ধ্রুবতারা পর্ব_৬ পুষ্পিতা_প্রিমা

ধ্রুবতারা
পর্ব_৬
পুষ্পিতা_প্রিমা

সবেমাত্র ভার্সিটির গেইট পার হয়ে রাস্তা ধরেছে নোহা। রিকশার দেখা নেই। বান্ধবীগুলো আজ আসেনি। গরমে বিরক্তিতে থিতিয়ে উঠেছে সে। এখন নাকি আবার শীতকাল? রোদের কি তেজ! ঘাম ছুটে গেল। ব্যাগে থাকা রুমাল বের করে কপাল মুছলো নোহা। বেশকিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে রিকশার দেখা মিলল অবশেষে। রিকশায় ধপাধপ উঠে বসলো। মেইনরোড পার হয়ে সরু রাস্তা ধরতেই নোহা খেয়াল করল তার ফোন বাজছে। ফোন তুলতেই জায়িদের গলা ভেসে আসে।
‘ কোথায় নোহা?
‘ এই তো আব্বা রিকশায় উঠে গেছি। এখুনি পৌঁছে যাব? খেয়েছ?
জায়িদ বলল
‘ না, এখুনি যাব। সাবধানে যেও।
‘ জ্বি আব্বা।
ফোন রেখে দিল নোহা। রিকশার পেছনে বাইকের আওয়াজ শুনলো হঠাৎ। রিকশার পেছনের পর্দাটা সরাতেই দেখলো ওইদিনের হেলমেট পড়া ছেলেটি। কপালে ভাঁজ পড়লো নোহার। বাইকটি রিকশার পেছন পেছন ধীরেধীরে আসছে। অনেক্ক্ষণ চুপ থাকলো নোহা। দেখল ছেলেটি যাওয়ার নয়। যদি এই ছেলেটির চেহারাটা দেখতে পেত সে? আব্বাকে বলে এমন মাইর খাওয়াতো!
প্রায় অনেকপথ যেতেই নোহা নিচু স্বরে ডাকল রিকশা চালককে
‘ মামা রিকশাটা দাঁড় করায় দেন।
রিকশা চালক দাঁড় করিয়ে দিল। নির্জন রাস্তা। দু একজন মানুষ দেখা যাচ্ছে। রিকশা থামতেই বাইক আচমকা ব্রেক কষলো। নোহা লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নেমে চিল্লালো।
‘ এই মানুষ! দাঁড়ান! দাঁড়ান বলছি।

বাইক ঘুরানো সোয়েভ তাকালো তাড়াতাড়ি। নোহার দিকে তাকিয়ে খুললো হেলমেট। নোহা চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। নাক ফুলিয়ে বলল
‘ আরেহ কি সমস্যা আপনার? একটা মেয়েমানুষকে হেনস্তা করে কি পান আপনারা?
সোয়েভ এদিকওদিক তাকিয়ে চুল ঝাড়া দিল। তার পেছনের ছেলেটাকে বলল
‘ এই তানিম্মে এই মহিলা কি আমাকে কথা শোনাচ্ছে?
তানিম ভ্যাবাছ্যাঁকা খেল। বলল
‘ হ মামা ।
নোহা তুড়ি মারতে মারতে এগিয়ে এল। বলল
‘ ওহ হ্যালো, আমি আপনার সাথে কথা বলছি। আপনি কয়েকদিন ধরে আমাকে ফলো করছেন কেন? কেন?
সোয়েভ বলল
‘ ভুল হচ্ছে আপনার। আমি কেন আপনাকে ফলো করতে যাব?
নোহা মাথার কাপড়টা আর ও টানলো। ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বলল
‘ আমাকে গোল খাওয়াতে আসবেন না। আপনিই আমাকে ফলো করছেন। স্বাক্ষী আমার চোখ।
সোয়েভ এদিকওদিক তাকালো। বলল
‘ আমি নাহ। আমি নাহ।
নোহা ব্যঙ্গ করে বলল
‘ তো কে? তো কে?
সোয়েভ তানিমের মাথায় চাপড় দিয়ে বলল
‘ এই শালা।
তানিম হা করে থাকলো। সোয়েভ তানিমের মাথায় আর ও দুটো ঠাসস ঠাসস মেরে বলল
‘ এই তুই না বলছিলি, এই মেয়েকে ফলো করতে। নাহ?
নোহা হা করে তানিমের দিকে তাকালো। বলল
‘ সাহস কত? আমাকে ফলো করেন? কেন?
সোয়েভ তানিমকে মেরে মেরে বলল
‘ হ্যা, সাহস কত? এত্ত বড় সাহস পুলিশের মেয়ের পিছু নিস?
নোহা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো সোয়েভের দিকে।
‘ আপনি কি করে জানেন আমার আব্বা পুলিশ?
হাসলো সোয়েভ।
‘ এসব জানা লাগেনা ম্যাডাম।
মাথা নাড়ালো নোহা। তানিমের দিকে আঙুল বাড়িয়ে কিছু বলার আগেই সোয়েভ আঙুল তুলল। তানিমকে উদ্দেশ্য করে বলল
‘ যদি আরেকবার ফলো করতে বলিস? তাইলে তোরে,
বলতে না বলতেই ধুপধাপ মাইর বসালো সোয়েভ। নোহা হাত নাড়িয়ে বলল
‘ আরেহ থামেন থামেন। আর মারবেন না। আমি কি আপনাকে মারতে বলেছি?
সোয়েভ থামলো। তানিম হাতের বাহুতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল
‘ এটা কি হলো মামা?
সোয়েভ চোখ মারলো নোহার অগোচরে । আবার চোখ রাঙিয়ে বলল
‘ আমাকে দেখ ভাই, আমি কত ভালো ছেলে। কোনো মেয়ের দিকে আজ পর্যন্ত চোখ তুলে তাকিয়েছি কিনা কেউ বলতে পারবে?
তানিম হাতের বাহু ঘষতে ঘষতে বলল
‘ না বলতে পারবে না।
‘ তো, আমার মতো হবি।
তানিম কাঁপা গলায় বলল
‘ তোর মতো হলে তো, আমার লাশ পড়তো মামা।
নোহা রিকশায় উঠে বসে। কখন যে চলে যায় খেয়াল করল না সোয়েভ। তানিমের পিঠে দু ঘা বসিয়ে বলল
‘ শালা সামনাসামনি ধরা খেলাম। ধ্যাত।
তানিম বলল
‘ আমাকে মারলি কেন? তুই নিজের দোষ ঢেকে সাধু পুরুষ হলি আর আমাকে দোষী বানিয়ে দিলি।
সোয়েভ বলল
‘ শালা তুই বুঝবি না। পুলিশের মেয়েকে পটাতে গেলে সাধুপুরুষ সাজতে হয় মামা বুঝলি?
তানিম বলল
‘ তো আমাকে ফেলি?
ওয়ালেট বের করে পাঁচশ টাকার নোট বের করল সোয়েভ। তানিমের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে
‘ চল, চল, গরম গরম চা খেয়ে আসি। এখন দুই পুলিশের লাঠির বাড়ি খাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। এক মোর বাপের, দুই মোর শ্বশুরমশাইয়ের।
তানিম গাল হা করে রাখলো। সোয়েভ টাকার নোটটা পুড়ে দিল তানিমের গালে। তানিম ইয়াকক করে ফেলে দিয়ে আবার তুলে নিল। তারপর সোয়েভের পেছনে বাইকে উঠে বসলো।

