#নীল_অপরাজিতা
#পার্টঃ৩
#Rifat_Amin
এখন দুপুর ১২ টা ১৪। হালকা রোদ দেখা যাচ্ছে জানলা দিয়ে। বিয়ে বাড়িতে সাধারণত যে রকম গমগমে পরিবেশ থাকে সেটা এখনো নেই। আগামী শনিবার শানাজ আপুর বিয়ে অথচ আজ শুক্রবার হওয়া সত্ত্বেও এখনো বাসায় তেমন আমেজ নেই কেনো সেটাই বুঝতে পারলো না অভি। অন্তত বাচ্চাদের দৌড়াদৌড়ি তো থাকা উচিত। সারারাত বাস জার্নি করার পর সকাল ৭ টায় মিষ্টির মামা বাড়িতে এসে পৌঁছাতে পেরেছে অভি। সাধারণ পরিচয় পর্ব সেরে নিয়েই ঘুমের দেশে চলে গিয়েছিল অভি। শেষরাতে একটু ঘুমিয়ে পড়লেও এখনও মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। মিষ্টির মামা বাসার সবাই অভিকে ভালো করে চিনে। মিষ্টির মামা তো অভিকে নিজের ছেলের মতো ভাবে। তাঁর কাছে অভির মতো ছেলে হাজারে একটা। লেখাপড়া, আদব কায়দা সব বিষয়েই একশোতে একশো। কিন্তু মিষ্টি তেমন প্রশংসা আদায় করে নিতে পারে নাই মামার থেকে। তবে এই বিষয়ে তেমন মাথাও ঘামায়নি মিষ্টি।
সকালে ঘুমিয়ে পড়ার পর মাত্র ঘুম ভাঙলো অভির
। যদিও ঘুমটা মন মতো হয়নি। নতুন একটা জায়গায় তেমন ভালো ঘুম না হওয়া স্বাভাবিক। তবে একটা সময় ছিলো যখন রাতের পর রাত শুধু গেমিং করেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম। তখন ভার্সিটিতে সবেমাত্র চান্স পেয়েছি।
হঠাৎ উচ্চস্বরে বেজে উঠলো অভির ফোন। ফোনটা সাইলেন্ট না করে রাখায় যথেষ্ট বিরক্ত হলো অভি। স্ক্রিনে জ্বল জ্বল করছে সৌমিত্রর দাঁত ক্যালানো হাসি। সৌমিত্র ফোন করেছে! তাও আবার এই সময়–
” দোস্ত আমরা তো এসে পড়েছি। ”
ফোনটা কানে নেয়ার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে উচ্চস্বরে বলে উঠলো সৌমিত্র। অভি বুঝতে পারলো না কিছুই —
” কি বলছিস?? এসে পড়েছি মানে কি?? ”
” এসে পড়েছি মানে এসে পড়েছি। আর কয়েক মিনিটের মধ্যে বাড়িতে ঢুকছি। মিষ্টি তোকে কিছু বলেনি। ”
” আমি ঠিক বুঝতে পারছি না দোস্ত! মিষ্টিতো কিছুই বলে নাই। “.
” হায় হায়, মিষ্টিই তো আমাদের দাওয়াত করলো। সাথে বললো পুরো সিলেট ঘুরবো বিয়ের পর। আমি তো লোভ সামলাইতেই পারলাম না। তাছাড়া
সামনে পড়াশোনার চাপ নেই। মিষ্টিতো মিথিলাকেও জোর করে রাজি করিয়েছে। এখন মিথিলা আমার পাশে ”
” ঐ শয়তান মেয়ে আমাকে কিছুই বলে নাই। মিথিলাকে আনলি কিভাবে?? যদি একবার ধরা খাইস না। তাহলে আজীবনের জন্য প্রেম করা বাইর হয়ে যাবে। ”
” তোকে ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না মামা। নিজে তো একটা প্রেম করতে পারলি না। তোর সাঝ ধরলে চিরকুমার থাকতে হবে। ”
” আচ্ছা তুই সাবধানে চলে আয়। তবে ভুলেও এমন বিহেব করিস না মিথিলার সাথে, যাতে সবাই সন্দেহ করে। ”
——🖤
ফোনটা কেটে দিয়ে রুম থেকে বের হলো অভি। বাড়িটায় সেই কবে আসছিল মনে করতে পারছে না । অভি যখন ছোট ছিল তখন নিয়মিত প্রতিমাসে একবার হলেও এখানে আসতো মিষ্টির মায়ের সাথে। এই কথা অভির মনে নেই, কিন্তু অভির মা প্রায়ই গল্প করতেন আর পুরোনো দিনের সব কাহিনি জুড়ে দিতেন। ছোট বেলা থেকেই অভি মিষ্টির একসাথে বেড়ে ওঠা। ঝগড়া ছাড়া এমন কোনো সপ্তাহ কেটে গেছে বলে মনে হয়না। দুস্টু প্রকৃতির অভি এখন শান্ত হয়ে গেলেও মিষ্টি হতে পারেনি। মিষ্টির আগের সেই চঞ্চলতা এখনো আছে।
