ত্রয়ী পর্ব ২৫

0
975

ত্রয়ী
মোর্শেদা হোসেন রুবি
২৫||

” কী ? ” পলাশ দারুণ বিস্মিত হয়ে সাবার দিকে তাকাল। আচ্ছা, হারামজাদি তাহলে নাটক করছে ওর সাথে ? আগেই সব স্যারকে বলে দেয়া হয়েছে ? আর ভড়ং ধরেছে ভালমানুষের ? একই সাথে সাবাও বাদল স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে বিস্ময় নিয়ে। লোকটাকে সে বারবার মানা করেছিল সাবার আগমন সম্পর্কে ধারণা না দিতে। অথচ উনি তাই করলেন। এখন তো সব গেল। সাবা হতাশা ভরে মুখ নামিয়ে নিল।
পলাশ তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলল, ” স্যার, আমি আমার ক্লাসের চল্লিশটা ছাত্রীরই ঘনিষ্ট বন্ধু। আমার সব ছাত্রীর সাথে আমি ফ্রেন্ডলি মিশি। এখন কেউ যদি নিজের মনে মনে আমাকে প্রেমিকের জায়গায় বসিয়ে ফ্যান্টাসীতে ভোগে তাহলে আমার কী করার আছে ? আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে স্যার। স্ট্রাগল করে কূল পাইনা, প্রেম করব কখন ? হা হা হা। ” ফাঁকা হাসল পলাশ। বাদল স্যারও ওর সমর্থনে মাথা নাড়লেন।
-” হম, ঠিকই বলেছ। যাই হোক। বেচারী তার বোনের চিন্তায় অসুস্থ হতে চলেছে। আমাদের কোচিং এ পড়ত ওর বোন। আমাদেরও তো একটা দায়বদ্ধতা এসে যায় কী বলো ? সব শুনে তো আর হাত পা গুটিয়ে থাকতে পারিনা। আমি নিজে একটা মেয়ের বাবা। আমার ঘরেও ছোট্ট একটা স্কুল পড়ুয়া মেয়ে আছে আর তোমার ঘরে আছে তোমার বোন। আমরা সবাই পারস্পরিকভাবে দায়বদ্ধ। আচ্ছা, ওর বোনের সাথে তোমার শেষ কী কথা হয়েছিল ? ”
-” এসব কী বলছেন স্যার ? ওর বোনের সাথে আমার পারসোনাল কোন আলাপ নেই।”
-” উঁহু, উত্তেজিত হয়োনা পলাশ। তুমি কিন্তু প্রথমেই এই মেয়েটাকে না চেনার ভান করে বিপদে পড়ে গেছ। এখন আমি নিজেও তোমার ব্যপারে সন্দিহান। কাজেই আমি যা জিজ্ঞেস করব তার সোজা সাপ্টা উত্তর দিয়ে যাও, মামলা খালাস কর। আমারও হাতে অনেক কাজ।”
-” আমি বুঝতে পারছিনা আপনি এই ব্যপারটাতে আমাকে টানছেন কেন? ”
-” কারণ তুমি শিরির টিচার। শিরি অংকে দুর্বল বলে ওকে পারসোনালি কয়েকদিন ক্লাস করিয়েছ ওকে এবং সেই ক্লাসের জন্য কোন পেমেন্টও চাওনি। সেসময় আমি এটাকে তোমার বদান্যতা ভেবেছিলাম কিন্তু এখন আর সেটা ভাবতে পারছিনা। ”
-” আপনি যা খুশি ভাবতে পারেন। শিরি না কে তার ব্যপারে আমি কিছুই জানিনা। আপনি যতবার জিজ্ঞেস করবেন এর উত্তর একটাই।”
-” রিয়েলি ? দেইখো। কথা কিন্তু এখনও তোমার আর আমার মধ্যে আছে। এটা বেড়ে গেলে কিন্তু তুমি নিজেই ঝামেলায় পড়ে যাবা। আমি চাইনা তুমি কোন ঝামেলায় পড়। এরা সন্দেহ করছে শিরি মেয়েটা তোমার সাথে আছে। কী, ঠিক না ? ” কথা বলার ফাঁকেই সাবাকে জিজ্ঞেস করলেন বাদল স্যার। সাবা মাথা নাড়ল। পলাশ পাংশু মুখে তাকাল তার দিকে।
-” আমার সাথে আছে মানে? ”
-” পলাশ, তুমি ওনাকে বাদ দাও। ও তোমাকে ভয় পাচ্ছে। তুমি আমার সাথে কথা বলো। একদিন শিরি মেয়েটা তোমার সাথে হোটেলে চা নাস্তা পুরি সিঙ্গাড়া খাবার সময় ধরা পড়ল। ওর এই বোনটা তোমাদের হাতেনাতে ধরল। তারপর তোমাকে অপমান করল। এই নালিশ আমার কাছে এসেছে। তখন এটাকে পারসোনাল ম্যাটার মনে করে পাত্তা দেইনি কিন্তু এখন দিতে হচ্ছে। ওদের ধারণামতে ওর বোনকে যদি তুমি গুম বা খুন করে ফেল তাতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। আজকাল এগুলিই হচ্ছে।”
