ত্রয়ী পর্ব ৯

0
835

ত্রয়ী
মোর্শেদা হোসেন রুবি
৯||

অনেক কথাই হতে পারত। প্রশ্নবৃষ্টি শুরু হবার আগেই ড্রইংরুমের মেঘলা আবহাওয়া দেখে নীলিমা চট জলদি একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। তার মেয়ে পাওয়া দরকার ছিল, তা তিনি পেয়ে গেছেন। এখন যেসব কথা হবে সেসবের সাথে তার স্বার্থগত কোন মিল বা দ্বন্দ নেই। বলতে গেলে অনর্থক কালক্ষেপণ। যা’ই ঘটে থাকুক না কেন, এখানে মেয়ে বিয়ে দেবেন না তিনি। কাজেই এদের সাথে তেলানো আলাপে কাজ কী। খপ করে সায়রার কব্জি ধরে ওকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। পেছনে মঈন। সায়রা কী বলবে বা করবে বুঝে ওঠার আগেই বন্দী হলো গাড়ীর ভেতর।
পুরোটা পথ কোন কথা বললেন না নীলিমা। থমথমে মুখ নিয়ে মঈনের সাথে স্বাভাবিক কথা চালিয়ে যেতে লাগলেন। বাড়ি পৌঁছেই মঈনকে বললেন,
-” মঈন ? ”
-” জি আপা।”
-” রুৎবাকে ফোন দে।”
-” এখনই ? ”
-” এখন বলছি তো এখন দিবি না তো কখন দিবি ? ”
-” না, মানে। এখন তো রাত…!”
-” তোর কী ধারণা আমি ঘড়ি চিনি না ? ”
মঈন কথা না বাড়িয়ে ফোন দিল রুৎবাকে। সায়রা তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। মঈন ফোন কানে লাগিয়ে কিছু বলতেই যাচ্ছিল তার আগেই নীলিমা ছোঁ মেরে টেনে নিলেন ফোনটা।
-” হ্যালো রুৎবা ? ”
-” জি, আপা।”
-” সায়রাকে তোর কাছে কবে নিতে পারবি ? ”
-” ওমা, তুমি যখন বলবে তখনই ও আসবে। আগেই তো বলেছি। আমার কোন সমস্যা নেই। তাছাড়া ওর কাগজপত্র সবই তো আছে। বাকি যা ফরমালিটিজ দরকার তা প্রতীক্ষার বাবা দেখবে।”
-” গুড। তাহলে আমি এদিকে সব গুছাই। ”
-” হম, তা করতে পারো। কোন সমস্যা হয়েছে আপা?”
-” হ্যাঁ, তোর ভাগনী আজ এক ছেলের সাথে ভেগে গিয়েছিল। এইমাত্র সে প্লেজার ট্রিপ সেরে বাসায় ফিরেছে।”
-” ইন্না-লিল্লাহ। সিরু এমন একটা কাজ করবে ভাবতেই পারছিনা। ওকে ফোনটা দাও তো, একটু কথা বলি।”
-” দরকার নেই। ওর সাথে আর কোন কথা হবেনা। ওকে প্লেনে তুলে দিয়ে তবেই আমার শান্তি। এমন হাড় বজ্জাত মেয়ে আমি রাখবোনা। আপাতত তোর কাছে ওকে রাখ। তারপর ওর বাবা ফিরলে বিয়ের ব্যবস্থা করব তারপরই ওর মুক্তি।” কথা শেষ করে মঈনকে ওর ফোন ফেরত দিতেই নীলিমা সায়রার তীব্র প্রতিবাদ শুনলেন ।
-” আমি কোত্থাও যাবো না।”
মেয়ের কথা শেষ হওয়ামাত্র ঘুরে তাকিয়েই প্রচন্ড চড় কষালেন । সাথে সাথেই পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ ফুটে উঠল সায়রার ফর্সা গালে। নীলিমা তর্জনী তুলে হিসহিস করে শাসালেন মেয়েকে।
-” আর একটা কথা না। এক্কেবারে মেরে হাড় গুঁড়িয়ে দেব পাজি বজ্জাত মেয়ে।” সায়রা গালে হাত রেখে ঠান্ডা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

