ত্রয়ী পর্ব ২২

0
619

ত্রয়ী
মোর্শেদা হোসেন রুবি
২২||
শিরি ভেজা চুলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙার পর ঘোর কাটতে কিছুটা সময় লাগল ওর। চোখ মেলে নিজেকে ছোট্ট একটা আবদ্ধ রুমে এরকম আধাভেজা অবস্থায় পেয়ে প্রথমটায় হকচকিয়ে গেল। ইস্, এ কী অবস্থা। কখন ঘুমালো ও। কতটা ক্লান্ত থাকলে এভাবে মড়ার মত ঘুমায় মানুষ। গরমে ঘামে গায়ের জামা ভিজে লেপ্টে আছে গায়ের সাথে৷ ওপর দিকে তাকাল। ফ্যানটা ঘুরছে ঠিকই কিন্তু একদম বাতাস নেই। পরক্ষণেই নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে মনটা হঠাৎ কেমন যেন করে উঠল। ধীরে ধীরে মনে পড়ল সকালের কথা। গোসল সেরে এসে নাস্তার অপেক্ষায় বসে থাকতে গিয়েই চোখটা লেগে এসেছিল। তারপর থেকেই নির্ঘুম রাতের ক্লান্তি নিয়ে মড়ার মত ঘুমিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনমনা হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ঘড়ি দেখল। সাড়ে পাঁচটা। কপাল কুঁচকে ভাবার চেষ্টা করল এটা কোন সাড়ে পাঁচটা। মনে পড়ল ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় ও জেগে ছিল আর তখন পলাশও ছিল ওর পাশে। তারমানে এখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। পলাশ এখনও ফেরেনি ভেবে বিস্মিত হলো। মানুষটা গেল কোথায় ? ভাবতে ভাবতেই দুর্বল হাতে চুলে পেঁচানো কাপড়টা টেনে খুলল শিরি। চুলগুলো পেঁচানো অবস্থাতেই আধা শুকনো হয়ে গেছে। হালকা গন্ধও আসছে ওগুলো থেকে। ভেজা চুলগুলো কাপড়ের চাপড়ে শুকাতে গিয়ে টের পেল নড়তে গেলেই পা দুটো রীতিমত টনটন করে উঠছে। শরীরের নিচের দিকে অসম্ভব ব্যথা আর ব্যথাটা শুরু হয়েছে কোমড়ের নিচ থেকে। মাটিতে শোবার কারণে কিনা কে জানে শরীরের গিঁটে গিঁটেও ব্যথা। সারা শরীরে এক অসাঢ় অনুভূতি। ভীষণ ক্লান্তও লাগছে । জীবনে এর আগে কখনও এত দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকেনি বলেই হয়ত। রোজা রাখার সময় থেকেছে না খেয়ে কিন্তু তখন এত ক্লান্ত লাগেনি। আজ কেমন যেন অসুস্থ মনে হচ্ছে নিজেকে। টের পেল পেটে ভেতর গুড়গুড় করছে। ওটা প্রবল খিদের লক্ষণ। হঠাৎ করেই গতরাতের কথা মনে পড়ল। পলাশ খুব অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল । ওকে এত অসহনশীল আগে কখনও মনে হয়নি। অল্পবিস্তর হলেও সেটাকে প্রেম কাতরতা বলেই মনে হত। কিন্তু কাল তো ওকে চেনাই যাচ্ছিল না। এক বুভুক্ষ স্বেচ্ছাচারী। শিরি নিজেই একটা পর্যায়ে বাধা দিয়েছিল কিন্তু পলাশের প্রচন্ড বিরক্তিমাখা চেহারা দেখে সহনশীলতার চুড়ান্ত অবলম্বন করতে হয়েছে ওকে। শিরিকে ভেতরে বাইরে ব্যবচ্ছেদ করেও যেন চলছিল না । স্রষ্টা প্রদত্ত ক্ষমতার সীমারেখা বেঁধে না দিলে হয়ত ওর ঐ আগ্রাসী ভূমিকা আরো অনেকক্ষণ দেখতে হত শিরিকে। এ মুহূর্তে নিজেকে ডাস্টবিনের ছিবড়ে বলে মনে হচ্ছে। কেবল এই আদিম আনন্দটুকুর জন্য এত গুলো সম্পর্কের বিসর্জন। এমন কেন চাওয়াটা ?