-” স্যার আপনি এসব কী বলছেন ? আপনি কী জানেন না আমার ফ্যামিলি সম্পর্কে ? আমার কাজিন আপনার বন্ধু মানুষ। সেই সেন্স থেকেও আপনার এভাবে কথা বলা উচিত না স্যার।”
-” তোমার কথা ঠিক। তুমি রাশেদের কাজিন আর রাশেদ আমার ক্লাসমেট। আর এ কারণেই তোমার ব্যপারে আমার দায়বদ্ধতা বেশি। তুমি অযথাই আমাকে ভুল বুঝছো পলাশ। আমি চাইছি যেন থানা পুলিশ হলে তোমাকে নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া না হয়।”
-” থানা পুলিশ হলে আমাকে নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া হবে কেন।? আমি কী করেছি আশ্চর্য? ”
-” তুমি মেয়েটাকে খুন করে লুকিয়ে রেখেছ বা কোথাও বিক্রি করে দিয়েছ বা কোথাও আটকে রেখেছ…ইত্যাদি। এগুলো আমার অভিযোগ না। সব সম্ভাব্য অভিযোগ। ”
-” কিন্তু আমিই কেন? এই মেয়ের আর কোথায় কোন কাহিনী আছে দেখেন গিয়ে।”
-” চিন্তা করো না। ওটাও দেখা হবে। তুমি শুধু তোমার অংশটুকু পরিস্কার কর।”
-” বাদল ভাই, আপনি আমাকে সরাসরি একটা কথা বলুন। আপনি আমাকে এখানে কেন ডেকেছেন ? আমার পেমেন্ট দেবার জন্য নাকী পেমেন্টের নাম করে আমাকে ডেকে এনে ট্রাপে ফেলার জন্য। এই মেয়ে আর তার বোন ধান্ধাবাজ। আপনি ওদের কথায় নাচছেন। ” পলাশ এবার রেগে গিয়ে বলল। বাদল কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পকেট থেকে ফোন বের করল। আর অমনিই পলাশকে উঠে দাঁড়াতে দেখে হাতের ইশারায় তাকে বসতে বলে কান থেকে ফোন সরাল।
-” বসো পলাশ। রাশেদকে ডাকছি। কারণ তোমার নামে যে সব কমপ্লেইন আছে সেগুলো বিহিত না করলে আমার কোচিং এর রেপুটেশন নষ্ট হবে। আমি চাই তোমার বদনাম ঘুচুক আর সত্য সামনে আসুক। তোমার নামে নালিশ এই একটাই না। আরো আছে। কাজেই তুমি দৌড় দিও না তখন তোমার পেছনে আমাকে দৌড়াতে হবে।” বলে ফোন কানে চেপেই দ্রুত সোজা হয়ে বসল বাদল স্যার।
-” হ্যালো, দোস্ত। তোমারেই খুঁজতেসি। একটু আমার এখানে যে তোমাকে দরকার ছিল। ঐ যে গতরাতে বললাম। হ্যাঁ, পলাশও আছে। ওর জন্যই তোমাকে দরকার বন্ধু। পরে বলবা তোমার ভাইরে আমি সেইফ করি নাই। ওকে, ওকে। আসো তাহলে।”
পলাশ বসে বসে এবার ঘামতে লাগল। সাবা তখনও নিঃশব্দে কাঁদছে। ও নিজেও বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা এভাবে হ্যান্ডেল করবেন বাদল স্যার। ও ভেবেছিল পলাশের পিছু নিয়ে ওর গতিবিধি জানবে। যদিও কাজটা একজন মেয়ে হিসাবে কঠিন কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটাই ভাল হয়েছে। সব সামনা সামনি আলাপ হবে। কিন্তু এর বড় ভাই যদি এসে নিজের ভাইয়ের পক্ষ নেয় তাহলে ? ওর কী দুলাভাই বা মঈন ভাইকে ডাকা উচিত ? দুলাভাই এ সময় আসতে পারবেন না আর মঈন ভাই পারলেও তাকে সাবা ডাকবেনা। দেখা যাক্, কী হয়।” সাবা মনে মনে দোয়া করতে লাগল আজ যেন পলাশের মুখোশ খু্লে যায়।

