ছায়াকরী পর্বঃ১২

0
482

# ছায়াকরী
# পর্বঃ ১২
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি

ধূলো উড়ানো প্রান্তর! দীপ্তিময় বিবস্নানের খাড়া রশ্মি! তপ্ত বালির বুকে পা রাখল জেহেন। দিনের আলোতে মহাচ্ছায়া জঙ্গল যেন হেসে থাকা পত্রপল্লবের নিবিড় আবাস, যা রাতের তিমিরে হয়ে উঠে রহস্যময় আঁধার আলয়।

বালির বুকে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে জেহেন। তার উশপিশ মস্তিষ্ক! রাতের আঁধারে আঘাত করা সেই চিলের অবস্থা দেখার জন্য মনস্থির করেছে সে।

জঙ্গলে পা রাখল জেহেন। সহসা দমকা হাওয়া গায়ে লাগল তার। জেহেন পেছন ফিরে তাকাল। ধূ ধূ মরুভূমির মতো জায়গাটায় কোনো মানুষজনের পায়ের ধূলিও পড়ে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। মানুষ মাড়ায় না এইপথ। শহরে যাওয়ার দুটো পথ। এক এই মহাচ্ছায়া জঙ্গলের কাছ ঘেঁষে। যাতে স্বল্প সময়ে শহরের রাস্তা ধরা যায়। অন্যদিকে পদ্মনগরের শেষ প্রান্ত। সময়ের আধিক্য থাকলেও মানুষ সেই পথ ব্যবহার করে।

জেহেন ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। ধীরপায়ে চলতে লাগল জঙ্গলের ভেতর। ক্রমশ আলোর পরিমান কমে আসলো। জেহেন তার আকাঙ্ক্ষীত জায়গা পেয়ে গেল। সে অবাক হলো। কুঞ্চিত হলো ভ্রু। চিলের মৃত দেহ এখনো সেখানেই পড়ে আছে। অনুরূপ ভঙ্গিতে। তবে জেহেন সতর্ক হলো। তার সচল মস্তিষ্ক জানান দিলো, এই চিল সেটা নয় যাকে সে মেরেছে। জেহেন স্থির হয়ে দাঁড়াল। দুটো কাঠবিড়াল গাছের ডালে বসে জেহেনের দিকে চেয়ে আছে। বাঘের গর্জন ভেসে আসছে কোথাও থেকে। জেহেন প্রসন্ন হাসল। সে তৃপ্ত। কারণ, সে একা নয়, আরও কেউ আছে এই মেদিনীর বুকে তার মতো। ছায়াকরীর নীল চোখের তীব্রতা জেহেনকে বিভ্রান্ত করেছে। জেহেন খুঁজে চলছে এক অনাকাঙ্ক্ষিত সত্য!
,
,
,
বিকেল ছাড়িয়ে ফেলেছে দিনের শেষ ভাগ। সূর্য ডুবো ডুবো। রক্তিম আভা ধূসর আকাশ মেখেছে। দিঘীর শান্ত, শীতল জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে তোভিয়া। মানসপটে ভেসে উঠছে তার নিজস্ব পুরুষের ছবি। তোভিয়ার অন্তঃকরণে প্রলয়কারী প্রণয়ের ঝড় উঠেছে। যা শান্ত করতে পারে তার সেই সুদর্শন পুরুষ। দিঘীর পাশে থাকা স্থুলকায় গাছটা থেকে শুকনো পাতা খসে পড়ছে। পদ্মফুলের নয়নাভিরাম নৈসর্গিক সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরানো দায়! তোভিয়া পা দিয়ে জলের ভেতর ঝংকার সৃষ্টি করল। দূরের আকাশে তাকিয়ে হাসতেই তার পায়ে টান পড়ে। অতর্কিতে জলে ডুবে যায় তোভিয়া। সাঁতার জানা তোভিয়া ডুবে যায় দিঘীর স্বচ্ছ জলে। দাপরাতে থাকে জলের ভেতর। তার মনে হচ্ছে কেউ তাকে দিঘীর অতলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ছায়াকরী গাছের ডালেই বসে ছিল। চঞ্চল, অধৈর্য সে। তার পক্ষে তোভিয়াকে বাঁচানো সম্ভব নয়। মাটির বুকে পা রেখে নিজের নারী অবয়বে ফিরে এলো সে। দিঘীর সিঁড়িতে নেমে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। তেহজীব বেরিয়েছে মহল থেকে। ছায়াকরী ফন্দি আটল। তেহজীব দিঘীর সন্নিকটে আসতেই একটা বড়ো পাথর ছুড়ে ফেলল জলের ভেতর। জোরালো শব্দ হলো তাতে। তেহজীব ভ্রূ বাঁকালো। সন্দেহ জমলো মনে। সে দ্রুত ছুটে এলো সিঁড়ির কাছে। জলের ভেতর ঘূর্ণি দেখে ছুটে এসে লাফ দিলো। তোভিয়াকে টেনে তুলল তেহজীব। ভয়ে বুক ধুকপুক করা কণ্ঠে বলল—

“তোভিয়া! তোভিয়া!”

