ধ্রুবতারা
পর্ব_২৬
পুষ্পিতা_প্রিমা
পরদিন সবাই ফিরলো শহরে। রাহা ফিরতে চাইলো না কিন্তু ফিরতে হলো তাননার জোরাজুরিতে। রোয়েন তাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে অন্যত্র চলে গেল। তার গ্রামের দু একটা হসপিটাল ভিজিট করার আছে। সে কালকে শহরে ফিরবে।
রাহাকে বাড়ি ফিরতে দেখে খুশি হলো নাহিল আর সোরা। তবে সালেহা বেগম বললেন
‘ ফেরার কি দরকার ছিল? তালাক হওয়া দুইজন এক বাড়িতে থাকা এমনিতে ও ভালো না। আমাদের সময় মুখ দেখাদেখিও তো করতো না। কিন্তু কি যুগ আসলো। একই বাড়িতে থাকতে হবে তাদের।
তাননা বলল
‘ তালাক হয়ে গেছে তো কি হয়েছে দাদু? মনে করো ওদের আগে কোনো কিছু হয়নি। বিয়েও হয়নি ডিভোর্স ও হয়নি।
সালেহা বেগম বলল
‘ এটা আবার কেমন কথা? ওদের বিয়ে হয়েছে, তালাক ও হয়েছে। সব হয়েছে। কিছু মনে করব না এটা আবার কেমন কথা?
তাননা আর ও কিছু বলতে যাচ্ছিল। রাহা বলল
‘ কথা বাড়ানোর কি দরকার আছে আপু? আমি তো তোমাকে বলেছি আমাকে জোর করে এনো না এখানে। আমি ওখানেই ভালো ছিলাম।
তাননা আর ও কিছু বলতে গেল। সোরা ইশারায় চুপ করতে বললো।
রাহা রুমে চলে গেল। সোরা গেল তার পিছু পিছু। রাহা মুখহাত ধুঁয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই সোরাকে দেখলো। থেমে গেল। আর এগোলো না। সোরা নিজেই এগিয়ে গেল। মেয়েকে টেনে এনে বুকে জড়িয়ে বলল
‘ তোমার ফোন কোথায়?
রাহা নরম গলায় আওয়াজ করলো।
‘ আছে। বন্ধ।
‘ কেন?
‘ যাতে কেউ কল দিতে না পারে।
সোরা বলল
‘ আমি তোমার মা। আমার সাথে তোমার রাগ করা মানায় না রাহা। আমি তোমায় যতটা শাসন করি, তারচাইতে ও বেশি ভালোবাসি। আমি মা হয়ে মেয়ের খারাপ কখনো চাইবো না। চাইনি। চাইনা।
রাহা মুখ তুললো। টলটলে চোখে বলল
‘ আমার খারাপ তো কেউ চায়নি আম্মা। আমার সাথে তারপর ও কেন খারাপ হয়? আমি ও কারো খারাপ চাইনি। কিন্তু দেখোনা সবাই ভাবে আমার জন্যই সব খারাপ হয়। কেউ হারিয়ে গেলে তার দায় আমার। কেউ অসুস্থ হলে তার দায় আমার। বাড়িতে অশান্তির কারণ ও আমি। আমি এমনটা কখনো চাইনি আম্মা। তুমি ও তো ভুল বুঝো আমায়। আব্বার মতো করে বুঝতে চাওনা। আব্বা ছাড়া কেউ ভালো করে বুঝতে চায় না আমায়। আব্বার মতো কেউ ভালোবাসেনা আমায়।
সোরা কিছু বলতে পারলো না। নিজের জঠরের সন্তান যখন অভিযোগ তুলে তখন কি বলার থাকে? তবে সোরা এটুকু জানে সন্তানের খারাপ কখনো কোনো মা-ই চায় না। সোরা ও কখনো চায়নি। সে সবসময় চেয়েছে রাহা ভালো থাকুক। ভালো থাকুক তার প্রিয় ভালোবাসার মানুষটার সাথে। হয়ত রাহার কপালে ছিল না? কপালের লিখন কে খণ্ডাতে পারে? অত সাধ্য কার?
