পারমিতা” পর্ব-২৫

0
1396

#পারমিতা
পর্ব ২৫
_নীলাভ্র জহির

রাসিফের কণ্ঠস্বর অনেক বদলে গেছে। ওর কথা শুনে প্রথমে অচেনা লাগছিল। কথা বলার স্টাইলটাও চেঞ্জ হয়ে গেছে। আগে রাসিফ ছিল ভীষণ চঞ্চল। ঘনঘন কথা বলতো। যেকোনো কথা দ্রুত উচ্চারণ করে শেষ করে দিতো। কিন্তু আজকে খুব ধীরগলায় বললো, কেমন আছো পারমিতা?
পারমিতা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ওর বিশ্বাস হতে চাইছিল না এটা রাসিফের গলা।
রাসিফ বললো, আমাকে চিনতে পেরেছো? আমি রাসিফ।
পারমিতা মৃদু স্বরে উত্তর দিলো, হুম।
– ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়েছ। সরি এত রাতে ফোন করার জন্য।
– ইটস ওকে। জরুরি কিছু বলার আছে?
– উমম আছে। আমি প্রীতুলের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
পারমিতার বুক ধক করে উঠল। এত বছর কোনো খোঁজ না নিয়ে আজ হঠাৎ জাগ্রত হয়ে সে প্রীতুলের সাথে দেখা করতে চায় কেন? প্রীতুলকে নিয়ে যেতে চায় না তো? অজানা আশংকায় পারমিতার বুক কাঁপতে লাগল।
রাসিফ বললো, চুপ করে থাকবে? বলবে না কিছু?
– প্রীতুলের সঙ্গে দেখা কেন?
– আমি ওর বাবা। ওর সঙ্গে আমি দেখা করবো না?
পারমিতা আর নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। রীতিমতো রাগ দেখিয়ে বললো, কিসের বাবা? এতগুলো বছরে তো একবারও প্রীতুলের খোঁজ নাও নি। আমরা বেঁচে আছি কিনা তাও না। আমার কথা বাদ দাও। প্রীতুল বেঁচে আছে কিনা জানো?
– জানি। আমি ওর সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছি। খোঁজ না নিয়ে ফোন করিনি।
– তাই? হতে পারতো আমি ওর দায়িত্ব নিতে পারিনি বলে কাউকে দত্তক দিয়ে দিয়েছি? পারতো না? বা এতিম খানায় রেখে দিয়েছি।
– কি যা তা বলছো এসব?
– তাছাড়া আর কি বলবো তোমাকে? তোমাকে তুমি সম্বোধন করতেও আমার ঘেন্না লাগছে। তুই শব্দের যোগ্য তুমি।
– পারমিতা। মাথা ঠাণ্ডা করো। এত রেগে যাচ্ছো কেন?
– এত বছর পর কল দিয়ে ছেলের দাবী করছো আর আমি রেগে যাবো না? আমি প্রীতুলের সঙ্গে তোমার দেখা করাবো না। যা ইচ্ছে করতে পারো। পারলে কেস করো। উকিল লাগাও। কিছু যায় আসে না আমার। আইন আমার পক্ষে যাবে। কারণ প্রীতুল আমার পক্ষে। যে বাবা ছোট্ট শিশু স্ব স্ত্রীকে পথে ছেড়ে দিয়েছে, কখনো খোঁজ নেয়নি, সেই বাবাকে আইন কখনো শ্রদ্ধা করে না।
– বড় বড় কথা বলে ফেললে। আমাকে আইনের কথা বোলো না। আমি ওইসব করবো না। আমি তোমার কাছে এপোলজির জন্য ফোন করেছি।
– কিসের জন্য? তুমি? রাসিফের আবার অনুশোচনা হয় নাকি?
– হুম। পারমিতা আমি আমার ভুল বুঝতে পারছি। তোমার আর আমার মাঝে যাই ঘটে থাকুক, এটার প্রভাব আমাদের ছেলে ভোগ করুক আমি সেটা চাই না। তুমি প্রীতুলকে আমার ব্যাপারে বলো। আমি ওর সাথে দেখা করি। দেখবে ভালো কিছু হবে।
– ছেলের মাঝে যা প্রভাব ঘটার, ঘটে গেছে। ও জানে ওর বাবা নেই। আমি ওকে বলবো ওর বাবা মরে গেছে। তুমি দয়া করে আর কক্ষনো আমাকে ফোন করবে না। নয়তো আমি কিন্তু সিম ভেঙে ফেলবো। প্রীতুল আমার একার সন্তান। তুমি ওর দাবী নিয়ে কখনো আমার সামনে আসবে না। খুন করে ফেলবো নয়তো।

