নীল অপরাজিতা পার্টঃ৯

0
667

#নীল_অপরাজিতা
#পার্টঃ৯
#Rifat_Amin

পরদিন দশটায় ঘুম ভাঙলো সবার। সকালের খাবার খেয়েই একবার হসপিটালে দেখা করতে যেতে হবে মেয়েটার সাথে। তারপর সোজা জাফলং। রাতে তেমন ঘুম না হওয়ার কারণে সবার মাথা হালকা ব্যাথা করছে। তাই হসপিটালে যাওয়ার আগে সবাই একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো এক কাপ কফি খাওয়ার জন্য। সকাল থেকেই সৌমিত্র ভীষণ রকম চটে আছে মিষ্টি আর অভির উপর। মিথিলাকে নিয়ে বাহাদুরি করে এতদূর নিয়ে আসা একদম ঠিক হয় নি তাঁর। তাও যদি বিয়ের পরই ঢাকা চলে যেতো তাহলে একটা কথা ছিলো।
মাহিন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে পুরো জার্নি জুড়ে। কফির পর্ব শেষ করে হাসপাতালে পৌঁছালো তারা। সেখানে নীরবকে পাওয়া গেলো না। মেয়েটার বেডের পাশে নার্সকে জিজ্ঞেস করলে জবাব দিয়েছে, সে নাকি একটু আগে কোনো এক দরকারে বাসা চলে গেছে। সৌমিত্র আর অভি কেবিনে থেকে বাকি সবাইকে বাইরে যেতে বললো অভি। বেডের পাশে একটা চেয়ার টেনে মেয়েটার সামনে বসলো সে। মেয়েটা এখন পুরোপুরি সুস্থ। তেমন গুরুতর চোট ছিলো না। ভয় আর শরীর দূর্বলের কারণেই হয়তো মাথা ঘুরে পরে গেছে। অভি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো –

– এখন কেমন লাগছে তোমার? তুমি করেই বললাম। দেখে মনে হচ্ছে আমার থেকে তুমি ছোট।

উত্তরে মেয়েটা হাসলো। সে কিভাবে কৃতজ্ঞতা জানাবে সেটাই বুঝতে পারছে না।

– আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি।

কথা শেষ হতেই না হতেই কেবিনে প্রবেশ করলো মেয়েটার বাবা মা। কৃতজ্ঞতায় তাঁদের চোখ জ্বলজ্বল করছে। সেখান থেকে ভদ্রলোক বলে উঠলেন –

– তোমার নাম অভি তাইনা? তোমাকে যে কিভাবে ধন্যবাদ জানাবো। তোমার জন্যই আমার মেয়েটা আজ বেঁচে আছে বাবা।

অভি কিছু বলতে যাবে তাঁর আগেই সৌমিত্র বললো –

– আমরা শুধু আমাদের দায়িত্বটুকু পালন করেছি আঙ্কেল। দোয়া করবেন আমাদের জন্য।

অভি পান্জাবীর পকেট থেকে ফোন আর সিম বের করে দিলো মেয়েটার সামনে –

– এইযে তোমার ফোন। আঙ্কেলকে জানাতে সিম খুলে নিয়েছিলাম। আচ্ছা তোমার নাম কি??

– আমার নাম রাইয়াতুল রিশিতা।

বলতে বলতে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে। শরীর এখনো অনেকটা দূর্বল। রিশিতার মা বললো –

– তোমরা থাকো কোথায় বাবা? বাইরে আরো কয়েকজনকে দেখলাম।

– আসলে আমরা ঢাকায় থাকি। এখানে একটা বিয়ের ইনভাইটেশন ছিলো আর তারপর কাল জাফলং যাওয়ারও প্লান ছিলো। গাড়িতে উঠার আগে আগেই এই ঘটনা ঘটলো তো তারপর আর যাওয়া না। এখানে একটা হোটেলে উঠেছি। একটু পর যাবো।

বলেই বসা থেকে উঠলো অভি আর তার দেখাদেখি সৌমিত্র। রিশিতার বাবা মা অনেক অবাক হয়ে গেলো অভির কথায়। একটা মেয়েকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে কেউ ট্যুর ক্যান্সেল করে এটা তাদের জানা ছিলো না। কৃতজ্ঞ স্বরে বললো –

– এখন কি তোমরা রওনা হবে?