রোয়েন ফিরলো তারপরের দিন। মেজাজ তখন চরম পর্যায়ে। গ্রামের হসপিটালগুলোতে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। চিকিৎসা না পেয়ে মানুষ রোগে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। শহরের হসপিটালে মানেই তাদের কাছে টাকার বান্ডিল। এই ভয়ে ও কেউ শহরে আসেনা। কিন্তু এমন হলে তো মানুষ সামান্য জ্বরে ও মারা যেতে পারে। তার বাবার দেশ, তার দাদার দেশ। তার পূর্বপুরুষের দেশ, দেশের মানুষ যদি এমন অবস্থায় থাকে তাহলে তাদের উন্নতি কোথায় হলো? এত এত দান, খয়রাত দিয়ে কি হচ্ছে? যেখানে নিজের দেশের মানুষ চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। কথায় আছে, আগে ঘরে বাতি জ্বালাও, পরে মসজিদে।
রোয়েন সিদ্ধান্ত নিল স্কুলের পাশে তাদের যে জমিটা খালি পড়ে আছে ওখানে একটি হসপিটাল তুলবে। বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হবে দুঃস্থ, অসহায়, গরিব মানুষদের।
তাননা সমর্থন জানালো তার সিদ্ধান্তে। নাহিল ও সম্মতি দিল। সালেহা বেগম শুনে বলল
‘ আল্লাহ তোকে অনেক বড় করুক ভাই। দুঃস্থ মানুষের পাশে থাকিস সবসময়। আমি যখন তোর ফুপীকে নিয়ে বস্তিতে থাকতাম তখন খুব কাছ থেকেই অসহায় মানুষদের অসহায়ত্ব দেখেছি। কাজ করে নায্যমূল্য পায় না তারা। বিনা চিকিৎসার অভাবে মরে অল্পতেই।
রোয়েন বলল
‘ যেখানে সমাজের রাঘব বোয়ালগুলো চুপ থাকে সেখানে আমাদের মতো সামান্য চুনোপুঁটিগুলো কি করবে দাদু? গ্রামে হসপিটাল তোলার কথা বলায় গ্রামের চেয়ারম্যান আমাকে ডেকে বললেন গ্রামের পুলটা ঠিক করার জন্য। তাদের নাকি চলতে অসুবিধা হয়। রিকশা যেতে পারেনা ওই পুলের উপর দিয়ে। ঝড় হলে অবস্থা খারাপ হয়। তুমি বলো যারা দুটাকা খরচা করে একটা পুল দিতে পারেনা তারা করবে দুঃস্থ মানুষকে সাহায্য?
অথচ নিজের কতবড় দালানবাড়ি। আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। অ্যাপায়নে ত্রুটি নেই। অথচ খোঁজ নেই গ্রামের কত মানুষ না খেয়ে আছে? গ্রামের এসব কাজ কারবার দেখলে মাথা খারাপ হয় আমার। তারউপর তো বাল্যবিবাহ আছেই। চৌদ্দ পনের বছরের মেয়েগুলোকে ত্রিশ চল্লিশ বছরের বয়স্ক পুরুষদের সাথে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারপরেই মেয়েগুলো সন্তান প্রসবের সময় কিংবা অল্পসময়ে জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। সুষ্ঠু চিকিৎসা তো পাচ্ছেই না। এসবের জন্য কে দায়ী? গ্রামের মাতব্বরগুলোই তো। তাহলে যদি তারা সাবধান না হয় তাহলে এতসব সমস্যা দূরীভূত হবে কি করে?
তাননা বলল
‘ আচ্ছা, ঠিক আছে। এসব নিয়ে বাবাইয়ের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিস। এসেছিস কিছু খা, তারপর রেস্ট নে।
রোয়েন নিজের ঘরে চলে গেল। শাওয়ার নিল লম্বা সময় ধরে। তাননা কফির মগ আনলো। রোয়েন মাথা মুছতে মুছতে বলল
‘ তুই কি চলে যাবি?