পারমিতা কথা বলতে বলতে কাঁপছে। ফোন কেটে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ও। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে ওর। এতটা রেগে যাবে নিজেই বুঝতে পারেনি। রাসিফের মেজাজ ঠাণ্ডা ছিল। যথাযথ সম্মানের সাথে কথা বলেছে রাসিফ। পারমিতার উচিৎ ছিল ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টাকে হ্যান্ডেল করা। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই ওর এত রাগ উঠে গেছে যে, সামলাতে পারেনি। তাই ঝেড়ে দিয়েছে।
পারমিতার ফোন আবারও বেজে ওঠে। এবার সাইলেন্ট করে রেখে দিলো ও। রাসিফের সঙ্গে আর কথা বলতে চায় না। ওকে কল করাটাই ভুল হয়েছে। তবে রাসিফের গলা নরম। ওকে অনুতপ্ত শোনাচ্ছে। হয়তো সম্পর্কের ব্যাপারে নয়, রাসিফ শুধুমাত্র প্রীতুলের জন্যই ফোন করেছে। তবুও ওর এই নরম কণ্ঠস্বর শুনে পারমিতা মনেমনে কিছুটা অবাক ও হতাশ হয়েছে।

সারা রাত আর ঘুম এলো না ওর। রোদের মধুর স্মৃতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন শুধু চিন্তা হচ্ছে প্রীতুলকে নিয়ে। যাকে নিজের বুকে আগলে রেখে মানুষ করেছে ও, তাকে কি করে আরেকজনের কাছে দিয়ে দেবে সেটা ভাবতে পারেনা পারমিতা। প্রীতুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ কান্না করলো ও। বিয়ে বাড়ি এখনো জাগ্রত। অনেকেই জেগে আছে। হাসাহাসির শব্দ ভেসে আসছে। বাচ্চার কান্না, মশলা বাটার ঘ্রাণ সবই আসছে। এতকিছুর মধ্যেও আজ ঘুমাচ্ছে সামান্তা। বাবার বাড়িতে আজই তার শেষ ঘুম। এরপর হয়তো আসা হবে, ঘুমানো হবে, কিন্তু নিজের ঘর ভেবে আর ঘুমানো হবে না। সবকিছুই বদলে যাবে তখন।

খুব সকালেই পারমিতার ঘুম ভাংলো। কখন ঘুমিয়েছে টেরই পায়নি। তবে স্বপ্ন দেখেছে একটা। এমেলো স্বপ্ন। রোদের হাসিমুখ, রোদকে আলিঙ্গন, এ ধরনের অনুভূতি হচ্ছিল। আবার দেখছিল রাসিফ ওর সঙ্গে বসে হাসছে, ওরা একসাথে নৌকায় ঘুরতে বেরিয়েছে। এসব আজগুবি স্বপ্ন কেন যে দেখল, ব্যাখ্যা খুঁজে পেলো না। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল রোদ গুড মর্নিং মেসেজ পাঠিয়েছে। পারমিতা মোবাইল রেখে দিলো। হাতমুখ ধুতে চলে গেল ও।

সামান্তা বলল, আজকে তারাতাড়ি পার্লারে যাবো। বাসায় ফিরতে দেরি যেন না হয়।
– পার্লারে গেলে দেরি হবেই। এটা মাথায় রাখ।
– তোকেও কিন্তু আজ সাজতে হবে। শাড়ি, জুয়েলারি ও মেক আপ।
– কেন সামান্তা? তোর বিয়ে। আমি সাজবো কেন?
– আমার বিয়ে, আমি বউ সাজবো। তুই বউয়ের বান্ধবী, তুই সাজবি নায়িকা। যেন নায়কের মাথা ঘুরে যায়।

হেসে উঠল সামান্তা। পারমিতা মুখ ধুতে ধুতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। রাসিফ কল দিয়েছিল কথাটা বলতে গিয়েও বললো না। আজকের দিনে সামান্তাকে অযথা টেনশন দিতে চায় না ও।
সকালের খাবার খেয়ে পারমিতা প্রীতুলকে নিয়ে বসে রইল। আজকে কোনো কাজ নেই। শুধু হৈ হুল্লোড় করা। সবাই মিলে আড্ডা, গান বাজনা, নাচানাচি, হাসাহাসি এসবই চললো দুপুর পর্যন্ত। দুপুরের আগেই প্রীতুলকে নিয়ে পারমিতা ও সামান্তা পার্লারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। মনটা ভালো হয়ে গেছে পারমিতার।

