ধ্রুবতারা
পর্ব_৫
পুষ্পিতা_প্রিমা
সকালের তেজদীপ্ত রোদ। পাখির কিচিরমিচির শব্দে কল্লোলময় পরিবেশ। বাগান বিলাসের ফুলগুলো সবে ফুটতে শুরু করেছে। এই ফুলগুলো খুব পছন্দ রাহার। সুদূরে একটি বেলীফুলের গাছ। ফুলগুলো সাদা, শুভ্র। অপরূপ সুন্দরী ফুলগুলো। এত সাদা! রাহার হিংসে হয়। এই সাদা ফুলগুলোর মতো সে হতে পারতোনা। রঙটা হলুদ বর্ণ না হয়ে ওই ডাক্তারবাবুর মতো ফর্সা হলে কেমন হতো! একটু বেশিই ভাবসাব নেওয়া যেত। এখন ডাক্তারের ভাব বেশি। একটু সুন্দর টুন্দর দেখতে হলে যা হয় আরকি।
নিজের আনমনে আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে কখন ফুল ছিঁড়ে ফেলল রাহা বুঝে উঠতে পারলোনা। তবে সশব্দে চেঁচানোর আওয়াজ কানে এল।
‘ স্টুপিড রাহা, ফুল ছিঁড়েছ কেন? তোমার সাহস কি করে হয় এভাবে অকারণে ফুল ছেঁড়ার। টোটালি ননসেন্স।
রাহা ঘাড় ঘুরিয়ে রোয়েনকে দেখে। আহা, যাকে নিয়ে এত আকাশকুসুম কল্পনা জল্পনা তিনি হঠাৎ এমন চিল্লাচ্ছেন কেন?
‘ কারণ কি মহাশয়? ফুলগাছ আমার। বাগান আমার। ফুল ও আমার। ছিঁড়ব ও আমি। আপনি আমাকে শাঁসানোর কে? কে?
ভ্রু কুঞ্চন করে তাকায় রোয়েন।
‘ আমার বাগান বলিনি রাহা। কথা ঘুরাবেনা। একদম পছন্দ না আমার। তুমি ছোটবাচ্চা নও যে অকারণে গাছের ফুল ছিঁড়বে। বাগান তোমার হলেে ও ফুল ছেঁড়ার রাইট নেই।
মুখ মোচড়ালো রাহা। চোখ সরিয়ে নিল রোয়েন। কোমরে হাতে দিয়ে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে এল রাহা।
‘ আবার কবে বিদায় হচ্ছেন?
‘ মন হচ্ছে আমাকে তাড়াতে পারলেই তোমার শান্তি।
রাহা রসিকতা করে বলল
‘ শান্তি মানে? খুব শান্তি। আপনি আশপাশে থাকলেই তো ধড়ফড়ানি বেড়ে যায় আমার।
চমকালো রোয়েন।
‘ মানে?
‘ মানে খুব সিম্পল এন্ড ইজি। বেশিকিছু ভেবে ফেলবেন না আবার। আমার ধড়ফড়ানি এজন্যই বাড়ে, কারণ কখন সবাই জোর করে আমাকে আপনার গলায় ঝুলিয়ে দেয়। আপনার জন্য মায়া হয় ডক্টর।
নির্নিমেষ তাকালো রোয়েন। রাহা হেসে ফেলল।
‘ ভীষণ লজ্জা পাচ্ছি ডক্টর। ওভাবে তাকিয়ে থেকে কি পটানোর চেষ্টা করছেন?
কাজ হবেনা, আমি পটে গিয়েছি অনেক বছর আগে।
রোয়েন কেশে উঠলো।
‘ খুশি হবেন না ডক্টর রোয়েন। খুশি হওয়ার কিছু নেই। আমি এখন আপনার উপর আর পটে নেয়। পছন্দ বদল হয়েছে।
পকেটে হাত পুড়ে দাঁড়ালো রোয়েন। মাথা নেড়ে বলল
‘ রাহা তুমি যা যা বলেছ দুর্ভাগ্যবশত আমার রেকর্ড পেনে রেকর্ড হয়ে গিয়েছে। এখন এসব যদি বাবাইকে গিয়ে শোনায় তাদের ভুল ধারণটা কমে যাবে। আমি বুঝাতে চাইছি যে, ওদের বলা উচিত তোমার মনবদল হয়েছে। পছন্দ বদল হয়েছে। অ্যাম আই রাইট?
