ত্রয়ী পর্ব ২৭

0
1882

ত্রয়ী
মোর্শেদা হোসেন রুবি
২৭||

পলাশদের বাড়ির পরিস্থিতি বেশ থমথমে হয়ে আছে। গতকাল সকাল এগারোটা থেকে এখন বেলা তিনটা। বিগত তিরিশ ঘন্টায় রাশেদের নাওয়া খাওয়া ঠিক মত হয় নাই। বরং সে পুরোপুরি আটকা পরে গেছে এখানে। শিরির ঘটনা শেষে ভেবেছিল বাড়ি ফিরে মামার হাতে তার সুপুত্রকে সোপর্দ করে দিয়েই নিজের ডেরাতে ফিরে যাবে। গোসল করবে ভাত খাবে। কিন্তু কোনটাই হয়নি। গতকাল সারাটা দিন গেছে পলাশের এসব অপকীর্তির পেছনে। ওকে মামার হাতে তুলে দিয়ে সন্ধ্যের পরপর ফিরেছিল হোস্টেলে। কোনো লাভ হয়নি। আধাঘন্টার মধ্যে মামার ফোন পেয়ে হুড়মুড় করে হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে ছুটতে হয়েছে। সেখানে গিয়ে জানতে পারল রাতে হৈ চৈ এর এক পর্যায়ে মামি নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। ছেলের এই আচরণ তিনি সহ্য করতে পারেন নি। আল্লাহর রহমত ছিল বলেই মামা সাথে সাথে টের পেয়ে যান। রান্নাঘরের দরজা ভেঙে মামিকে বের করেন মামা আর পলাশ মিলে। সব শুনে রাশেদ সরাসরি ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করে। তিনি নিজেই জানালেন। ক্ষত সামান্যই কিন্তু ঠিক মত চিকিৎসা না নিলে এটা বেড়ে যেতে পারে। তবে রুগীর চাপ এখন বেশি কাজেই তাকে এখানে রাখা যাবেনা। হাসপাতাল থেকে মামিকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাসায় আনতে আনতে বেজে গেছে রাত বারোটা। অত রাতে হোস্টেলে ফিরে যাবার উপায় থাকেনা ছিল না। সুপারিন্ডেন্ট একশটা প্রশ্ন করে মাথা খারাপ করে দেবে। তার উপর রাশেদ থাকে আরেকজনের সিটে। খবরটা পাঁচকান হলে আরেক ঝামেলা বাড়বে। দরকার কী। তারচেয়ে একটা রাত মামার বাড়িতে থাকাই বেটার। কিন্তু পলাশের সাথে এক ঘরে থাকার প্রবৃত্তি হচ্ছিল না বলে মামার ড্রইংরুমটাকেই বেছে নিয়েছে রাশেদ। এ পর্যন্তও সব ঠিক ছিল। রাশেদ ফজরের নামাজের পরপর হোস্টেলে ফিরে এলেও দশটার দিকে পলাশের ফোন পায়। সে নিজেই কাকুতি মিনতি করে রাশেদকে আসতে বলে। ফলে কোনরকমে নাকে মুখে দুটো গুঁজে ফের মামার এখানে আসতে হয়েছে রাশেদকে। ঘটনা গতরাতের তুলনায় সামান্যই। আমজাদ মামা পলাশকে আজ সকালে ঠান্ডা মাথায় ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেছেন এবং ওর বইখাতা কাপড়চোপড় সব বাইরে ছুঁড়ে ফেলে নিজের পথ দেখতে বলেছেন। শেষ পর্যন্ত বাপকে থামাতে না পেরে রাশদকেই ফোনে ডাকতে হয়েছে পলাশকে। রাশেদ এ বাড়িতে এসেই দেখেছে তুলকালাম অবস্থা। পলাশের জিনিসপত্র সারা ঘরময় সয়লাব। রাশেদকে দেখেই আমজাদ কঠিন কণ্ঠে বলে উঠলেন, ” ওকে চলে যেতে বল রাশেদ। আজ থেকে ওর আর আমার কোন সম্পর্ক নেই। ওকে আমি ত্যাজ্যপুত্র করেছি। এরকম কুলাঙ্গার ছেলে আমার দরকার নেই।”
