ত্রয়ী পর্ব ২৬

0
1466

ত্রয়ী
মোর্শেদা হোসেন রুবি
২৬||

সাবা মুখ নামিয়ে বসে আছে। মাথার ভেতরটা হঠাৎ করেই কেমন যেন হালকা লাগছে। পুরো ব্যপারটা যেভাবে ভেবে রেখেছিল ঘটনা সেদিকে যাচ্ছেনা। কেমন করে যে এক কথায় দু’কথায় পরিস্থিতি বদলে এমন হয়ে গেল বুঝতেই পারেনি সাবা। বাদল স্যার ওর মতামত না নিয়ে ফট করে সব বলে দিলেন আর নিজের মত করে জেরা করা শুরু করে দিলেন। পলাশ তখন থেকেই নাস্তানাবুদ প্রায়। জানোয়ারটা মুখ তুলে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। বিশেষ করে বাদল স্যারের শোষোক্ত কথাটার পর বেয়াদবটার অবস্থা জোঁকের মুখে নুন পড়ার মত হয়েছে। তবে বাদল স্যার এরপরে আর ক্লাসে যান নি। পলাশের কোন এক ভাই এর জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি। সাবা হাত দুটো কোলের ওপর রেখে বসে আছে চুপচাপ। মাঝে মধ্যেই তর্জনী দিয়ে চোখের কোন মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করছে। নিজের মনেই ভাবতে বসল সাবা, বাদল স্যার যদি এখন পলাশকে চেপে না ধরতেন। সাবার কথামত পুরো ব্যপারটা চেপে যেতেন তাহলে যা হতো তা হলো , পলাশ বেতন নিয়ে বেরিয়ে যেতো আর সাবা পলাশের পিছু পিছু হাঁটতে থাকত। অবাস্তব না হলেও সম্পূর্ণ ছেলেমানুষি একটা কল্পনা। এভাবে কতদুর যেতে পারত সাবা। তাছাড়া পলাশ নিশ্চয়ই সোজা শিরির কাছেই যেত না। সাবা কী সারাদিন ওর পিছু নিয়ে ঘুরতে পারত ? অসম্ভব একটা ব্যপারকে কল্পনা করে আজ এতদুর এসেছে সাবা। অথচ ব্যপারটা যে কতটা হাস্যকর তা এই মুহূর্তে টের পাচ্ছে সাবা। পলাশ সহজ ছেলে না। এই ছেলে ঘুণাক্ষরেও টের পেলে ওর পিছু লাগা তো বন্ধ করতোই উল্টো বিপদেও ফেলে দিতে পারত। অন্তত একটু আগে পলাশের কথা বলার ধরণেই মনে হয়েছে ছেলেটা নির্দয় প্রকৃতির। সে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকেই সাবার দিকে কয়েক বার তাকিয়েছে। চাহনীটা এত ভয়ংকর ছিল যে সাবা শিউরে উঠেছে। সেই থেকে তাকানো বন্ধ রেখেছে ওর দিকে। আল্লাহই জানে এর ভাই আসলে আবার কোন একটিং শুরু করে অমানুষটা। ভাই তো নিশ্চয়ই এর সাপোর্টই করবে। চিন্তায় সাবার কলজে শুকিয়ে এল।
-” আস্সালামুআলাইকুম বাদল ভাই। ” দরাজ কণ্ঠে কাউকে সালাম দিতে শুনে চমকে তাকাল সাবা আর নিজের জায়গাতেই জমে গেল। হায় হায়, এ তো তোয়ার ভাইয়ের সেই দাড়িওয়ালা বন্ধুটা। সেইদিন সায়রার বিদায় দিতে গিয়েই তো এর সাথে মার্কেটে দেখা। দিন কোথায় ওটা তো রাত ছিল। সাবা মনে মনে এবার প্রমাদ গুনল। সর্বনাশের ষোলোকলা বাকি ছিল, এবার পূর্ণ হল। মনে