সৌমিত্র জবাব দিলো –

– হ্যা আঙ্কেল। সকাল সকাল যেতে হবে আমাদের।

রিশিতার বাবা অভির দিকে তাকিয়ে বললো –

– তাহলে তোমরা জাফলং থেকে ঘুরে আসো। তোমাদের কন্টাক্ট নাম্বার টা দিয়ে যাও। বাসায় তোমাদের দাওয়াত রইলো। ভেবো না আমার মেয়েকে বিপদ থেকে রক্ষা করেছো বলে প্রতিদান দিতে চাইছি।

অভি কিছু না ভেবেই নাম্বার দিয়ে দিলো। সাথে সাথেই কেবিনে প্রবেশ করলো মাহিন, মিষ্টি, মিথিলা। এতক্ষণ ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তারা একদম বিরক্ত হয়ে গেছে। তাদের কেবিনে আসতে দেখে রিশিতার মা বললো –

– এরা কে হয় তোমার বাবা ?

ভদ্র মহিলার এই প্রশ্নে বিভ্রান্তিতে পরে গেলো অভি। কি বলবে ভেবেই পাচ্ছে না সে। আমরা যে শুধুমাত্র বন্ধু এটা কি তিনি বিশ্বাস করতে চাইবেন?
হয়তো উল্টাপাল্টা ভেবে বসবেন। কিছু একটা ভেবে অভি সৌমিত্র আর মিথিলার দিকে তাকিয়ে বললো —

– এরা হাসবেন্ড ওয়াইফ। তারপর মিষ্টির দিকে ইশারা করে বললো, আমাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে কিছুদিন আগে। সৌমিত্র ঘুরতে আসছিলো মিথিলাকে নিয়ে, তাই আমাদেরও আসতে বললো ওদের সাথে৷ মেইনলি আমরা বিয়ে এটেন্ড করতে আসছিলাম।

রিশিতার বাবার বিশ্বাস হলো না তারা বিবাহিত। এদিকে মিথিলা, মিষ্টি বুঝে গেলেও মাহিন বুঝলো না মিথ্যা বলার কারণ কি?? সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অভি ওর দিকে তাকিয়ে বললো –

– তুই বাইরে গিয়ে দেখতো কোনো ডক্টর বা নার্স আছে কি না।

রিশিতার মা এগিয়ে মিষ্টির সামনে আসলো –

– ভারী মিষ্টি দুজন। তা তোমাদের হাতে চুড়ি কই। বিয়ের পর তো এসব পড়তে হয়। জানোনা?

রিশিতা ওর মায়ের কথা শুনে হালকা হেসে বললো —

– বিয়ে করলেই চুড়ি পড়তে হবে না’কি মা?

আরো কিছুক্ষণ কথা বলার পর সবাই হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে আসলো। সেখানে নীরবের সাথে দেখা হয়ে রিশিতার রিলিজের বিষয়ে, আরো অনেক কথা হলো। অতঃপর রিশিতার বাবা মা’র থেকে বিদায় নিয়ে কদমতলি বাসস্ট্যান্ডে আসলো তারা। সাথে নীরবও এসেছে বিদায় জানাতে। জাফলং যাওয়ার জন্য কদমতলি বাসস্টান্ড থেকে একটা লেগুনা ঠিক করলো অভি। লেগুনাতে সর্বোচ্চ দশজন বসার যায়গা। অভিরা পাঁচজন হলেও এটাই ভাড়া করলো । যেতে যেতে বাইরের দৃশ্য উপভোগ করার ব্যবস্থা আছে লেগুনা’তে। সিলেট থেকে জাফলং যাওয়ার দুরত্ব হচ্ছে ৬০ কিলোমিটার। যেতে মোটামুটি এক থেকে দেড় ঘন্টা সময় লাগবে। শুধু পৌঁছে দেওয়ার জন্য হাজার টাকায় এই লেগুনা ভাড়া করলো তারা। রাতে ঘুম কম হওয়ার কারণে বাইরে থেকে আসা বাতাসে ঘুমে চোখ লেগে আসছে। অভি হাত ঘড়ি চেক করে দেখলো দুপুর বারোটা। সুর্য ঠিক মাথার উপরে আগুন হয়ে আছে। সৌমিত্র মিথিলার পাশাপাশি এক সাইডে আর একসাইডে মিষ্টি, মাহিন আর অভি। সৌমিত্র ক্লান্তস্বরে বললো –