রাশেদ চুপচাপ সব শুনল। তারপর ঘরের চারপাশে ছড়ানো ছিটানো জিনিসগুলো দেখল আর গেটের বাইরে চোরের মত দাড়িয়ে থাকা পলাশকেও দেখল। মেজাজটা চড়তে গিয়েও চড়তে দিল না। পলাশের কারণে আজ ওর এনাটমির অতি গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসটা মিস হল। বোঝাই যাচ্ছে আজকের দিনটাও এদের বাপ ছেলেকে উৎসর্গ করতে হবে। নিজেকে বোঝাল মাথা গরম করা যাবেনা। এদের সময়টা খারাপ যাচ্ছে। ছেলের এমন অপকীর্তি কোন ভালমানুষ বাবার জন্য মেনে নেয়া সত্যিই কঠিন। তার উপর মামির অসুস্থতা তাকে একরকম অস্থির করে রেখেছে। মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত নিজে আক্রান্ত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সে মাথা ঠান্ডা রেখেই কথা বলতে পারে। বিপদের আঁচ যখন নিজের গায়ে লাগে তখনই তার মুখ থেকে উফ শব্দটা টের পাওয়া যায়। প্রথমদিন এই মামাই ওকে শান্ত মুখে ডেকে কোচিং এর নালিশ শুনিয়ে বিবাদ মেটাতে পাঠিয়েছিলেন। পরে যখন শিরির দুর্দশা শুনলেন তখনও মামা একরকম স্থিরই ছিলেন আর ছেলেকে ছি ছি করছিলেন। কিন্তু আজ যখন মামি অগ্নিদগ্ধ হয়ে গেলেন তখন আর টেম্পার ধরে রাখতে পারছেন না মামা। এখন তার পলাশকে আবর্জনা মনে হচ্ছে। অথচ মামির গায়ে আগুন লাগার আগেও ছেলেকে কীভাবে সোনা রূপার পানি দিয়ে ধুয়ে পবিত্র করা যায় সেই ভাবনাতেই মগ্ন ছিলেন। রাশেদ শান্ত ভঙ্গিতে মামার দিকে তাকিয়ে বলল, ” তার মানে আপনি বলতে চান পলাশ আজ থেকে আপনার ছেলে না ? ”
-” না, ওকে আমি আমার সম্পত্তি বাড়ি ঘর সব কিছু থেকে বে-দখল করলাম।”
-” কিন্তু এখানেও তো মুশকিল মামা।”
-” আবার কী মুশকিল ? ”
-” মুশকিল এই যে, আমাদের রীতিতে ত্যাজপুত্র নেই। এই আইনও নেই। কাজেই চাইলেও ওকে বঞ্চিত করতে পারবেন না। পলাশ আপনার ছেলে না, এসব বলে দায় এড়াতে পারবেন না আপনি। এখানেও না কাল কেয়ামতের মাঠেও না। আপনাকে ওর পূর্ণ দায় নিতেই হবে মামা। কারণ আজকের পলাশ আপনার ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছে। একটা ছেলেমেয়ে যখন অপকীর্তি শুরু করে তখনই তাকে কঠিনভাবে থামানো উচিত। কিন্তু আপনারা একমাত্র পুত্র বলে মাথায় তুলে রেখেছেন। আজ ত্যাজ্য করবেন কয়েক দিন পর মাথা ঠান্ডা হলে মাফ করে বুকে তুলে নেবেন। কিন্তু ঐ মেয়েটার কী হবে যার চরম সর্বনাশটা আপনার ছেলে করল ? কী ক্ষতিপূরণ দেবেন ঐ বাচ্চা মেয়েটার ? ওদের তো ক্ষতিপূরণ চাইবার সামর্থ্যটুকু নেই। আপনি ছেলেকে বের করে দিলেই গুনাহ থেকে বেঁচে যাবেন না।”
-” তাহলে কী করতে বলিস তুই আমাকে ? ” আমজাদ বিভ্রান্ত বোধ করলেন। তাকে বেশ অসহায় দেখাচ্ছে। রাশেদ মাথা নাড়ল, ” ওকে পুলিশে দিন। ও যা করেছে তার কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। ”
-” পু…পুলিশে দেব ? কী বলিস তুই ? ওর মায়ের এই অবস্থা। তাছাড়া জেল জরিমানা হলে আত্মীয় স্বজন সবাই জানবে। আমার মান-সম্মান…!’
