ত্রয়ী পর্ব ২৪

0
823

ত্রয়ী
মোর্শেদা হোসেন রুবি

২৪||
নোংরা একটা পরিবেশে নাপাক অবস্থায় জড়োসড়ো হয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে শিরি। বাথরুম খালি হবার অপেক্ষা করছে। এই মুহূর্তে বাথরুমে আরেকজন গোসল করছে। অপেক্ষা না করে উপায় নেই।
বাসার পরিবেশটা জঘন্য। ঘিঞ্জি একটা পরিবেশ। বাথরুমের সামনে পাথর ফেলে এবড়ো থেবড়ো পথ তৈরী করা হয়েছে। একপাশের সরৃু নালা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পাশের বাড়ির বাথরুমের পানি। কখনও হলুদ কখনও সাদা সাবানের ফ্যানা মেশানো বিদঘুটে বৈশিষ্ট্যের পানি। সেই পানি আবার নালা দিয়ে যাবার সময় উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। শিরি ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। তাকালেই বমি এসে যাচ্ছে ওর। সে কোনমতে গোসল করে বেরোতে পারলে বাঁচে। উপায় নেই বলে এখানে আসা নইলে দ্বিতীয়বার এই বাথরুমে আসত না শিরি। সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা একটা ভাঙা পাথর। নিচে শ্যাওলা পড়া পিচ্ছিল জমিতে পা রাখার প্রবৃত্তি হচ্ছেনা বলে কষ্টসৃষ্টে পাথরের ওপরেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এরকম একভাবে দাঁড়াতে গিয়ে কোমড় ধরে এসেছে শিরির। ঐ অবস্থাতেই বাম হাতে দলাপাকান জামার পুট্টুলিটা গায়ের সাথে চেপে ধরে রেখেছে । গোসল করার পর এটা গায়ে দেবে। ওর পরনে যে ম্যাক্সিটা আছে সেটা ধুয়ে শুকোতে দিতে হবে। এমনিতে যে ঘরটায় ও থাকে সেখানে রোদের কোন ব্যপার নেই। গুমোট একটা ঘর। তার উপর পাশেই একটা প্লাস্টিকের কারখানা। সারাদিন ঘটাং ঘটাং শব্দ। একপাশের দেয়াল রীতিমত উত্তপ্ত হয়ে থাকে কারখানার মেশিনের উত্তাপে। লেবারদের কথা আর হাসির শব্দ পাওয়া যায়। ভয়ে দরজা ঠেসে বন্ধ করে রাখে শিরি। সারাদিন পলাশ থাকেনা। কেউ এসে ওকে এভাবে একা দেখলে কী ভাববে কে জানে। এটা যে কোন সংসার না তা তো একনজর দেখলেই বোঝা যায়। না আছে খাট না একটা চৌকি। না কাপড় রাখার আলনা না পানির কলসি। কিছুই তো নেই। থাকার মধ্যে দুই পাশের দেয়ালে পেরেক গেড়ে কাপড় লটকানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে পলাশ। একপাশে ভেজা কাপড় অন্যপাশে শুকনা কাপড়। ওতেই মেলতে হয় শিরির ভেজা কাপড়গুলো। এছাড়া আছে দুই লিটারের একটা পানির বোতল আর একটা ওয়ান টাইম গ্লাস। এই হলো শিরির সংসার। গত তিনদিন ধরে শিরির অসহিষ্ণুতায় পলাশ কেবল একটা সান্ত্বনাই দিয়ে আসছে, আর কয়েকটা দিন কষ্ট করো। তারপরেই তোমাকে নিয়ে একটা ভাল বাসায় উঠব। এক বন্ধুর সাথে আলাপ করেছি। ওর চিলেকোঠাটা খালি আছে। তোমাকে নিয়ে উঠব শুনে ও রাজী হয়েছে। কিন্তু খালি হাতে তো আর ওঠা যায়না। কিছু টাকা পয়সা ব্যবস্থা করে ওর হাতে দিতে হবে। হালকা পাতলা দুটা ফার্ণিচার কিনতে হবে। তারপর তোমাকে নিয়ে উঠব। এমনিতেই কী ওঠা যায় ? শোনার পর থেকে আশায় বুক বেঁধেছে শিরি। চিলেকোঠা মানে তো ছাদের অংশ। একটু খোলা আকাশ আর বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার মত সামান্য একটু বাতাস। এই ঘরটা তো রীতিমত জেলখানা।
