নীল অপরাজিতা পার্টঃ২

0
1190

#নীল_অপরাজিতা
#পার্টঃ২
#Rifat_Amin

রাত ১১ টা ৩৩। বাস চলছে তার আপন গতিতে। আমার বাম পাশে ঘুমিয়ে আছে মিষ্টি। চেহারায় রাজ্যের ক্লান্তির ছায়া। অভি ভেবে পাচ্ছেনা এই মেয়েটা এত জ্বালায় কিভাবে। আর এখন মনে হচ্ছে এই মেয়েটার মতো শান্ত মেয়ে এই জগতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মিষ্টির ক্লাস ৫ এ পড়া ছোট ভাই মাহিন কানে হেডফোন লাগিয়ে ফ্রি ফায়ারে মনোযোগী ছাত্রের ভুমিকা পালন করছে। পুরো বাসে পিনপতন নিরোবতা বিরাজ করছে। মনে হচ্ছে অভি আর মাহিন ছাড়া কেউ বাসে জেগে নাই। বিষয়টা ভেবে অভি চারপাশে সুতীক্ষ্ণ চোখ দিয়ে স্কেন করা শুরু করলো। না!! অনেকেই জেগে আছে। তাদের এই বোরিং সময়ে ফোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অভি মাহিনকে হালকা নাড়িয়ে বললো —

-” কি অবস্তা তোর? চোখে কি ঘুম আসে না?? সারাদিন রাত গেম নিয়ে পড়ে থাকিস ”

মাহিন গেম থেকে চোখ সরিয়ে কানের হেডফোন খুলে ফেললো। রিরক্ত কন্ঠে বললো —

-” কিছু বলছিলে ভাইয়া?? ”

-” না বাবু। সারাদিন যে চোখে চশমা লাগায় গেমে পড়ে থাকো, পড়াশোনা করবা কখন?? ”

-” তুমিও তো আগে অনেক গেম খেলতে। আমি তোমার ফ্যান। তাই আমিও সারাদিন গেম খেলে তোমার মতো হতে চাই। ”

মাহিনের যুক্তিপূর্ণ জবাবে দমে গেলো অভি। সত্যি তো! বড়দের কাছ থেকেই তো ছোটরা শিখবে। যেখানে আমিই ছিলাম গেমের পোকা। সেখানে মাহিনরে নিষেধ করে অপমানিত হবার কিছু নাই।

-” ভাইয়া তোমার ইউটিউবের কন্টেন্টগুলা কিন্তু ফাটাফাটি। সেই ভিউ আসে। ”

-” তোকে ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। এখন চুপচাপ ফোন রেখে ঘুমায় পর। নাহলে বিয়ে বাড়িতে গিয়ে দিনের বেলা ঘুমে ঢুলবি। ”

-” ভাইয়া, বিয়ে বাড়িতে গিয়ে কেউ যদি তোমায় চিনে ফেলে আর সবাইকে বলে দেয় যে তুমি ইউটিউবার। আ’ম সিওর বাংলাদেশের সব জায়গায় তোমার ভিউয়ার আছে। এটা কি চিন্তার বিষয় না?? ”

-” হ্যা ভাই। অনেক চিন্তার বিষয়। তুই ফোন রেখে চিন্তা কর। ঘুমাতে হবেনা। এদিকে দেখ তোর বোন মরার মতো ঘুমিয়ে আছে। ”

-” তুমি আপুর কথা বাদ দাওতো। তুমি কি জানো?? আপু আমার গেম খেলা একদম সহ্য করতে পারেনা। শুধু তোমাকে গালি দেয় “।

অভি একটু নড়েচড়ে বসলো। অভির অজান্তে ওর নামে এমন অপবাদ দেয় এই মেয়ে, তা জানা ছিলো না।

-” তোর গেমিংয়ের সাথে আমাকে গালি দেয়ার সম্পর্কটা ঠিক বুঝলাম না। একটু বুঝিয়ে বল তো। ”

-” আপু বলে তোমার কারণেই নাকি আমি দিনদিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছি। ”

-” তোর আপুর কথা আধা সত্য। তুই নষ্ট হচ্ছিস এটা সত্য কিন্তু এটার কারণ আমি না বুঝলি। ”

-” আপুর কথা বাদ দাওতো। আপু একটা বোরিং মানুষ। কথায় কথায় আমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। সামান্য একটা ফ্যানের সুইচ অফ করতেও আমাকে ডাকে। তুমিই বলো তো, আমি একটা গেমার মানুষ। আমাকে দিয়ে কি সবসময় কাজ করানো উচিত?? ফ্যানের কথা নাহয় বাদই দাও। এখন তো শীতকাল পরবে। তাই আগের মতো আর জ্বালায় না। কিন্তু লাইট অফ অন করতে প্রতিদিন ডাকবে । অসহ্য। ”