পড়ল লোকটার বলা শেষ কথাটা। এরপর আর যদি কখনও এমন পরিবেশে দেখি তাহলে আপনাকে খুব খারাপ মেয়ে ভাবব। আর আজও সেটাই হল। লোকটার সাথে এ পর্যন্ত যতবার দেখা হয়েছে প্রতিবারই একটা ঝামেলাযুক্ত পরিবেশে। প্রথমবার তোয়ার বাসায় যাবার সময় দেখা হল রাস্তায়, একদল বখাটের মাঝখানে, দ্বিতীয়বার দেখা হল সায়রার সাথে দেখা করতে যাবার রাতে, মৌচাক মার্কেটে। আর আজ ? নিজের বোনের অপকীর্তির সাথে জড়িত একটা ছদ্মবেশী ছেলের সাথে। এই লোক তো আজ সরাসরিই বলে বসবে যে সাবা একা নয় ওর পুরো ফ্যামিলিই আসলে খারাপ। মুখে না বললেও মনে মনে ভাববে। সাবা নিজেকে প্রানপণে সামলাতে লাগল। নিজেকেই বারবার শাসাতে লাগল, সাহস হারাবিনা সাবা।

-” কী নাম যেন তোমার ? ” বাদল স্যারের ডাকে সম্বিত ফিরল সাবার। মুখ তুলতেই দেখল লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নিরব নির্লিপ্ত চাহনী। পূর্ব পরিচিতের লেশমাত্র নেই সে চাহনীতে। যেন বাদল স্যারের কথাতেই তাকিয়েছে।
-” জি, সাবরিনা সুলতানা। ” সাবা দ্রুত বলে উঠল।
-” আমাকে তো সেদিন এই নাম বলোনি।”
-” মানে, সাবা।” বলতে গিয়ে ফের দাড়িওয়ালার দিকে তাকাল। লোকটা চোখ সরিয়ে নিয়েছে ততক্ষণে। টেবিলের ওপর রাখা পেপার ওয়েটটা দেখছে মনোযোগ দিয়ে। যেন ওটার ডিজাইন নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন তিনি।
-” ইয়েস, সাবা। ছোট বোনের নাম শিরি।” বলে বাদল স্যার বন্ধুর দিকে মনোযোগ দিলেন, ” বুঝলে রাশেদ। এটা ঐ মেয়ের বড় বোন। আর ঘটনা তো তোমাকে আমি গতরাতেই ফোনে সব বলেছি। পলাশ তোমার কাজিন। আমি পলাশের চেয়েও বেশি চিনি তোমাকে । তোমার রেফারেন্সেই পলাশকে এখানে কাজের সুযোগ করে দেয়া। এর মধ্যে এরকম একটা ব্যপার ঘটে গেল। কী করবে এটার করো। আমি ততক্ষণে একটু ক্লাসগুলো ঘুরে আসি। তুমি ওদের সাথে কথা বল।” বলেই বাদল স্যার সাবার দিকে তাকালেন। পরিচয় করানোর ভঙ্গিতে বললেন, ” মিস সাবা, এটা আমার ভাই এবং বন্ধু রাশেদ। আমরা একই গ্রামের ছেলে। একই স্কুলে পড়াশোনা করেছি। শহরে এসে কলেজে ভর্তির পর দুজন দু’দিকে। ও কিন্তু হাফ ডাক্তার, মানে ডাক্তারি পড়ছে। হস্টেলে থাকে। খুবই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। এমনিতে বয়সে আমি ওর বছর দুয়েকের সিনিয়র হলেও আমরা ভাল বন্ধু। পলাশ ওরই কাজিন। কাজেই তুমি তোমার বোনের ব্যপারটা নিয়ে ওর সাথে সরাসরি কথা বল। কেমন ? আমি ভেতরটা হয়ে আসি।” বলে রাশেদের দিকে তাকালেন বাদল স্যার।