তাননা মিনমিন স্বরে বলল
‘ মা ফোন করল আজকে। জিশানকে নাকি মিস করছে। কথায় সামান্য রাগের আভাস ও পেলাম। চলে যেতে হবে হয়ত। তোর ভাই তো কিচ্ছু বলে না। সব আমার উপর ছেড়ে দেয়।
রোয়েন বলল
‘ কি করবি আর? যাহ। তোর ঘর আছে, সংসার আছে। ভাইয়ের হাত ধরে বসে থাকার সময় তো কবেই চলে গেল।
তাননা বলল
‘ আমি তোর জ্বালায় কোথাও গিয়ে শান্তি পাই না। একটা বিয়ে করে নে। তোকে কারো হাতে তুলে দিতে পারলেই শান্তি। যার তার হাতে নয়, যে তোকে ভালো রাখবে। ভালো বাসবে। আগলে রাখবে। তোর অসুখ হলে সেবাযত্ন করে সারিয়ে তুলবে।
মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে কফির মগ নিয়ে নিল রোয়েন। মগে চুমুক দিয়ে বলল
‘ ভাইকে নিয়ে এত চিন্তা তোর। ভালো কথা। কিন্তু বিয়ে বিয়ে করিস না। এই বিয়ে নিয়েই তো এত ঝামেলা হলো। শেষমেশ আমার পিএইডিটা মাটি। সে যাইহোক এখানেই নিতে হবে আপাতত। কি আর করার?
তাননা বলল
‘ একটা কথা জিজ্ঞেস করব? সত্যি করে বলবি। মিথ্যা বলবি না মুননু।
রোয়েন কপট রাগ দেখিয়ে বলল
‘ আমি কখন মিথ্যে বলি তোকে?
তাননা বলল
‘ বলব?
রোয়েন চুপ করে রইলো। তাননা হেসে ফেললো। ভাইয়ের কাছে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। দুলতে দুলতে বলল
‘ এই মুননু সত্যি করে বল তুই রাহাকে ভালোবাসিস? বল।
হাত দুটো আলগা করে কফির মগে চুমুক বসাতে যাচ্ছিল রোয়েন। তাননার কথায় গালে থাকা কফিগুলো ছিটকে পড়ে মেঝেতে পড়লো। তাননা তাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল
‘ কি হয়েছে?
রোয়েন বলল
‘ কোথায় কি হয়েছে? এমনি পড়ে গেল।
তাননা বলল
‘ যাহ মিথ্যে বলছিস। বল না সত্যিটা। ভালোবাসিস?
রোয়েন নাকমুখ বিচ্ছিরি করে বলল
‘ ইয়াক কি বাজে শোনায় কথাগুলো? তোর কি আমাকে দেখে মজনুর মতো লাগছে? ফালতু কথা বলিস কেন? ভালোবাসা শব্দটাই তো বিচ্ছিরি, জঘন্য। আমি কেন ওসব করতে যাব?
তাননা বলল
‘ তারমানে ভালোবাসিস না। ঠিক বলেছি?
রোয়েন কফির মগে চুমুক দিল। তাননা ডাকলো
‘ এই মুননু?
রোয়েন বলল
‘ আরেহ যাহ তো। মাথা খারাপ করিস না। যাহহ।
তাননা বলল
‘ আমায় কান্না পায় তোর কথায়।
রোয়েন বলল
‘ কান্না কর। কর। তোর জামাই জানে তুই অন্যের জামাইকে জ্বালিয়ে মারিস? জানে?
তাননা হাসি-হাসি মুখ করে বলল
‘ কার জামাই? রাহার জামাই? বল বল?
রোয়েন বলল
‘ ফালতু কথা বলবি না। যাহ তো ভাই। যাহ। তোর প্যানাপ্যানানি ভালো লাগেনা।
তাননা বলল
‘ আমি সবাইকে বলে আসি তুই রাহাকে বিয়ে করতে চাস। বলি?
রোয়েন বজ্রগম্ভীর স্বরে ডাক দিল
‘ তাননা? চড় মেরে দাঁত ফেলে দেব। বেয়াদবি করবি না। রাহাকে আমি কেন বিয়ে করব? রাহার সাথে আমার কি?
তাননা বলল
‘ রাহা তোর বউ। তোর ওয়াইফ। তোর স্ত্রী। তোর বাচ্চাকাচ্চার মা।
রোয়েন থম মেরে চোয়াল শক্ত করে তাননার দিকে চেয়ে রইলো।
তাননা বলল
‘ রাহাকে অন্য কোথাও বিয়ে দেবে বাবাই। দেখবি ও ভালো থাকবে। কিন্তু তুই পটাশ! দেবদাস থাকবি। তোর মতো গোঁয়ার, ত্যাড়াকে কে বিয়ে করবে? কে ভালোবাসবে?