মাহিনের বড়ো বড়ো কথায় ঠিক কি রিয়েকশন দিবে বুঝতে পারলো না অভি। বাংলাদেশের প্রতিটা বড় ভাইবোন তাঁর ছোটোর কাছ থেকে এমন কাজ করিয়ে নেয়। তবে এই ছেলের যে গেম মাথার ভীতর স্নায়ুগুলোকে বস করছে তা ভালো করে বুঝতে পারছে অভি। শরীরের পুরো ভার সিটের উপর রেখে বললো—

” ঘুমিয়ে পর। ”

—–🖤

বাস চলছে নজরুল ইসলাম সেতুর উপর দিয়ে। বাসের ছোট জানালা দিয়ে প্রচন্ড বাতাস বাসের ভীতর প্রবেশ করছে। বাতাসের জন্য এক নির্মল পরিবেশ বিরাজ করছে পুরো বাস জুরে। সেই বাতাসে হালকা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। অক্টোবরের শেষের দিকে এই গরম আর ঠান্ডার মিশ্রণটা অনেক ভালোলাগে। তবে বেশীক্ষণ এত শান্তি পাওয়া যাবে বলে মনে হয়না। শেষ রাতের দিকে ঠান্ডা পরবে অনেক। মেঘনা নদীর উপর দিয়ে নির্মিত এই সেতুর পাশে আরো দুটি সেতু রয়েছে। সেটা অবশ্য রেলসেতু। মধ্যরাতের এই কোলাহলমুক্ত পরিবেশে চারপাশটা কেমন রহস্যময়ী মনে হচ্ছে। রেলসেতুতে লাইটিং ব্যাবস্তা না থাকায় এই অন্ধকারে সেতুটা চোখে পড়লো না।
গাড়িটা যখন থামলো তখন রাত তিনটা। সেতু পাড় হয়ে আশুগন্জের উজানঘাটি রেস্টুরেন্টের ঠিক সামনে দাঁড়ালো বাসটি। এখানে হালকা নাস্তা করতে হবে। সেই ডিনারটা রাত ন’টায় করার কারণে এখন ক্ষুধাটাও লেগেছে মোটামুটি।
অভি একটু দাঁড়িয়ে শরীরটাকে ঠিকঠাক করলো। এতক্ষণ সামান্য ঘুমাতেও পারেনি সে। দুইটা মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্ব যখন কাঁধে পড়ে। তখন ঘুমানোর সময় পাওয়া যায় না।

” মাহিন উঠে পর। এখানে খাবো আমরা। ”

একটু আগে ঘুমিয়ে পড়া মাহিনের কানে অভির বলা কথা কানে গেলো না। বাসচালক সবাইকে কিছু খাওয়ার জন্য আর কিছু লাগলে তা নেয়ার জন্য বিশ মিনিট দিয়েছেন। এখন সময় নষ্ট করা উচিত হবে না। অভি মাহিনের শরীর হালকা ঝাকিয়ে বললো —

” এই ওঠ। আমাদের এখানে একটু নামতে হবে। ”

মাহিন চোখ খুলে একবার নিজের দিকে তাকাচ্ছে আর একবার অভির দিকে তাকাচ্ছে। এখন ও ঠিক কোথায় আছে তা বুঝতেই পারলো না। ঘুমে চোখ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখন অনেক ঘুম দরকার। অভি ব্যাগপত্র ঠিকঠাক করে মাহিনকে বললো —

” তোর বোনকে ডাক। ঐযে ঘুমিয়ে পড়লো, আর জেগে ওঠার নাম নেই। ”

মাহিন তার অভি ভাইয়ের কথা শুনে সিট থেকে উঠে মিষ্টি শরীরে ধাক্কা দিয়ে বললো —

” আর কত ঘুমাবা?? মরার মতো পড়ে থাকলে হবে না। উঠে পরো আপু৷ ”

প্রথম ডাকেই আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়লো মিষ্টি।
চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তিভাব টেনে বললো –

“এত তারাতারি সিলেট আসলাম কিভাবে মাহিন?? আমাদের তো সকালে পৌছানোর কথা। ”
মিষ্টির কন্ঠ শুনে অভি পেছনে ফিরে তাকালো।

-” আমরা সিলেট এখনো পৌছাইনি ম্যাডাম। আমাদের এখন নামতে হবে। সামান্য খাওয়া দাওয়া করতে হবে৷ “.