-” এবার লাইনমত কথা বলেছেন মামা। নিজেকে সেইফ রেখে দন্ড দিতে চাইছেন। কিন্তু ত্যাজ্য যে আমাদের আইনে নেই। আমাদের শরীয়তে সন্তানের সমস্ত দায় বাবা-মা’কেই বহন করতে হয়। পলাশ তো এতিম না যে সে যা করেছে তা দেখার কেউ ছিল না। পলাশ যখন পরিক্ষায় নম্বর কম পায় সেই খবর যদি আপনি জেনে নগদে ব্যবস্থা নিতে পারেন তাহলে পলাশ যেদিন প্রথম বাইরে রাত কাটিয়েছে বা বন্ধুদের নিয়ে দরজা বন্ধ করে মুভি দেখেছে সেটারও নগদ ব্যবস্থা নেয়া আপনার উচিত ছিল। কাজেই এই দায় আপনি এড়াতে পারবেন না মামা। আর আমার পক্ষেও লেখাপড়া বাদ দিয়ে প্রতিদিন এত দৌড়ঝাঁপ করা সম্ভব না। গত দু’দিনে এমনিতেই অনেক পিছিয়েছি গিয়েছি আমি। যা ডিসিসান নেবার আজই ফাইনাল করেন। ” আমাজাদ হোসেন বোকার মত বোনপোর দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। রাশেদকে তার ভালমতই চেনা আছে। চাঁছাছোলা কথায় ওস্তাদ। মেজাজও বেশ কড়া। তিনি মামা বলেই হয়ত রয়ে সয়ে কথা বলছে। এর পরের বার ডাকলে ওকে হয়ত পাওয়াও যাবেনা। এদিকে পলাশের মায়ের কাতরানি সহ্য হচ্ছেনা তার। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। অসহায়ের মত বললেন, ” তুই কী করতে বলিস আমাকে। যা করতে বলবি তাই করব।”
-” প্রথমেই তো বললাম পুলিশে দেন। আপনার ছেলের পাছার ছাল ছাড়িয়ে আনি। তারপর বাকি কাজ।”
-” সমাধানের কথা বল বাবা। আমার বুড়ো হাড়ে জোর নেই। থানা পুলিশ করলেই কী তোর ভাই শুধরে যাবে ? ”
-” ওর শোধরানোর চিন্তা আপনার মামা, আমার না। আপনি যদি এখনও না বোঝেন কী করতে হবে তাহলে আমার মনে হয় পলাশকে ওর মত ছেড়ে দেয়া উচিত। প্রতিবার একবার করে ত্যাজ্য করবেন ব্যস্, শাস্তি দেয়া হয়ে যাবে। ”
-” রাগ করিস কেন তুই। বল না কী করব ? ”
-” মামা, আপনি কিন্তু ঐ মেয়েটার কথা একটাবারও জানতে চান নি। মেয়েটা এতিম। বাবা নাই, ভাইও নাই। আপনার মাকাল ফল ছেলের কথার ফাঁদে পড়ে সে নিজেতো মরেছেই পরিবারকেও মেরেছে। ”
আমজাদ হোসেন কিছুক্ষণ নিরব রইলেন। তারপর আস্তে করে বললেন, ” আমাকে ওদের বাড়ি নিয়ে যাবি ? ” রাশেদ থেমে গেল। মেয়েটাকে দেখতে যাবার একটা হালকা তাগিদ নিজের ভেতরও অনুভব করেছে কিন্তু ঐ সাবা মেয়েটার রণরঙ্গিনী মুর্তির সামনে দাঁড়াবার মত যথেষ্ট সাহস কেন যেন নিজের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছে না। এর আগর দু’বার তো নিজেই মেয়েটাকে কড়া কথা শুনিয়েছে। আর এবার নিজেই পুরোপুরি বেকায়দায়। তাছাড়া মামা ওখানে গিয়ে কী করতে চান বা বলতে চান সেটাও তো জানা দরকার। আলটপকা কিছু বলে বসলে রাশেদকে আবার অপদস্থ হতে হবে সাবার সামনে। রাশেদ তা চায় না। সাবার সামনে এরকম বারবার নাকাল হবার কোন ইচ্ছেই ওর নেই। গতকাল বিকেলে রিক্সা ভাড়া ফেরত দেবার কথাটা মনে পড়তেই ভেতরে ভেতরে দুমড়ে মুচে গেল রাশেদ। কতটা ঘৃণা করলে মানুষ ঐভাবে কথা বলে।