রোয়েন বলল
‘ ভুল কথা।
তাননা বলল
‘ কোনটা ভুল কথা?
‘ রাহার বিয়ে হচ্ছে না৷ বিয়ের কি দরকার? যেভাবে আছে সেভাবে ভালো আছে আমি দেখছি। বিয়ের দরকার নেই। রাহা বিয়ে করবে না।
তাননা বলল
‘ রাহা বিয়ে করবে। কিন্তু তোকে তো জীবনে ও করবে না। আমি তো ওসব কথার কথা বলেছি। তোর সাথে রাহার যায় নাকি? রাহার সাথে তোর বিয়ে নাজায়েজ হয়ে গেছে। রাহাকে তো তুই ভুলে ও পাবিনা। সেই ভালো বাস, কিংবা না বাস।
রোয়েন বলল
‘ তুই যাহ তো ভাই। মেজাজ খারাপ করিস না। এই বাড়িতে কোনো বিয়ে টিয়ে হবে না আর। বিয়ে মানেই আস্ত একটা ঝামেলা।
তাননা বলল
‘ রাহার বিয়ে হবে। ওর ছোট নোহার বিয়ে হয়ে গেছে। ওর বিয়ে হয়নি এটা নিয়ে প্রতিবেশীদের মধ্যে কত গুঞ্জন তুই জানিস?
রোয়েন বলল
‘ প্রতিবেশী কি বললো সেটা দেখিস কেন? প্রতিবেশী তুই না খেয়ে থাকলে খোঁজ নেয়? তোকে একবেলা ডেকে খাওয়ায়? তোকে দুপয়সা দিয়ে সাহায্য করে? তাহলে?
তাননার এবার ভীষণ মন খারাপ হলো। ভীষণ মন খারাপে সিক্ত হয়ে সে বললো
‘ তুই আস্ত একটা পাথর মুননা। রাহার উচিত হয়নি তোর মতো পাথরকে ভালোবাসার। অবশ্য সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে এবার।
রোয়েন তাননার দিকে তাকালো। তাননা তাকে চুপ থাকতে দেখে বললো
‘ তুই নিখোঁজ হওয়ায় মেয়েটা কতটা ভেঙে পড়েছিল তুই জানিস? আরেহ তুই জানবি কি করে? তোর অত সময় কোথায়? তুই তো মানবদরদি, গ্রামের অসহায় দুঃস্থ মানুষদের জন্য তোর মন কাঁদে। কিন্তু তোর পাশেই থাকা দেয়ালের ওপারে মেয়েটার আর্তনাদে তোর মন কাঁদেনা। তুই তাকে বুঝিস না। তার শুকিয়ে যাওয়া চোখের জলের কারণ খুঁজিস না? তুই কেন এমন মুননা?
রোয়েন বেশকিছু বললো না৷ শুধু এটুকুই বললো
‘ এসব আমার উপরে আনা মিথ্যে অভিযোগ। আমি পাথর নই।
তাননা রোয়েনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল
‘ তুই পাথর। আস্ত একটা পাথর।
রোয়েন হনহন পায়ে ড্রয়িংরুমে চলে এল। জায়িদ বসা সোফায়। নাহিলের সাথে। ঈশান দুহাত মুখের কাছে রেখে বসেছে। সোয়েভ রোয়েনকে দেখে নড়েচড়ে বসলো। রোয়েনকে দেখে তাদের প্রতিক্রিয়া, ভাবাবেগ পরিবর্তন হলো। রোয়েন বুঝে গেল যা বুঝার। কপট রাগমিশ্রিত গলায় বলল
‘ এই বাড়িতে কোনো বিয়ে হবে না। যাকে বিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে বিয়ে দাও৷ নয়ত আমাকে বলো, চলে যাব।
জায়িদ বলল
‘ এসব কেমন কথা মুননা? রাহা এই বাড়ির মেয়ে। রাহার ভালো অন্তত এইবার চাও। এইবার তোমাকে নিয়ে আর কোনো সমস্যা হবে না।
রোয়েন বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। বিয়ে ছাড়া কি থাকা যায় না? কেন বিয়ে করতে হয়?