হঠাৎ করেই স্মৃতিবিদূরতায় আক্রান্ত হয়ে গেল শিরি। বাড়ির কথা মনে পড়ল। অনেক ধনী পরিবারের মেয়ে না হলেও একেবারে বস্তিবাসী নয় সে। বোনেরা সবাই লেখাপড়া জানে। এইচ এস সি দেবার পরপর সুরমা আপার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল বলে বেচারী আর পড়তে পারেনি। সে তুলনায় মিলি আপার পড়াশোনা ভাল। ভাল সাবজেক্টে অনার্স পড়ছে সে। সাবা ও মন দিয়েই পড়াশোনা করছে। সাবা ওর মাত্র এক বছরের বড় বলে ওকে নাম ধরেই ডাকে শিরি। তাছাড়া বাবা হঠাৎ মারা যাবার পর মায়ের উপর সংসারের ভার চলে এলেও ওদের কাউকে পড়ালেখা বাদ দেবার কথা কখনও কেউ ভাবেনি। বাবলুর মত ফাঁকিবাজকেও ধরে ধরে পড়ায় সাবা। শিরির জন্য নিজের জমানো টাকাগুলো খরচ করতে এতটুকু দ্বিধা করেনি। আর শিরি কিনা তার প্রতিদান এভাবে দিল। ও নিজেই যেন জানেনা হঠাৎ কী করে বসল এটা। কেন যে পলাশ স্যারের সাথে একা রুমে বসতে গিয়েছিল আর নিজের ধৈর্য্যকে পরীক্ষায় ফেলেছিল। কে জানে ওর লেখাপড়া আর হবে কি না। পলাশ কী ওকে পড়াবে। সে নিজেই তো এখনও ছাত্র। মনটা হঠাৎ করেই বিষম খারাপ হয়ে গেল শিরির। এর মধ্যে পেটের খিদেটা বারবার চাগিয়ে উঠতে চাওয়ায় আরো যেন অস্থির লাগছে ।
দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে মুখ তুলে ঘরের একমাত্র জানালাটার দিকে তাকাল শিরি। ওটা দিয়ে ঘোলাটে আলো আসছে। দুপুরের আলোটা এরচেয়ে অনেক কড়া হয়, এটা বিকেলের বিষন্ন আলো। শিরির মনের অবস্থা এখন ঐ এক চিলতে আলোটুকুর মত। আচ্ছা, পলাশ ফিরছে না কেন। বলে গেল নাস্তা নিয়ে আসি। নাস্তা আনতে এতক্ষণ লাগে ? সকালের নাস্তা বিকালে খাবে নাকি ? অজান্তেই পেটে হাত বুলাল শিরি । পেটটা যেন একেবারে পিঠের সাথে লেগে গেছে। শিরি এমনিতেই রোগা। কণ্ঠের হাড়ের জন্য সাবা ওকে প্রায়ই ক্ষেপায়। আজ তো মনে হয় শরীরের সবগুলো হাড় ফুটে ওঠার দশা হয়েছে ওর। সাবা দেখলে কী বলত কে জানে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে পলাশকে ফোন দিল শিরি। এখনও বন্ধ ফোনটা। কী অদ্ভুত ছেলে। সকাল থেকে ফোনটা বন্ধ করে রেখেছে। আচ্ছা, ওর কোন বিপদ হলো না তো। ফের বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল শিরি। বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। প্রচন্ড খিদায় বমি বমি ভাব হচ্ছে এখন। বার দুয়েক ওয়াক হলো কিন্তু পেটে কিছু থাকলে তো পড়বে। অস্ফুটে বলে উঠল, ” ওহ্, পলাশ। তুমি কোথায়। আসোনা কেন ? ”
=====
-” এই অসময়ে আবার কোথায় বেরোচ্ছিস ? সারাটা দিন তো পড়ে পড়ে ঘুমালি। এই নাকি তোর লেখাপড়া? ”