” এই মেয়ে তুমি কী গুসোল করবা ? ” বাড়িওয়ালীর বাঁজখাই ডাকে সচেতন হল শিরি।
-” জি, গোসল করব।”
-” গুসোল করবা ভাল কথা। তোমার স্বামী তো এখন পর্যন্ত আমারে গত তিন দিনের পয়সা দেয় নাই। তার সাথে আগেই কথা হইসে। পোরতেক দিন বাথরুম ব্যবহার করনের লেগা তিরিশ ট্যাকা দিব। আইজকা তিনদিন গেল কোন খবর নাই। তোমার জমছে তিন তিরিশে নব্বই। তার উপর তুমি রোজ করো গুসোল। পানি বেশি খরচা হয়। একশ ট্যাকা দিবার কইবা তোমার স্বামীরে।”
-” জি, ঠিকআছে। ও এলে আমি বলব আন্টি। এখন আমি বাথরুমে ঢুকি ? ” আগেরজনকে বেরোতে দেখে ত্রস্তে বলল শিরি। কারণ এখানে দেরী হলে ফট করে আরেকজন ঢুকে যাবার সম্ভাবনা। অনেক পরে বুঝেছে শিরি যে জায়গাটা একটা বস্তির অংশ। এখানে যারা থাকে তারা কেউ রিক্সাচালায় তো কেউ বাদাম বিক্রি করে। এদের কারখানার লাগোয়া খালি স্টোর রুমটাই সম্ভবত ভাড়া নিয়েছে পলাশ। এগুলো সবই ওর আন্দাজ অনুমান।
-” আজকা ঢুকতাছো ঢুকো। এই ট্যাকা শুধ না দেওন পর্যন্ত কালকা থেকা বাথরুম ব্যভার করতে পারবা না।” বাড়িওয়ালী খ্যাচ খ্যাচ করে উঠল।
” জি।” আস্তে করে মাথা নেড়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল শিরি। আগেরজন বাথরুমকে গন্ধ করে রেখে গেছে। সন্তর্পনে বালতির পানি ঢেলে আগে বাথরুমটা আগে ধুয়ে নিল শিরি। পানির শব্দে মুহূর্তেই বাইরে থেকে চিৎকার ভেসে এল, ” এই….পানি কম ফালাও মাইয়া। পানির বিল দিতে দিতে আমার জান শেষ। পয় পরিস্কার কম দেহাও। নিজের ফেলাট বাড়িতে গিয়া দেহাও গা।”
বাথরুমের ফ্লোরে বসে মাথায় পানি ঢালতে গিয়ে অজানা আবেগে কেঁপে উঠল শিরি। বাড়ির বাথরুমটার কথা মনে পড়ল। ঠিক এই কথাগুলোই মিলি আপা অন্যভাবে বলত। শিরির দীর্ঘসময় লাগিয়ে প্রচুর পানি ফেলে গোসল করার অভ্যাস। মিলি আপা বারবার বলত, পানির কিন্তু হিসাব দিতে হবে শিরি। কেয়ামতের দিন তো দেখা যায় তুই পানির হিসাবেই আটকে যাবি। এত পানি নষ্ট করিস কেন ! কথাগুলো মনে পড়তেই চোখ ফেটে উষ্ণ পানির নহর বইল। গত তিন তিন দিনের হিসাব দিতেই জান বেরিয়ে যাচ্ছে ওর। আর কোন হিসাব দিতে চায়না শিরি। চোখের পানি আর মগের পানি মিলেমিশে এবার একাকার হতে লাগল।