সাজসজ্জা শেষে হা করে সামান্তার দিকে তাকিয়ে রইল পারমিতা। মুগ্ধ নয়নে চিরচেনা প্রিয় বন্ধুটিকে দেখছে ও। এতটা অপূর্ব দেখাচ্ছে বউয়ের সাজে, যেন অপ্সরা। পারমিতা এই সাজে সামান্তাকে দেখার অপেক্ষায় অনেক গুলো দিন কাটিয়েছে। যেদিন ওরা একসঙ্গে বিয়ের কেনাকাটা করেছে, সেদিনই এই সাজে সামান্তার ছবি মনের দৃশ্যপটে কল্পনা করেছিল। আজকে বাস্তবে সেই দৃশ্যপটের মিল খুঁজে পেয়ে পারমিতার বিস্ময় জেগেছে। ও সামান্তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোকে অপূর্ব লাগছে। আজ তো বরের মাথা ঘুরে যাবে।
সামান্তা বলল, তোকেও দারুণ লাগছে পারমিতা। ভয়ংকর রকমের সুন্দর। রোদ সাহেব আজকেই তোকে তুলে নিয়ে না যায়।
দুই বান্ধবী উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।

পারমিতা সামান্তার পাশে বসে আছে। হঠাৎ একটা মেয়ে এসে হাতে একটা চিরকুট দিয়ে গেলো। পারমিতা অবাক হয়ে চিরকুট খুলে দেখল সেখানে লেখা, You are my Fairy. The most Wonderful woman in the world. I love You.

পারমিতা মুচকি হাসলো। রোদ তাকে এভাবে প্রপোজাল দেবে এটা তার কাছে অকল্পনীয় ব্যাপার। আজকাল রোদ যা করছে, উফফ! লজ্জা করে ওর। পারমিতা স্থির হয়ে বসে থাকতে পারলো না। একবার চোখ তুলে রোদকে খুঁজলো, আবার পরমুহুর্তেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। রোদ আড়ালে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে। কিন্তু সে যে এখানে উপস্থিত, তার উপস্থিতি ঠিকই জানান দিয়ে গেছে।

পারমিতা চুপ করে বসে রইলো। প্রীতুল তার পাশেই ছিল। এখন দেখতে পাচ্ছে না। প্রীতুলকে খুঁজতে উঠে এলো পারমিতা। ওর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে একদিকে এসে দেখল চেয়ারে বসে আছে প্রীতুল আর রোদ ওর সামনে হাটুগেরে বসে প্রীতুলের সঙ্গে কথা বলছে। রোদ প্রীতুলের জন্য অনেক গুলো খাবার এনেছে, সেগুলো রাখা প্রীতুলের কোলের কাছে, চেয়ারের ওপর। পারমিতা ধীরপায়ে পেছনে এসে দাঁড়াল। রোদ ওকে খেয়াল করেনি। ওদের মধ্যে কি কথা হচ্ছে সেটা শোনার জন্য নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল পারমিতা।
রোদ প্রীতুলকে বলল, তোমার আম্মুকে আমাদের সারপ্রাইজ টার কথা বলবে না কিন্তু।
– কিন্তু আম্মুকে তো বলে দিয়েছি।
– আর বলবে না। সারপ্রাইজ পেতে চাইলে কি করতে হবে জানো?
– হ্যাঁ জানি। খুব লক্ষি আর ভদ্র হয়ে থাকতে হবে। আম্মুকে জ্বালানো যাবে না। আম্মুকে কষ্ট দেয়া যাবে না। আম্মুর কাছে খাবার কিনতে চাওয়া যাবো না। আমার কিছু লাগলে তোমাকে বলতে হবে।
– গুড। আমার কাছে ফোন করতে হবে কিভাবে জানো?
– জানি। আম্মুর মোবাইলে রোদ নামে যে নাম্বারটা সেভ করা আছে ওটা দিয়ে কল দিয়ে তোমাকে বলবো।
– আমার কাছে লজ্জা পাবে না। আম্মু যেমন তোমার আপন, আমিও তোমার আপন।
– আব্বুর মতো আপন?

