ছায়াকরী পর্বঃ১০

0
449

# ছায়াকরী
# পর্বঃ ১০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

নোনতা জলে সয়লাব তোভিয়ার চোখ, কপোল, কণ্ঠদেশ। অবাধ্য ধারাকে কিছুতেই বাঁধ মানাতে পারছে না সে। তার পাশেই বসে আছে জেহেন। আঁধারাচ্ছন্ন গহন জঙ্গলে এক মানবী বসে আছে এক হিংস্র পশুর সন্নিকটে!
মোটা গাছটায় হেলান দিয়ে বসে আছে জেহেন। তার চাহনি ওই জঙ্গলের আঁধার ভেদ করে সর্বত্র। তার কাছে অস্পষ্ট নয় কিছুই। টর্চলাইটটা পাশে জ্বালিয়ে রেখেছে জেহেন। তার আলোতেই জেহেনের দিকে জলসিক্ত চোখে চেয়ে আছে তোভিয়া। জেহেন ঘাড় কাত করে চাইল। অধর কোণে উদাস হেসে বলল—

“এখনো বলবে, তুমি আমাকে ভালোবাসো?”

তোভিয়া চেয়ে রইল। মানুষের আদলে এক ভয়ংকর পশুর তীক্ষ্ম চোখে। জেহেন সোজা হলো। তোভিয়ার ভয়ে জমাট বাধা হৃৎপিন্ড কম্পিত হচ্ছে স্বাভাবিক মাত্রায়। জেহেন বলতে শুরু করল—

“বাবার সাথে ফিরে আসার পরের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মিনিট আমার মনে আছে। কিছু ভুলিনি আমি। কিন্তু এই মহলে আসার আগে কোথায় ছিলাম আমি, কী হয়েছে আমার সাথে তার কিছুই জানা নেই আমার। এমনকি আদৌ আমি জন্ম থেকে এমন কি না তাও জানি না।
যখন থেকে আমার এই সত্তা আমার সামনে প্রকট হয়েছে, আমি ভীত হয়েছি। বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে আমার সাথে। নিজেকে আড়াল করতে শুরু করি। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তখনও গড়ে ওঠেনি আমার মাঝে। তাই কক্ষের মধ্যে নিজেকে বন্দি করেছি।ধীরে ধীরে আমার এই দ্বিতীয় সত্তা আমার মনুষ্য সত্তাকে ছাপিয়ে গেল। আমাকে বাধ্য করতে শুরু করল তার মতো হয়ে উঠতে। হয়ে উঠলাম আমি। এক হিংস্র মাংসাশী পশুতে পরিণত হলাম। ”

থামল জেহেন। তোভিয়া চেয়ে আছে পলকহীন। তারদিকে তাকাল জেহেন। মোলায়েম স্বরে বলল—

“আমার এই চোখ তারই দৃষ্টান্ত। আমি মানুষ নই তোভিয়া। আদৌ তোমাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক আছে কি না সে বিষয়ে আমি অবগত নই।”

তোভিয়া হু হু শব্দে কেঁদে ফেলল। চন্দ্রানন আচ্ছাদিত হলো কৃষ্ণাভ মেঘে। সে ভেজা কণ্ঠে বলল—

“আপনি কাকারাজ কে জিজ্ঞেস করেননি? তিনি তো ছিলেন আপনার সাথে?”

“বাবা কিছু বলেনি। ভয়ে তাকে বলতেও পারিনি আমি। তোমার বাবার সাথে বাবার যে বিরোধ ছিল, তা নিয়ে আমি আরও বেশি শঙ্কিত ছিলাম। কারণ, তাদের সেই মতবিরোধের কারণ আমি। ”

তোভিয়া নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল—

“এতদিন কেন বলেননি?”

“আমি আমার অস্তিত্বকে খুঁজে চলছি তোভিয়া। কে আমি? কোথায় জন্ম আমার? কেন আমি তোমাদের মাঝে? আর কেউ কী আছে আমার মতো?
পাইনি আমি উত্তর।”

তোভিয়া ক্রন্দনের ঝড় তুলল। ডেকে উঠল পাখি। ভয়ংকর আওয়াজে থমকে গেল তোভিয়া। অপ্রকৃতিস্থের মতো এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। জেহেন আত্মবিশ্বাস ছুড়ে বলল—

“ভয় পেয়ো না। আমি থাকতে তোমার কিছু হবে না।”

“আপনি জানতেন আমি আপনার পিছু নিয়েছি?”