বাদল স্যার ক্লাসের দিকে চলে গেলে সাবা দারুণ সংকোচ নিয়ে মুখ নামিয়ে ফেলল। চোখ তুলে তাকাতেও সাহস হচ্ছেনা। মনে মনে ঢোক গিলল। বোঝাই যাচ্ছে লোকটা ধমক ধামক দিয়ে দুর্বল করে দেবে ওকে। হাজার হোক নিজের ভাই বলে কথা। তার উপর সাবা তার চোখে দেখা সেই মেয়ে যাকে সে সবসময় অজায়গায় দেখে আসছে । আর আজকের ঘটনার পর তো সাবা তার কাছে খারাপ দি বেস্ট বলে গণ্য হবে। আজ থেকে শুধু সাবা খারাপ না সাবার পুরো পরিবার হবে খারাপ। বলবে এর ছোটবোনও এই পদেরই। কথাটা ভাবতে গিয়ে মনে মনে দমে গেল সাবা। আর তখনই শুনল রাশেদ লোকটা কথা বলছে। সাবা তাকাল।
রাশেদের চোখ পলাশের দিকে। সে পলাশকেই প্রশ্ন করছে।
-” কী হয়েছে ঠিক করে বল। পুরো ঘটনা বলবি। স্কিপ করবি না আর মিথ্যেও শুনতে চাই না।”
পলাশ আমতা আমতা করে বলতে লাগল, ” আরে, তেমন কিছুই হয় নাই। বাদল ভাই সাসপেক্ট করতেসে মানে…আমার কোন্ স্টুডেন্ট নাকি মানে…আমি তো কিসুই বুঝতেসিনা। কোথায় কে কী করল, আমাকে এটা সেটা বলে ডাকল আর এখন তার দায় আমাকে নিতে বলছে। আমি এর দায় নেব কেন। জাস্ট ইরিরিটেটিং।” পলাশ স্মার্টলি উত্তর দেবার চেষ্টা করলেও ওর কণ্ঠের দুর্বলতা লুকানো যাচ্ছেনা।
-” খবরদার, একদম বাজে কথা বলবেন না। আপনি দায়ী। আমি সব জানি। আপনিই সেই ক্রিমিনাল। ” প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠল সাবা। রাশেদ আর পলাশ তো বটেই সাবা নিজেও চমকে গেল নিজের আচমকা প্রতিক্রিয়াতে। সত্যি বলতে, পলাশের ভন্ডামী এতক্ষণ যাওবা সহ্য হচ্ছিল কিন্তু বাদল স্যারের কথা গুলোর পর ওর দ্বিধা পুরোপুরি কেটে গেছে। পলাশ ভাল ছেলে হলে বাদল ওর ভাইকে ডাকাতেন না। এটকু বোঝার বুদ্ধি সাবার আছে। কাজেই এখন আর লুকোনোর কোনো মানে নাই। সাবার আচরণে পলাশ নিজেও অবাক। এতক্ষণ ধরে মিউ মিউ করা বিড়াল হঠাৎ এমন হালুম করে উঠবে হয়ত ভাবে নাই। রাশেদ শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে সাবার দিকে। কথা বলতে গিয়ে সাবার চোখ ভরে গেছে পানিতে। প্রথমদিন বাদল স্যারকে যা বলেছে তার সবটাই ফের বলতে লাগল সাবা। হারামজাদাকে যখন গার্জেন সহ পাওয়া গেছে সে আর দ্বিধা করবে কেন। পরে হয়ত এমন সুযোগ নাও আসতে পারে। সাবা এবার সরাসরি আঙ্গুল তাক করল পলাশের দিকে।
– ” আপনি আমার বোনকে ফুসলিয়ে তার সাথে বন্ধুত্ব গড়েছেন। তাকে অকারণে বেশি এটেনশন দিয়ে তার মনে ফ্যান্টাসির জন্ম দিয়েছেন। নইলে কোন্ টিচার আছে যে বিনা স্বার্থে ঊনচল্লিশটা স্টুডেন্ট বাদ দিয়ে কেবল একজন স্টুডেন্টকে পারসোনালি সময় দেবে ? বলুন ? তাকে আলাদা ক্লাস নেয়া আবার রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাওয়ানো ? এসবের মানে কী ? ভাইয়ের সামনে স্বীকার করুন। আপনি এসবই করেছেন। আমার কোমলমতি বোনটাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছেন। এখন আবার ন্যাকামী দেখাচ্ছেন ? ” সাবার ভেতরের রাগটা ফুঁসে বেরোতে চাইছে। পলাশ রেগে গেল। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল, ” এই মেয়ে বেশি কথা বলবেনা। তোমার বোন এমনিতেই ধান্ধাবাজ। সে গায়ে পড়ে টিচার আর স্টুডেন্ট সবার সাথে আলগা খাতির দেখায়। নির্লজ্জ বোন নিয়ে ফুটানি কত। নিজের বোনকে সামলাও বেয়াদব মেয়ে।” এতটুকু বলার ছিল, তাতেই সাবা রীতিমত জ্বলে উঠল বারুদের মত। চিৎকার করে উঠল সে, ” সামলেই রাখতাম যদি জানতাম তোর মত জানোয়ার এখানে আছে। আগে আমার বোনকে ফেরত দে তুই ! ফেরত দে আমার বোনকে ! ” সকল ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে হিস্টিরিয়া গ্রস্তের মত চেঁচাল সাবা। রাশেদের দিকে তাকাল। একইভঙ্গিতে বলতে লাগল, ” আপনার ভাইকে বলুন সে আমার বোনকে যেন ফেরত দেয়। জিজ্ঞেস করুন ওকে সে কোথায় আটকে রেখেছে শিরিকে। সে সমানে মিথ্যে বলে যাচ্ছে ! ” সাবা ঝরঝর করে কাঁদছে।
-” একদম তোর গাল ফাটিয়ে ফেলব ছেমড়ি। ” পলাশ চড় মারার ভঙ্গিতে হাত তুলে দাঁড়িয়ে পড়ল। সাবাও কম যায় না। ভেতরের রাগ যেগুলো সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মত ঘুমিয়ে ছিল ভেতরে সেই রাগগুলো হঠাৎ করেই অগ্ন্যুৎপাত ঘটাতে শুরু করল। সেও সমান তেজে জবাব দিলো, “আয়, আমার জুতা ছিঁড়ব আজ তোর মুখে বদের হাড্ডি। তুই গাল ফাটালে আমারও হাত আছে। স্যান্ডেল পেটা করব তোকে আমি। ইতর, কামুক, নারীলোভী। পাচারকারী দলের দালাল। তোকে রেস্টুরেন্টেই সাবধান করেছিলাম সেদিন। তুই শুনিস নাই। তুই এসব ধান্ধাই করিস। এখন আমি বুঝতে পারছি। তুই এক নম্বরের লম্পট। ” সাবার যা মনে এল রাগে তাই বলতে লেগে গেল ও। রাশেদ থমথমে মুখে দুজনেরই তীর্যক বাক্যালাপ দেখছিল। সে ঠিক করেছে একটা পর্যায় পর্যন্ত দুজনকে বাধা দেবেনা। কারণ দুজনের এসব কথোপকথনে অনেক সত্য সামনে চলে আসবে যেটা এতক্ষণ ধরে দুজনই ভদ্রতার চাদরে ঢেকে রেখেছিল। আচমকা পলাশকে সাবার দিকে তেড়ে যেতে দেখে রাশেদের পক্ষে আর নিরব থাকা সম্ভব হলো না। সে চট করে উঠে সাবাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে গেল। পলাশ রাগে গনগন করছে। পারলে যেন সাবাকে তখনই মারে। রাশেদ ধমকাল, ” এ্যাই, তুই কী শুরু করেছিস ? এতক্ষণ ধরে যে আমি জিজ্ঞেস করছি তোর কানে যায় না। এখন এই মেয়ের সাথে মারামারি শুরু করেছিস ?”
