পারমিতা” পর্ব-৩৪

1
1277

#পারমিতা
পর্ব ৩৪
নীলাভ্র জহির

পারমিতা ছুটে এসে রোদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। রোদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, আপনি আড়াল হলে আমার কেমন শূন্য শূন্য লাগে!
রোদ আলতো করে পারমিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, আড়াল হচ্ছি না পাগলী। এক্ষুণি আসছি।
পারমিতাকে রেখে রোদ পাশের ঘরটায় গেল। নিজের এই কাজে লজ্জায় পড়ে গেল পারমিতা নিজে। রোদের কাছে কখনো ও মনের অনুভূতি প্রকাশ করেনি। মুখ ফুটে বলেনি কখনো কিছু। আগ বাড়িয়ে ওকে জড়িয়ে ধরাটা কি ঠিক হল? পারমিতার ভেতর থেকে উত্তর এলো, অবশ্যই ঠিক হয়েছে। রোদ এখন শুধুই আমার। ওকে আমি খুব যত্ন করে ভালোবাসবো, আমার একান্তই আপন করে রাখবো। ও শুধু আমার।

– দাঁড়িয়ে আছ কেন?
রোদের গলা শুনে চমকে উঠলো পারমিতা, আপনি যাননি?
– গিয়েছিলাম। ভাবলাম তোমাকেও ফ্রেশ হতে বলি। আর আমাদের ডিনারটাও রেডি করতে বলি।
– আমরা এত তারাতাড়ি খাবো?
– রেডি করতে তো সময় লাগবে। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। ব্যাগ বুঝিয়ে পেয়েছো তো?
– হুম।
লজ্জাসূচক হাসলো পারমিতা। রোদ দুলতে দুলতে চলে গেল। পারমিতা দরজা আটকে দিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। ধীরেধীরে গা থেকে শাড়ি খুলে ফেলে। নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে আপনমনে মুচকি হাসে ও। কখনো কখনো এই শরীরের প্রতি ওর তীব্র রাগত হতো। আবার কখনো একেই ভালবেসে বলতে ইচ্ছে হয়, আমি আমার নিজেকে অনেক ভালবাসি। আর কখনো নিজেকে কষ্ট দেবো না।
পারমিতা ওয়াশরুমে ঢুকল। এর আগে এমন ওয়াশরুমে ঢুকেনি ও। বিশাল একটা বাথটাব দেখে খুশিতে চিৎকার করতে যাচ্ছিল ও। এত ঝকঝকে সাদা মার্বেল পাথরের একটা বাথটাব! ইচ্ছে করছে এখনই গরম পানি ছেড়ে দিয়ে বাথটাবে শুয়ে পড়ি।
পারমিতা গরম পানির কল ছেড়ে দিলো। অসম্ভব সুন্দর একটা বাথটাব। আস্তে আস্তে পানি জমছে। ও ধীরপায়ে বাথটাবে এগিয়ে গেল। শুয়ে শুয়ে গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে অন্যমনস্ক হয়ে গেলো ও। এভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে ওর মনে হচ্ছে পৃথিবীটা কত অদ্ভুত! এখানে কত অদ্ভুত অদ্ভুত অনুভূতি হওয়ার সুযোগ থাকে!
পারমিতা গায়ে সাবান মেখে ফেনা তুলে শুয়ে রইল। নিজেকে ওর লাক্স সাবানের মডেল মনে হচ্ছিল। সেসব ভেবে ও হেসে উঠল একা একা। তারপর বাথটাব থেকে উঠে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে গোসল শেষ করলো। আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিলো ওর। কিন্তু ওদিকে রোদ অপেক্ষা করছে।