সোয়েভ তার পিছু পিছু দৌড় লাগালো। রোয়েনের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
‘ বন্ধু এইবার অন্তত চেপেচিপে রাখা কথাগুলো ফাঁস কর। এভাবে চলতে থাকলে চিরতরে নিঃস্ব হবি। আমি জানি তুই রাহার বিয়েতে খুশি না। কেন খুশি না কারণটা উল্লেখ কর এইবার? আর কতদিন ইয়ার?
রোয়েন বলল
‘ আরেহ যাহ৷ রাহাকে গিয়ে বল ড্যাংড্যাং করে বিয়ে করে নিতে। আমার কি যায় আসে? রাহাকে নিয়ে ভাবার অত সময় কোথায়? কত কাজ আমার৷
সোয়েভ ক্ষেপে বলল
‘ যাহহ তুই কাজ নিয়ে থাক। থাক তোর মতো। রাহার বিয়েতে ও নাক গলাবিনা শালা।
রোয়েন ফিরে বলল
‘ মুখ সামলে কথা বল সোয়েভ। তোর কি যায় আসে? তুই এত কথা বলছিস কেন?
সোয়েভ বলল
‘ আমার অবশ্যই যায় আসে। রাহাকে আমার মামাতো ভাইয়ের জন্য নিয়ে যাচ্ছি।
রোয়েন বলল
‘ তাই নাকি? ভালোই তো। আমি তো ভেবেছি তোর জন্য নিয়ে যাচ্ছিস।
সোয়েভ সাথেসাথে ঘুষি বসালো রোয়েনের মুখে। রোয়েন বাইকের কাছে গিয়ে পড়লো। কপালে নাকে,মুখে ব্যাথা পেল।
সোয়েভ নিজে নিজে আঁতকে উঠলো৷ দৌড়ে গিয়ে রোয়েনকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে ফেলে বলল
‘ কেন এমন করিস রোয়েন? আমি তোকে আঘাত করতে চাইনি। বিশ্বাস কর,
রোয়েন ছাড়িয়ে নিল নিজেকে৷ যেতে যেতে বলল
‘ আমি আঘাত পায় না৷ যে যে-রকম ইচ্ছা করুক। আমার যা ইচ্ছা আমি তাই করব। তোর ও যা ইচ্ছা তাই কর৷ যার জন্য ইচ্ছা তার জন্য নিয়ে যাহ। আমার কিচ্ছু যায় আসেনা।
______________
রাহার জন্য আনা শাড়িটা খাটে রাখলো নোহা। রাহা শাড়ি দেখে বলল
‘ এই খয়েরী শাড়িটা পড়ি। ওটা পড়বো না।
নোহা রাহার দিকে তাকিয়ে বলল
‘ ঠিক আছে। তোমার যেটা ভালো লাগে।
রাহা খয়েরী শাড়িটা পড়লো। এটা বোধহয় একবারই পড়েছিল সে। মনে পড়ছেনা কখন পড়েছে। তবে পড়েছিল। আম্মা বলেছিল যখন সে পাগল ছিল তখন একবার পড়েছিল। কে দিয়েছিল সেটা ও জানা নেই।
সোরা দেখতে এল রাহার হয়েছে কিনা। তাননাকে না দেখে বলল
‘ তাননা আসেনি?
নোহা বলল
‘ আপুর নাকি মাথা ব্যাথা করছে।
সোরা বলল
‘ ওহহ।
রাহার মাথার পেছনে বাঁধা খোপা। প্রসাধনিহীন চেহারাটিতে রাজ্যের ক্লান্তি, অবসাদ। তেল ছিটছিটে মুখটা মুছে দেওয়ার চেষ্টা করলো নোহা। বারণ করলো রাহা।
‘ থাক না। এভাবেই যাই। বিয়ের পর তো দেখবে আমি কেমন।
নোহা বলল
‘ ছেলের মা বোন আসছে। ওরা তো দেখবে।
রাহা বিরক্ত হলো।
নোহা তাই কথা বাড়ালো না। বের হয়ে গেল রুম থেকে৷ রাহা ও বের হয়ে গেল অনেক্ক্ষণ পর। উদ্দেশ্য তাননার ঘর।
তাননা শুয়েছিল বিছানায়। জিশান ঘুম। ছেলেটা অবেলায় ঘুমায় আজকাল। তাননা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছে। রোয়েন এসে কয়েকবার ডাকলো তাকে। তাননা চেতন থেকেও উঠলো না। রোয়েন তার হাতের বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে ডাকল
‘ তাননা এই অবেলায় ঘুমাচ্ছিস কেন? শরীর খারাপ লাগছে?