—-🖤

উজানঘাটি এই রেস্টুরেন্টে ঢুকে তিন জনের জন্যই দুটো করে পরোটা আর সবজি অর্ডার করলো অভি। মিষ্টি আর অভি নিজের জন্য দুটো চায়ের অর্ডার দিলেও মাহিনের জন্য একটা কোক বরাদ্দ রাখলো। বরাবরের মতো মাহিনের কোকে দূর্বলতা। সেই কোক যখন চোখের সামনে দেখতে পেলো তখন সামনে থাকা অন্য খাবারে আর নজর পড়লো না। কিন্তু হাত দিয়ে কোক স্পর্শ করার আগেই সেটা নিয়ে নিলো অভি। চোখেমুখে রাগি ভাব এনে বললো —

” আগে পরাটা খা। খালি পেটে এসব খেলে পেট ব্যাথা করবে। ”

” আমি কোক যেকোনো মহুর্তে খেলেও পেটব্যাথা করবে না অভি ভাই। ”

” তুই চুপচাপ আগে পরোটা খা। দেন কথা বলিস। ”

খাওয়ার পুরোটা সময় চুপচাপ থাকলো মিষ্টি। খাওয়া দাওয়ার পাট যখন শেষ হলো তখন ৩ঃ৩০। সবাই বাসে উঠার পর বাস পুনোরায় সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। এখন হালকা শীত শীত করছে মিষ্টির কিন্তু জানলাটা অফ করতে ইচ্ছা করছে না। এই জানলার পাশে বসার জন্যই রাতে ঝগড়া হইছে একদফা। এখন আর যদি জানলাটা অফ করি তাহলে খোঁচামুলোক কিছু বাণী শুনতে হবে। তার থেকে এমনেই থাকি বাবা।

-” কিরে জানলাটা অফ করে দে। ঠান্ডায় কাঁপছিস অথচ জানলা অফ করছিস না। কারণটা কি?? ”

-” কিছুনা। আমার এমনেই ভালোলাগছে। ঠান্ডায় কাঁপতে আমার ভালোলাগে। বুঝছিসতো?? এখন চুপচাপ থাক৷ ”

” এই জন্যই মানুষের ভালো করতে নাই। সোজা কথা সোজা হিসেবে নিতে পারিস না?? ”

-” আমার ভালো করতে হবে না তোর। ”

” আচ্ছা ব্যাগ থেকে একটা ঠান্ডার কাপড় বের করে নে। নাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে। ”

অভির এরকম ভদ্রতা দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো মিষ্টি।

” কি ব্যাপার বলতো। এতো খেয়াল রাখার নাটক করছিস যে। ”

” আমার সব কিছুই তো তোর নাটক মনে হয়। এখন ঠান্ডা লেগে যাক আর জ্বর বাঁধিয়ে ফেল। তখন বিয়েটাও শান্তিতে খেতে পারবো না। বিয়ে না খেয়ে তখন তোকে টানতে হবে আমার। আর আঙ্কেলও তার গুণধর মেয়েকে আমার দায়িত্বে রেখে দিয়েছেন। এখন সামান্য কিছু হয়ে গেলে জবাব দিহি তো আমাকেই করতে হবে তাইনা?? ”

অভির কথায় মুখটা কুঁচকে গেলো মিষ্টির। এই মহুর্তে সুন্দরভাবে একটা উসকানিমূলক কথা বলা দরকার ছিলো৷ তখন ঝগড়া বেজে যাবে। আর বাসসুদ্ধ মানুষ এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। এদের ঘুম দরকার। অন্যদের বিরক্ত না করাই শ্রেয়।

ভোর ৬ টার দিকে যখন অভির ঘুম ভাঙলো তখন বাসটি কিনব্রিজে এসে পড়েছে। এই ব্রিজকেই সিলেটের ল্যান্ডমার্ক বলা হয়। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই ব্রিজটা অসাধারণ দেখতে। হালকা কুয়াশায় ঢাকা ব্রিজটা দেখতে যে কারোরই ভালো লাগবে। ব্রিজটা সুরমা নদীর উপর নির্মিত। যে নদী পাড় হয়ে হযরত শাহজালাল ( রাঃ) সিলেটে প্রথম পা রেখেছিলেন। একটু পরেই পৌঁছে যাবো তিনশো ষাট আউলিয়ার দেশ সিলেটে। তারপর সেখান থেকে আবার মৌলভীবাজার। সেটাই আমাদের গন্তব্যস্থল।

বাস থেকে নেমে নাস্তা করার জন্য তিনজনেই ঢুকে পড়লো রেস্টুরেন্টে। সকালের নাস্তাটা করে রওনা হতে হবে।
#চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here