সচকিত চোখে তাকালো রাহা। যাব্বাবা এই ডক্টর তো বহুত সেয়ানা। চালাকি করল রাহা। রোয়েনের দিকে এগিয়ে বলল
‘ আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?
রোয়েন পিছু হাঁটলো।
‘ সো সরি রাহা। আমাকে যেতে হচ্ছে এখন?
রাহা চেঁচিয়ে ডাকলো।
‘ এই ডক্টর শুনেন, আমার সাথে পাল্লা দিতে আসবেন না একদম। ভালো হবেনা।
রোয়েন চালাকির সহিত জিজ্ঞেস করল
‘ তুমিই তো বললে মন বদল হয়েছে। এখন আমি সত্যিটা সবাইকে বললেই দোষ?
কাঁদোকাঁদো হলো রাহা। কিন্তু শক্ত থাকার চেষ্টা করে বলল
‘ একদম না। যদি বলেন আপনার নামে মামলা লড়বো আমি।
‘ ঠুনকো উকিল হলে যা হয় আরকি?
রেগে গেল রাহা।
‘ আমি ঠুনকো উকিল?
রোয়েন মাথা নেড়ে স্বাভাবিক স্বরে বলল
‘ অবশ্যই, নাহলে কেউ এমন ঠুনকো বিষয় নিয়ে মামলা লড়বো বলে? অন্তত আমার জানা নেই।
বোকা হাসলো রাহা।
‘ কাউকে কিছু বললে আমি আপনাকে?
‘ কি করবে?
উসখুস করল রাহা। হঠাৎ করে বলল,
‘ সবাইকে বলব, আপনি আমার দিকে কাল হা করে তাকিয়েছিলেন। তারপর তারপর?
রোয়েন জিজ্ঞেস করল
‘ তারপর?
রাহা আর কিছু বলতে পারলোনা। রোয়েন বলল
‘ আমি তো সবার দিকে হা করে তাকায়। ওভাবে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করি, রোগী কি পিজিকালি সিক নাকি মেন্টালি?
হা হয়ে গেল রাহা।
‘ এতবড় অপমান? এতবড়? সে এর শেষ দেখে ছাড়বে।
থমথমে মুখে গটগট পায়ে হনহন করে চলল রাহা। রোয়েন তার যাওয়ার দিকে তাকালো। হাতের কব্জির উপর ঘড়িটা দেখতে দেখতে হাঁটা ধরল সামনেই। সকাল সকাল রাহার জন্য মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল। ধ্যাত।
___________
সন্ধ্যার চায়ের আসর বসলো সেই ড্রয়িংরুমে। সালেহা বেগম বসে আছেন সোফায়। সোরা তার পাশে বসে পান ধুঁকছে। নাহিল ফিরেছে বেশকিছুক্ষণ আগে।
ওয়াশরুম থেকে মুখহাত ধুঁয়ে নিচে নেমে আসতেই মেয়ে দৌড়ে গেল তার কাছে। সোরা ডাক দিল
‘ রাহা তোমার আব্বার জন্য চা নিয়ে এসো।
রাহা বাবার বুকে ঝাপটে পড়ে লেপ্টে থেকে বলল
‘ তুমি দাও আম্মা। আমি আব্বার আদর পাইনা সারাদিন। শুধু কাজ আর কাজ। এখন আদর খাবো।
নাহিল হেসে ফেলল। মেয়ের মাথায় হাত বুলালো।
নাতাশা আঁড়চোখে তাকালো। সালেহা বেগম হেসে বলল
‘ আহারে বাপ দরদী। আর কতদিন? পরের বাড়ি কি যাবি না?
রাহা হেসে বলল
‘ এটাই আপন বাড়ি, এটাই পরের বাড়ি।
সবাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে সশব্দে হেসে উঠলো। নাহিল বলল
‘ সেটা তো বুঝলাম। কিন্তু ডাক্তার বাবু কোথায়?