পারমিতা গোসল শেষ করে বের হয়ে এসে মাথায় তোয়ালে পেচিয়ে দারুণ মুশকিলে পড়ে গেল। কি জামাকাপড় পরবে সেটা বুঝতে পারছে না। এত সুন্দর একটা রাতে শাড়ি পরতে ইচ্ছে করছে আবার শাড়ির ঝামেলা এইমুহুর্তে সহ্য করতে ইচ্ছে করছে না। অবশেষে একটা স্যালোয়ার কামিজ পরলো ও। চুলগুলো পিঠের ওপর এলিয়ে দিলো। ভেজা চুল থেকে পানি পড়ছে টপটপ করে।
পারমিতা দরজা খুলে রোদের দরজায় কড়া নাড়ল। রোদ দরজা খুলে বলল, হয়ে গেল এত তারাতাড়ি?
– আপনি কি ভেবেছিলেন আরও সময় লাগবে?
– তা তো ভেবেই ছিলাম।
রোদের পরনে তোয়ালে। খালি গায়ে পিঠের ওপর তোয়ালে জড়ানো। বুকের লোম বেরিয়ে আছে। সেখানে চোখ চলে গেল পারমিতার। রোদের বুকটা অসম্ভব সুন্দর। রোমশ, ব্যায়াম করা দেহ। রোদ বলল, ভেতরে আসো?
পারমিতা ভেতরে ঢুকে বিছানার এক কোণে বসল। রোদের রুমটা ওর রুমের চাইতে কিছুটা ছোট। ওর রুমের মতো বিশাল জানালা নেই। জানালায় পর্দা সরানো। রোদ একটু আগেই গোসল থেকে বেরিয়েছে। মেঝেতে ওর গা থেকে পড়া পানি জবজব করছে। সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। বরং রোদ এগিয়ে এসে পারমিতাকে বলল, তোমার চুলের পানিতে পিঠটা ভিজে যাচ্ছে। দেখি দাড়াও তো।
পারমিতা দাঁড়িয়ে পড়ল। রোদ নিজের পিঠের তোয়ালে টা দিয়ে পারমিতার মাথাটা সুন্দর করে মুছে দিতে লাগল। এর আগে কেউ কোনোদিনও পারমিতার মাথা মুছে দেয়নি। রাসিফ কখনো ভুল করেও বলেনি এই কথা। কেউ আদর করে মাথা মুছিয়ে দিতে দিতে শাসন করলে এতটা ভালো লাগা কাজ করে, সেটা জানা ছিলোনা ওর।
পারমিতা মুগ্ধতার ঘোরে হারিয়ে গেলো। চেনা এক জগত ছেড়ে অনুভূতির অন্য এক জগতে প্রবেশ করেছে ও।
রোদ তোয়ালেটাকে সোফার ওপর ছুঁড়ে মারল। তারপর লাগেজ থেকে জামাকাপড় খুঁজতে লাগল। পারমিতা পেছন ফিরে দেখল রোদ খালি গা। ওকে প্রথহমবার খালি গায়ে দেখছে তা নয়, এর আগেও দেখেছে। সেই যে প্রথম পরিচয় হলো, তখনই তো সুইমিংপুলে দেখেছিক রোদকে। সেদিন তো এমন ফিলিংস হয়নি। আজ কেন হচ্ছে! সেদিন সাধারণ একজন অচেনা মানুষ মনে হয়েছিল। অথচ আজ ইচ্ছে করছে রোদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে, আদর করতে।
পারমিতার শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। রোদ একটা টি শার্ট ও প্যান্ট বের করে বাথরুমে গেল। জামা পরে বেরিয়ে এসে বলল, তোমার বাথরুমে হেয়ার ড্রায়ার নেই?
– খেয়াল করিনি।
– থাকার কথা। রুমেও থাকতে পারে। এভাবে ভেজা চুলে থাকলে তো সর্দি লেগে যাবে। রাত হয়েছে না?
– আপনি কখনো ভেজা চুলে থাকেন না?
– আমি আমার কথা বলিনি, তোমার কথা বলছি।