সাবা আজ আগেভাগেই কোচিং এ চলে এসেছে। তবে আজ ও একাই এসেছে। মঈন সাথে আসতে চেয়েছিল সাবা বিনয়ের সাথে মানা করে দিয়েছে। পরে মিলির ইঙ্গিতে মঈনও আর বাড়াবাড়ি করেনি। সাবা বসে আছে একটা চেয়ারে। কোচিং সেন্টার খোলা হয় রোজ সকাল নয়টায়। এখন বাজে সাড়ে আটটা। বুয়া সবেমাত্র এটাকে খুলে ঝাট দেয়া শুরু করেছে। এখনও ছাত্র শিক্ষক কেউই আসেনি। সাবা এত আগে আসার কারণ সে পলাশের মুখোমুখি হবার আগে কোচিং এর দায়িত্বে যিনি আছেন সেই স্যারের সাথে একটু আলাদা কথা বলতে চায়। সেকারণেই আসা।
বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর নয়টা বাজার পাঁচ মিনিট আগে থেকে ছাত্র ছাত্রীরা আসা শুরু করল। তার একটু পর এলেন দুজন শিক্ষক । তারা অফিসরুমে উঁকি দিয়ে সাবাকে বসে থাকতে দেখে যে যার ক্লাসে চলে গেলেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকটা এলেন নয়টা বিশে। সবাই তাকে বাদল স্যার বলেই ডাকে। তাকে দেখেই সাবা উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। লোকটা চকিতে ঘড়ি দেখে বলল, ” আমি তো এখন তোমাকে সময় দিতে পারব না। ক্লাস নিতে যাব। এমন সময় এলে কেন ? তোমাকে আরো অনেকক্ষণ বসতে হবে। এতক্ষণ বসবে না পরে আসবে ? ”
-” আমি নাহয় বসি স্যার ? ” বিনীত স্বরে অনুরোধ জানাল সাবা।
-” আচ্ছা বসো। সমস্যা নাই। ” বলে স্যার ঝড়ের বেগে ভেতরে চলে গেলেন।
বসে থেকে থেকে ঝিমুনি আসছিল সাবার। ঠিক ত্রিশ মিনিট পর লোকটার পায়ের শব্দে সোজা হল সাবা। লোকটার কপালে বিরক্তির ভাঁজ স্পষ্ট। সাবা তটস্থ হয়ে বসে রইল। এরই মধ্যে ছাত্ররা আসছে যাচ্ছে। একথা সেকথা বলছে। স্যারও তাদের সাথে কথা বলছেন। ড্রয়ার ঘাটছেন। দুজনের বেতন নিলেন। দশ বারো মিনিট পর লোকটা হাত নেড়ে বলল, ” তুমি একদম অসময়ে এসেছ। এটা কাজের সময় বুঝলে। বিচার সালিশের সময় এটা না তাছাড়া তোমার ব্যপারটাও কনফিউজিং। যাই হোক, বসো। আমি পলাশকে সকালে ফোন দিয়েছিলাম। নিজ গরজেই। বলেছে এগারোটার দিকে আসবে।”
-” আমি আসলে পলাশ স্যার আসার আগে আপনাকে একটা অনুরোধ করতে চেয়েছিলাম স্যার ।”
-” বলে ফেল তাড়াতাড়ি । ”
-” আপনি কিন্তু পলাশকে বলবেন না যে তার নামে আমি কোন অভিযোগ করেছি।”
-” মানে ? তুমি অভিযোগ না করলে তাকে ডাকালাম কেন ? আর তুমিইবা এখানে কেন ? পলাশ জানতে চাইবে না ? ” লোকটার কপালে বিরক্তির চিহ্ন গাঢ় হল।
-” আপনি তো তাকে টাকা দিতে ডাকছেন, তাই না ? আর আমি এসেছি আমার বোনের খোঁজে।”
-” সেটা তো…..আচ্ছা, এক মিনিট। তুমি আসলে কী করতে চাচ্ছ ? ” বলেই লোকটা হঠাৎ কী ভেবে শান্ত হয়ে গেল।
সাবা ইতস্তত করে বলল, ” আমি চাইনা সে আমার অভিযোগ শুনে পালিয়ে যাক। কারণ খুব স্বাভাবিক ভাবেই সে এই অভিযোগ অস্বীকার করবে। তারপর আপনার টাকা নেবে আর চলে যাবে।”
-” আজব। আমি কী টাকা হাতে নিয়ে বসে আছি নাকি ? কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত টাকা দেব কেন ? ”