বাড়ি ফিরে মোড়ের ডাক্তারখানা থেকে নিজেই কমপাউন্ডার ছেলেটাকে ডেকে এনেছিল সাবা। ওর তত্ত্বাবধানেই চিকিৎসা চলছে শিরির। ছেলেটা এমনিতে ডাক্তার না হলেও বেশ ভাল ডাক্তারিই জানে। প্রাথমিক চিকিৎসা সহ ছোটখাট কাঁটা ছেড়া সেলাই ফোঁড়াই করতে পারে দক্ষতার সাথে। দীর্ঘ কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার দরুণ ছোটখাট চিকিৎসাগুলো নিজেই চমৎকার করতে পারে। ওর ধারণা মতে শিরিকে ডোপিং করে রাখা হচ্ছিল। যার কারণে সে এখনও ঘোর কাটিয়ে উঠতে সময় লাগছে। ওর কথামতই শিরিকে মুখে আঙ্গুল দিয়ে বমি আর হালকা ব্যায়াম করিয়েছিল সাবা। তাতে শিরি চোখ মেললেও নিস্তেজভাবটা কাটেনি। ছেলেটা বারকয়েক অনুরোধও করেছিল শিরিকে ডাক্তারের কাছে নেবার জন্য। কিন্তু সাবা জানে তা সম্ভব না। বাসার সবাই এমনিতেই মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। ফলে নিজেদের অপারগতার কথা জানিয়ে ছেলেটাকেই অনুরোধ করেছিল সাবা যেন সে নিজেই মোটামুটি একটা চিকিৎসা দেয় শিরিকে। এ বাড়ির কেউই শিরির ব্যপারে এখন আর ততটা উদ্বিগ্ন না। সুরমা আপার সোজা কথা শিরি মরে যাক। তবে মিলি আপা এবার তুলনামূলক রাগ কম দেখিয়েছেন। এদিকে মঈন ভাইকেও আজকাল এখানে আসতে দেখা যায় না। সাবা বুঝতে পারছে ওর কথার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই মিলি আপা এই অবস্থান নিয়েছেন। আপাতত মিলি আপা ওর চিন্তার বিষয় না, শিরির কী করা যায় এটা নিয়েই ওর চিন্তা। সত্যি বলতে গত কয়েক দিনে ওর জীবনে কয়েকটা পরিবর্তন ওকে সবকিছু অন্যরকম করে ভাবতে শিখিয়েছে। সেই রাতে ওভাবে বখাটেদের কবলে পড়া আর তা থেকে সসম্মানে ফিরে আসা সেও ঐ কাঠখোট্টা লোকটার বদৌলতে। আবার তারই কাজিনের দ্বারা শিরি এতবড় একটা সর্বনাশ হওয়া যেন সাবাকে অনেকখানি পরিণত করে দিয়েছে। মায়ের উপর রাগ করে লাভ নেই। তিনি একরকম অথর্বই বলা চলে। সুরমা আপা যে তার সংসার ফেলে এটুকু দেখেন তাতেই ওরা কৃতজ্ঞ। বাকি রইল মিলি আপা। জেদ নাকের ডগায় রেখে ঘোরে বলে ওকে কিছু বলতেই মন চায় না। ওর জন্য মঈন ভাইই পারফেক্ট। মেরে ভর্তা বানালেও টুঁ শব্দ করবে না। এদিকে বাবলু আর শিরির ব্যপারে সবার উদাসিনতাই আজ এই পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশে দায়ী। যদিও সবাই সাবাকেই দায়ী করছে কারণ ঐ কোচিং এ ভর্তির কাজটা সাবার একার সিদ্ধান্ত ছিল।