-” মারাই উচিত এদের। থার্ড ক্লাস ফ্যামিলির সব আবর্জনা।”
-” আমি থার্ড ক্লাস ফ্যামিলি হলে তুই ফিফথ ক্লাস ফ্যামিলির। তার চেয়েও জঘন্য। ” সাবা চেঁচাল।
-” আহ্, আমাকে কথা বলতে দিন।” রাশেদ ঘাড় ফেরাল। সাবা থেমে গেল।
-” এখন বল এর বোনের সাথে তোর কী সম্পর্ক? ” রাশেদ ধমকাল।
-” আরে কী রাশেদ ভাই। এর বোনরে আমি ভাল করে চিনিনা পর্যন্ত। মাত্র দুই তিন মাস ক্লাস করসে। এভাবে কী কাউকে চেনা যায় ? ”
-” একদম মিথ্যে কথা। ডাহা মিথ্যে কথা। ” পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলে রাশেদ ফের হাত তুলে থামাল ওকে। ” আপনি বসুন প্লিজ, আমি কথা বলছি। একটা সাউন্ড করবেন না। পলাশ তুইও বস। এবার আমি যা জিজ্ঞেস করব তার পরিস্কার জবাব দিবি। নইলে তোর খবর আছে। তুই কী এর বোনকে চিনিস না বলতে চাস ? সাবধানে জবাব দিবি কিন্তু , তুই যা বলবি আমি সেটাই সত্যি বলে ধরে নেব।” রাশেদকে সিরিয়াস দেখাল। পলাশ কিছুটা আমতা আমতা করে বলল, ” আলাদা করে চিনিনা। এমনি ক্লাসের স্টুডেন্ট হিসেবে চিনি।”
-” হম । তুই কী ঐ মেয়ের আলাদা ক্লাস নিয়েছিস ? ”
-” আরে আমি তো এমন অনেক দুর্বল স্টুডেন্টের ক্লাস নিয়েছি। ওর বোনের আলাদা নেব কেন?”
-” সে কারণেই ভাল করে চিনিস না তাই তো ? ”
-” হ্…হ্যাঁ, এরকমই। চিনিনা মানে ঐভাবে জানিনা। বাই ফেস চিনি আরকি।”
-” তার মানে তাকে ভালোভাবে জানোস না কেবল বাই ফেস চিনোস? তাই তো ? কথা ক্লিয়ার কর পলাশ।”
-” হম। হুম। ” পলাশ খেই না হারানোর প্রানপন চেষ্টা করছে।
-” তো এমন অজানা অচেনা একজনকে নিয়ে হোটেলে চা সিঙ্গারা খেতে গেসিলি কী মনে করে ? ” রাশেদ প্রশ্ন করছে শান্ত গলায় কিন্তু ওর রাগটা চাপা থাকছে না। রাশেদের মুখ লালচে দেখে ঘামতে লেগেছে সে। রাশেদের মেজাজ সম্পর্কে ওর ভাল করেই জানা আছে। সে এমনিতে খুব শান্ত তবে রেগে গেল তাণ্ডব ঘটিয়ে দেয়।
পলাশ এবার ভিন্ন রাস্তা ধরল,
-” রাশেদ ভাই শোনেন, আমি আপনাকে বলি। আমার একটা বাজে অভ্যাস হল সব ছাত্র ছাত্রীর সমস্যাকে নিজের সমস্যা মনে করি। এই মেয়ের বোন নিজে আমার কাছে পড়া বুঝতে চেয়েছে তাই আমি ইগনর করিনি। আর হোটেলের চা সিঙ্গারা ? ঐদিন আমার সাথে ওর পথেই দেখা হয়ে যায়। আমি চা খেতেই যাচ্ছিলাম। ঐ মেয়ে তখন নিজেই আমাকে বলল সে ঐদিন দুপুরে ভাত খাবার সুযোগ পায়নি আর তার নাকি খুব খিদে পেয়েছে। এরকম করে কেউ বললে কাউকে মানা করা যায় আপনিই বলেন। ”
-” তারমানে এর বাইরে ঐ মেয়ের ব্যপারে আর কিছুই জানিস না তুই ? ” সাবা পাশ থেকে কিছু বলতে চাইলে রাশেদ তাকে হাত দেখালে সে থেমে গেল। পলাশ মাথা নাড়ল।
-” না। ঐ মেয়ের ব্যপারে আর কিছুই জানিনা।” একগুয়ের মত করে বলল পলাশ। রাশেদ মাথা নাড়ল, ” ওকে। তোর মোবাইলটা একটু দে তো দেখি।”
-” আমার মোবাইল ? কেন ? ” পলাশ অজান্তেই বুক পকেটে হাত দিয়ে চাপা দিল। যেন যক্ষের ধন আগলাচ্ছে।
-” কেন, মোবাইল দিতে কী সমস্যা ? ”
-” মোবাইল আমার পার্সোনাল জিনিস। আপনি নেবেন কেন ?”