পারমিতা লজ্জায় অন্যদিকে তাকালো। মুচকি হেসে চুপ করে রইলো ও।
রোদ বলল, ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করেছো?
– না। গরম পানি দিয়ে।
– গুড। ভেরি গুড।
কী যেন খুঁজছে রোদ। পারমিতা জানতে চাইলো, কিছু খুঁজছেন?
– না।
– আমি তো দেখছি খুঁজছেন।
রোদ মুচকি হেসে বলল, কিছু না। বডি স্প্রে।
– দরকার আছে কি?
– নাহ নেই। এজন্যই হয়তো নিয়ে আসিনি। বডি স্প্রে আমার খুব পছন্দের জিনিস।
– তাই? আমারও পছন্দের। আপনি আশেপাশে এলেই এটা আপনার উপস্থিতি জানান দেয় আমাকে।
– বাপরে, তাই নাকি?
রোদ মুচকি হাসলো। পারমিতা লাজুক হাসি দিয়ে বলল, হুম তাই।

বেয়ারা এসে জানালো খাবার রেডি। তাদের ভিলার ডাইনিং টেবিলেই খাবার দেয়া হয়েছে। রোদ ও পারমিতা এসে বসলো। দুজন মানুষ, বিশাল একটা টেবিলের এক কোণে বসেছে। খাবার নাড়াচাড়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। পারমিতার মনে হচ্ছে তারা ভুল করে অন্য একটা জগতে চলে এসেছে।
খাবার অত্যন্ত সুস্বাদু হয়েছে খেতে। রোদ খুব মজা করে খাচ্ছে। দেখতেই ভালো লাগছে পারমিতার। ও তাকিয়ে আছে খাওয়া বন্ধ করে। রোদ বলল, কি দেখছ?
– আপনি অনেক মজা করে খাচ্ছেন।
– খেতে ভালো লাগছে। অসাধারণ রান্না এদের।
– হুম। আসলেই ভালো রাঁধে। আমিও কিন্তু ভালো রান্না করি।
রোদ খাওয়া বন্ধ করে দুচোখ গোল গোল করে পারমিতার দিকে তাকালো, সত্যিই! আরে আমি তো আজ অব্দি তোমার রান্নাই খেয়ে দেখিনি। মাই গড, এটা কোনো কথা?
হাসতে লাগল রোদ। পারমিতা বলল, আচ্ছা একদিন খাওয়াবো।
– একদিন কি? প্রতিদিন খাওয়াবে। আমি এখনো তোমার হাতের রান্না খাইনি। কি বলো..?
– ঠিক আছে। বাসায় যাই, তারপর খাওয়াবো।
– খেয়ে যদি লোভে পড়ে যাই?
– প্রতিদিন খাওয়াবো।
– সেটাই তো চাই। যাক, অবশেষে মহারাণীর মন গললো।
– মহারাণী আমি?
– ‘হ্যা।
– মহারাণীরা কি প্রতিদিন রান্না করে?
রোদ হেসে বলল, তা করেনা। মহারাজা যদি বলেন, রাণীর রান্না ছাড়া উনি কারও হাতের খাবার মুখেই দেবেন না, রাণী রান্না না করে যাবেই বা কোথায়? এটা তো শুধু কাজ না, এটা ভালবাসা।
– হুম এটা ঠিক।
পারমিতা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। রাসিফ ওর হাতের রান্না খেতে খুব পছন্দ করত। পছন্দ করলেই কি সব হয়? দু একটা পছন্দ একটা সংসারকে টিকিয়ে রাখতে পারে না। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পারমিতা।
রোদ হঠাৎ খাবার এগিয়ে নিয়ে এলো পারমিতার মুখের কাছে, হা করো।
পারমিতা লজ্জা পেয়ে বলল, না না।
– হা করো বলছি।
হা করতে বাধ্য হল পারমিতা। রোদ যেভাবে শাসনের চোখে তাকিয়ে আছে, তাতে মন হয় না আজকে সে হাত সরাবে। পারমিতা হা করলে রোদ ওর মুখে খাবার তুলে দিলো। লাজুক হেসে মুখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো পারমিতা।
রোদ বললো, তুমি আমাকে এখনো এত লজ্জা পাও কেন জানতে পারি?
– লজ্জা জিনিসটা হয়তো কারও কারও বৈশিষ্ট্য।
– হতে পারে। তোমাকে লজ্জা না পেয়ে বেহায়া হতে দেখলে অবশ্য আমার ভালো লাগবে কিনা বলতে পারছি না। হা হা হা।
পারমিতা বলল, একবার খাইয়ে দেয়া ঠিক না। আরেকবার দিন।
রোদ আরও একবার তুলে দিলো ওর মুখে। দীর্ঘ বছর পর কেউ ওকে যত্নের সঙ্গে খাবার খাওয়াচ্ছে। পারমিতার মনটা ভরে যাচ্ছে আনন্দের উচ্ছ্বাসে। খাওয়া শেষ করেও সেই আনন্দ ঘিরে রইলো ওকে।
রোদ বললো, এখন একটু বারান্দায় বসি কি বলো?
বেয়ারাকে ডেকে বারান্দায় মশার কয়েল জ্বালিয়ে দিতে বললো রোদ। বারান্দায় পাশাপাশি রাখা দুটো ইজি চেয়ার। সামনেই বিশাল গাছের বাগান। ঘন সবুজ, শিশির পড়ছে। চারদিক নির্জন। ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া কোনো শব্দ নেই।
পারমিতা প্রাণভরে নিশ্বাস নিয়ে বলল, এজন্যই বুঝি মানুষ এত টাকা পয়সা খরচ করে ভ্যাকেশনে যায়? এত ভালো লাগছে এখানে এসে।
– আমি সুযোগ পেলেই এখানে ওখানে ছুটি কাটাতে যাই।
– কিসের সুযোগ?
– সময় পাইনা। চাকরি করলে কি আর এত সময় মেলে?
– আপনি চাকরি করছেনই বা কেন? বাবার অফিসে জয়েন করছেন না কেন?
– এটা তো আগেও বলেছি। আমি নিজের মতো কাজ করায় আনন্দ পাচ্ছি। তাছাড়া বাবাও এত তারাতাড়ি অবসরে যাক সেটা চাই না। উনি ব্যবসাটাকে ধরে রেখেছেন শক্ত করে। আমি না জেনে শক্ত না হলে ব্যবসাকে ধরবো কি করে?
– আপনি শক্ত নন?
– না। আমার আরও স্ট্রং হওয়া প্রয়োজন। সেটার জন্য সময় লাগবে। এত অল্প বয়সে কেউ এত ম্যাচিউরড হতে পারে না।
– হয়তো বা।
– আচ্ছা পারমিতা, আমাকে তোমার কোন দিক থেকে ভালো লাগে?
পারমিতা মুচকি হেসে উত্তর দিলো, সেটা ব্যাখ্যা করতে পারবো না। এর উত্তরটা খুব কঠিন।
– কতটা? যা ব্যাখ্যার অতীত?
– থাক না। সবকিছু জেনে ফেললে তাতে আনন্দের কিছু থাকে না। আমরা বরং আজকের রাতটাকে উপভোগ করি।