-” এমনও হতে পারে সে টাকা না নিয়েই চলে গেল। আপনার সাথে পরে এটা নিয়ে আলাপ করবে ভেবে ? ”
-” হম, বুঝলাম। তোমার ইচ্ছেটা কী তাহলে ? ”
-” আমি দেখাতে চাই আমি তাকে সন্দেহ করিনি। আর আমার ওনার প্রতি কোন অভিযোগ নেই। সে আমাকে দেখে এটাই যেন বুঝতে পারে যে আমি ওর কাছে না বরং আপনার কাছেই এসেছি। এতে সে নির্ভার হবে। পালাবে না স্বাভাবিক থাকবে। আমি তো শুধু আমার বোন ফেরত চাই। জানতে চাই সে কোথায় কেমন আছে। পলাশ যদি একবার টের পায় তাহলে ওর নাগাল পাওয়া আমার জন্য কঠিন হবে। আপনিও তো বারবার আমাকে সাহায্য করতে পারবেন না। বিরক্ত হবেন। আর সে হলো গভীর জলের মাছ। একবার ফসকে গেলে তার নাগাল পাবো না। আমাকে এটুকু সাহায্য করুন স্যার।” সাবা কাতর গলায় কথাগুলো বললে স্যার লোকটা দু মিনিট ভাবলেন। তারপর দ্বিমতের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন।
-” আচ্ছা, বসো। দেখি কী হয়।”

একটু পরেই বাদল স্যার উঠে ক্লাস নিতে চলে গেলেন। আর ঠিক তারপর পরই পলাশ কোচিং এ ঢুকল। সাবাকে দেখে সে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সাবাও তাকে দেখে বিস্মিত তবে সেটা মাত্র দু সেকেন্ড। অল্পই সময় লাগল ওর নিজেকে সামলাতে। দ্রুত সালাম দিল সাবা। মনে মনে খুশি হল স্যারের অনুপস্থিতিতে এর সাথে দেখা হল বলে। তাতে অন্তত কিছুক্ষণ সময় পাওয়া যাবে কথা বলার। সাবা চেহারায় ভদ্রতা ফুটিয়ে তুলে করুণ হাসি দিয়ে বলল, “ভাল আছেন স্যার ?”
ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগল পলাশের। সাবার এই আচরণ একেবারে অপ্রত্যাশিত। বরং সে এতক্ষণ ঝড়ের গতিতে ভাবছিল সাবার আক্রমনাত্মক কথার জবাবে তার নিজের ভূমিকা কী হবে। এই মেয়ে সেদিন হোটেলে ওকে যা তা বলে অপমান করেছে। আজ নিশ্চয়ই ছেড়ে কথা বলবে না। কিন্তু সাবার এমন বিপরীতমুখী আচরণে পুরোপুরি বিভ্রান্ত বোধ করল পলাশ। কেস কী। এরা কী কিছুই টের পায়নি ? যাক্ বাবা। পলাশ কিছু বলার আগেই সাবার চোখে পানি দেখতে পেয়ে থেমে গেল। কী বলে শোনা যাক।
-” সেদিনের আচরণের জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত স্যার।” সাবার কণ্ঠে বিনয় ঝরে পড়ছে। পলাশ বিড়বিড় করে কিছু বলল যা সাবা শুনতে পেল না। সে আবারও বলল,
-” আসলে আমার বোনটা একটু বোকা আর আবেগী। সেকারণেই ঐদিন….! এই দেখুন না, গত তিনদিন আগে বকাঝকা করেছি বলে রাগ করে কোন বান্ধবীর বাড়ি গিয়ে যেন বসে আছে। ভেবেছিলাম কোচিং এ আসবে। এখানে এসে শুনলাম ক্লাস করতে আসেনা।” ঝাড়া এক মিনিট সময় লাগল পুরো ব্যপারটা বোধগম্য হতে। পলাশের বুকের ভেতর এখন ঝর্ণার কলকল বয়ে যাওয়া। আহা, এরা জানেই না ওর বোন পলাশের লোভের