-” পলাশ, তোকে একটা কথা বলি। তুই স্বীকার করিস আর না করিস। যেহেতু ঐ মেয়েকে জড়িয়ে তোর নামে ব্লেম উঠেছে। ব্যপারটা এখন পুলিশ পর্যন্ত গড়াবে। আর এখন তো আমি নিজেও এখানে ইনভলবড হয়ে গেলাম। এই মেয়ের পরিবার তোরে পুলিশে না দিলেও আমি তোরে পুলিশে দেব। রাতে বাদল ভাইয়ের মুখে আমি সব শুনেছি। তোর সম্পর্কে তার রিপোর্ট এমনিতেও ভাল না। তাই আমি এখানে আসার আগে আমজাদ মামার সাথে কথা বলে এসেছি । তিনি পুরো ব্যপারটা আমার উপর ছেড়েছেন। এত কিছুর পরও যদি সত্য জানার জন্য পুলিশের দ্বারস্থ হতে হয় আমি হব। আর সেক্ষেত্রে জিনিসটা তোর জন্য খুব খারাপ হয়ে যাবে। কতটা খারাপ তোর ধারণাতেও নেই। কারণ যে মেয়েটাকে পাওয়া যাচ্ছে না সে একজন নাবালিকা। আর নাবালিকা অপহরণের মামলা নারী-শিশুর কঠিনতম মামলার একটি। কেবল সন্দেহের কারণেই তুই জেলে যাবি। মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত যতদিন বিচার চলবে ততদিন জেলে থাকবি। এটুকু হলেও কথা ছিল না। তোর কারণে তোর বাবা মা’ও এরেস্ট হয়ে যেতে পারে যদি তুই কোন চালাকি করার চেষ্টা করিস তো। কাজেই তুই এতে জড়িত না কী জড়িত না সে বিচার পরে আগে তো সন্দেহ নিরসন। আর পুলিশের সন্দেহ নিরসন তুই ভালোই বুঝিস। এই মেয়ের জোর সন্দেহ তোর দিকে। আর তোর ফেঁসে যাবার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। কী করবি ভেবেচিন্তে বল।” পলাশ এবার দ্বিধাদ্বন্দে দুলতে লাগল। আর হঠাৎ করে উঠেই রাশেদের হাত ধরে টেনে পাশের ঘরে নিয়ে গেল ওকে। সাবা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল নিজের জায়গায়। ওর মনে হল, এতবড় একটা ম্যাটার হ্যান্ডেল করতে ওর একা আসা মোটেও উচিত হয় নাই। বড় কাউকে আনা উচিত ছিল। এখানে যদি দুই ভাই প্ল্যান করে কিছু করে আর সাবাকে মিথ্যাবাদীদের দলে ফেলে দেয় তাহলে সাবার কিছু করার থাকবেনা। ওর কী মঈন ভাইকে ডাকা উচিত ? ভাবতে ভাবতেই ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করল সাবা। মঈন মিলি দুজনের নাম্বারের ওপর দ্বিধান্বিত আঙ্গুলটা ঘোরাফেরা করতে করতেই প্রবল চড়ের শব্দ কানে এল। সাবা চমকে পাশের ক্লাসের দিকে তাকাল। এরপর আরেকটা শব্দ। সাবার বুকের ধ্বক ধ্বক শব্দ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ঐ রূমে সমানে চড়াচ্ছে রাশেদ পলাশকে। সেই শব্দে বাদল স্যারকে আসতে দেখা গেল। একটু পর বাদল স্যার আর রাশেদকে দেখা গেল কথা বলতে। পলাশকে দেখা যাচ্ছেনা। সাবা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ পর তিনজনই এ রুমে এলো। পলাশের গালে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ দেখে বোঝা যাচ্ছে চড়গুলো ওকেই মারা হয়েছে। চোরের মত মুখ নামিয়ে রেখেছে সে। রাশেদ কিছুক্ষণ ভেবে সাবাকে সরাসরি বলল , ” আপনার সাথে বড় কেউ আছে ? ”