_________

গাছ থেকে বড়ই পাড়তে গিয়ে এক বিরাট ভয়ানক কান্ড ঘটে বসলো। রাহার হাত থেকে বাঁশ পড়ে গিয়ে নিচে পড়ে গেল। সেই বাঁশ আবার মাটিতে পড়েনি, পড়েছে ডাক্তার বাবুর মাথায়। আহা, কি এক বিচ্ছিরি ব্যাপার স্যাপার!
জিভে কামড় দিয়ে তাকিয়ে থাকলো রাহা। রক্তবর্ণ চোখে চোখ তুলে তাকালো রোয়েন। দাঁতে দাঁত গিজগিজ করতে করতে বলল
‘ হাউ ষ্টুপিড রাহা!
রাহা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল
‘ আমি দেখিনি ভাইয়া। একদম দেখিনি।
বিশ্বাস করল না রোয়েন। কানের পাশে লাগায় ছিলে গিয়েছে। জ্বলছে সে জায়গায়। রাগ, বিরক্তি বাড়লো তরতর করে। রাহা দৌড়ে নিচে নেমে এল। যদি ও সময় লাগলো। নিচে নেমে এসে রোয়েনের সামনাসামনি এসে বলল
‘ সে সরি ভাইয়া। সত্যি দেখিনি। দেখি লেগেছে কিনা।
সাথেসাথে ধমক দেয় রোয়েন। একদম এগোবে না ননসেন্স। দিনদিন কি তুমি ছোট হচ্ছো রাহা? একদম আমার সামনাসামনি আসবে না। আমার সাথে কথা ও বলবেনা। স্টুপিড।