-” আহা, আম্মা। সারারাত স্টাডি করলে সারাদিন ঘুমাবো না তো কী করব। রেস্টেরও তো দরকার আছে। আমাকে গরম গরম এককাপ চা দাও তো। খেয়ে বেরোবো।”
-” যাবি কোথায় এখন ? ”
-” আবার কোথায় ? আরিফের ওখানে। আচ্ছা, এত জেরা করছ কেন তুমি ? ”
-” জেরা করব না ? তোর বাবা তো সব রাগ আমাকে দেখায়। নিজে কিছু বলতে পারেনা। আমার হয়েছে যত জ্বালা। তোর রেজাল্ট কিছু হলে তোর বাবা আমাকে আস্ত রাখবেনা আগেই বলে দিয়েছে।”
-” বাবার দৌড় ঐ পর্যন্তই। তোমার সঙ্গেই চোটপাট দেখায়। এত যে রেজাল্ট রেজাল্ট করে কয়টা টিচার রেখে পড়িয়েছে যে এত দাবি ? আমি কোচিং করে ঐটার পয়সা দিয়ে নিজের যাবতীয় শখ মেটাচ্ছি। মাথা কুটে মরে গেলেও পাঁচ টাকার জায়গায় ছয় টাকা কোনদিন দেয়নি তোমার জামাই। আবার কথা বলতে আসে।”
-” নিজের বাবার সম্পর্কে এভাবে কথা বলছিস? ”
-” তো কী করব ? কবে থেকে একটা মোবাইল কিনে দিতে বলছি। দিয়েছে কিনে ? কাজেই আমার ব্যপারে তার চাহিদাও যেন কম থাকে। বলে দিও। ” পলাশ বেরুতে গেলে মা পিছু ডাকলেন, ” কী রে, যাচ্ছিস কই ? চা খাবিনা ? ”
-” লাগবেনা তোমার চা। চা-পাতা বাচিয়ে দিলাম তোমার। যাও, খুশি থাক। ” সদর দরজা দিয়ে বেরোবার মুখে কথাগুলো শোনা গেল। তাতেই মন খারাপ হয়ে গেল হামিদা বেগমের। সত্যিই, ছেলেটা এত কষ্ট করছে লেখাপড়া নিয়ে। কথাগুলো না শোনালেই পারতেন।

পলাশ যখন রুমের দরজা নক করল তখন রাত আটটা। টোকা শুনেও জায়গা ছেড়ে নড়লোনা শিরি। আরো দু তিনবার টোকা পড়ল। আর তারপরেই পলাশের কণ্ঠ। দ্রুত উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল শিরি। তাতেই মাথাটা ভীষণভাবে চক্কর দিয়ে উঠলে দেয়াল ধরে নিজেকে কোন রকমে সামলালো। আস্তে করে দরজাটা খুলতেই পলাশ ঢুকল। আর অজানা আবেগে ওর ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ার মত করল শিরি। তারপরেই ফুঁপিয়ে কান্না। পলাশ ওকে সামলে নেবার সুযোগ দিল। তারপর ওর হাত ধরে বসালো একপাশে। শিরি তখনও কাঁদছে। পলাশ ওর হাত ধরে বলল, ” আমি জানি তুমি কষ্ট পেয়েছ কিন্তু আমি কী পাইনি ? তুমি না খেয়ে আছ। আমি কী খুব খেয়ে দেয়ে এসেছি ? সব না জেনে খামোকাই রাগ করছ।”
-” এই তোমার দশ মিনিট ? ” শিরি কেঁদে ফেলল এবার।
-” আমার উপর দিয়ে কী গেছে যদি জানতে।”
-” কী হয়েছে ? ” শিরি চোখ মুছল।
-” আচ্ছা, সব কথা বলব, তার আগে এই পরোটা সব্জিটা খেয়ে নাও। এই খাবারটুকু যোগাড় করতে যে কী কষ্ট হয়েছে তা কেবল আমিই জানি। ”
-” কই ছিলে তুমি সারাদিন ? ” শিরি পরোটা বের করে কাগজে রাখল। পরোটা দেখেই খিদেটা নতুন করে জানান দিচ্ছে। পলাশ এক টুকরো ছিঁড়ে নিজ হাতে শিরির মুখে তুলে দিয়ে বলল, ” হাসপাতালে। ”