তাননা রোয়েনের হাতটা ফেলে দিল ঝেড়ে। রোয়েন আবার হাত দিল কপালে। দেখলো টেম্পারেচার নর্মাল। তাননা আবার ও তার হাতটা ঝেড়ে ফেলে দিল। বলল
‘ দূর হ আমার সামনে থেকে। খোদার কছম মুননা। রাহার বিয়ে যদি অন্য কারো সাথে হয়ে যায় এই বাড়িতে পা জীবনে ও রাখবো না আমি। তুই কোন ললনাকে বিয়ে করবি কর। কিন্তু কখনো আমাকে এখানে আসতে বলবি না।
রোয়েন নিচু গলায় বলল
‘ নাজায়েজ বিয়ে জায়েজ করার জন্য কেন উঠে পড়ে লেগেছিস। ভালো কাজ করার আর ও সুযোগ আছে। সেগুলো কর। উঠে বোস। ভালো লাগছেনা এভাবে দেখতে।
তাননা উঠে বসলো।
রোয়েন রুম থেকে বের হয়ে যেতেই থমকে গেল। তেলতেলে অবসাদগ্রস্ত চেহারায় শাড়ি পড়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে এক রমণী। রোয়েন চোখ নামিয়ে তাকালো রাহার দিকে। রাহা চোখ তুলে তাকালো। পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে ফেললো। রোয়েন বাম হাত দিয়ে মুখ মুছে বলল
‘ দেখি পথ ছাড়ো।
রাহা পথ ছেড়ে দিল। রোয়েন বলল
‘ আমার শাড়ি পরে কারো সামনে যাবে না। আমার শাড়ি আমার ঘরে গিয়ে রেখে এসো।
রাহা চমকালো।
‘ আপনার শাড়ি?
‘ যেটা পড়ে আছ।
রাহা বলল
‘ থাক না। এটাতে বেশি ভালো লাগছে মনে হচ্ছে। পরে না হয় দিয়ে দেব। পরের জিনিস নিজের কাছে রাখিনা আমি। যাওয়ার আগে দিয়ে যাব।
রোয়েন ক্ষ্যাপাটে চোখে চেয়ে রইলো। রাহা বলল
‘ মারপিট কার সাথে করেছেন?
‘ তুমি জেনে কি করবে? যা করছ তাই করতে থাকো। বেশি জানার চেষ্টা করোনা।
রাহা বলল
‘ করছিনা। আমার আগ্রহ, কৌতূহল খুবই কম৷ আপনার ব্যাপারে তো একদমই কম। আমি তো পারিনা আপনাকে দুচোখে না দেখতে।
একদম দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে এমন ভয়ংকর আওয়াজ করে কিছু একটা ভেঙে গেল। কিন্তু হায় আওয়াজ হলোনা।
রোয়েন বলল শেষমেশ
‘ তোমার আশা পূরণ হতে যাচ্ছে। ভালো।
রাহা বলল
‘ দোয়া করবেন যাতে যার কাছে যাচ্ছি তাকে যেন ভালো রাখতে পারি। আমার কাছে তো আবার ভালো থাকেনা কেউ।
বাঁকা হাসলো রোয়েন।
‘ আমার দোয়া শাপ হয়ে দাঁড়ায় শেষে। দোয়া চেওনা রাহা। তুমি ভালো থাকবে না। তুমি ভালো থাকতেই পারো না। আমি ভালো চাই না তোমার।
রাহা চুপটি করে শুনলো। বলল
‘ আমি ভালো থাকব। আটকে দেখান।
রোয়েন দাঁতে দাঁত চেপে বলল
‘ সরো। সময় হলে সব দেখতে পাবে।
রাহার দুচোখ এবার ভেজা ভেজা। গলা ও। সে ভিজে গলায় বলল
‘ কি করবেন আপনি?
