তোমায় ঘিরে পর্ব-৩
#শারমিন আঁচল নিপা
ধরীতা রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। অধরাও ধরীতার পাশে দাঁড়ানো। দুজনের বাসায় একসাথে। ধরীতা লক্ষ্য করল সিয়াম তার গাড়িতে উঠছে। সিয়াম গাড়িটা স্টার্ট করে ধরীতার সামনে এসে বলল
“আপনারা চাইলে আমার সাথে যেতে পারেন। ভার্সিটিতে আমি টিচার হলেও এখন আমি আপনাদের ওয়েল উইশার। এ সময়টায় এখানে বাস পাওয়া যায় না। সুতরাং আপনারা ইচ্ছা করলেই আমার সাথে যেতে পারেন।”
ধরীতা রাগী চোখে তাকিয়ে জবাব দিল
“ভার্সিটিতে আপনি আমার টিচার হলেও এখানে একজন সাধারণ মানুষ। আর আমরা যার তার কাছ থেকে সাহায্য নিই না। লেভেল বজায় রেখে সাহায্য নিই। আপনি আমাদের লেভেলেরেই না।”
ধরীতার শক্তপুক্ত কথা শুনে অধরা পাশ থেকে চুপ হওয়ার জন্য বতলে লাগল। তবে এতে তার কোনো বোধদয় হচ্ছে না। সে একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে সিয়ামকে। কথার এক পর্যায়ে ধরীতা হাতে টান অনুভব করল। লক্ষ্য করল তার হাতের ব্যাগটা কেউ টেনে নিয়ে গেছে। ধরীতা লোকটার পেছনে ব্যাগ ব্যাগ বলে চিল্লাতে লাগল আর দৌড়াতে লাগল। দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় হাঁপিয়ে থুবরে পড়ল রাস্তায়। সিয়াম গাড়িটা ততক্ষণে স্টার্ট দিয়ে লোকটার সামনে গাড়িটা দাঁড় করাল। তারপর গাড়ি থেকে নেমে লোকটার কলারটা ধরে ব্যাগটা নিতেই লোকটা হাত ছাড়া পেয়ে দৌড়ে পালালো। এদিকে অধরাও পেছন পেছন দৌড়ে আসলো। ধরীতাকে হাত ধরে টেনে তুলল। ধরীতার সারা শরীরে জখম হয়ে গেল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাগ পড়ে গেল শরীরে। সিয়াম এর মধ্যেই গাড়ি নিয়ে তাদের সামনে আসলো। ধরীতার দিকে ব্যাগটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল
“সবসময় তো গুন্ডামি করেন। কিন্তু ঠিক জায়গায় এসে থুবরে পড়েন। এখন আপনার স্টেমিনা কোথায় গেল? ছিনতাইকারীর হাত থেকে নিজের ব্যাগটাও উদ্ধার করতে পারেন না। অথচ সবসময় বস বস একটা ভাব ধরেন। আর মেয়েদের এমন গুন্ডামি মানায় না। আমি আপনার কাছের কেউ হলে গাল বরাবর ঠাটিয়ে চড় মারতাম। আর আপনি প্রথমদিন ভার্সিটিতে এসেছেন আপনার পোশাকের এ অবস্থা কেন? মেয়েদের একটু গুছিয়ে চলতে হয়৷ আমারও বোনও আছে। দাওয়াত রইল আমায় বাসায় তাকে দেখে আসবেন। তাহলে বুঝবেন মেয়েদের কেমন হওয়া উচিত। যাইহোক চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসুন। এ জায়গা এত ভালো না।”
ধরীতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর কিছুই বলার সাহস সে পাচ্ছে না। যদিও সিয়ামের কথায় একটু অপমানবোধ তার কাজ করছে তবে সেটা সে এভাবে শোধ নিবে না । শোধ নেওয়ার আরও অনেক উপায় আছে। সবসময় চিল্লাচিল্লি, ঝগড়া করে অপমানের শোধ নেওয়া যায় না। কিছু সময় মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে হয়। তা না হলে জীবনে অনেক পস্তাতে হয়। ধরীতা নিজের মথাকে ঠান্ডা করে অধরাকে নিয়ে গাড়ির পেছনে বসলো। সিয়াম কিছুটা অবাক হলো ধরীতার এমন ব্যবহারে। যে মেয়েটা চিৎকার ছাড়া কথা বলে না, কাউকে পরোয়া করে না সে মেয়েটা এখন এত কথা শুনার পরও কোনো কথা বলল না এটা সিয়ামের মানতে একটু কষ্ট হচ্ছে। সিয়াম তাই ধরীতাকে একটু খুঁচিয়ে বলল
“আপনার মুড অফ নাকি?”
ধরীতা স্পষ্ট ভাষায় উত্তর দিল
“মুড অফ হবে কেন?”