বাড়িতে আনার পর রাত দশটার দিকে শিরির জ্ঞান ফিরেছে। কিংবা হয়ত ঘুম ভেঙেছে। সে চোখ মেলে নিজেকে ঘরে দেখে যথেষ্টই অবাক হযেছিল। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল সাবার দিকে। দৃষ্টিতে লজ্জা মেশানো ভয়। যদিও জানে সাবা মিলি আপার মত না। মিলি আপা হলে এতক্ষণ চড় চাপড় দিয়ে বসতেন। শিরি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গিয়েছিল। সাবাই কথা বলল প্রথমে, ” কী, খুব অবাক হয়েছিস ? ” শুনে শিরি কোনো জবাব দেয় নি। সাবা একগ্লাস দুধ ওর সামনে ধরে বলল, ” এটা খেয়ে নে।”
শিরি বিস্মিত চোখে তাকাল বোনের দিকে। সাবা মৃদু ধমকের সুরে বলল, ” হা করে তাকিয়ে আছিস কেন ? কষ্টের পয়সায় দুধ কিনে এনেছি। এটা খেয়ে নতুন কী নেমকহারামি করবি সেটা চিন্তা কর। আরে মানুষ কুকুর বেড়াল পুষলেও তারা ক্ষতি করার আগে একবার ভাবে। তুই তো মানুষ। কেমন করে পারলি এমনটা করতে ? একটাবার আমাদের কথা ভাবলি না ? এটা মনে হলো না যে আম্মা এটা শুনলে বাঁচবে না মরে যাবে ? ” বলতে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল সাবা।
শিরিও নিঃশব্দে কাঁদছিল। একটু পর শান্ত হলে সাবা বলল, ” আর কান্নার ঢং আর দেখানো লাগবে না। খেয়ে দেয়ে বেঁচে থাক। মা’কে মারতে হবে না ? তোর মত দু’চারটা ছেলেমেয়ে বেঁচে না থাকলে বাপ মায়ের পাপ মোচন কে করবে। আম্মা তো তোরে জন্ম দিয়ে পাপ করে ফেলেছিল যার প্রতিদান এভাবে দিলি।” আর তখনই শব্দটা যেন ছিটকে বেরিয়েছিল শিরির মুখ থেকে।
-” আপু…!” কোনমতে কান্না গিলে বলল, ” আমার কোন দোষ নাই। আমি আসলে পারি নাই। একদম পারি নাই। অনেক চেষ্টা করসি সাবাপু ..!” বলতে গিয়ে মুখ বিকৃত করে হু হু করে কেঁদে উঠল শিরি। সাবা কঠিন স্বরে কিছু বলতে যাবার আগেই শিরি হাতের ইশারায় নিজেকে দেখাল, ” সে আমাকে প্রথমেই এখানটায় ছুঁয়ে দিয়েছিল। আর আমি নিয়ন্ত্রণ হারালাম। ঠিক যেন একটা ইঞ্জেকশান পুশ করলে মানুষ নেতিয়ে যায় সেভাবেই আমি নেতিয়ে গেছি। তার ঐ স্পর্শটুকু আমাকে বিশ্বসংসার ভুলিয়ে দিয়েছিল আপু। ”
-” তোর বিশ্বসংসার ভুলিয়ে দিয়ে সে নিজে তো ঠিকই হুঁশে ছিল। এ কেমন স্বার্থপরতা। ভুললে দুজনই ভুলবি। তুই একা কেমনে ভুললি আর সে কেন হুঁশে থেকে ছড়ি ঘুরাইল ? ”