রোয়েন চলে গেল।
রাহা মাথা চেপে ধরলো। পাশ ফিরে রুমের দিকে তাকাতেই তাননাকে চোখে পড়লো। তাননা রেগেমেগে বলল
‘ তোদের এই রংবাজি খেলা কখন শেষ হবে?কখন একটু শান্তি পাব? তুই কেমন ভালোবাসিস আমার ভাইকে? মানছি সব ওর দোষ, ও কিছু বলেনা, তোকে ভালোবাসে বলেনা। তোকে চাই সেটা বলেনা। কিন্তু তাই বলে তুই ও বুঝবি না? ভালো থাকবি? পারবি? পারলে তো ভালো কথা। যাহ বিয়ে করে নে। যাহ। আমরা দুইভাইবোনকে আর টানিস না।
রাহা কানে ভুল শুনলো মনে হলো। তাননার বলা প্রতিটা কথা কানে বাজলো দ্বিগুন হয়ে।
” মানছি সব ওর দোষ, ও কিছু বলেনা, তোকে ভালোবাসে বলেনা। তোকে চাই সেটা বলেনা। কিন্তু তাই বলে তুই ও বুঝবি না?
রাহা এলোমেলো পায়ে হেঁটে রুমে গেল। সোরা তাকে খুঁজতে এসেছিল। রাহা শক্ত থাকার চেষ্টা করে বললো
‘ আম্মা বিয়ে কবে?
সোরা থতমত খেয়ে গেল অমন প্রশ্নে। সে অন্য কিছু শুনতে চেয়েছিল।
সোরা বলল
‘ কেন?
রাহা বলল
‘ এমনি। তেমন কিছুনা।
‘ জানিনা কবে।
সোরা আবার বের হয়ে গেল রুম থেকে। কেন দ্বিতীয় বিয়ে হওয়া যায় না? রোয়েন কি বিয়ে করত জায়েজ হলে? কেন ডিভোর্স দিল?
__________
রাহাকে দেখতে এল প্রায় ঘন্টাখানেক পরে। ছেলের মা, বোন আর মামা এসেছে। মা বোন অনেক কথাবার্তার পরে রাহাকে দেখতে চাইলো । রাহা ততক্ষণে শাড়ি পাল্টে নিয়েছে। তারা দেখে বলল
‘ কোনো সমস্যা না। শাড়ি পড়তে হবে এমন কোনো কথা নেই। এমনিতেই ভালো লাগছে।
রাহা উসখুস করলো। হাতের তালু ঘষলো ঘনঘন। গায়ের কামিজের ওড়নাটি টেনে নিল অনেকটা। রোয়েন এসে দাঁড়িয়ে থাকলো এককোণে। সব কথা মনোযোগ সহাকরে শুনলো। শেষমেশ পাত্রপক্ষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল জায়িদ। বলল
‘ ভাই হয়। রাহার বড়আব্বার ছেলে।
রোয়েন মাথা নাড়ালো। কথাবার্তা শেষের দিকে। পাত্রের মামা রোয়েনকে ডেকে বললেন
‘ এদিকে এসো বাবা। বসো কথাবার্তা বলি।
রোয়েন গেল। বসলো সোফায়। আয়েশি ভঙ্গিতে বসে বললো
‘ ছেলের জন্য একটা বিবাহিত মেয়েকে কেন দেখতে এসেছেন? মেয়ে কি কম পড়েছে? আমাকে বলতেন। মেয়ে যোগাড় করে দিতাম।
পাত্রের বড়বোন বললেন
‘ কিছু বুঝলাম না।
হাসলো রোয়েন। জায়িদ এসে ডাকলো
‘ মুননা চলে এসো।
রোয়েন গেল না। পকেট থেকে কাগজ বের করে দিল পাত্রের বোনের হাতে।
রাহা উৎসুক হয়ে কাগজটার দিকে তাকালো। কি লিখা আছে?
পাত্রের বোন হুংকার ছাড়লো। নাহিলকে বলল
‘ আপনাদের কাছে এটা আশা করিনি। কি হচ্ছে এসব? এই মেয়ে তো বিবাহিত। রোয়েন আহম্মেদ তার হাজবেন্ড। কে রোয়েন আহম্মেদ?