মামার বাড়িটায় একটু পুরাতন পুরাতন ভাব। কিন্তু রুমের ভীতর ঢুকলে মনে হবে এটা কোনো রাজমহল। মিষ্টির নানা ছিলেন অত্যন্ত শৌখিন মানুষ। তাঁর শৌখিনতার ছোঁয়া সারা বাড়িতে লেগে আছে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। প্রতিটা রুমের বাইরে দুইটা দুইটা করে অপরাজিতা আর অলকানন্দা লাগানো। সবগুলো রুমের দরজা দেখলে মনে হবে এটা কোনো রাজপ্রাসাদের প্রবেশ দরজা। অভি বারান্দায় দাড়িয়ে সারাবাড়িটায় নজর বুলিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় শানাজ আপুর আগমন ঘটলো। অভি সালাম দিয়ে নম্রভাবে জিজ্ঞেস করলো —
” ভালো আছো আপু?? ”
বিনিময়ে শানাজ আপুর মুখে স্পষ্ট হাসি লক্ষ করা গেলো। বিয়ের আগে কি প্রতিটা মেয়েই এমন করে হাসে?? লুকিয়ে লুকিয়ে হাসতে পারে কিন্তু এভাবে হয়তো না। তবে বিদায়ের মহুর্তটাকে মনে করে খুব হাসি পেলো অভির। মেয়েরা কেমনে যে এগুলা পারে৷
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো ভাই৷ তুই কেমন আছিস?? ”
” এইতো আলহামদুলিল্লাহ। বাড়িতে কাউকে দেখছি না যে। সবাই কই গেছে?? ”
” এখনো তো অনেকেই আসে নি। তারা সবাই বিকালে আসবে । আসলে আমাদের যত আত্মীয় আছে তারা সবাই আশেপাশেই থাকে। আর বিয়েটাও হুট করে ঠিক হলো। তা এখনো গেম নিয়েই পড়ে থাকিস নাকি চাকরি বাকরি করবি?? ”
শানাজ আপুর কথায় লজ্জা পেয়ে গেলো অভি। অভি আর শানাজ দুজনেই প্রায় সমবয়সী। তবুও অভি তুমি করে বলে। কখনো তুই করে বলতে পারে নাই।
ছোটবেলা থেকে আপু বলেই ডেকে এসেছে।
” না আপু। গেম আগের মতো খেলি না। চাকরি বলতে বাবার অফিসে জয়েন হতে বলছে সবাই। দেখি কি করা যায়।!”
” ভালো ভালো। চাকরি পেলে বিয়ে শাদি করিস। মিষ্টি, মাহিন কি এখনো উঠে নাই?? ”
” না, তবে এখন উঠবে মনে হয় । গায়ে হলুদ তো আজকে তাইনা?? ”
” হ্যাঁ। আজকে সন্ধ্যায়। আচ্ছা থাক আমাকে যেতে হবে। ”
শানাজ চলে যাবে এমন সময় আবার পেছনে ফিরে বললো —
” ওহহ!! যে কাজে এসেছিলাম সেটাই তো বলা হলো না। আম্মু তোকে আর বাকি দুজনকে গোসল করে খেতে ডাকছে৷ চলে আসিস তারাতারি। ”
——🖤
গায়ে হলুদের পাট চুকে গেলো সন্ধ্যার পরপর। গ্রামীণ সমাজে গায়ে হলুদের সময় অনেক আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়। তাদের মধ্যে অধিকাংশই হয়তো কুসংস্কার। গায়ে হলুদের সময় কনে কে হলুদ লাগানোই তো নিয়ম । অথচ তা না করে আশেপাশের যাকেই পায় তাকেই হলুদে মাখামাখি করে দেয়। এই ভয়ে চালাকি করে সৌমিত্রর সাথে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো অভি। ফোনটা বুদ্ধি করে বাসায় রেখে দেওয়াই একদম ভালো হয়েছে। নাহলে মিষ্টির মামা ফোন করে একদম জ্বালিয়ে মারতো। সকালে বাড়ির যে পরিবেশ ছিলো, তার পুরোপুরি পাল্টে গিয়েছে বিকেল হতে না হতেই। মিষ্টির দুই ফুফি আর সাথে তাদের পরিবারের কয়েকজান করে লোক। তারপর আবার আছে মিষ্টির মায়ের পরিবারের লোকজন। এখন বাড়িতে পুরো মেলা বসেছে মনে হচ্ছে। হলুদের সময় পালিয়ে এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে অভি আর সৌমিত্র। অচেনা, অজানা যায়গায়