সাবা চাপা ধমকের সুরে কথাগুলো বলেও হঠাৎ থেমে গেল। এমনিতেই সারা সন্ধ্যা ওদের পরিবারের ওপর দিয়ে ঝড় গেছে। মিলি আপার আচরণটা আজ সুরমা আপা করেছে। পায়ের স্যান্ডেল খুলে ইচ্ছামত পিটিয়েছে এই অর্ধোচেতন শিরিকেই। তাকে বড় দুলাভাই টেনে না ধরলে সে আজ শিরির গলা টিপে মেরেই ফেলত। মিলি আপা সেই ঘে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, আর কোন কথাই বলেনি সে। আম্মা তার নিজের রুম থেকে উঠে আসেন নি কেবল একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন কী খাইসে না খাইসে জিজ্ঞেস কর। এ পর্যন্ত বলেই তিনি আর কোন কথা বলেন নি। তার ওপর সাবাদের একমাত্র চাচা হানিফ আহমেদ এসে যা তা বলে গেছেন ওদেরকে। তার এই ভাইয়ের পরিবারের কারণে আজ নাকি তার নাক কাটা গিয়েছে। তিনি আজ থেকে সাবাদের সাথে কোন সম্পর্ক রাখবেন না বলেও ঘোষণা দিয়ে গেছেন। বলেছেন, মানুষ জিজ্ঞেস করলে বলবেন, তার কোন ভাই নাই তাই ভাই এর পরিবারও নাই। সাবা, মিলি তখন সামনেই দাঁড়িয়েছিল। শিরি সহ ওদের মা’কেও তিনি জাহান্নামের কীট বলে অভিহিত করে গেছেন। সাবা কিছু বলেনি। মুখ নিচু করে সেসব শুনেছে। কেবল মিলি আপা শেষের দিকে আর থাকতে না পেরে বলে বসেছিল ” আমাদের মতো নরকের কীটের চাষাবাদ তো আপনার মত পাতি মুসলিমরাই করে। যাদের লেবাস থেকে আতরের ঘ্রান বের হয় ঠিকই কিন্তু রূহ থেকে বের হয় জাহান্নামের গন্ধ। যারা মৃত ভাইয়ের বিধবা আর এতিমদের খোঁজ রাখার প্রয়োজনটুকু বোধ করেনা। কাজেই আমার বাবার অবর্তমানে আমাদের দেখাশোনার দায়িত্ব কতটুকু পালন করেছেন সেই হিসাব করে তারপর কথা বলতে আইসেন চাচা। আমরা তো সবসময়ই নরকের কীট। আপনি কোন জান্নাতের ফুল সেটা পারলে জানায়েন। আপনাদের মত দায়িত্ব এড়ানো মুসলমানদের কোন দরজা দিয়ে জান্নাতে ঢুকতে দেয় নামটা একটু জানা দরকার। পারলে একটু কষ্ট করে জানাবেন। ” এ পর্যন্ত বলার পরই চাচাজান ছোটলোক, বেয়াদব বলে বেরিয়ে গেছেন।

===

রুৎবার বাড়িতে আজ বিরাট আনন্দায়োজন। তার আদরের সায়রার বিয়ে। পেয়ারী মির্জা আজ তার মনের কথাটি চায়ের টেবিলে অকপটে বলে গেছেন। কথাটা জানার পর সিদ্ধান্ত নিতে রুৎবার দশ মিনিট লেগেছে। সায়রার সাথে কথা বলার আগেই তিনি বারসাতকে কল করেছেন। বারসাতের দিক থেকে সব ঠিক আছে কি না জানার জন্য। বারসাত কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলেছে, সায়রার কী মত আন্টি ? ”
-” বেটা, উসকি ছোড়ো। তুম বোলো।” রুৎবার গদগদ কণ্ঠ শুনে বারসাত হেসেছে আর তুষারপাতের শব্দে বলেছে ‘ ইয়েস ‘!