রোয়েন বলল
‘ আমি।
সবাই চোখ বড় বড় করে তাকালো। নাহিল কপালে হাত দিল। সোরার ঠোঁটে হাসি। রাহার ভীত চোখ।
সালেহা বেগম কপাল ভাঁজ করে চেয়ে আছেন। পাত্রপক্ষ চলে গেল একগাদা কথা শুনিয়ে। সোয়েভকে ও বাদ যায়নি। ওরা চলে যেতেই সবাই জেরা করলো রোয়েনকে। জায়িদ বলল
‘ কাগজটা কিসের? এই কাগজটা কিসের মুননা? তোমাদের বিয়ের? কিন্তু তোমাদের তো ডিভোর্স হয়েছে।
রোয়েন কাগজটা কেড়ে নিল। ছিঁড়ে ফেললো। উড়িয়ে দিল। গর্জে বলল
‘ নকল রেজিস্ট্রি পেপার। বিয়ে ভাঙার প্ল্যান। বলেছিলাম এই বাড়িতে বিয়ে না নামানোর জন্য।
নাহিল বলল
‘ যা ইচ্ছা তাই করছো তুমি। কি চাচ্ছো তুমি?
রোয়েন রাহার দিকে তাকালো। পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল
‘ রাহাকে আমি বিয়ে করব। অন্য কেউ না।
পুরো বাড়িতে যেন ঝড় তুলে মুহূর্তেই কোথাও নিরুদ্দেশ হলো সে। সবাই হতভম্ব, হতবাক, স্তব্ধ। তাননা হাসলো। যাক তার ব্ল্যাকমেল কাজে এসেছে। রাহার চোখের পলক নড়লো না। কান দিয়ে গরম হাওয়া বয়েই চলেছে। থামলো না।
সোরা দৌড়ে ঘরে চলে গেল। এদিকওদিক হেঁটে আল্লাহ আল্লাহ ডেকে বলল
‘ আল্লাহ তুমি মুখ তুলে চেয়েছ৷ শুকরিয়া।
কিন্তু সালেহা মাথা ঠুকালো। এসব বিয়ে হয় না। তালাকের পর বিয়ে হয় না। এসব পাপ। তাননা এসে বলল
‘ কিসের পাপ দাদু? ইসলামে দ্বিতীয় বার বিয়ে জায়েজ আছে। ১৯৬৯ সালের মুসলিম পরিবার আইনের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, পুনঃ বিবাহ হতে পারে। কোনো বাঁধা নেই। যুগ পাল্টেছে দাদু। তাছাড়া তালাক আর ডিভোর্স দুইটা ব্যাপারই ভিন্ন৷ মুননা রাহাকে কবুল বলে বিয়ে করেছে ঠিকই কিন্তু মুখে তালাক দেয়নি। নর্মালি আমি যতগুলো কেস সলভ করেছি তার উপর ভিত্তি করে বলতে পারি ডিভোর্স লেটারে এক তালাকের কথা উল্লেখ থাকে। ওটাকে তিন তালাক ধরা হয় না। বলা হয় না তারা আবার বিয়ে করতে পারবে না। অনেক ডিভোর্স লেটারে তো সেটা ও উল্লেখ থাকে না। আইনের বিচ্ছেদ আর তালাকের মধ্যে ফারাক আছে দাদু।
সালেহা বেগম বলল
‘ তারমানে?
তাননা বলল
‘ তার মানে কি? ইসলামে তালাকের পর পুনঃ বিবাহ জায়েজ। যদি তা এক তালাক কিংবা দুই তালাক হয়। আমি প্রমাণ ও দেখাতে পারি অনেক। বাবাইকে কোনো আলেমের সাথে কথা বলে জিজ্ঞেস করতে বলিও। মুননু বিয়ে করবে বলেছে দাদু। এবার আর কোনো বাঁধার সৃষ্টি করো না প্লিজ।
সালেহা বেগম বলেই গেলেন
‘ ওসব হয় নাকি?
এদিকে জায়িদ আর সোয়েভ পড়লো মহাবিপদে। রোয়েনের খোঁজ খবর নেই। কোথায় যে গেল? নোহা বলল
‘ ভাইয়া বোধহয় লজ্জা টজ্জা পেয়েছে। হায়রে কিভাবে বলে ফেললো। এমন চমক তো সিমেন্টওয়ালা ও কখনো দেয়নি আমাকে ।
সোয়েভ রাগ করে চেয়ে রইলো।
চলবে
গল্প আর দুই পর্ব হবে। তারপরেই ফিনিশ। অগ্রিম বিয়ের দাওয়াত।