“এই যে এত গুলো কথা নির্দ্বিধায় হজম করলেন তো তাই ভাবলাম মুড অফ।”
“আমি একদম ঠিক আছি। আর আপনি আমাকে যেমন ভাবছেন আমি তেমন না। আমি একটু রুড হতে পারি তবে এতটাও রুড না যে আমাকে সব জায়গায় ঝগড়া করতে হবে। আর আপনি যা বলেছেন আমি সেটা যাচাই করতেছি। যদি আমার মধ্যে ভুল হয় আমি সেটা শুধরে নিব।”
ধরীতার কথা শুনে পাশে বসা অধরাও বেশ চমকালো। তারও সিয়ামের মতো বিশ্বাস হচ্ছে না সে এভাবে কথা বলছে। মনে হচ্ছে ধরীতার উপর কোনো আত্মা ভর করেছে আর তার জন্যই তার কথা এত কোমল হয়েছে। অধরা ধরীতাকে ছোটোবেলা থেকে চিনে৷ ধরীতার মেজাজ সবসময় রক্ষ থাকে। সহজে কোনো কথা কারণ ছাড়া সে হজম করে না। একটা কথার দশটা জবাব দেওয়া যে মেয়ের স্বভাব সে কী করে এত চুপ হয়ে এতগুলো কথা সহ্য করল সেটাই ভেবে পাচ্ছে না অধরা। সে কিছুটা বিস্ময় চোখে ধরীতার দিকে দৃষ্টিপাত করল। ধরীতা বেশ শান্ত হয়ে বসে আছে। কিছু একটা ভাবছে সেটা তার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে। তার মনে কী চলছে কে জানে। অধরা আর এ বিষয় নিয়ে বেশি মাথা ঘামাল না। দেখা যাবে মাথা ঘামাতে গিয়ে মাথাটায় বিগরে গেল তার। অধরার কানে কণ্ঠসুর ধেয়ে আসলো
“আপনাদের দুজনের বাসায় কী একসাথে?”
ধরীতা নম্র গলায় জবাব দিল
“আমার দু বোন হই। ওর আর আমার বাসা একই সাথে। ছোটো বেলা থেকে আমরা একসাথে থাকছি। আচ্ছা বাই দ্যা ওয়ে সকালে যে মেয়ে দেখতে গিয়েছিলেন তার সাথে কী আর যোগাযোগ হয়েছে? নাকি বিয়ে সত্যি সত্যি ক্যানসেল হয়ে গিয়েছে?”
সিয়াম গলা খেঁকিয়ে উত্তর দিল
“এতকিছুর পর বিয়ে ঠিক থাকে নাকি? মেয়ে অলরেডি বাসায় ছড়িয়ে দিয়েছে আমার গার্লফ্রেন্ড আছে। আর একটা না অনেক গুলা আছে। যে জায়গায় কখনও মেয়েদের দিকে ঠিক করে তাকাইনি সে জায়গায় আজকে এত বড়ো অপবাদ মাথা পেতে নিতে হলো। আচ্ছা নিজের বোনের বয়ফ্রেন্ডকে কেউ চিনতে ভুল করে? আপনি কী এর আগে তাকে কখনও দেখেন নি?”
“আমি ছেলে মানুষ, প্রেম, ভালোবাসা এসব সহ্য করতে পারি না তাই কখনও ছেলেদের সাথে কথা বলা বা অন্যদের বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলা বা দেখা করার মতো কাজ আমি করি না। অধরা বলেছিল তার বয়ফ্রেন্ড ফ্লার্ট করতেছে তাই মারতে গিয়েছিলাম। কারণ ছেলে জাতিটাকেই আমার বিরক্ত লাগে। এদেরকে একটু পিটাইতে পারলে মনটা শান্তি লাগে। ”
সিয়াম খিলখিল করে হেসে দিল। মেয়েটাকে যতটা রুড সে ভেবেছে মেয়েটা ততটা রুড না। তবে ছেলেদের প্রতি এক রকম এলার্জি মেয়েটার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। কিছুক্ষণ নিজেই হাসলো তারপর উত্তর দিল
“নিজের বাবা, ভাই তারাও ছেলে তাদের প্রতি রাগ হয় না?”
“উনারা আমার বাবা, ভাই। যদি অন্যায় করে তাহলে অবশ্যই রাগ হবে। তবে আমি আমার বাবাকে পছন্দ করি না। আমার বাবাকে আমি কখনও ভালো মানুষ বলি না। ”
ধরীতার কথা শুনে সিয়াম কিছুটা বিস্মিত হলো। প্রতিটা মেয়ের কাছে তার বাবা রাজা আর ধরীতা সেখানে নিজের বাবাকে ঘৃনা করে। কেন করে জানার তীব্র ইচ্ছা জাগলেও সিয়াম তা নিবারণ করল। শান্ত গলায় প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে জিজ্ঞেস করল
“আগে কি দুজন একই কলেজে পড়তেন?”
ধরীতা আর কোনো জবাব দিল না। বাবার কথা মনে হতেই তার মায়ের কথা মনে হয়। সব মিলিয়ে তার তখন ভীষণ ছন্নছাড়া লাগে। এ সময়টায় সে নিজেকে সবচেয়ে বেশি অসুখী মনে করে। কেন যে এ কথাগুলো না চাইতেও বারবার চলে আসে! কেন যে ঘটনা গুলো বারবার সামনে এসে ঘুরপাক খায় সেটা ভেবেই আফসোস হচ্ছে তার। সে চায় না পুরনো সে অতীত গুলো তার পিছু এখনও নিক। ধরীতার নীরবতা টের পেয়ে অধরা উত্তর দিল
“জি আমরা একই কলেজে পড়তাম। আমাদের সবকিছুই একই সাথে হয়। আমরা ভালো ফ্রেন্ড এবং ভালো বোন।”
সিয়াম আর কোনো কথা বাড়াল না। গাড়িটা চলতে লাগল।বেশ জ্যাম পড়েছে রাস্তায়। ক্লান্ততায় ধরীতার চোখটা লেগে আসলো। চোখটা লাগার পরক্ষণেই চমকে উঠল সে। কারণ
চলবে?