=====

বিকেলে আর বের হওয়া হলোনা ওদের। সন্ধ্যের পর পর বারসাত ফোন করে গাড়ীর ব্যবস্থা করল। ইতোমধ্যে সায়রার রুৎবা খালামনির সাথেও কথা হয়েছে ওর। সায়রা যে ভেতর থেকে তার দরজা বন্ধ করে রেখেছে আর ওকে কিছু অদ্ভুত কথা শুনিয়ে গেছে তার সবই তাকে বলেছে কারসাত। সব শুনে রুৎবা খালামনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছেন, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে বারসাত। তার আগে একটা অনুরোধ সায়রাকে একটু সামলে নাও প্লিজ। ” বারসাত সেই থেকে ঐ চেষ্টাই করছে। সায়রাকে সামলানোর পরিকল্পনা বের করেছে। যদিও জানেনা এ বয়সী মেয়েদের কীভাবে সামলাতে হয়। তবে সন্ধ্যার পরপর শ্রাবণীর মাধ্যমে সায়রার দরজা খোলাতে সক্ষম হল বারসাত। যদিও শ্রাবণী এসবের বিন্দুবিসর্গ জানেনা। সে তার মত করে সায়রাকে খোঁচাতে লাগল। চলে যাবার আগে একটু বাইরের দৃশ্যটা দেখে আসতে চায় শ্রাবণী। এখন তুষারপাত বন্ধ। কাজেই এটাই মোক্ষম সুযোগ। কিন্তু শ্রাবণীর পীড়াপীড়িতে কাজ হলো না। সায়রা রাজি হলো না। বিরক্ত হয়ে শ্রাবণী শেষ পর্যন্ত মায়ের কাছে গেল। কিন্তু এখানেও না-রাজির সাইনবোর্ড ঝুলছে। পেয়ারী মির্জার মাথা ধরা সারেনি কাজেই উনার বাইরে বেরোনোর প্রশ্নই ওঠেনা। শেষ পর্যন্ত শ্রাবণীকে একাই নিচে নেমে যেতে হল। বারসাত অবশ্য ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে , তুই নিচে অপেক্ষা কর আমি দেখি সায়রাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিচে আনতে পারি কিনা।”
” পারবিনা। মোটেও পারবিনা। আচ্ছা, তোর বউ এত্ত মুড মারে কেন রে ? ওর আসলে হয়েছেটা কী, বল তো ? ”
-” আমার বউ মানে ? শ্রাবণী মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ। সে এখনও আমার বউ হয়নি। আর তাছাড়া ওর কী হয়েছে এটা জেনে তোর কাজ কী ? হয়ত তার কোন পারসোনাল ম্যাটার। এসব কথা ছাড় আর তুই নিচে যা, আমি দেখছি ওকে ।”
এ পর্যন্তই ছিল ওদের দু’ভাইবোনের কথোপকথন। এরপর আধাঘন্টা পেরিয়ে গেছে। সায়রা আর বারসাতের খবর নেই।