খাঁচায় বন্দী। এরা এখনও ভাবছে সে বান্ধবীর বাসায় গিয়ে লুকিয়েছে। হাউ স্যাড। অার ভাববে নাই বা কেন। এইটাও তো পোলাপান। কচি বয়স তবে শিরির চেয়ে জোশ। এক নজরেই বোঝা যায় শিরির তুলনায় অনেক বেশী সম্পদশালী সাবা। পলাশ দ্রুত নিজের চোখকে সামলে নিল। ওকে দেখে আজ পর্যন্ত কেউ বেহায়া ভাবতে পারেনি। পলাশ এত কাঁচা খেলুড়ে না। ওর চাহনী সবসময় নিটোল পবিত্র। বরং এতে এমন মাদকতা মিশিয়ে রাখে যে মেয়েরা পারলে খুলে সবকিছু দেখায়। ওরা জানেই না পলাশের ষড়রিপুর বাইরেও আরেকটা রিপু আছে। সেই রিপুর তাড়নায় প্রতিটা মেয়েকে এক নজরেই চর্ব চোষ্য লেহ্য পেয় রূপে কল্পনা করে এক অপূর্ব রস আস্বাদন করে। আগে পর্ণ দেখে আস্ফালন করত। এখন বৃথা আস্ফালনের দিন শেষ। শিরির মত কাঁচা বুদ্ধির আবেগী মেয়েরাই ওর টার্গেট। এরচেয়ে একটু বড় মেয়েগুলা বেশির ভাগই ত্যাঁদোড়। এদের কয়েকজন ছাড়া বাকি গুলা ট্যাটন প্রকৃতির। এরা নজরের দোষ দেখলে কেটে পড়ে। তাই পলাশকে এখন মহান সাজতে হবে। সে হালকা একটা বিস্ময় ধ্বণি করে পাশের চেয়ারে বসে পড়ল, ” বলেন কী ? রিয়েলি ? ”
-” জি, স্যার। ও এরকমই করে। রাগ হলেই এর তার বাড়িতে গিয়ে বসে থাকে। দুচারদিন ভুগায় তারপর ব্যাক করে।”
-” তারপরেও। দিনকাল ভাল না। ফোনে কথা বলে দেখেছিলেন ? ” সতর্কতার সাথে প্রশ্ন করল পলাশ। সাবা ঠোঁট উল্টাল, ” ও ফোন ধরবেনা স্যার। ওকে জানি তো। ও তো ফোন সেদিন থেকে বন্ধই করে রেখেছে। এক কাজ করুন না স্যার, আপনার ফোন থেকেই কল দিয়ে দেখুন না। খোলা থাকলে হয়ত আপনার ফোন ধরলেও ধরতে পারে।”
-” ওহ্, না না আমার কাছে তো ওর ফোন নম্বর নেই।” বলেই দ্রুত দাঁড়িয়ে পড়ল পলাশ। বিড়বিড় করতে করতে ভেতরে উঁকি ঝুঁকি মারল বারকয়েক। আপন মনেই বলতে লাগল,
-” বাদল স্যার কী ক্লাসে নাকি ? আমাকে ডেকে ক্লাসে বসে আছে, আজব তো। আমাকে আবার এক জায়গায় যেতে হবে। ” পলাশ ফের ভেতরে উঁকি দিল। বাদল স্যার ক্লাস নিচ্ছিলেন। পলাশকে দেখতে পেয়ে সেখান থেকেই হাত নাড়লেন তিনি। পলাশ অফিস রুমে ফিরে আসতেই সাবা অনুরোধের সুরে বলল, ” স্যার, এই উপকারটা একটু করুন না স্যার। একটা চান্স নিতে চাচ্ছি আরকি। আপনার ফোন থেকে একটা কল দিয়ে দেখুন না। যদি ধরে।”
-” আরে একবারই তো বললাম আমার কাছে ওর নম্বর নেই।” ফ্যাকাশে হেসে পরিস্থিতি সামলাতে চাইল পলাশ যদিও ওর হাসিতে ওর অপরাধবোধ স্পষ্ট। সাবার বুকের ভেতর আগুন জ্বলছে। নিজেকে প্রানপনে সামলে রেখে বলল,
-” ওর নম্বর মুখস্ত আছে আমার । আমি বলছি, আপনি নাহয় নম্বর লিখে নিন। ”
পলাশ বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ করল না কারণ তাতে সাবার সন্দেহ হবে। সে সাবার বলে দেয়া নাম্বারে কল করল এবং বরাবরের মতই সংযোগ বন্ধ আছে শুনে তিক্ত হেসে বলল, ” কী বললাম। এই দেখুন, ফোন বন্ধ। ”