-” হাসপাতালে ? ”
-” হম, এক বন্ধুর রক্ত লাগবে শুনে সেখানে গেলাম। এই দেখো হাতে এখনও ব্যান্ড এইড লাগানো। ” হাতটা বাড়িয়ে দেখাল পলাশ। তাতে সত্যি সত্যি একটা ব্যান্ড এইড লাগানো৷ শিরি আলতো ছুঁলো জায়গাটা।
-” তবে রক্ত দেবার বিনিময়ে একটা টাকা নেইনি জানো। ওকে শুধু বলেছি, আমাকে পারলে একশ টাকা ধার দে। পরে শোধ দিয়ে দেব। শুনে ও একশো টাকা দিল। সেটা দিয়ে তোমার জন্য এসব আনলাম।”
শিরির চোখ জলে ভরে এল। অথচ সে কিছুক্ষণ আগেই পলাশের ব্যপারে কত আজেবাজে ভাবনা ভেবে মনে মনে রেগে ছিল। সত্যিই, অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। শিরি অপরাধীর ভঙ্গিতে মুখ নামিয়ে বলল, ” স্যরি।”
-” ইটস ওকে। এখন তুমি খাও আমি দেখি।”
-” তুমি খাবেনা ? ”
-” নাহ্। হাসপাতাল থেকে বেরোনোর আগে বন্ধুটা আমাকে অনেক কিছু জোর করে খাইয়ে দিয়েছে। এগুলো যা এনেছি সব তোমার ! ” শিরি নিঃশব্দে খাবার মুখে তুলল। মৃদু শব্দে জানতে চাইল, ” আমরা কাজি অফিসে কখন যাব ? আজ না আমাদের বিয়ে করার কথা ? ”
-” কীভাবে যাব জানু তুমিই বলো ? মাত্র একশ টাকা আমার পকেটে। এই টাকায় কী বিয়ে হয় ? তোমার মোহরানা, কাজির পেমেন্ট, বন্ধুদের মিষ্টি। সব মিলিয়ে অনেক টাকার ব্যপার।”
-” তাহলে কী আমরা বিয়ে ছাড়াই এভাবে থাকব ? ”
-” শোনো, বিয়েটা একটা ফরমালিটি। মনের বন্ধন অটুট থাকলে বিয়ে ফিয়ে লাগেনা। আজকাল তো লিভ টুগেদার করছে অনেকেই। যাদের পকেট ভর্তি টাকা আছে তারাও করছে। আর আমি তো গরীব।”
শিরি নিঃশব্দে তাকিয়ে থেকে কথাগুলো শুনল। কয়েক লোকমা পেটে যাবার পর শরীরটা ভাল লাগতে শুরু করেছে। মাথাটাও ঠিকমত কাজ করছে। ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,” পৃথিবীর সবচে কম মোহরানা আমার হোক। তবু আমাকে বিয়ে করো পলাশ প্লিজ। এভাবে ভাল লাগছেনা। আজ সকালে ঐ বাড়ির আন্টি জানতে চেয়েছিল আমাদের বিয়ে হয়েছে কবে। ”
-” তুমি কী বলেছ ? ”
-” বলেছি গতকাল।”
-” এই তো, গুড। এভাবে উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে জানতে হয়। তুমি তা পেরেছ। কাজেই ওটা নিয়ে ভেবে আমাদের সুন্দর সময়টা নষ্ট করার মানে হয়না। এবার খেয়েদেয়ে আমার মনের ক্লান্তি দুর করে দাও তো দেখি।”
শিরি নিরবে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মৃদু স্বরে বলল,” সারাটা দিন এই খুপড়ির মত রুমে থেকে আমার দম বন্ধ লাগছে পলাশ। আমাকে একটু বাইরে নিয়ে যাবে ? চলো না প্লিজ।”
-” যাব। অবশ্যই যাব। তবে আজ না। এখন রাত। কাল নিয়ে যাব।”
-” বেশী রাত তো হয়নি। মাত্র….!”