শ্রাবণীকে নিচে পাঠিয়ে বারসাত সায়রার রুমে নক করেছিল। তাকে চোখ বন্ধ করে ঘুমাতে দেখে ফিরে গেছে সে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফের নক করেছে। সায়রা সাড়া দেয়নি। এর কিছুক্ষণ পর বারসাত আবার ফোন করেছে। সায়রা ওর নম্বর দেখেই কেটে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছে বারসাতকে। ভেবে চিন্তে একটা মেসেজ লিখল সে।
টেক্সটটা এমন ছিল, ” আমি জানি, আপনি নীলিমাকে আহমেদকে ঘৃণা করলেও আমির সানাকে ঘৃণা করেন না। বরং আমির সানা আপনার জীবনের সবচে গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। এখন হঠাৎ যদি শোনেন আমির সানা হার্ট এ্যাটাক করেছেন তাহলে কী খুব খুশি হবেন ? ”

মেসেজটা লিখে বারসাত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। সায়রা সিন করেছে মেসেজ কিন্তু কোনো রিপ্লাই নেই। বারসাত ফের লিখল, ” ওকে। আমি আমির সানাকে জানিয়ে দিচ্ছি যে তার কন্যা মৃতপ্রায় অবস্থা। আ’ম শিওর এটা শোনার পর আমির সানা হার্ট এটাক বা এ জাতীয় কিছু করবেন। তারপর দেখি আপনি কী করেন। স্বার্থপর মানুষদের লিমিট খুব বেশী থাকে না শুনেছি। আমাকে জানতে হবে আপনি আসলে কী চান। আ’ম গোয়িং টু কল হিম।”

মেসেজটা লিখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা একপাশে সরিয়ে রাখল বারসাত। ওর হাতে এটাই ছিল শেষ অস্ত্র। এরপরেও সায়রা রেসপন্স না করলে বারসাতের করার কিছুই থাকবেনা। রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে সোজা রওনা দেবে ওরা। ঘন্টাখানেকের পথ। সায়রাকে ওর খালার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে মা আর শ্রাবণীকে নিয়ে নিজেদের বাড়ি চলে যাবে বারসাত। ভাবতে ভাবতেই আচমকা নরম কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে চমকে উঠল বারসাত। তার একটু পর আরেকটা। কী রে..! বারসাত দ্রুত ঘাড় ফেরানোর আগেই আরেকটা কুশন উড়ে আসল ওর দিকে। এটা সরাসরি ওর মুখে বারি খেয়ে সরাসরি সেন্টার টেবিলের উপর রাখা ফ্লাওয়ার ভাসটার উপর পড়ল। কুশন আর ভাস একসাথেই গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। তবে ফ্লোরে পুরু শ্যাগ কার্পেট থাকায় ভাসটা ভাঙল না। বারসাত দ্রুত সেটাকে তুলে রেখে সায়রার মারনোদ্যত হাত থেকে কুশন ছিনিয়ে নিয়ে হাতের ইশারায় জানতে চাইল, ” এসব কী হচ্ছে ? ”