” জি না। কেন ? ”
-” কাউকে ডাকাতে চান ? দেখুন, আমার সোজাসাপ্টা কথা। আপনার বোনের সন্ধান পাওয়া গেছে। আমি এখন সেখানে যাব ওর সাথে। আপনি চাইলে বড় কাউকে সাথে নিতে পারেন।”
-” শিরির কাছে যাবেন ? আমি যাব আপনার সাথে।” সাবার চেহারা জ্বলে উঠেই নিভে গেল রাশেদের পরের কথা শুনে, ” আপনাকে নিয়ে একা যেতে দ্বিধা আছে আমার। আপনি নিজেও তো নাবালিকা। আপনার ফ্যামিলিতে বড় কেউ নেই ? বাবা, বড় ভাই বা এরকম কেউ ? ”
-” থাকলে কী আজ আমাদের এরকম দুর্দশা হয় ? ” সাবার হঠাৎ করেই যেন ভীষণ কান্না পেল।
রাশেদ কিছুটা বিব্রত বোধ করল, ” আচ্ছা, ঠিকআছে। চলুন। ”
কোচিং থেকে বেরিয়ে দুটো রিক্সা নিল ওরা। প্রায় পনের বিশ মিনিট পর একটা বস্তিমত জায়গায় এলো তিনজনে। সামনেই কিছু দোকানপাট তারপর একটা প্লাস্টিকের কারখানা। তার পাশের গলি দিয়ে ওরা যেখানে এসে থামল সেখানে কয়েকটা কাঁচাপাকা ঘর আছে। তার একটাতে নক করল পলাশ। কেউ দরজা খুললো না। পলাশ ফ্যাকাশে হেসে আরো কয়েকবার নক করল। রাশেদের সন্দেহ হলে সে এগিয়ে গিয়ে জোরে কয়েকবার নক করে পলাশের দিকে তাকাল, ” কী ব্যপার মেয়ে দরজা খোলেনা কেন? কী করছিস তুই ওরে ? ”
-” আরে আমি কী করব, সে ঘুমাইতেসে হয়ত।”
-” এ কেমন ঘুম যে শব্দ পায় না ? ”
-” হেয় এমুনই। হারাদিন গুমাইয়্যা থাহে। কেউর লগে মিশে না, রান্দে না বাড়ে না কতা কয় না। বিহান বেলায় নাহায়া ধুইয়া হেই যে দরজা বন করে আর খুলে না। ” রাশেদ তাকিয়ে দেখল একটা অল্পবয়স্কা কিশোরী কথা বলছে। পরনের শাড়িটা মলিন। কোলের শিশুটা যদি ওর হয়ে থাকে তাহলে অবাক হবেনা রাশেদ। সাবার দিকে তাকাল। মেয়েটা শব্দ করছেনা বটে তবে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে সমানে। এক পর্যায়ে দরজা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিল রাশেদ। শুনেই পলাশ মিনমিন করল, ” বাড়িওয়ালা রাগ করবে শুনলে। ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।”
-” দিতে হলে তুই দিবি। ” চোখ গরম করে বলল রাশেদ। অবশেষে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে যাকে দেখল তাকে চিনতে পারল না সাবা। একটা জীবন্ত কঙ্কাল ঢোলা একটা ম্যাক্সি পড়ে মাটিতে অচেতন পড়ে আছে। সারা দেহে কোন সাড় নেই তার। সাবা ছুটে গিয়ে শিরিকে ধরল। চিৎকার করে ডাকল। ধাক্কা মেরে জাগানোর চেষ্টা করল। সমানে ঝাঁকাল বারকয়েক। কিন্তু শিরির সাথে একজন মৃত মানুষের পার্থক্য এতটুকুই যে শিরি সন্ধ্যার পর পর জেগে উঠতে পারে। সারাদিন সে মৃতের মত ঘুমায়। পলাশের দেয়া অষুধের প্রতিক্রিয়াটাই এমন। রাশেদের সাহায্য নিয়ে শিরিকে রিক্সায় তোলা হল। শিরিকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পলাশের