ছায়াকরী পর্বঃ১১

0
458

# ছায়াকরী
# পর্বঃ ১১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

তোভিয়াকে দেখেই ভ্রু বাঁকায় তেহজীব। কাষ্ঠ গলায় বলল—

“গলায় কী হয়েছে তোমার?”

দৈবাৎ শোনা কঠোর কণ্ঠে কেঁপে উঠে তোভিয়া। চাহনির ভাব বদলে দৃঢ় কণ্ঠে বলল—

“কিছু না।”

তেহজীব রুষ্ট হলো। অন্তঃকরণ অশান্ত হলো। তোভিয়া গলার কামড়ের দাগে কিছু একটা মেখে রেখেছে। তেহজীব অস্থির চাহনিতে বলল—

“মিথ্যে বলছ।”

তোভিয়া স্বাভাবিক হলো। স্বর পেলব করে বলল–

” সীমা লঙ্ঘন করো না। ”

তোভিয়া হাঁটা ধরল। তেহজীব বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্ক হিসহিসিয়ে বলল—

“তোমার এই সীমাহীন প্রেমের ভয়াল তান্ডব নিঃশেষ করবে জেহেনকে। কেউ বাঁচাতে পারবে না ওকে। মনে রেখো পদ্মকুমারী।”

ছায়াকরী করিডরের রেলিং এর ওপর দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা অবলোকন করলো। তার ভেতরকার সুপ্ত অঙ্গনা হেসে উঠে বলল—

“সত্য-মিথ্যের বিভেদের দেয়াল ভেঙ্গে জয় সত্যের হবে। এই পদ্মমহল তার উত্তরাধিকার পাবে। যুবরাজ মায়ং ফিরে পাবে তাঁর রাজত্ব।”
,
,
,
অশান্ত, অস্থির, বিচলিত নুয়ায়াম। তার সমস্ত বুক জুড়ে ফুলে উঠেছে আঁচড়ের দাগ। যা আসলে আঁচড় নয়। জায়গায় জায়গায় মাংসপিন্ডের সমান্তরাল ভঙ্গিতে ফুলে ওঠা যা লাল! তা গাঢ় হতে লাগল। গাঢ় থেকে প্রগাঢ়। চকিতে তার রোমশহীন বুকে জেগে উঠল কালো কুচকুচে লোম। নুয়ায়ামের শ্বাস ঘন হলো। ভয়ে তার কলিজা লাফিয়ে উঠল। হৃৎপিন্ডের গতি বাড়তে লাগল। নুয়ায়াম শুকনো ঢোক গিলতে গিলতে দেয়ালের সাথে লেগে গেল। অসহনীয় ব্যথা, তীব্র যন্ত্রণায় হিতাহিত বোধশূন্য হয়ে নিজেকে আঘাত করতে শুরু করে। দুই হাতের নখের সাহায্যে চুলকাতে থাকে পশমে আবৃত নিজের দেহকে। বিতৃষ্ণার পাহাড় ধ্বসে পড়ে নুয়ায়ামের ওপর। চকিতে ছায়াকরীর মিহি ডাক!
নুয়ায়াম সপ্রতিভ দৃষ্টিতে তাকাল। বিস্ময়ে বিমূঢ় হলো সে। তার দেহের সমস্ত পরিবর্তন এক নিমেষেই উবে গেল। সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। উন্মাদগ্রস্তের মতো নিজেকে আরশিতে দেখতে লাগল নুয়ায়াম। সে মুক্ত শ্বাস ফেলল। বিছানাতে হেঁটে চলছে ছায়াকরী। নুয়ায়াম ব্যস্ত হয়ে ছায়াকরীর নিকটে এসে হাঁটু মুড়ে বসল। ছায়াকরীকে হাতের তালুতে নিয়ে প্রসন্ন হেসে বলল—

” আমি জানি না, কোন সত্যের মায়াজালে পীড়িত আমি, কোন মোহজালে আবদ্ধ আমি। আমার এই পরিবর্তন কোন সীমানায় নিয়ে যাবে আমাকে? তবে, তুমি আমার সেই স্বস্তি, যার প্রতি কৃতজ্ঞ আমি। নিভৃতে যেই যন্ত্রণা আমাকে পীড়িত করে তার দাওয়া(ঔষধ) তুমি। ধন্যবাদ ছায়াকরী!”