সায়রার চেহারা তখন প্রথম সকালের তাজিনডং। নাকের চুড়ায় যেন আগুন লেগেছে। কেঁদেকেটে চেহারা তো আগেই ফুলিয়েছে। এখন পুরো মুখ লাল হয়ে আছে রাগে। বারসাত চাপা স্বরে বলল, ” এসব ছুঁড়ে মারছেন কেন আমাকে ? কী করেছি আমি ? ”
-” শোকর করুন আপনার গলা টিপে ধরিনি। ” হিসহিস করে বলল সায়রা। সে এখনও রীতিমত ফুঁসছে। বারসাত মায়ের দরজার দিকে একবার তাকিয়ে হঠাৎ সায়রার ঘরের দিকে রওনা দিল। যেতে যেতেই সায়রাকে তর্জনী ইশারা করে সেদিকে ডাকল। সায়রা কী করবে ভেবে না পেয়ে কিছুটা বিস্ময় কিছুটা রাগ মেশানো পায়ে সেদিকে যেতেই বারসাত আস্তে করে রুমের দরজা বন্ধ করে দিল। শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা সোফা দখল করে বসে সায়রাকে পাশের জায়গাটা ইঙ্গিতে দেখিয়ে বলল, ” আসুন, এখানে বসুন। এখানে সুবিধা আছে ।”
-” মানে ? ” সায়রা অবাক।
-” গলা না টিপতে ইচ্ছে করছে বললেন ? বাইরে গলা টিপলে আমি চিৎকার করব। সেটা শুনে আমার মা ছুটে আসবে আর আমাকে বাঁচিয়ে নেবে। আপনার ইচ্ছেটা আর পূরণ হবেনা। তাছাড়া আমি আপনার চেয়ে লম্বা। আপনি মনে হয়না আমার গলার নাগাল পাবেন। তাই…!” বারসাত হাসছে না তবে চোখেমুখে কৌতুক। সায়রা কিছুক্ষণ সেদিকে একভাবে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলে উঠল, ” আমার এই কষ্টটা আপনার কাছে তাহলে ঠাট্টার বিষয়বস্তু ? আপনি কী জানেন আমার কেমন লাগছে ? ”
-” উঁহু। জানিনা। শুধু এটুকু জানি। আপনি কষ্ট পাচ্ছেন জানলে আপনার মা-বাবা কষ্ট পাবেন।”
-” আমার কোন মা নেই।” সায়রা সরে জানালার সামনে গেল। পুরো জানালা সাদা হয়ে আছে। বারসাত পেছন থেকে বলল, ” নীলিমা আপনার মা নন।? ”
-” না। সে আমার মা নয়।” সায়রার কণ্ঠ স্থির।
-” রিয়েলি ? মা না হবার পরও শুধু আপনাকে তার পেটে বাঁচিয়ে রাখার অপরাধে তাকে ইকবাল সানার বেল্টের আঘাত সহ্য করতে হয়েছে। সত্যি, নীলিমা আহমেদ এবরশন করে ফেললেই পারতেন।”
সায়রা নিজেও জানেনা ও কতটা বিস্মিত হয়েছে। ওর বিস্ফোরিত চোখ আর তাতে ঝুলে থাকা দু ফোটা পানি। কতক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে ছিল বলতে পারবেনা। হঠাৎ ‘ক্লিক’ করে শাটার টেপার শব্দে সম্বিত ফিরল সায়রার। ততক্ষণে বারসাত ওর সামনে থেকে ডিভাইসটা সরিয়ে নিয়েছে। সেল ফোনটা সায়রার দিকে ধরতেই তাতে নিজেকে দেখতে পেল সায়রা। অদ্ভুত সুন্দর এসেছে। তবে মুখে নির্বিকার ভাবটা ধরে রাখল।
– ” এরকম একটা চমৎকার ছবির জন্য আমাকে আপনার থ্যাঙ্কস দেয়া উচিত। দেখুন, কীরকম কাডলি লাগছে আপনাকে। চোখের পানিটা রীতিমত জ্বলছে দেখেছেন ? ”