ব্যপারে প্রতিক্রিয়া দেখানোর সুযোগ পেল না সাবা। কিন্তু রাশেদ রিক্সাওয়ালার হাতে ভাড়া গুঁজে দিতে গেলে সাবা হঠাৎ কঠিন কণ্ঠে বাধা দিল রিক্সাওয়ালাকে ” এই যে, ওনার টাকা ওনাকে ফিরিয়ে দিন ভাই। ” বলে রাশেদের দিকে তাকাল, ” আপনাদের অনেক দয়া। আর দয়া দেখাবেন না। ভাইকে বাসায় নিয়ে যান আর ডিম দুধ খাইয়ে মোটাতাজা বানিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেন যেন আরেকটা মেয়ের সর্বনাশ করতে পারে। ” বলেই সাবা অগ্নিঝরা চোখে পলাশের দিকে তাকাল, ” আজ আমার ক্ষমতা নেই বলে তুই বেঁচে গেলি কিন্তু তোর এই জুলুমের বিচার একদিন আল্লাহ করবে দেখিস। এই রিক্সাটা টান দেন তো ভাই।” চরম বিতৃষ্ণা নিয়ে কথাটা উচ্চারণ করল সাবা। রাশেদ কোন কথা না বলে চুপচাপ তাকিয়ে রইল সেদিকে। সাবা তখনও অচেতন বোনকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ওর কাঁধে শিরির মাথাটা তখনও হেলে পড়ে আছে। আর সাবাকে দেখাচ্ছে ঠিক একটা পাথরের মুর্তির মত।

=====

সায়রাদের গাড়ি যখন রুৎবার বাড়িতে পৌঁছুল তখন রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। রুৎবার শত পীড়াপীড়িতেও পেয়ারী মির্জা নামতে রাজি হলেন না তবে পরদিনের চায়ের দাওয়াত কবুল করতে মোটেও দ্বিধা করলেন না তিনি। রুৎবার বারবার অনুরোধের বিপরীতে নিজেই হেসে জানালেন, ” আরে রুৎবা, রিস্তা হোনে যা রাহা হ্যায়, আনাজানা তো লাগা রাহেগা।” শুনে রুৎবা স্বস্তির হাসি হাসি হাসলেন। চাপা আশঙ্কার যে হালকা মেঘ ঈষাণ কোণে জন্মেছিল তা ফাল্গুনের দমকা হাওয়ায় নিমিষেই উড়ে গেল। তবে দুজনের কথোপকথনের আড়ালে আরো কিছু ঘটে গেল নিরবে, যা সবার চোখ এড়ালেও শ্রাবণীর চোখ এড়ালো না। সে পর্যায়ক্রমে একবার ভাইকে দেখছে অরেকবার সায়রাকে দেখছে। বারসাতের পরিবর্তিত আচরণ বিস্মিত করেছে শ্রাবণীকে । মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই যে মানুষটা সায়রাকে উন্নাসিক, ছন্নছাড়া, মুডি আর এটা সেটা বলে বিয়ের কনে হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করল সেই বারসাতই এখন সায়রাকে ইঙ্গিতে পাঁচ আঙ্গুলকে ফোন বানিয়ে কানের সামনে ধরছে আর নিজের রিস্টওয়াচে টোকা মেরে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে আর অপরপাশে সায়রা সমানে দু’পাশে মাথা নাড়ছে। যার অর্থ দাঁড়ায় রাতে ভাইয়া ফোন দেবে আর সায়রা যেন সেটা ধরে। কিন্তু সায়রা আজ উল্টো মানা করছে যে সে ফোন ধরবেনা। প্রতি উত্তরে বারসাতকে অভিমানের চোখে তাকাতে দেখে অবাক হল শ্রাবণী। এদের ভাব হল কখন। নিশ্চয়ই যখন সে নিচে ছিল তখনই হবে। ওদের দুজনের আকার ইঙ্গিতের মান অভিমান দেখতে ভালই লাগছে শ্রাবণীর।
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here