-” আমি জেদ পছন্দ করিনা শিরি। কাল বলেছি কাল। স্বার্থপরের মত শুধু নিজের দিকটা দেখছ বলেই এভাবে কথা বলতে পারছ। সারাটা দিন এই রুমে তুমি শুয়ে বসে কাটিয়েছ। ইট ভাঙোনি। আমার উপর দিয়ে কী গেছে তা আমি জানি। একটাবার তো আমার দিকটা ভাবো।”
শিরি চুপ করে গেল। আর কোন কথা না বলে খাওয়া শেষ করে খালি কাগজগুলো গুটিয়ে পলিথিনে ভরে বোতলের মুখ খুলল পানি খাবার জন্য। পলাশ হঠাৎ সুর নরম করে ওকে কাছে টেনে আদরের সুরে বলল, ” একদম স্যরি জান। এভাবে কথাটা বলা আমার উচিত হয়নি। আমি জানি তোমার শরীর, গা-মাথা ব্যথা করবে। এজন্যই আমি তোমার জন্য ট্যবলেট নিয়ে এসেছি। এটা খাও দেখবে মাথা ব্যথা শরীর ব্যথা সব গায়েব হয়ে গেছে।” ট্যাবলেটটা শিরির হাতে দিলে সে নেড়েচেড়ে উল্টেপাল্টে দেখল সেটা। কাটা পাতা বলে নামটা দেখা যাচ্ছেনা।
-” কী নাম এটার ? ”
-” আরে ধুর। নাম দিয়ে কাম কী। খেয়ে কাজ হলেই হল। খাও তো।” শিরি বিনা বাক্য ব্যয়ে ট্যবলেটটা খেয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর মনে হল, ট্যাবলেটটা আসলেই ভাল। কেমন যেন ঘুম ঘুম অনুভূতি অথচ সারাটা দিন পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে।
=====
দুপুর খাবারটা লজেই সারল ওরা। তুষারপাত হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। বারসাতকে বাধ্য হয়েই বেড়ানো বাদ দিয়ে লজে ফিরতে হয়েছে ওদের দুজনকে নিয়ে। তাতেই শ্রাবনীর মুড অফ। তবে ফেরার পর থেকে সায়রাকে আর দেখা যায়নি। সে এসেই যে তার রুমে গিয়ে ঢুকেছে আর বেরোয়নি। লজটা এমনিতে বেশ বড়সড়। বারসাত জানে এখানকার লজগুলো কটেজের মত। রান্নাঘর ডাইনিং স্পেশ থেকে শুরু করে একটা পরিবারের জন্য যা যা দরকার হয় তার সবই থাকে লজগুলোতে। বারসাত বেছে বেছে একটা বড়সড় ফ্যামিলি লজ ভাড়া নিয়েছে কারণ ওদের একাধিক রুমের দরকার পড়বে। আম্মা আর শ্রাবনীকে মাস্টার বেডটা ছেড়ে দিয়ে সায়রাকে একা একটা সিঙ্গেল রুম দিয়েছে। আফটার অল সে গেস্ট। আর নিজের জন্য ড্রইংরুমের ডিভানটাকেই বেছে নিয়েছে বারসাত।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে ডিভানে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখতে দেখতেই পরবর্তী করনীয় সম্পর্কে ভাবছিল বারসাত। এমন সময় সায়রাকে বেরিয়ে আসতে দেখল ওর রৃুম থেকে। মেয়েটা ইতোমধ্যে পোশাক বদলে ঘরোয়া হয়ে গেছে। এখন ওর পরনে ফ্লোর টাচ কাফতান। একটা হালকা ওড়না মত কাশ্মিরী শাল দিয়ে মাথা সহ উর্ধাংশ পেঁচিয়ে রেখেছে। কাফতানের রংটা চমৎকার। ব্রাউনিশ রেডের সাথে রয়েল আর ডিপ ব্লুর মিশ্রণ। শালটা বারগান্ডি কালার। সব মিলিয়ে রঙের ছড়াছড়ি। সায়রাকে এ মুহূর্তে অন্য সব সময়ের তুলনায় বেশ বড়সড় দেখাচ্ছে। মেয়েটা আসলেই ক্লাস টেনে পড়ে তো ? বারসাতের হঠাৎ সন্দেহ হতে লাগল। ফেল টেল মেরেছে কিনা কে জানে। যা উড়ো স্বভাব। মারলেও মারতে পারে। রোল নম্বরটা জানা দরকার।