এই মধ্যরাতেই ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল সারল সায়রা। পেটের ভেতর ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি করছে কিন্তু তারপরেও সে খাবেনা বলে ঠিক করেছে। সেই জেদ থেকে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে সায়রা। অবশ্য তাতে নীলিমার কিছু যায় আসেনি। তিনি শান্ত মুখে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকেছেন। সায়রা খিদে সহ্য করতে পারেনা। তারপরেও এতটা সময় কেমন করে ছিল বলতে পারবেনা। খিদেটা ভু্লে থাকার জন্য ফোন হাতে নিল। তোয়া বা সাবাকে কল দিয়ে লাভ নেই। দুজনেই এখন গভীর ঘুমে। তারচে আরমানকেই দেয়া যাক। ওর সাথে তেমন কোন কথাই হয়নি। কীভাবে কী হল জানা দরকার। ওর বাসার কী অবস্থা কে জানে। তাছাড়া সায়রাকে দেশছাড়া করার পাঁয়তারা করছে ওর মা এটাও তো জানানো দরকার ওকে।
একটু ভেবে ফোন চেপে কানে ধরল। আর তখনই মনে পড়ল আরমানের সেলফোন ওরা মেরে দিয়েছে। কল কেটে দিয়ে আরমানদের ল্যান্ডফোনে রিং করল সায়রা। নাম্বারটা আগে থেকেই ছিল ওর কাছে। একটু সন্দেহ ছিল আরমান ধরবে কি না। ঠিক করেছে অন্য কেউ ধরলে কেটে দেবে। তবে সায়রাকে খুশি করে দিয়ে আরমানই ধরল।
-” হ্যালো? ”
-” হ্যালো আরমান ? ”
-” তুমি ? এতরাতে আবার ফোন কেন করেছ ? ”
-” কী করছেন আপনি ? ”
-” গুন্ডাদের হাতে মার খেয়ে বাড়ী ফেরার পর নায়করা যা করে তাই করছি। আবার কী করব ?”
-” কী করে নায়করা? ”
-” তুমি কী এটা জানতেই ফোন দিয়েছ?”
-” আমাকে এ সপ্তাহেই দার্জিলিং পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে আরমান।”
-” বল কী ? কার কাছে? ” সুর কিছুটা নরম হল আরমানের।
-” ছোট খালামনি।”
-” অহ। ভালই তো। যাও।”
-” মানে ? আপনি আমাকে আটকাবেন না?”
-” কেন ? আমি আটকাব কেন ? হু এম আই ? ”
-” এত রেগে রেগে কথা বলছেন কেন ? ”
-” তিনটা অমানুষ আমাকে বেধড়ক পিটিয়েছে। আমার দামী ফোন রেখে দিয়েছে। সারা শরীরের গিঁটে গিঁটে ব্যথা। বাড়ী ফিরে একগাদা কথা শুনতে হয়েছে। তারপরও তুমি কীভাবে আশা কর আমি তোমার সাথে হেসে হেসে কথা বলব ? ”
-” স্যরি, আরমান। সব আমার জন্য।”
-” বোঝোই যখন তখন জিজ্ঞেস কর কেন ? ”
-” আচ্ছা, আপনি আমাকে পেলেন কীভাবে ? ”
-” এগুলো নিয়ে এখন আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না সায়রা।”
-” জানেন, আর একটু হলেই আমি একাই রওনা দিয়ে দিতাম। আপনার সাথে দেখা হত না।”
-” আল্লাহর শোকর কর যে দেখা হয়েছে। নয়ত কাল পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হতে।”
-” কেন ? ”
-” তোমার কী ধারণা বাস ড্রাইভার আর হেল্পার তোমাকে সসম্মানে বাসায় পৌঁছে দিত ? ”
-” আমার কাছে নেইল কাটার ছিল। একদম নতুন। ফাজলামি করতে এলে গলার রগ কেটে ফেলতাম।”
-” তুমি তো সাংঘাতিক মেয়ে দেখা যায়। ব্যাগের মধ্যে এসব নিয়ে ঘোরো নাকি ? ”
-” শুধু মরিচগুঁড়া আর নেইলকাটার।”
-” তাতেই কী সম্মান বেঁচে যাবে ? এতোটা বেপরোয়া হওয়া ভাল না সায়রা। জীবনটা নাটক সিনেমা না।”
-” জানি। ”
-” আচ্ছা ফোন রাখো।”
-” বললেন না, আমাকে কীভাবে পেলেন? ”
-” কীভাবে আর পাব। জ্ঞান ফেরার পর তোমাকে ঐখানেই কয়েক চক্কর খুঁজেছি। ফোনও ছিল না যে ফোন দেব। তারপর হেঁটে হেঁটে বাইক পর্যন্ত আসি। ভাগ্য ভাল ওরা বাইকের খবর জানতো না। নইলে এটাও নিয়ে নিত। ”
-” তারপর বাইক নিয়ে আমাকে পেয়ে গেলেন? ”
-” নাহ্, তোমার জন্য অনেকক্ষণ ধরেই বেরোবার মুখটাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম আর বারবার ভেতরের রাস্তা আর মেইনরোডের উপর চোখ রাখছিলাম। কারণ জানতাম তুমি বেরোলে এদিক দিয়েই বেরোবে।”
-” যদি না বেরোতাম ?”
-” তাহলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার ভেতরে খুঁজতাম। তবে আমার মন বলছিল তোমার কিছু হয়নি। কারণ তুমি খুব সাহসী মেয়ে। যেভাবে ঝেড়ে দৌড় দিয়েছিলে আমাকে ফেলে।”
-” কী করব বলেন। জানের চেয়ে মান বড়। প্রানভয়ে যে দৌড়াইনি তা আপনিও জানেন।”
-” দেখ, মেয়েদের এভাবে ঝুঁকি নেয়া উচিত না। আমার কথা শোনো, তোমার বাসা থেকে যা বলে তাই করো।”
-” আপনি আমাকে বিয়ে করবেন না, তাই না? ”
-” এখন আর এটা সম্ভব না সায়রা। তাছাড়া বিয়ের জন্য চুল, টাক, লম্বা এসব কোন মানে রাখেনা। আমি নিজেও যথেষ্ট ডিস্টার্বড। এসব নিয়ে আর ভাবতে চাই না। সামনের দিনগুলো আমার জব ক্যারিয়ার এসব নিয়ে ভাবতে চাই। তাই তোমার প্রতিও আমার অনুরোধ থাকবে। প্লিজ, ডোন্ট কল মি।”
-” মানে? ”
-” মানে সহজ। আমাকে আর ফোন দিও না। ”
-” আরমান শোনেন…!”
কল কাটার শব্দে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল সায়রা। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল ওর।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here