#নীল_অপরাজিতা
#পার্টঃ১৫
#Rifat_Amin
অভির দাদিমা’র সামনে বসে আচার খাচ্ছে মিষ্টি। আজ দুই বছর পর দেখা হলো দাদিমা’র সাথে। দাদিমা মিষ্টির সামনে বসে গল্প করে যাচ্ছে আর মিষ্টি মনোযোগ সহকারে শুনছে। সব গল্পগুলো পুরোনো দিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তিনি শুধু কথায় কথায় বলছেন ‘কোথায় হারিয়ে গেলো সেই দিনগুলো? আজ যদি থাকতো ‘। গল্পের ফাঁকে মিষ্টি বললো-
– দাদিমা আপনার হাতে বানানো আচারের কিন্তু জবাব নেই। এবার আমাকে শিখিয়ে দিয়ে যাবেন কিভাবে বানাতে হয়। শিখাবেন না?
– আচ্ছা শিখিয়ে দেবো।
– আচ্ছা আপনি কি অভির জন্যও আচার এনেছেন? এনে থাকলে আমাকে দিয়ে দিন। অভিতো এসব খায়না। আর যদি খেতে চায় তাহলে আমি দিয়ে দেবো।
– হ্যা এনেছি তো। সব তোমার আন্টির কাছে আছে। বলেছিলেন অভি নাকি এসব খায়না। তবুও আনলাম কেনো জানো?
মিষ্টি আগ্রহের সাথে সামনে আসলো কথা শোনার জন্য। যেনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চলেছে দাদিমা। দাদিমা বললো-
– থাক পরে বলবো।
মিষ্টির হঠাৎ করেই রাগটা উঠে গেলো। আগ্রহ দেখিয়ে আবার যদি না বলে তাহলে এভাবে বলার কি দরকার ছিলো? দাদিমা আবার বললো-
– শুনো মেয়ে। এবার আমি এখানে এসেছি কেনো জানো?
মিষ্টি এবার শক্তকন্ঠে জবাব দিলো –
– না দাদিমা। আগে বলেন তারপর জেনে যাবো।
– শুনো তাহলে। আমি এসেছি অভির বিয়ে দিয়ে দিতে। অভির বাপ তো বললো- এখনো তেমন বয়স হয় নি। আর ও তো কিছুই করে’ও না। আমি কি বলেছি জানো?
মিষ্টির হঠাৎ করেই মনে হলো এই মহিলার জানো জানো বলার রোগ আছে। তবে প্রসঙ্গ যেহেতু অভির বিয়েকে কেন্দ্র করে তখন আগ্রহ দেখালে দোষ নেই। মিষ্টি এবার আগ্রহের সাথে বললো-
– হ্যা বলেন
– বললাম তোর তো অফিসে বাবুকে জয়েন করিয়ে দিতে পারিস। আর বয়স হয়নি মানে কি? আলবাত হয়েছে। অতঃপর মিষ্টির কানে কানে বললো- তখনি অভির বাবা রাজি হয়ে গেলো জানো! কারণ আমার কথাই শেষ কথা। কার সাথে বিয়ে ঠিক করেছি জানো?
– না।
– তোমার সাথে।
– কিহহহহ!!!!
কথাটা শোনার পর জড়েসড়ে একটা চিৎকার দিয়ে ফেললো মিষ্টি। দাদিমা মিষ্টির হঠাৎ চিৎকারে হতভম্ব হয়ে গেলেন। বললেন-
– কি হলো মেয়ে? হঠাৎ এমন করলে কেনো?
– আপনি আমার সাথে বিয়ে ঠিক করেছেন মানে কি? অভিকে বিয়ে করবো আমি? এটা অসম্ভব।
– শুনো মেয়ে, সব মেয়েরা’ই বিয়ের আগে এমন অযুহাত দেখায়। কিন্তু বিয়ের পর দেখবে সব ঠিক। আর অভিকে বিয়ে না করার কি আছে? ওমন হীরার টুকরা ছেলে মা শা আল্লাহ। আর আমার তোমাকেও অনেক পছন্দ ছোটবেলা থেকেই। তোমার বাবা’ও রাজি হয়েছে। আমার বয়স হয়েছে আর এই বয়সে যদি নাতিপুতি না দেখে যেতে পারি তাহলে শান্তি পাবো না।
– কিন্তু আমি ওকে বিয়ে করতে পারবো না। অসম্ভব। সারাটা জীবন আমাকে জ্বালিয়ে মারলো আর বিয়ে করলে তো আমি শেষ। হায় আল্লাহ!