এমন করে হাঁটতে একদম ভালোলাগছে না সৌমিত্রর। সৌমিত্র পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে মুখে দিতে বললো —
” আর কতক্ষণ এমন করে হাটবো বস। পায়ে ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে তো ”
” এখন যাবো চল। ”
সৌমিত্র সিগারেট জ্বালিয়ে সিগারেটে একটা টান দিয়ে বললো–
” আমরা আসলাম ভালো কথা। মিথিলাকেও আনলে ভালো হতো না?? ”
” হ্যা ভালো হতো। তখনও সিগারেট খেতে পারতি। ”
” এমন করিস কেন মামা??? আজকে সারাদিকে মিথিলার জন্য একটা সিগারেট খেতেও পারিনি। এখন অন্তত শান্তিতে খেতে দে। ব্লাকমেইল করিস না ”
” আচ্ছা যা করলাম না। মিষ্টি যে তোদের ডাকবে এটা কল্পনার অতীত ছিলো আমার। যেখানে আমার আসায় ছিলো অনিশ্চিত। সেখানে তুই তোর গার্লফ্রেন্ড নিয়ে হাজির হইলি। ”
কথার মাঝখানে ফোন আসলো সৌমিত্রর। ফোনটা পকেট থেকে বের করতে করতে সিগারেটটায় শেষ টান দিয়ে ফালায় দিলো মাটিতে। সাথে পা দিয়ে পিশে সিগারেটের চিহ্ন বিলুপ্ত করলো। ভাবটা এমন যে সিগারেট ওর চরম শত্রু। শত্রুকে ফালায় যেমন পা দিয়ে মাটিতে পিশতে ইচ্ছে করে তেমনি সিগারেটও ওর চরম শত্রু।
” মিথিলা কল দিছে দোস্ত। ধরবো?? ”
” ফোন টা পিক করে কথা বল। আর আমাদের কথা জিজ্ঞেস করলে বলিস একটা দরকারে বাইরে আসতে হয়েছে। এখন বাসায় ফিরছি। ”
সৌমিত্র ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলবে তার আগেই মিথিলা চিল্লিয়ে বললো —
” কু*ত্তার বাচ্চা কু*ত্তা। শালা গায়ে হলুদ শুরু হয়েছে আর হাওয়া হয়ে গেছিস। আয় আগে বাড়িতে। মামা তোদের খোঁজ করছে তখন থেকে। ”
” আসলে দোস্ত একটা দরকারে বাইরে বের হয়েছি। আমরা আসছি, চিন্তা করিস না “।
” তোর কি দরকার আমার জানা আছে। মিথিলাকে আজ সব বলবো তুই লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাস। ঐ গাঁধাটা কোথায় রে?? ঐ ফোন রিসিভ করছে না কেন? ”
” কিহহহ!! দোস্ত প্লিজ দাড়া আমি এক্ষুনি যাচ্ছি বাসায় অভিকে নিয়ে। তুই কিছু বলিস না প্লিজ। “”
কথাটা শুনলো কি না জানি না। তার আগেই ফোন কেটে দিলো মিষ্টি। সৌমিত্রর রিতিমত ঘাম ছুটছে শরীর থেকে। মিষ্টি যা বলে তাই করে। সৌমিত্র সিগারেট খায় এই কথাটা মিথিলা জানতে পারলে সোজা বৃন্দাবনে পাঠাবে পবিত্র হবার জন্য।
” কি বললো রে মিথিলা?? ”
সৌমিত্র জিহ্বা দিয়ে ঠোঁটটা ভিজিয়ে বললো
” আমি সিগারেট খাই এটা মিষ্টি কিভাবে জানলো?? তুই ছাড়া তেমন কেউ জানেনা এই খবর। ”
” মিষ্টিকে কি তোর খুকি মনে হয় যে ওকে বলতে হবে। ও বুঝে গেছে সব। ”
” চল দোস্ত চল। আমাকে বাঁচা! ”
অভি আর সৌমিত্র বাসায় আসলো সন্ধ্যা ৭ টার দিকে। বাড়িতে কোলাহল একটু আগের থেকে কমেছে। সৌমিত্র গেট দিয়ে কেবল বাড়িতে ঢুকবে তার আগেই সামনে এসে দাড়ালো মিথিলা।
সৌমিত্র শুধু মনে মনে জপলো ” হে ভগবান আমায় এবারের মতো বাঁচিয়ে দাও ”
#চলবে….