– অবশেষে জাফলং যেতে পারবো।

বলেই ফোঁস করে ক্লান্তির নিশ্বাস ফেললো সে। মিথিলা ক্লান্তিতে সৌমিত্রর কাঁধে ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথাটা কাঁধ বরাবর না থাকায় হয়তো অসুবিধা হচ্ছে মিথিলার। সৌমিত্র শরীরটা একটু নামিয়ে কাঁধে বালিশের মতো একটা জায়গা করে দিলো। সাথে সাথেই মিথিলার সিল্কিচুলগুলো এলোপাথাড়ি ছুটোছুটি করতে থাকলো সৌমিত্রর শরীরজুড়ে। মিথিলার চুল থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে যা সৌমিত্রর কাছে অসাধারণ অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে। সময়টা এখানেই থেমে গেলে বোধহয় ভালো হতো। ওপাশ থেকে মিষ্টি বারবার অভিকে ধাক্কা দিচ্ছে এই প্রেমলীলা দেখার জন্য। অভি বিরক্ত হয়ে চুপ থাকতে বলছে মিষ্টিকে আর মিষ্টি ঠোঁট বাকাচ্ছে। মাহিন গেমে এতক্ষণ জমে থাকলেও হঠাৎ সৌমিত্রর দিকে চোখ পড়ায় গলা কাপিয়ে গান ধরলো —

– ‘ তোমার চুলের গন্ধে মাতোয়ারা
হয়েছি সন্ধ্যে সকাল, অজান্তে!
বলো, তোমায় ছাড়া কি আছে আর আমার। ‘

সৌমিত্র মাহিনের দিকে বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো। অভি ভ্রু কুঁচকে চোখ পাকিয়ে বললো –

-এখন সকাল বা সন্ধ্যে না রে মাহিন। এটা দুপুরবেলা সো তোর এই গান খাটবে না এখানে।

মাহিন অসন্তুষ্ট হয়ে গেলো অভির কথায়। মন খারাপের ভান করে বললো –

– কোথায় তোমরা গানটা শুনে বাহবা দিবে তা’না করে অপমান! এটা কি মানা যায়?

মিষ্টি মৌনতা কাটিয়ে মাহিনের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললো-

– তুই গেম খেল। পারলে গেমের ভীতর ঢুকে যা। বেশী বকবক করিস না তো। মাথা ব্যাথা করছে অনেক। অতঃপর অভির দিকে তাকিয়ে বললো – এইযে আপনিই তো এ’কে নষ্ট করেছেন। এখন এই নেশা কাটানোর ব্যাবস্থা করুন। ‘

– আমি আবার কি করলাম বাবা? আমি কি ও’কে বলেছি গেম খেলতে? সবসময় তুই আমাকে দোষ দিস কেনো বলতো।

সৌমিত্র মাঝকান থেকে বলে উঠলো –

– এখন আমরা যাচ্ছি কই দোস্ত?

অভি ভীষণ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো –

-শশুড়বাড়ি যাচ্ছি। তুই’য়ো যাবি নাকি?

– আরে ভাই বলছিলাম যে এখান থেকে এখন কোথায় নামবো? সোজা তো আর জাফলংয়ে ডুপ দিতে পারবো না।

– এখন সোজা নামবো মামার বাজারে। ওখান থেকে জৈন্তিয়া হিল রিসোর্টে গিয়ে থাকার বন্দবস্ত করবো। তারপর বাকি কাজ।

মিষ্টি উৎফুল্ল হয়ে অভির দিকে তাকিয়ে বললো-

– কয়দিন ওখানে থাকবো দোস্ত?

– কয়দিন থাকবো মানে কি ? আজকে যাবো আর কালকে চলে আসবো। এতেই যা যা দেখার দেখে নিতে হবে। বুঝলি?

শাঁ শাঁ করে গাড়ি চলছে জাফলংয়ের উদ্দেশ্যে। রাস্তার দু’ধারে গাছপালা আর খোলা মাঠ। চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো দৃশ্য। অবশেষে এক ঘন্টার মধ্যে তারা পৌঁছে গেলো মামার বাজার বাসস্ট্যান্ডে।

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here