বুক চিরে। হঠাৎ স্নেহা আর্যকে বলল,”ভালোবাসা না বন্ধুত্ব? কোনটা বেশি প্রিয়?”
“অভ্যাস…।”
“যদি কেটে যায়।”
“না, কাটবে না। বাড়ি ফিরে মাকে না দেখলে, এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজে না পেলে চিল্লা-চিল্লি করি রোজ। মা কখনো রাগ করে না। বরং উল্টে ইচ্ছে করে চরম বিরক্তি দেখিয়ে বলে,’এসেই শুরু তোর!’ আসলে কিছু ভালোবাসা সময়ের সাথে সাথে অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়, আর এই অভ্যাস কখনো কাটে না। শুধু ভরসা রেখে পাশে থাকতে জানতে হয়।”
“কিন্তু, তোর মা!” আর্য আর কিছু বলল না। বুকটা হালকা করে কেঁপে উঠলো। চোখের কোনে জলের রেখা স্পষ্ট, অন্ধকারের মধ্যে যা দেখতে পেল না স্নেহা।
পর্ব ৫ আসছে