ত্রয়ী পর্ব ৮

0
830

ত্রয়ী
মোর্শেদা হোসেন রুবি

৮||

মুক্কালা…মুকাবেলা…হোগা
ওহো…ল্যায়লা…।
বিশ্রী ভঙ্গিতে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছে ছেলেগুলো। সায়রা দরদর করে ঘামছে। অজান্তেই ব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরল বুকের সাথে । লম্বা বিটকেল ধরনের ছেলেটা এখন ওর দশ গজের মধ্যে। সায়রা বিড়বিড় করে আল্লাহকে ডাকতে লাগল। মাথার ভেতরটা ফাঁকা লাগছে ওর। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ায় ব্যাগের দিকে তাকাল। একইসাথে সতর্ক দৃষ্টি রাখল সামনের দিকে তাকাল। লম্বা ছেলেটা অনেকটা কাছে এসে পড়েছে। দু হাত শূণ্যে তুলে ঝাঁকাচ্ছে আর নাচার ভঙ্গিমা করছে। অন্যসময় হলে হয়ত নাচার ভঙ্গিমাটা নিয়ে ঠাট্টা করত নাগীন ডান্স বলে। কিন্তু আজ এটা ওর জীবন মরণের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্রুত ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ছোঁ মেরে বের করে আনল প্লাস্টিকের শপিং ব্যাগটা। কোনমতে মুখটা খুলেই ভেতরে হাত ঢুকিয়ে খাবলা মেরে তুলে আনল এক মুঠো লাল পাউডার। গেল সপ্তাহেই পলিথিনে মুড়ে ব্যাগে পুরেছে। ভারতের বিখ্যাত নাগা মরিচ গুঁড়া। রুৎবা খালামনি আম্মুকে পাঠিয়েছিলেন। সেখান থেকেই কিছুটা তুলে রেখেছিলেন। ক্লাসের এক বান্ধবীর পরামর্শে আজকাল ব্যাগে রাখা শুরু করেছে ওরা তিনজনই। দাম বেশী বলে সাবা দেশী মরিচের গুঁড়াই রাখে। সায়রা রাখে নাগামরিচ। যদিও এ পর্যন্ত কখনও কাজে লাগানোর প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু আজ যখন প্রয়োজন পড়ল তখন সন্দেহ হচ্ছে এর যথেষ্ট ব্যবহার করতে পারবে কি না।
দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করছে সায়রা। দৃষ্টি সেঁটে আছে সামনের ছেলেগুলোর দিকে। বুকের ভেতর অস্বাভাবিক গতিতে লাফাচ্ছে হৃৎপিন্ড। চারপাশে কোন মানুষের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক রাতের নিস্তব্ধতাকে আরো গাঢ় করে তুলেছে। সামনে এগিয়ে আসছে ঠিক মানুষের মত দেখতে তিনটা অমানুষ। একেকজনের অঙ্গভঙ্গি আর ইঙ্গিত চুড়ান্ত অশ্লীল। সায়রা আতঙ্কে কাঁপছে। ঠিক কতটুকু সামনে এলে এটা ছুঁড়তে হয় কোন ধারণা নেই। তারপরেও সতর্ক দৃষ্টি রাখল সামনের দিকে। লম্বা ছেলেটা কাছে এসেই ওর হাত চেপে ধরতে উদ্যত হল। ঠিক ঐ মুহূর্তেই শরীরের সমস্ত শক্তি আর ঘৃণার সাথে সায়রা ওর মুখে ছুঁড়ে মারল নাগা মরিচের ঝাঁঝাল গুঁড়ো।
ছেলেটা ‘আহ্..’ বলে চিৎকার করেই দুহাতে চোখ চেপে বসে পড়ল। এক মুহূর্তও দেরি না করে সায়রা পাশের জনের দিকে তাক করে ছুঁড়ল বাকি গুঁড়ো টুকু। উত্তেজনায় প্রথমবারেই বেশী চলে গিয়েছিল। সে তুলনায় এর চোখে কম। তারপরেও ছেলেটা মরিচ গুঁড়ার ভয়াবহ ঝাঁঝে মাটিতে বসে কাতরাতে লাগল। তবে প্রথম জনের অবস্থা মারাত্মক। সে সমানে চিৎকার করছে গলা ফাটিয়ে। হয়ত তার একটা চোখ গেছে। তৃতীয় জন মুহূর্তেই থমকে গেল সঙ্গী দুজনের অবস্থা দেখে। সে সামান্য দুরে থাকায় অবস্থা দেখে আর আগে বাড়ল না। আতঙ্কিত চোখে সঙ্গী দুজনের বেহাল অবস্থা দেখল। তবে সে আগেই সাবধান হয়ে গেছে। মেয়েটার আচরণ এমনিতেই সন্দেহজনক মনে হচ্ছিল ওর। এখন তা সত্যি হল। বোকার মত সাথের দুজনকে দেখল সে। প্রথম জনের চোখ আর নাক দিয়ে সমানে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। দ্বিতীয় জনের অবস্থাও তথৈবচ। দুজনের প্রবল হাঁচি আর যন্ত্রণাময় চিৎকারে মুখরিত হয়ে উঠল নির্জন এলাকাটা। মেয়েটার দিকে তাকাল। কী সাংঘাতিক মেয়ে। ব্যাগের মধ্যে মরিচগুঁড়া নিয়ে ঘুরছে।