পারমিতার চোখ ছলছল করছে। এই কথাটা শুনে আরও আর্তনাদ করে উঠল ওর ভেতরটা। রোদ উত্তর দিলো, হ্যাঁ আব্বুর মতোন।
– জানো সবার আব্বু আছে শুধু আমার আব্বু নেই।
– তোমার আব্বুও আছে। এটাই তো সারপ্রাইজ। তুমি যদি লক্ষি হয়ে থাকো, তোমাকে তোমার আব্বুর কাছে নিয়ে যাবো।
– সত্যি!
– হ্যাঁ বাবু সত্যি।

পারমিতা চোখ মুছল। রোদ ওকে ওর বাবার কাছে কিভাবে নিয়ে যাবে! অবিশ্বাস্য। কিন্তু রোদের এই কথাগুলো শুনে রোদের প্রতি সম্মান বেড়ে গেলো ওর। কেউ ওর জন্য এভাবে ভাবেনা, একমাত্র সামান্তা ছাড়া। সেখানে রোদ তার জন্য প্রীতুলকে এত সুন্দর করে বোঝাচ্ছে যে, পারমিতার আনন্দে ও খুশিতে রোদকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। ধীরেধীরে রোদের পাশে গিয়ে দাঁড়াল পারমিতা।
রোদ চমকে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল ও। পারমিতার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে বলল, অপূর্ব!
– প্রীতুল তুমি খাবার গুলো রুমে রেখে আসো।
প্রীতুল খাবারের প্যাকেট নিয়ে চলে গেল। পারমিতা রোদের কাছে জানতে চাইলো, ওকে আপনি যেসব বলেছেন আমি সব শুনেছি।
– সরি। আসলে আমি ওকে শেখাচ্ছিলাম যাতে ও তোমাকে জ্বালাতন না করে।
– আমি জানি। শুনেছি সব। আমি মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু একটা ভুল করে ফেলেছেন। ওকে বলেছেন, ওর সারপ্রাইজ হিসেবে ওকে ওর বাবার কাছে নিয়ে যাবেন। কিন্তু এটা তো অসম্ভব।
– কোনোকিছুই অসম্ভব না। তুমি চাইলেই সব সম্ভব।
– কিন্তু আমি ওর সাথে আর কখনো দেখা করতে চাই না। ওর সঙ্গে প্রীতুলের দেখা হোক সেটাও চাই না।
– যদি বলি তুমি আজকাল তার সঙ্গে দেখা করো।
– কি বলছেন এসব? আমি গত কয়েক বছর তাকে দেখিনি।
– যদি বলি সে এখন তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
– মানে!
– মানে যে লোকটা এখন তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, সে কি প্রীতুলের বাবা হতে পারে না?

পারমিতা চমকে উঠলো। ওর কি হল কে জানে। দ্রুত এসে রোদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ও। কাঁদল অনেক্ষণ ধরে। ওর খুব কান্না পাচ্ছে। রোদ টিস্যু বের করে ওর চোখ মুছে দিয়ে বলল, কেঁদো না লক্ষিটি। মেক আপ ধুয়ে যাবে।
পারমিতা লজ্জা পেয়ে সরে দাঁড়াল। হাসি ফুটলো ওর ঠোঁটে। রোদ বলল, যদি পারি, জান দিয়ে চেষ্টা করবো আজীবন তোমার মুখে এরকম হাসি ফোটানোর।
পারমিতা স্মিত হেসে বলল, আজ আপনাকে অন্যরকম লাগছে।
– আমি তো সবসময় যেমন থাকি আজকেও তাই- আজকের পোশাকটা একটু আলাদা মনে হচ্ছে।
– তোমাকেও তো। আজ তোমাকে রানীর মতো লাগছে।

পারমিতা লজ্জায় রক্তিম হয়ে অন্যদিকে মুখ ফেরালো। কি জানি, রোদ প্রশংসা করলে ওর এত ভালো লাগে কেন! পৃথিবীতে প্রশংসা শব্দটাই হয়তো সুন্দর। সবাই প্রশংসা শুনতে ভালবাসে। কিন্তু রোদ যখন ওকে সুন্দর বলে, কিছু বলে সম্বোধন করে, সেই মুহুর্তটা ওর কাছে জগতের সবচেয়ে সুন্দর মুহুর্ত হয়ে ওঠে। এটাকে কি প্রেম বলে?

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here