জেহেন গাঢ় হাসল। চোখের পলক ফেলে ধনাত্মক স্বীকারোক্তি দিলো। তোভিয়া পূনরায় বলল—-

“তাহলে বাঁধা দিলেন না কেন?”

“তোমার সত্য জানা প্রয়োজন।”

“যদি আমি সবাইকে বলে দিই?”

“তুমি তা করবে না। পদ্মকুমারী, বোকা নয়।”

“কত মানুষের প্রাণ নিয়েছেন আপনি?”

“অগণিত।”

“এর জন্য আপনার শাস্তি হতে পারে।”

“আমি বাধ্য ছিলাম।”

জেহেন উঠে দাড়ায়। তোভিয়ার দিকে নজর ফেলে বলল—

“মহলে চলো। ”

তোভিয়া উঠে দাড়াল। চোখের পল্লব মেলে ধরে চেয়ে রইল। জেহেন আশ্বস্ত করে বলল—

“আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি করব না। বিশ্বাস করতে পারো। চলো।”

জেহেন চলতে শুরু করে। আড়ষ্ট তোভিয়ার দেহে জঙ্গমতা এলো। জেহেনকে অনুসরণ করতে শুরু করল। দূরত্ব বাড়ল তাদের মধ্যে। জেহেন থামল। পেছনে এসে বলল—

“তুমি সামনে যাও। এই জঙ্গল তোমার মতো পদ্মকুমারীর জন্য ঠিক নয়।”

তোভিয়া দ্বিরূক্তি করল না। যত দ্রুত সম্ভব সে এই জঙ্গল থেকে বের হতে চায়। পূনরায় চলতে শুরু করল দুইজন।
তোভিয়া ছোটো ছোটো পায়ে এগোচ্ছে। তাকে নজর বন্দি করে রেখেছে জেহেন। তোভিয়ার হাতে টর্চ লাইট। সেই লাইটের আলোতেই সে চলছে। তার পা ছাড়িয়ে যাওয়া গোলাকার জামায় লেগে যাচ্ছে জঙ্গলের শুকনো পাতার দল, ভেঙ্গে যাওয়া গাছের ছোট্ট শুকনো ডাল। সেই নিয়ে সে চলছে। আচানক কিছু হলো। চিৎকার করে উঠল জেহেন।

“তোভিয়া….!”

তোভিয়া বিদ্যুস্পৃষ্টের মতো পেছন ফিরতেই দেখল, জেহেনের পশু সত্তা সরোষে লাফ দিয়েছে তার ওপর। ভয়ে বিধ্বস্ত তোভিয়া আর্তনাদ করে বসে পড়ে। জেহেন লাফিয়ে পড়ে কোনো অদৃশ্য সত্তার ওপর। মাটিতে পতিত হতেই সেই সত্তার অবয়ব দৃশ্যমান হয়। একটা বৃহৎ আকারের চিল। যা কোনো সাধারণ চিল নয়। চিলটি তার শক্তপোক্ত ডানার ঝাপটায় ঝটকা মেরে ফেলে দেয় জেহেনকে। মাটির বুকে ঢলে পড়ে জেহেন। চিলটি উড়ে গিয়ে বসে থাকা বলয় আকৃতির তোভিয়ার ওপর আক্রমন করতে উদ্যত হতেই জেহেন ঝাঁপিয়ে পড়ে চিলটির ওপর। চিলটির বুকের ওপর পা রেখে কামড়ে ধরে গলা। চিলটি তার ডানার ঝাপটায় ক্ষত-বিক্ষত করে জেহেনের পিষ্ঠদেশ। জেহেন ক্রোধে বিহ্বল, আক্রোশে বশীভূত হয়ে দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিলটির গলায় তার ধারালো দাঁত বসিয়ে টান মারে। মুখে রক্ত ছিটে আসে জেহেনের। চিলটির গলা দ্বিখণ্ডিত হয়। পরিবেশ শান্ত হয়। চিলটি গরগর শব্দ করতে করতে নিশ্চেতন হয়ে পড়ে। সরে আসে জেহেন। তার দেহ মানুষের আকার লাভ করে। কিছুই দেখেনি তোভিয়া। হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁপছিল সে। তার মাথায় হাত রাখে জেহেন। চকিতে মাথা তুলে তোভিয়া। জেহেনের জ্বলজ্বলে চোখ চক্ষুগোচর হতেই ব্যগ্র হয়ে তার বুকে গুঁজে যায়। জেহেন শ্বাস ফেলে বলল—