-” শোকর আলহামদুলিল্লাহ ! ” বলেই রুৎবা ঐ পায়েই বাংলাদেশে ফোন করে বোন আর বোন জামাইকে সব জানিয়ে দিয়েছেন। এও বলতে ভুলেননি যে পেয়ারী মির্জা সায়রাকে অসম্ভব পছন্দ করেছেন তার বারসাতের জন্য। কাজেই রুৎবার ইচ্ছে, এটাকে অনর্থক ফেলে না রেখে একটা পর্যায়ে আনতে হবে। অন্তত আকদটা হয়ে যাক। বাকি যা করার সেসব মেয়ে তুলে দেবার সময় করা হবে। সামনে সায়রার পরীক্ষা আছে। কাজেই এখন কেবল রাজামান্দি। রোকায় কোনো ভরসা নাই। ছেলেমেয়ে লুকিয়ে কথা বলবেই, ঠেকানো যাবেনা। ব্যপারটা হারাম পর্যায়ে যেন না যায় তাই আকদ। সব শুনে আমির সানা মত দিয়েছেন। মেযের সাথে কথাও বলেছেন। সায়রা তার সাথে কথা বলার সময় শুধু কেঁদেছে আব্বু আব্বু বলে। কিন্তু কিছু বলতে পারেনি। তবে সায়রাকে কোনভাবেই নীলিমার সাথে কথা বলানো যায়নি। রুৎবাও আর বাড়াবাড়ি করেনি। বারসাত নিজেই জানিয়েছে, আকদটা হয়ে যাক, সে নিজেই সায়রার সাথে শ্বাশুড়ি আম্মার কথা বলিয়ে দেবে। তার নতুন দুলহান নিশ্চয়ই তার প্রথম অনুরোধ ফেলবে না। এ বিশ্বাস বারসাতের আছে। মুশকিল হল, সায়রা গতকাল থেকে ওর ফোনটা রিসিভ করছে না। কথাটা রুৎবা আন্টিকে বললে তার ফোনেই পাওয়া গেল সায়রাকে।
বারসাত কিছুটা ধমকের সুরেই বলল ” এ কেমন অভদ্রতা সায়রা ? ”
-” কী কেমন অভদ্রতা? ”
-” ফোন দিলে ফোন ধরছেন না, এটা কী তবে ভদ্রতা ? ”
-” এখনও আপনি আমার জন্য গ্যায়র মাহরাম।”
-” ও, রিয়েলি ? তা ঢাকা টু দার্জিলিং যে মাহরাম ছিলাম এটা আগে বলবেন তো। সুযোগটা মিস করলাম। ইস্। ”
-” কিসের সুযোগ ? ” সায়রা লাল হল।
-” এবার কিন্তু আমাকে খোঁচানো হচ্ছে। বলব কিসের সুযোগ?”
-” রাখি।” সায়রা তাড়াতাড়ি বলে উঠলে বারসাত রেগে গেল এবার।
-” ফোন রাখলে ভাল হবেনা বলে দিলাম। আপকি শামাত আযায়েগি।”
-” আনে দো।”
-” রিয়েলি ? ”
-” হঠাৎ এত ক্ষেপলেন কেন ? এত জেন্টেলম্যান আপনি। ”
-” আপনার ছবিটা দেখে।”
-” বাহ্, আমাকে সবরের এত এত নসীহত করে এখন এই অবস্থা ?”
-” ফোনে কথা বললে কী হয়? ”
-” সবর নষ্ট হয় বারসাত।” সায়রা আস্তে করে বললে বারসাত লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
– ” হম, রাইট ইউ আর। ওকে। আপনার সবরের পরীক্ষা আর নেব না। কাল সন্ধ্যায় দেখা হবে। একদম নতুন পরিচয়ের সাথে। ”
-” ইনশাআল্লাহ।” সায়রা বলল, আস্থার সাথে। বারসাতও তার প্রতিধ্বণি তুলে ফোন রেখে দিল।

[আর একটা পর্ব দিয়েই ত্রয়ীর ১ম খন্ডের আপাতত সমপ্তি টানব। ২য় খন্ড শুরু করার আগে পাঠকদের জানিয়ে দেব ইনশাআল্লাহ। এই গ্রুপেই পাবেন সেটা ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here