সিক্ত তোভিয়ার দুই গালে দূর্বল আঘাত করে তাকে সচল করায় প্রয়াস চালাচ্ছে তেহজীব। তাতে কোনো লাভ হলো না। নিশ্চেতন তোভিয়া। তার কোমল নারীদেহ হিমশীতল! সর্বত্র পানির ছোঁয়া। জড়ানো নেত্রপল্লব, ভেজা ওষ্ঠাধর, সিক্ত কুন্তল। তেহজীব অধৈর্য হয়ে উঠল। সিঁড়ির ওপরে এনে ঘাষের বুকে শুইয়ে রেখেছে তোভিয়াকে সে। তেহজীব তোভিয়ার পালস চেক করল। নাসিকার নিকটে কান পেতে প্রশ্বাসের উষ্ণ ছোঁয়া পেল। তেহজীব কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কী করবে সে? বারকয়েক তোভিয়াকে জাগিয়ে তুলতে চাইল। বাধ্য হয়ে তার বুকে প্রেশার দিলো যাতে করে পেটে পানি জমলে তা বেরিয়ে আসে। তবে তেমন কিছু হলো না। তোভিয়া শ্বাস নিচ্ছে অতি ক্ষীণ। তাই তেহজীব সিপিআর দেওয়ার চিন্তা করল। নিঃসংকোচে অজ্ঞাত ঘোরের মোহে সে তোভিয়ার ওষ্ঠাধর ফাঁক করে নিজের অধর কাছে নিতেই চেঁচিয়ে উঠে কেউ—

“তেহজীব! কী করছ তুমি?”

জেহেনের ক্রোধিত কণ্ঠে শিথিল চোখে তাকাল তেহজীব। জেহেন ব্যগ্রতা নিয়ে ফের বলল–

“কী করছ তুমি?”

তেহজীব নরম কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করল—

“ভাইয়া, তোভিয়া দিঘীতে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল।”

জেহেন বিচলিত পায়ে ছুটে এসে তোভিয়ার পাশে বসল। ডাকল—

“তোভিয়া, তোভিয়া!”

তোভিয়া শান্ত। নাক কুঁচকে ফেলল জেহেন। হিসহিসিয়ে বলল—

“তোভিয়া সাঁতার জানে তেহজীব।”

“সেটা আমিও জানি। ও কী করে দিঘীর জলে ডুবে গেল তা আমি জানি না। সন্ধ্যা হয়েছ ভাইয়া।”

পশ্চিম আকাশে তাকাল জেহেন। সূর্য দেখা যাচ্ছে না। সায়াহ্নের তমসা বিছিয়ে যাচ্ছে বাহ্যজগতে। জেহেন দিঘীর জলে তাকাল। ক্ষুব্ধ হলো সে। তেহজীবের দিকে তাকিয়ে বলল—

“মহলে যাও। অনিতাকে খবর দাও। যাও।”

“জি, ভাইয়া।”

তেহজীব দ্রুত পায়ে চলল। তোভিয়ার মাথাটা হাতের ওপর রেগে বুকের সাথে লাগিয়ে নিল জেহেন। নির্মল গলায় ডাকল—

“তোভিয়া, চোখ খুলো। এই তোভিয়া! তুমি তো সাঁতার জানো। এই, তোভিয়া! কতবার বলেছি, সন্ধ্যায় দিঘীর পাড়ে আসবে না। কেন শোনো না আমার কথা? ওঠো, ওঠো বলছি।”

ঝরে পড়ছে তোভিয়ার মুখচ্ছবি থেকে পানি। জেহেন অসহনীয় শ্বাস ফেলল।

“কখনো শোনো না তুমি আমার কথা।”

ঝট করেই তোভিয়াকে ক্রোড়ে তুলে নিল জেহেন। বুকের সাথে আলগোছে চেপে ধরল। তার হৃদয়ে ব্যথা হচ্ছে। প্রেমব্যথা! তোভিয়ার নিশ্চল, সিক্ত, নির্বাক আননে চেয়ে থেকে বলল-

“What we have once enjoyed we can naver lose. All that we love deeply becomes a part of us.
—-Hellen Keller
I love you, and you, only you.”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here