সায়রা হঠাৎ ঝুপ করে মাটিতে বসে পড়ে ফোঁপাতে লাগল। বারসাত সেদিকে তাকিয়ে ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল। আস্তে করে হাঁটু গেড়ে ওর পাশে বসে মাথায় সান্ত্বনার হাত রাখল। মৃদু শব্দে বলল, ” মা -বাবার দোষ বিচার করার দায়িত্ব সন্তানের নয় সায়রা। কিছু জিনিস মানুষের অধিকারের বাইরে। আপনি আপনার মা’কে শাস্তি দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু তাতে লাভ কী বলুন। বরং মা’কে দেখে নিজেকে সংশোধন করে ফেলুন। কারণ বোঝাই যাচ্ছে ওনার লাইফস্টাইল আপনি পছন্দ করেন নি।”

-” আমি এরকম বেহায়া হয়েছি কেন জানেন কারণ আমার মা এরকম…!” হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল সায়রা। কাঁদতে কাঁদতেই উচ্চারণ করল, “আমি কোনদিন একটা ভাল মেয়ে হতে পারব না। আমাকে কেউ ভাল মেয়ে বলবেও না। কারণ আমি বা….!” বারসাত চট করে নিজের জিভ কাটল আর একই সাথে হাতের মোবাইলটা সায়রার ঠোঁটের উপর আলতো করে চেপে ধরল।
-” এই বাজে শব্দটা আর একবারও শুনতে চাই না। প্লিজ। একবার তো বলেছেন । এটা আর উচ্চারণ করবেন না। আপনার জন্মদাতা ইকবাল সানা এবং এটা সত্যি। কিন্তু সে মেনে নিতে চায়নি বলেই এত ঘটনা। ”
-” আপনি সব জানেন ? ” সায়রা কেঁদে ফেলল। বারসাত তাকে আশ্বস্ত করল।
-” শুধু আমি জানি। আজই জেনেছি। আর আমি জানলে কোন ক্ষতি নেই সায়রা। কারণ আমি আপনার বন্ধু হতে চাই। টেম্পোরারি না। একদম পারমানেন্ট বয়ফ্রেন্ড।”
-” ছিহ্, আমি আর এসবে নেই।” সায়রা মৃদু হেঁচকি তুলল।
-” উলে উলে মাশাআল্লাহ। সায়রা বেবি কো কিতনা সামাঝ আগায়ি। পারমানেন্ট বয়ফ্রেন্ড কাকে বলে জানেন ? ” বারসাত হাসছে। সায়রা চট করে মুখ নামিয়ে ফেলল। ওর চেহারায় এখন রক্তিমাভা। সেদিকে তাকিয়ে বারসাত স্বগোতক্তি করল,” খামোকাই টাইগার হিলে গিয়ে বসে থাকা। এখানেই তো দারুণ সানরাইজ আর সানসেট। ” সায়রা মুখ তুলে তাকাতেই দ্রুত বলল, ” তাড়াতাড়ি উঠুন। বাইরে যাব। শ্রাবণী বেচারী কাউকে না পেয়ে একা একাই নিচে চলে গেছে।”
সায়রা বারণ করতে গিয়েও দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল, “চলুন।”
-” দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল।” বারসাত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ” যেভাবে আছেন এভাবেই চলুন। পোশাক বদলাতে হবেনা। জিলবাবটা শুধু চড়িয়ে নিন।”

ওরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বরফের স্তুপের সামনে। উজ্জ্বল আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। বরফ সাদাকে ফ্লুয়োরোসেন্ট বাল্বের আলোয় আরো সাদা দেখাচ্ছে। সায়রা ভেবেছিল ওর কোন কিছুই ভাল লাগবেনা। কিন্তু হঠাৎ করেই মনে হল ওর আসলে সবকিছুই ভাল লাগছে। এই বরফ ঢাকা নির্জন প্রান্তর, রেললাইনের ঘটং ঘটং শব্দ, শ্রাবণীর খিলখিল হাসি আর হয়ত বারসাতকেও।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here