নুয়ায়াম তার ভয়ে শুকিয়ে যাওয়া ওষ্ঠাধরের পেলব সংসর্গ এঁকে দিলো ছায়াকরীর রক্তিম অধরে। শিরশির করে উঠল ছায়াকরীর উষ্ণ দেহ।
,
,
,
রাগের উদগীরণে আগুন ঝরা মস্তিষ্ক জেহেনের। সে বসে রইল নীরব। দরজা দিয়ে বিনা শব্দে প্রবেশ করল তোভিয়া। জেহেন স্থির চেয়ে রইল মেঝেতে। তোভিয়া সেই কাঁচের দরজাওয়ালা বাক্স থেকে ঔষদের কৌটা নিল। চিলের ডানার ঝাপটায় জেহেনের পিষ্ঠদেশ আঘাতপ্রাপ্ত। তোভিয়া ভারী ভাবাবেশ ছাড়া বিছানায় উঠে বসল। দুই হাঁটু ভাঁজ করে তার ওপর ভর দিয়ে বসল। অনাবৃত জেহেনের পিষ্ঠদেশ। তোভিয়ার পেলব হাতের ছোঁয়া পেতেই জেহেন অদ্ভুত আবেশে আঁখি নিমীলিত করল। তার হাতের রগ ফুলে উঠল অনুপলেই। তোভিয়া জেহেনের আঁচড় লাগা অংশগুলোতে আলতো হাত ছোঁয়াতে লাগল। অচিরেই তার চোখের কোটর জল ছেড়ে দিলো। দগদগে ক্ষত! যেন চির ধরেছে মৃত্তিকায়। কিন্তু ভাবলেশহীন জেহেন। যেন এই যন্ত্রণা তার কাছে কিছুই নয়। কিন্তু তোভিয়ার নিরন্ত আঁখিজল!
তোভিয়া ওষ্ঠাগত কান্নার স্বর ঠোঁট কামড়ে গিলে নিল। এই পুরুষটি তাকে দুই চোখের সীমানায় রাখতে চায় না। আর সে এই পুরুষটিকে পৃথিবীর কোনো কিছুর বিনিময়ে চোখের সীমানা থেকে এক মুহূর্তও সরাতে পারে না। প্রেম কেন বিষাদময়!

ঔষধ লাগানো শেষ হতেই বিছানায় পড়ে থাকা সফেদ রঙের শার্ট গায়ে গলিয়ে নিল জেহেন। দাঁড়িয়ে যেতেই ব্যস্ত কণ্ঠে শুধাল তোভিয়া—

“কোথায় যাচ্ছেন?”

“কাজ আছে আমার।”

“জঙ্গলে যাচ্ছেন?”

অসহনীয়, অব্যর্থ যন্ত্রণা ! জেহেন নিস্তব্ধ ! তোভিয়া বিছানা থেকে নেমে দাড়াল। ঝরা কান্নায় ভেজা গলায় বলল—

“আজ আমাদের বিবাহ জেহেন!”

জেহেন দেহভঙ্গিমা বদলিয়ে কড়া গলায় বলল—

“সেইটুকুই সময় তোমার কাছে। এরপর ভাবার সময় পাবে না। ভুল করছ তুমি।”

“এই ভুল আমার জীবনের ধ্রুবসত্য।”

দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে জেহেন—

“তোভিয়া! মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছ তুমি। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না।”

“আমি মেনে নিয়েছি। আমার দেহের শেষ রক্ত বিন্দু আমি আপনার নামে উৎসর্গ করেছি।”

” অনুতপ্ত হবে তুমি।”

“আমি কৃতার্থ।”

তোভিয়ার দুই বাজু সরোষে চেপে ধরে জেহেন। তার দুই আঁখি জ্বলে ওঠে। প্রশ্বস্ত হয়। তোভিয়া নিষ্কম্প চোখে চেয়ে রয়। কঠোর কণ্ঠে বলল—

“ফিরে আসুন। আমি অপেক্ষা করব আপনার জন্য। আজ রাতে আপনি আর মহলের বাইরে যেতে পারবেন না। আমি নিজেকে সমর্পণ করব আপনার কাছে। আপনি ফেরাতে পারবেন না আমায়।”

ফুঁসে যাচ্ছে জেহেন। তার প্রজ্জ্বলিত আঁখিদ্বয়ে একটুও ভয় হলো না তোভিয়ার। সে সচলচিত্তে পূনরায় বলল—

“যেতে পারেন আপনি।”

জেহেন নাক-মুখ কুঁচকে ফেলল। আজ সন্ধ্যায় তাদের বিয়ে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here