“ভয় পেয়ো না তোভিয়া। কিছু হবে না তোমার।”

দ্বিধা আর সংকোচ মিশে একাকার হলো। জেহেন সন্তর্পণে জড়িয়ে ধরল তোভিয়াকে। তোভিয়ার অঙ্গে অঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে গেল জেহেনের স্পর্শে। বাঁশপাতার মতো সূক্ষ্ম ভঙ্গিতে কম্পিত হতে লাগল তার দেহ। জেহেন হাতের বেষ্টনি দৃঢ় করল। তার বিশাল বক্ষপাটাতনে পিষে ধরল তোভিয়াকে। তোভিয়ার ভয় কেটে গেল। হৃদস্পন্দনের বেগতিক গতি স্বাভাবিক হলো। তার সমস্ত অঙ্গে তরতর করে ছড়িয়ে পড়তে লাগল জেহেনের দেহের উষ্ণতা। চট করেই তোভিয়াকে কোলে তুলে নিল জেহেন। বিভ্রম নিয়ে তাকাল তোভিয়া। জেহেন আলতো হেসে বলল—

“একা ছাড়া যাবে না পদ্মকুমারীকে। তোমাকে মহলে নিয়ে যাওয়া আমার দায়িত্ব।”

জেহেনের গলা জড়িয়ে ধরে তার হৃৎপিন্ডের বাহ্যিক অংশে মাথা রাখল তোভিয়া। অনুভূতির সাগরে উত্তাল ঢেউ উঠল। সেই ঢেউ ভাসিয়ে নিল তোভিয়াকে এক অচেনা জগতে।
,
,
,
মিষ্টি প্রত্যুষ! উষাপতির ঝলমলে নুর তরতর করে প্রকীর্ণ হচ্ছে মেদিনীর বুকে। বাহ্যজগত খেলে উঠেছে নিশাবসানে। পদ্মমহল জেগে উঠেছে।
একদৃষ্টে ছায়াকরীর দিকে চেয়ে আছে জেহেন। ছায়াকরীর ওই নীল নেত্রযুগল জ্বলজ্বল করছে। তা নিভৃতে অবলোকন করছে সে। নুয়ায়াম অনুদ্বেগ। শান্ত আর নরম স্বভাবের নুয়ায়াম পদ্মমহলে সকলের প্রিয়। যদিও সকলের মাঝে সুপ্ত কিছু বিষয় নিয়ে মন কষাকষি! তবুও নুয়ায়ামকে সকলে সমীহ করে।
ছায়াকরীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই কাটা চামচের ডগায় মাংসের টুকরো নিয়ে মুখে দেয় জেহেন। তার পাশেই উৎফুল্ল চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে তোভিয়া। মুখে রাখা সিদ্ধ মাংস চিবুতেই জেহেনের জিবের ডগায় তার স্বাদ প্রতীত হতেই সে সতর্ক হয়। উজ্জ্বল হয়ে উঠে তার চোখ। চেয়ারে হেলান দেওয়া পিঠ আলগা করে খাবারের প্লেটে তাকায়। নাক ফুলিয়ে চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে। ক্ষুব্ধ মেজাজে তাকায় তোভিয়ার দিকে। তোভিয়ার পাতলা ঠোঁটে হৃদয়ভেদী হাসি। ঝট করেই তার হাত ধরে ফেলল জেহেন। ঈষৎ কঁকিয়ে উঠল তোভিয়া। জেহেন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তোভিয়াকে একরকম টেনে নিয়ে যেতে থাকে। নুয়ায়াম মাথা উঁচু করে সামনে তাকায়। তেহজীব রুষ্ট হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়। নুয়ায়াম শীতল কণ্ঠে বলল—