মিষ্টি সুন্দর একটা নির্জন রাত আজ৷ চারদিকে ঘন অরণ্য হওয়ায় কোনো আওয়াজ নেই এখানে। নিস্তব্ধতা ভেঙে শুধু ঝিঁঝি পোকার ডাক কানে আসছে। রাতের এই শব্দটাই অন্যরকম লাগছে ওদের কাছে। ঢাকা শহরে ওরা কোনো রাত দেখে না, কোনো দিন দেখে না, শুধু গাড়ি, হর্ণ, জ্যাম, আর মানুষ। অথচ এখানে এত নির্জনতা সবখানে! পারমিতা রোদের কাঁধে মাথা রাখল। রোদ পারমিতার মুখের দিকে তাকালো। কোনো মেকাপের প্রলেপ নেই, নেই কোনো লিপস্টিক, নেই কোনো পাউডার বা প্রশাধনী। প্রাকৃতিক এই কন্যাকেই ওর এত ভালো লাগে..
রোদ পারমিতার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো। অনেক্ষণ দুজনে একে অপরের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ঘোর লেগে আসে। পারমিতার বাহুতে হাত রাখে রোদ। ধীরেধীরে ওরা এগিয়ে আসে একে অপরের দিকে। কাছাকাছি, আরও কাছাকাছি। পারমিতা লজ্জায় মুখ সরিয়ে নিয়ে বলল, আপনি আমাকেই কেন ভালবাসেন?

চলবে..

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here