সোরা বলল
‘ ব্যাডমিন্ট খেলতে গিয়েছে। ফিরতে রাত হবে বললো।
সালেহা বেগম বলল
‘ কিছুদিন পর বিয়ে করবে, আর সে নাকি এখনো খেলা খেলা?
নাহিল বলল
‘ বড় মা তোমার কি মুননাকে বড় মনে হয়? আমার তো মনে হচ্ছে এইদিনের মুননু? যাদের দেখার জন্য এব্রোড থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে এসেছি আমি। এদিনই তাদের নাম দিলাম। আর এদিনই মুননা আমার কাছে বললো, মুন্টু আচকিলিমি দিও, ফুতবল দিও, বল দিও। আর কিছু হতে না হতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হাত পা ছুঁড়ত। সেই মুননু না?
নাহিলের কথা শেষ হতে পারলো না। রাহা হেসে উঠলো৷
‘ সত্যি আব্বা!
রোয়েন ভাইয়া এরকম বলতো?
সালেহা বলল
‘ হ্যা, ঝাল ভাত জোর করে খাইয়ে দিলে বলতো, দাদুমুণি ঝান ঝান ভাতু দিচে। মুজা নাই। বিশিবিশি ঝান।
রাহা আর ও আওয়াজ করে হাসলো। সোরা বলল
‘ তাননা বলতো আল্লাহ মাববে। তারপর আমাকে ডাকতো সুলা ফিপি, আনহা আপাকে ডাকতো আননা ফিপি।
রাহা মুখ চেপে হাসে।
‘ আম্মা ডক্টরকে এখন থেকে এসব বলে বলে জ্বালাবো। দেখে নিও।
ধমক দেয় সোরা।
‘ রোয়েনের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকবে রাহা। ও এসব পছন্দ করেনা।
মুখ কালো হয়ে যায় রাহার। ওই ডাক্তারের জন্য আম্মা তাকে বকলো। দেখে নেবে সে৷
_____
তলে তলে কার্যসিদ্ধি অনেকদূর হলো। বাড়ির সবার মধ্যে এত উৎফুল্লতা দেখে নিজেই অবাক রোয়েন। জায়িদ এসে যেদিন জানালো রাহার সাথে তার বিয়ের ব্যাপার স্যাপার অনেকদূর এগিয়েছে সেদিন সেখানেই থমকে গেল রোয়েন। সবার উদ্দেশ্য চিল্লিয়ে বলল
‘ কি সমস্যা সবার?
জায়িদ পিঠ চাপড়ে বলল
‘ এত রাগ কেন মামা? তোমার আম্মা আব্বা রাহাকেই ছেলের বউ করে গিয়েছে।
রোয়েন শান্ত হয় তখুনি।
‘ আম্মা?
জায়িদ প্রমাণসরূপ দেখায় রোয়েনকে।
‘ আম্মা এসব কখনো বলেনি, মিথ্যে এসব।
তাননা মুখ ফুলিয়ে বলে
” আমি ও কি মিথ্যে বলব মুননা?
চোখ গোলগোল করে তাকায় রোয়েন। পকেটে হাত পুড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে
‘ অসম্ভব। আমি বিয়ে করব না।
সালেহা বেগম পান চিবোতে চিবোতে বলে
‘ তোর বাপ করবে।
রোয়েন গটগট পায়ে হেঁটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। ফুটবল নিয়ে হাঁটু দিয়ে খেলতে খেলতে তাকায় বারান্দায়। রাহার চোখাচোখি পড়তেই সরাসরি মুখ মোচড়ে দেয় রাহা। চোখ বড় বড় করে তাকায় রোয়েন। রাহা গলার কাছে হাত নিয়ে গিয়ে কেটে দেওয়ার মতো করে বলে
‘ মেরে ফেলব একদম।
ফুটবলে কিক বসিয়ে গলায় হাত দেয় রোয়েন। খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ে রাহা। পিঠ করে দাঁড়িয়ে হাসতে থাকে। অদ্ভুত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে থাকে রোয়েন। আশ্চর্য! এই মেয়ে নাকি তার বউ হতে চলেছে? ভারি আশ্চর্য!
চলবে