মুখ কালো হয়ে গেল রাহার। থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকলো সে। তখনি নোহা এসে পড়লো। রাহাকে ভালোকরে দর্শন করতে করতে বলল
‘ কি সমস্যা ডাক্তারের বউ? মুখ কালো কেন? ডাক্তার এত রেগেমেগে কই যায়?
রাহা গিজগিজ করে বলল
‘ তোর মায়ের বাড়ি যাচ্ছে বেয়াদব। ডাক্তার ভয়ানক রেগে গেছে।
নোহা বলল
‘ আবার কি করেছ?
রাহা সব বলল। হাসিতে ফেটে পড়লো নোহা। কোমরে হাত দিয়ে বলল
‘ তুমি তো সবসময় ভালো কাজই করো। টেনশন ফ্রি থাকো। ডাক্তার ভাই হবু বউয়ের উপর আর কত রেগে থাকবে?
রাহা ধমকে বলল
‘ চুপ থাক। বউ বউ করিস না, এই খিটখিটে ডক্টর দেখতে পায়না আমায়। বউ অনেকদূর।
নোহা বলল
‘ তুমি যা বোকা বোকা কাজ করো। ভীষণ বিরক্ত হয় রোয়েন ভাইয়া। এইবার একটু বুদ্ধিমতীর মতো কাজ করে দেখাও ডাক্তারবাবুকে। একটু পটানোর চেষ্টা করো। বুঝলে?
রাহা বলল
‘ সর, তুই এদিনের পুঁচকি৷ তুই আমাকে শিখাবি?
‘ হুহ, তুমি আমার নয় মাস নাকি এক বছরের বড়। দেখছ না আমার ও বিয়ের বয়স হয়েছে।
রাহা বলল
‘ যাবি নাকি যাবিনা নোহা?
নোহা যেতে যেতে বলল
‘ ডাক্তারবাবুর মাথায় বাঁশ ফেলে,বাঁশ খাইলো রাহা।
রাহা চিল্লালো।
‘ নোহার বাচ্চা তোরে আমি?
নোহা যেতে যেতে বলল
‘ নোহার বিয়ে হয়নি আপা। বাচ্চা কোত্থেকে আইবো?
রাহা ফুলেফেঁপে তাকিয়ে থাকলো নোহার দিকে।

_______

সন্ধ্যায় যখন বাড়ির সবাই একসাথে হলো তখন বিয়ের কথাবার্তা উঠলো। রোয়েন দুপুরের ঘটনা নিয়ে এমনিতে ও রেগে ছিল। তার উপর নাকি এসব বিয়ে টিয়ের ডেট ফেট নিয়ে কথা৷ যত্তসব!
বজ্রগম্ভীর স্বরে সবার উদ্দেশ্য বলল
‘ আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। তোমরা করো। আমাকে জোর করবেনা এই বিষয়ে। এই বাড়িতে যদি এই বিষয় নিয়ে আর কথা হয়, তাহলে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব আমি। আমার কথার কি কোনো মূল্য নেই?
সবাই হতভম্ব।

তাননা বলে উঠলো।
‘ ভেবে বলছিস মুননা?

‘ আমি ভেবেই কথা বলি তা তুই ভালো করে জানিস তাননা। তোর মনে হচ্ছেনা রাহাকে জোর করে আমার গলায় ঝুলানো হচ্ছে।

সবাই আরেকদফা চমকালো। নাহিল কিছু বলার সাহস পেলনা আর।
রোয়েন তাকালো নাহিলের দিকে বজ্রাহত দৃষ্টিতে। নাহিল বলল
‘ মুননা আমি….
বলতে দিল না রোয়েন। নাহিলকে থামিয়ে দিয়ে বলল
‘ রাহাকে অন্যকোথাও বিয়ে দাও। এসব কথা আর তুলবে না এই বাড়িতে।
তাননার রাগ লাগল ভাইয়ের উপর। সে ক্ষিপ্র গলায় বলল
‘ তোর মনে হচ্ছে না তুই ভুল করছিস।
রোয়েন বলল
‘ না। রাহাকে স্নেহ করি আমি। ওর সাথে অন্য কোনো সম্পর্কে জড়ানো সম্ভব না আমার পক্ষে।
চুপ করে থাকলো সবাই। তাননা বলল
‘ তাহলে নিজে দাঁড়িয়ে বিয়ে দে রাহাকে। তোরজন্য নইলে রাহার বিয়ে হয়ে যেত এতদিনে।
রোয়েন বলল
‘ ঠিক আছে। আমিই দেব।
সবাই তৃতীয় বারের মতো ধাক্কা খেল। তবে সবাই কিছু বুঝে উঠার আগে নেচে নেচে নিচে নেমে এল রাহা। তাননাকে একপাশে ডেকে এনে ফোনের ওয়ালে বধূশাড়ি দেখিয়ে বললো
‘ আপু দেখোনা, আমার এই শাড়িটা পছন্দ হয়েছে।
তাননা বলল
‘ ঠিক আছে, এটাই কিনবি।
হাসলো রাহা। রোয়েনকে দেখে বলল
‘ দুপুরের ঘটনার জন্য সরি ভাইয়া।
রোয়েন চোখ নিচেই রাখলো। সবাইকে চুপ দেখে রাহা নাহিলের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল
‘ সবার কি হয়েছে আব্বা?
নাহিল মৃদুস্বরে বলল
‘ তোমাকে দেখতে আসবে কাল। তার কথা চলছিল।
নাহিলের কথা বুঝতে সময় লাগলো রাহার। কিন্তু যখন বুঝল তখন হাত আলগা হয়ে যায় রাহার। নাহিলের কাছ থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায় রাহা। নেত্রকোণা ছলছল করে উঠে। রোয়েনের দিকে ফিরে তাকানোর সাথে সাথে রোয়েন চলে যায়। রাহা মুখের উপর হাত দেয়। মাথা নাড়ায়। ছলছল চোখজোড়া লুকোতে লুকোতে বলে, ঠিক আছে আব্বা।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here