বলেই আচারের বয়াম রেখে হন হন করে বেরিয়ে আসলো মিষ্টি। সেখান থেকে রাগি চেহারা নিয়ে একবার নিজের রুমে আসলো। যখন নিজের রুমেও রাগ কমলো না তখন ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। সৌমিত্র এসে বাবাকে দেখে চলে গেছে সেই সন্ধ্যার সময়। এখন হয়তো ছাদে কেউ নেই। একাকি একটু ছাদে সময় কাটালে হয়তো ভালো লাগবে। কিন্তু ছাদে এসে দেখলো অভি নিশ্চিন্ত মনে বই পরছে দোলনায়। শালা আমার সাথে তোর বিয়ে ঠিক হচ্ছে আর তুই নিশ্চিন্ত মনে বই পড়ছিস। দাড়া দেখাচ্ছি মজা। মিষ্টি এগিয়ে এসে পেছন থেকে দোলনায় দিলো একটা ধাক্কা। তখনি দোলনা থেকে ধপাস করে পরে গেলো অভি। পরে যাওয়ায় হাতে ভীষণ ব্যাথা পেয়েছে তখনি পেছনে মিষ্টিকে দেখতে পেয়ে রাগে শরীর কেঁপে উঠলো অভির। যখন তখন এসব কেমন পাগলামো৷ এদিকে অভিকে দোলনা থেকে ফালায় দিতে পেরে যেনো একটু শান্তি অনুভব করছে মিষ্টি। অভির হাত ছিলেছে, সেখান থেকে রক্ত পরছে একটু একটু। অভি উঠে এসে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সজোরে একটা থাপ্পর মারলো মিষ্টিকে। অভির এমন শক্তপক্ত হাতের থাপ্পড় খেয়ে মিষ্টি ছিটকে পড়ে গেলো ছাদে। থাপ্পড় দিয়েও থামলো না অভি। চুলের মুঠি ধরে দাঁড় করালো মিষ্টিকে। এদিকে মিষ্টি বাকরুদ্ধ অভির অতর্কিত আক্রমনে। অভির এই রুপ সে আগে কখনো দেখেনি। এ জেনো অন্য কোনো অভি। মিষ্টি কাঁদো কাঁদো গলায় বললো – ছাড় অভি। ব্যাথা পাচ্ছি খুব। চুল ছেড়ে দে আমার।
হুশ ফিরে পেয়ে মিষ্টিকে ছেড়ে দিলো অভি। রাগ তখনো সপ্তম আকাশে। সে কড়া গলায় বললো- মানুষের সবসময় মেজাজ ভালো থাকে না এটা নিশ্চই জানার কথা তোর। বলেই হন হন করে ছাদ থেকে নেমে আসলো অভি।
মিষ্টির এখনো যেনো বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে না এই সেই অভি। শান্ত মানুষ রেগে গেলে কি করতে পারে তার প্রমাণ পেলো মিষ্টি। এর আগেও কত রাগ করেছে কিন্তু কখনো গায়ে হাত তুলেনি। আজ কি হলো যে এমন ভাবে মারলো। ভয়ে সারা শরীর এখনো কাঁপছে মিষ্টির। ঠোঁটে হাত দিয়ে দেখলো ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। ছাদে পরে যাওয়ায় মাথায়ও হালকা লেগেছে তবে গুরুতর নয়। এখন প্রচুর কান্না পাচ্ছে মিষ্টির। কেঁদেকেটে ভাসিয়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে। চুলে হাত দিয়ে সেখানেই বসে কান্না করতে থাকলো মিষ্টি। চুলেও ব্যাথা হচ্ছে ভীষণ।
রাত ১০ টা ১৮ বাজে। পার্কে বসে নিশ্চিন্ত মনে সিগারেট খাচ্ছে সৌমিত্র। ফোনে মেসেজ আসার শব্দ পেয়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো সে। মেসেজ এসেজে মিথিলার নাম্বার থেকে। এখন আবার মেসেজ দিলো কেনো? একটু আগেই তো কথা হলো ওর সাথে।
“tmk akta kotha tkhn blai hoyni. joto taratari paro akta job a join kro. familly theke biyer jnno pressure asce.”
মেসেজটা দেখে চিন্তায় পরে গেলো সৌমিত্র। এখন যা সার্টিফিকেট আছে তাতে জব হলেও তেমন ভালো জব হবে না। হলেও মিথিলার বাবার সামনে কিভাবে দাড়াবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না সৌমিত্র। মিথিলার জন্য নিশ্চই অনেক বড় বড় পরিবারের ছেলেরা প্রোপোজাল পাঠায়৷ সেখানে আমার প্রোপোজাল এক্সেপ্ট করবে কেনো? নাহ! এবার কিছু একটা করতে’ই হবে। সৌমিত্রর বাবা সরকারী
অফিসার কিন্তু তিনি কি কোনো ব্যাবস্তা করতে পারবেন? আর যদি বিয়ের জন্যই রাজি না হোন তাহলে? অবশ্য মা আছে মানিয়ে নেয়ার জন্য। সৌমিত্র সিগারেটে শেষ টান দিয়ে তার মা’কে ফোন করলো। ফোন রিসিভ হলো না প্রথম বার। আবার ট্রাই করলো-
– হ্যা মা। কোথায় এখন তুমি?