“বসো।”

তেহজীব চোখ-মুখ বিকৃত করে। ক্ষীপ্ত হয় অন্তঃকরণ। রন্ধ্রে রন্ধ্রে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুটতে থাকে। ধপ করে চেয়ারে বসে। ফুঁসতে থাকে সে। অনিতা তাকাল। সে দেখতে পেল তেহজীবের ভাবভঙ্গি। ছায়াকরীও দেখল। সে হিসেব মেলাতে ব্যস্ত। মহলের প্রতিটি সত্তাকেই তার আসল রূপে টেনে আনবে সে। তার জন্য ছায়াকরীকে অপেক্ষা করতে হবে। জানতে হবে আরও অনেক লুকানো সত্য।
ঝামেলাহীন নুয়ায়াম। তার জীবনযাপন সবচেয়ে স্বস্তিকর।
,
,
,
তোভিয়ার চোয়াল চেপে ধরে জেহেন। দেয়ালে পিঠ ঠেকে আছে তোভিয়ার। তোভিয়া আজ সসের পরিবর্তে নিজের রক্ত ব্যবহার করেছে। ছায়াকরীকে পর্যবেক্ষনে এতটাই বিভোর ছিল জেহেন, সেদিকে নজর দিতে পারেনি। তার অবচেতন মস্তিষ্ক কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে খাবার মুখে নিয়ে নেয়। আর যখনই তাজা রক্তের স্বাদ তার জিব আস্বাদন করে ক্ষেপে উঠে সে।

বিক্ষিপ্ত, প্রকুপিত জেহেন তার ধারালো কামড় বসাল তোভিয়ার কণ্ঠদেশে। তোভিয়ার শুভ্র, পাতলা চামড়া বিদীর্ণ করল জেহেনের দন্তপাটি। তোভিয়ার নীরব অশ্রু কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। গাঢ় সবুজ রঙের চোখের মনির অধিকারী পুরুষটি তার জ্বলজ্বলে চাহনিতে কাঁপিয়ে দিলো তোভিয়ার অন্তরাত্মা। গলদেশ বেয়ে স্মিত ধারায় চুঁইয়ে পড়তে লাগল নোনতা, ঘন, তরল শোণিত। জেহেনের হৃদয় ভেদ করা কণ্ঠ—-

“বলেছি না, একদম আমার কাছে আসবে না। তোমার সাহস কী করে হলো এসব করার?”

তোভিয়ার দীঘিসুলভ দুই নেত্রযুগলের অবিশ্রান্ত ধারা চিবুক গড়িয়ে গলদেশের তরল রক্তের সাথে মিশে বুকে নেমে যাচ্ছে। ক্ষীণ শ্বাসে চলছে বুকের মৃদু কাঁপন। তার হৃৎপিন্ড ব্যবচ্ছেদ করা মিহি সুর—

“আমি আপনাকে ভালোবাসি।”

জেহেনের থম মেরে থাকা রাগের স্ফুলিঙ্গ আচমকা বিচ্ছুরিত হলো। তোভিয়ার ব্যান্ডেজ করা হাত দেয়ালের সাথে সেটে ধরতেই গোঙানি দিয়ে উঠে সে। জেহেনের ক্ষেপণাস্ত্রের মতো দৃষ্টিতে হিংস্রতার অভয়ারণ্য। তোভিয়ার মুখের সন্নিকটে গিয়ে হিসহিসিয়ে বলল—

” এইটুকু সহ্য করতে পারো না? এসেছ এক পশুকে ভালোবাসতে! আমার সংসর্গে শেষ হয়ে যাবে তুমি। আমার অস্তিত্ব এই দুনিয়ার বুকে বিলীন। স্বপ্নচারিতা, জাগ্রত স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে এসো।”

তোভিয়াকে ছেড়েই দমদম করে পা ফেলে বেরিয়ে যায় জেহেন। দেয়ালে পিঠ ঘষে নিচে বসে পড়ে তোভিয়া। বাঁধনহারা অশ্রুতে তলিয়ে গেল সে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here