সাবা মাথা নেড়ে স্যরি জানালে পলাশ হাত নাড়ল, ” ইটস ওকে।”
-” আচ্ছা, স্যার। গত তিন দিন আগে তো ও আপনার ক্লাস করেছিল। তখন কী ও কিছু বলেছিল আপনাকে ? ”
-” আশ্চর্য, আমাকে বলবে কেন। এসব আপনাদের পারিবারিক ব্যপার স্যাপার।”
-” না ভাবলাম, ও তো আপনাকে খুব পছন্দ করে। তাই যদি বলে থাকে। আম্মা ওর জন্য খুব চিন্তিত। ” সাবা বুঝতে পারছেনা ও কী করবে। মুখ নামিয়ে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরছে।
পলাশ আড়চোখে একবার ওকে আরেকবার ঘড়ি দেখছে। ভেতরে ভেতরে ও সাংঘাতিক উত্তেজিত দুটো কারণে। এক সাবা নিজে আর দুই ওর নালিশটা। মেয়েটা বোরকা পড়েছে ঠিকই কিন্তু হিজাবের আড়ালে ওর নিঃশ্বাস প্রশ্বাস গুনতে মোটেও অসুবিধা হচ্ছেনা পলাশের। তাকালে নিজেরই দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। দ্বিতীয়ত, পলাশের এখনও বিশ্বাস হচ্ছেনা মেয়েটা এতোটা ইনোসেন্ট। যদিও তার হাবভাব ইনোসেন্ট মেয়েদের মত। কাজেই বুদ্ধিমানের কাজ হলো, প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাওয়া। বাদল স্যারের উপর রাগ হলো হঠাৎ। লোকটা একটা ফালতু টাইম দিয়েছে ওকে। এখন এই মেয়ের সামনে দাঁড়াল সে প্রশ্ন করে অতীষ্ঠ করে ফেলবে। তাছাড়া কে জানে, স্যারের সামনে এই মেয়ে বে-ফাঁস কিছু বলে বসলে আরেক কাহিনী। এখন পর্যন্ত তো ভদ্রই আছে। কী মতলব এঁটে রেখেছে তা তো আর জানে না । তারচে মানে মানে কেটে পড় পলাশ। নিজেকেই যেন সতর্ক করল। উঠে বাইরে চলে যেতে ধরলে পেছন থেকে বাদল স্যারের ডাকে থেমে যেতে হল।
– ” আরে পলাশ। কেমন আছ তুমি ? ”
-” এই তো ভাল স্যার। আপনি কেমন আছেন ? ”
-” আলহামদুলিল্লাহ। বসো, চা আনাই।” বাদল স্যার নিজের চেয়ারে বসে বেল বাজালেন। পলাশ দ্রুত হাত নাড়ল।
-” না, স্যার। আমার একটু তাড়া আছে।”
-” আরে কিসের তাড়া বসো তো। এই আমজাদের মা….!” বলে হাঁক ছাড়লেন বাদল স্যার। পলাশের কোন আপত্তিই তিনি কানে তুললেন না। অগত্যা পলাশকে বসতে হল তবে ওকে দেখে মনে হল ওর ফাঁসির হুকুম হয়েছে। চেহারায় রাজ্যের বিষন্নতা ভর করেছে তার। বাদল স্যার সাবাকে দেখিয়ে বললেন, ” ওনাকে চেনো নাকি ? ”
-” না তো, ইয়ে মানে ঐভাবে চেনা পরিচয় নেই তবে আগে দেখেছি।” খেই হারিয়ে ফেলল পলাশ।
-” কোথায় দেখেছ ? ”
-” এই তো, কোচিং এই সম্ভবত।”
-” হম। তোমার স্টুডেন্ট শিরির বোন এটা। চেনার তো কথা। এই মেয়েটাই ওর বোনকে ভর্তি করিয়ে গিয়েছিল। ”
-” হতে পারে। খেয়াল নেই।”
-” শিরি মেয়েটা গত তিনদিন ধরে মিসিং। আর ইনি বলছেন ওর বোনের প্রেমিক তুমি। সত্যি নাকি ? “

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here