-” এই যে, আপনার কাছে রুৎবার খালামনির ফোন নম্বর আছে ? ” সায়রা কাছে এসে আস্তে করে কথাটা বললে বারসাত শোয়া থেকে উঠে বসল। সামনের সোফা দেখিয়ে বলল, ” বসুন। কী করবেন নাম্বার দিয়ে ? কথা বলবেন ? ” সায়রা বিস্মিত। বলতে চেয়েছিল নাম্বার দিয়ে কী করে মানুষ ? কিন্তু চেঁচিয়ে উঠে বলল ।
-” আপনার কাছে রুৎবা খালমনির নম্বর ছিল ? ”
বারসাত সাথে সাথেই “শশশ” শব্দে তর্জনী তুলে ঠোঁটে ধরে সতর্ক করে বলল , ” আহা, আস্তে কথা বলুন। কেন, থাকলে কী সমস্যা নাকি ? ”
-” একবারও আমাকে বলেন নি কেন ? ” চাপা ক্রোধে বলল সায়রা। বারসাত সে কথাকে পাত্তা না দিয়ে কল চাপল। ফোন কানে চেপে হালকা স্বরে বলল, ” ইয়াদ নাহি থে।”
-” হম, ইয়াদ নাহি থে….ইয়াদ থাকবে কেন ? ” সায়রাও চাপাস্বরেই জবাব দিল। বারসাত বিস্মিত হয়ে ফোনে ধরা হাতটা ঝুলিয়ে দিল নিচে।
-” আপনি তো দেখছি দারুণ ঝগড়াটে। ”
-” আমি আরো অনেক কিছু কিন্তু সেটা জানার সুযোগ আপনি পাবেন না। নিন, ফোন ধরে দিন। আমি কথা বলব খালামনির সাথে।”
বারসাত ফোনটা বাড়িয়ে ধরল,” লিজে, বাত কিজিয়ে।”
প্রায় ছোঁ মারার মত করে ফোনটা নিয়ে নিজের রুমের দিকে ছুটল সায়রা। বারসাত বোকার মত সেদিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফের শুয়ে পড়ল। প্রায় মিনিট বিশেক পর সায়রা ফিরে এল। বারসাত শোয়া অবস্থাতেই হাত বাড়িয়ে দিল আর তখনই সায়রার ফোঁপানোর শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে মুখ তুলে তাকাল। বিকেলের আবছা অন্ধকারেও মেয়েটার নাক মুখ লালচে বলে মনে হল ওর। দেখে মনে হল শালের কিছুটা রঙ নাকে লেগে গিয়েছে। জিজ্ঞেস করবেনা ভেবেও বলে ফেলল ,” কী হয়েছে? ”
সায়রা মাথা নেড়ে চলে যেতে ধরলে বারসাত পিছু ডাকল, ” দাঁড়ান। এখানে আসেন।” সায়রা ফিরল তবে এগোলো না। এখন সে শালের মধ্যে মুখ গুঁজে হেঁচকি তুলে কাঁদছে। বারসাত ত্রস্তে উঠে বসল, ” আরে কী হলো আপনার? ”
সায়রা ঝুপ করে সোফায় বসে দু হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, ” আ’ম আ বাস্টার্ড। আ রিয়েল বাস্টার্ড।”
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here