– কোথায় আর থাকবো? আগে বল তুই কোথায় এত রাতে? বাসায় আয় তারাতারি।
– আচ্ছা আসছি আমি। তবে একটা জরুরী কথা বলতে ফোন করলাম। বাবাকে একটু বলে দেখিয়ো তো আমার একটা চাকরির ব্যাবস্থা করতে পারে কি’না?
– কেনো তুই বললে কি সমস্যা? তোর বাবা বলে নি যে পরাশোনার পেছনে যত টাকা লাগে খরচ করতে রাজি আছি কিন্তু চাকরি তোকে নিজের যোগ্যতায় নিতে হবে। এখন বাবাকে বলে নিতে হবে কেন? নিজের যোগ্যতায় চাকরি নিবি।
– তুমি একটু বলো না মা। চাকরিটা ভীষণ দরকার। পরে নাহয় আমি আরেকটা ব্যাবস্থা করে নেবো।
ওপাশ থেকে আর কথা শোনা গেলো না। ফোন কেটে দিয়েছে। সৌমিত্র ফোন রেখে আরেকটা সিগারেট ধরালো৷ সিগারেটে একটা টান দিয়ে সেটাও ফেলে দিলো মাটিতে। নাহ! সিগারেট খেতেও ইচ্ছা করছে না। অসহ্য লাগছে জীবনটাকে। চারপাশে শুনশান নিরবতা বিরাজ করছে। সৌমিত্র বাইকেট চাবি বের করে বাইকটা স্টার্ট করলো। হঠাৎ মনে হলো অভি আর মিষ্টির বাবার নিজের বিজনেস আছে। ওদের বলে যদি কিছু করা যায়। কিন্তু কোন মুখ নিয়ে বলবে কথাটা। আত্মসম্মান বলেও তো একটা কথা আছে। নিজের চাকরির জন্য বন্ধুর বাবার অফিসে জয়েন করবো এটা খারাপ দেখায়। কিন্তু এটা ছাড়াও তো কোনো উপায় নেই। আবার মনে হলো চাকরি পেলেই কি বাবা মা রাজি হবে বিয়ে দিতে? একমাত্র ছেলে হিসেবে তাদের নিশ্চই স্বপ্ন আছে আমাকে নিয়ে। সৌমিত্র বাইক চালানো অবস্থায় মিষ্টিকে কল করলো –
– হ্যালো দোস্ত একটা দরকারে ফোন করেছিলাম।
মিষ্টি তখনো ছাদে বসে কান্না করছিলো। সৌমিত্রর ফোন পেয়ে হালকা খুশি হলো সে। রাগ ঝেরে ফেলার জন্য অন্তত একটা মানুষ পাওয়া গেলো। এই সৌমিত্রর একমাত্র আমার রাগ সহ্য করে হাসানোর ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে। নিশ্চই আমার এই কথা শুনে অভির প্রতি সেই রাগ করবে সে। কিন্তু ফোন ধরার পর সে আশা নিভে গেলো। সৌমিত্র নিজেও আবার দরকারে ফোন করেছে। এই পৃথিবীতে সবার দরকার ছাড়া বুঝি কিছু নেই।
মিষ্টি কাঠকাঠ গলায় বললো-
– বল তোর কি দরকার?
– বলছিলাম দোস্ত আমার একটা চাকরি ভীষণ দরকার। মিথিলার বিয়ের প্রোপোজাল আসছে আর আমিতো বেকার। বেকার ছেলের সাথে কেউ বিয়ে দেবেনা। আর হিন্দুদের বিয়েতে’ তো জানিস কত টাকা খরচ হয়। আমার বাবা মা’ও নিশ্চই রাজি হবে না। অভির সাথে কথা বলে একটা যদি চাকরির ব্যাবস্থা করিস। তাহলে ভালো হতো দোস্ত। অন্তত কয়েক মাসের জন্য। যাতে শুধু বিয়েটা হয়। তারপ না’হয় আমি নিজেই একটা চাকরি জোগাড় করে নেবো। প্লিস দোস্ত!
– পারবো না। শুনছিস! পারবো না। এই তোর এত দরকার হলে নিজে একটা জোগার করে নিতে পারিস না। গার্লফ্রেন্ড তোর, চাকরি জোগাড় করে আমি দেবো কেন? দরকারে আমাকে মনে পরে তাইনা? সব ছেলেরা’ই এমন। বলেই ফোন কেটে দিলো মিষ্টি। আরো কিছু বলতে ইচ্ছা করছিলো সৌমিত্রকে। কিন্তু কোথায় জেনো বাধা কাজ করছিলো। এদিকে মিষ্টির এমন জবাব পেয়ে জেনো বরফ হয়ে গেলো সৌমিত্র। শেষ আলোটাও নিভে গেলো। হঠাৎ সামনে থেকে আসা সিএনজির ধাক্কায় বাইক থেকে ছিটকে পরে গেলো সে।
চলবে?