সায়রা ঝুঁকেই পলিথিনটা দ্রুত তুলে নিয়ে আরেক খাবলা তুলতে গিয়ে টের পেল গুঁড়া তেমন নেই। যা আছে তা সামান্যই । ভয় আর ঝোঁকের মাথায় প্রথম বারেই একগাদা তুলে ফেলেছে। তারপরেও যা আছে কাজ চালানোর পক্ষে যথেষ্ট। তৃতীয় লোকটা একটু দুরে দাঁড়িয়ে শাসাচ্ছে সায়রাকে। সায়রা এবার যৎসামান্য হলেও আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে গিয়েও বাতাসে মরিচগুঁড়োর ঝাঁঝ টের পেয়ে মুখে ওড়না চেপে ধরে রাখল। ওর নিজেরই দম বন্ধ হবার যোগাড়। বাতাসে কেবল গুঁড়ো মরিচের ঝাঁঝাল ঘ্রান। নাক চেপে হাঁচি থামাল সায়রা।

তৃতীয় ছেলেটা আর এগোচ্ছেনা। প্রথম দুজন এখন ভয়াবহ ভাবে কাশতে শুরু করেছে। মরিচের ঝাঁঝে ওদের অবস্থা সঙ্গীন। সায়রা আর অপেক্ষা করল না। ঝুঁকে ব্যাগটা তুলে নিয়েই উল্টোদিকে ভোঁ দৌড়। ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে টের পেল, সে একেবারে মেইন রোডের উপর চলে এসেছে। বড় চওড়া একটা রাস্তা। হুঁশ হাঁশ গাড়ী যাচ্ছে। রাস্তায় লোকজন খুবই কম। প্রায় নেই বললেই চলে। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাল সায়রা। নাহ্, কেউ ধাওয়া করছেনা।
চারপাশে তাকাল একটা যানবাহনের আশায়। কিন্তু কোন গাড়ী চোখে পড়ল না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে ওর। বহুকষ্টে নিজেকে সংযত রাখল সায়রা।

===

-” ওস্তাদ, গাড়ী সোলো করেন। কপাল খুইলা গেছে।” চ্যাংড়া বয়সী হেল্পারের কথায় জানালা দিয়ে মেয়েটাকে দেখল হেলাল ড্রাইভার। তাকিয়ে মনে হল গলাটা মুহূর্তেই শুকিয়ে গেছে হেলালের। রীতিমত পরীর মত সুন্দর একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। কিন্তু এরকম সময়ে এই মেইন রোডের উপর এমন জলজ্যান্ত রুপসী মেয়ে। তাও আবার একা ? জিন ভুত নয়ত ? হেলালের সন্দেহ বাড়ল। তবে অজান্তেই গাড়ীটা স্লো করল কারণ মেয়েটা নিজেও হাত তুলেছে গাড়ী থামানোর জন্য।

হেলাল ত্রস্তে বলে উঠল, ” সাবধানে ভদ্রভাবে উডা। কইবি, পিছনে প্যাসেঞ্জার আছে। উডানের লগে লগেই আমি টান দিমু। জানালা সব বন্ধ করছোস নি ? ”
-” আগেই করসি উস্তাদ। গাড়ীডা থামান।” গেটে হাত ঝুলিয়ে ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করল হেল্পার।
-” কই যাইবেন আফা ? ”
-” ইয়ে, ঢাকা যাব। আমাকে আজিমপুর নামিয়ে দেবেন ? ”
-” আসেন। উইঠা পড়েন। যেহানে কইবেন ঐখানেই নামায় দিয়া আমু।”

সায়রা খানিক ইতস্তত করে অবশেষে বাসে উঠল। ভেতরে ঢুকতে যাবার আগেই নিজের নামটা কাউকে চিৎকার করে ডাকতে শুনে বুকের রক্ত ছলকে উঠল ওর।
চমকে গেটের বাইরে উঁকি দিতেই আরমানকে দেখে বিকট এক চিৎকার করে লাফ দিয়ে বাস থেকে নেমে পড়ল সায়রা।
-” কী অইল আফা। যাইবেন না ? ” হেল্পারের কণ্ঠে বিরক্তি। ভেতর থেকে হেলাল ড্রাইভার বিশ্রী একটা গালি দিয়ে উঠল। তবে গালিটা কাকে দিল তা বোঝা গেলনা।
সায়রা এসব শোনার মত অবস্থায় নেই। সে সব ভুলে সোজা আরমানের বাইকের দিকে ছুটল।

আরমানকে দেখা গেল মুখ কালো করে বাইকের উপর বসে আছে। সায়রা দৌড়ে কাছে যেতেই দেখল আরমান বাইকের স্টার্ট বন্ধ করেনি। সায়রাকে দেখে তাগাদা দিয়ে বলল, ” তাড়াতাড়ি আমার বাইকের পেছনে উঠে বসো। কথা পরে। আগে ওঠো। বাসের লোকটা ঝামেলা করতে পারে।”
সায়রা আর কথা না বাড়িয়ে চটপট উঠে বসল আরমানের পেছনে। সাথে সাথেই আরমান বাইক ছোটাল ঢাকা অভিমুখে।

====

রাত দুটো। আরমানদের বাড়ীর ড্রইংরুম গমগম করছে। আরমানের বাবা, মা ছোটবোন, সায়রার মা আর মঈনকে দেখা যাচ্ছে সেখানে। তবে কথা যা বলার নীলিমা একাই বলছেন। তিনি বেশ রাগারাগি করছেন আরমানের বাবা-মায়ের সাথে। আরমানের মা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। এমন সময় বেল বাজল। আরমানের বাবার ইশারায় ওর ছোট বোনটা ছুটে গিয়ে দরজা খুলেই চিৎকার দিল, ” ভাইয়া তুই ? ”
ঘরের প্রত্যেকে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল দুজন বিধ্বস্ত তরুণ- তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। দুজনকেই ক্লান্ত আর বিপন্ন দেখাচ্ছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here